রেজি : ডিএ ৫১৭ ॥ ৬৩ বর্ষ : ৬ষ্ঠ সংখ্যা ॥ ঢাকা, শুক্রবার, ২0 বৈশাখ ১৪৩১ ॥ ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী ॥ ৩ মে ২০২৪

॥ মাসুম খলিলী ॥
ইরান ও পাকিস্তান এমন দুই প্রতিবেশী দেশ, যাদের মধ্যে সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে অম্ল-মধুর। অল্প ক’দিন আগে দুই দেশের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ক্ষেপণাস্ত্র আক্রমণের পর এখন কৌশলগত অক্ষ তৈরি হওয়ার মতো কিছু চুক্তি ও সমঝোতা হয়েছে। এ ধরনের সম্পর্ক কি সামনে এগিয়ে নেয়া সম্ভব? অন্যভাবে বলা যায়, এ সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যেতে দেয়া হবে?
সাম্প্রতিক সময়ে এশিয়ায় এমন কিছুু ঘটনা চলমান রয়েছে, যাতে আগের অনেক সমীকরণ পাল্টে যাচ্ছে। আর এসব কিছু কাকতালীয়ভাবে হচ্ছে এমনও নয়, এর পেছনে সক্রিয় রয়েছে ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এসব উপাদান যেমন নতুন এক অবস্থার দিকে নিয়ে যাচ্ছে বলে মনে হয় মধ্যপ্রাচ্যকে, তেমনিভাবে দক্ষিণ এশিয়ায়ও মৌলিক কিছু পরিবর্তন আসতে চলেছে।
মধ্যপ্রাচ্যের এ নতুন মেরুকরণে একদিকে ইসরাইলের সাথে ভারতের মোদি প্রশাসনের কৌশলগত মিলন ঘটেছে; অন্যদিকে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ অক্ষের সাথে ইরান তার কৌশলগত গভীরতা তৈরি করেছে। এ ধরনের একটি সমীকরণ আগেও ছিল। তবে এবার এটি অনেক বেশি তীক্ষè হয়ে উঠেছে গাজা যুদ্ধের ফলে।
এ সমীকরণে মধ্যপ্রাচ্য প্রশ্নে পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী নীতিগতভাবে ইরানের প্রায় একই কাতারে অবস্থান নিয়েছেন। ইরানি প্রেসিডেন্টের পাকিস্তান সফরের সময় প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ স্পষ্ট উল্লেখ করেছেন, তার দেশ ফিলিস্তিনের জন্য শর্তসাপেক্ষ সমর্থন প্রদান করে না, বরং জেরুসালেমকে রাজধানী হিসেবে একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন না করা পর্যন্ত ইরানের সাথে ইসলামাবাদ সহযোগিতা অব্যাহত রাখবে।
নতুন বন্ধন কতটা দৃঢ় হবে
ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির সাম্প্রতিক পাকিস্তান সফরে ইসলামাবাদের সাথে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতার প্রতি তেহরানের জোরালো প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত হয়েছে। রাইসির ২২ থেকে ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত পাকিস্তান সফর আট বছরে ইরানের প্রেসিডেন্টের প্রথম ইসলামাবাদ সফর। এ সফরটি আন্তঃসীমান্ত হামলার তিক্ত সময়ের পর দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে নতুন অধ্যায় আনবে বলে বিশ্লেষকরা আশা করছেন।
রাইসির সফরের সময় উভয় সরকারই তাদের ভাগ করা সীমান্তকে ‘শান্তি সীমানা’ থেকে ‘সমৃদ্ধির সীমানায়’ রূপান্তরিত করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে। উভয়েই গাজায় ইসরাইলের কর্মকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানিয়ে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছে। তারা ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরাইল কর্তৃক সংঘটিত ‘অপরাধ’ এর জন্য জবাবদিহির দাবি জানিয়েছে।
পাকিস্তান সফরকারী প্রেসিডেন্ট রাইসি যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বলেন, পাকিস্তানি জনগণ ফিলিস্তিন ও গাজায় নির্যাতিতদের সমর্থন দিয়েছে এবং তারাও রাস্তায় নেমে জেরুসালেমের স্বাধীনতার জন্য স্লোগান দিয়েছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর যারা মানবাধিকারের জন্য ঠোঁট পরিষেবা দেয়, তারা তাদের কার্যকারিতা হারিয়েছে। যা আজ বিশ্বের জনগণকে ব্যথিত করে, তা হলো জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ তার দায়িত্ব পালন করছে না।
রাইসি ইরান ও পাকিস্তানের মধ্যে সকল রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সম্পর্ক জোরদার করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেওয়ার সাথে সাথে আরো বলেন, দু’দেশের মধ্যে প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে এবং এ সম্ভাবনার বিনিময় উভয় দেশের স্বার্থে কাজ করবে। তিনি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে এ সম্পর্কের মাত্রা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা উল্লেখ করে বলেন, কেউ কেউ এ সহযোগিতা পছন্দ নাও করতে পারে এবং এটি আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং এ সহযোগিতার ধারাবাহিকতা ও অগ্রগতিই গুরুত্বপূর্ণ।
আমেরিকান হুঁশিয়ারি
ইরানের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক নতুন স্তরে নিয়ে যাওয়ার এ প্রচেষ্টার ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সতর্ক করে বলেছে, যে দেশগুলো ইরানের সাথে ব্যবসা করছে, তারা ‘নিষেধাজ্ঞার সম্ভাব্য ঝুঁকির’ সম্মুখীন হয়েছে। ইব্রাহিম রাইসি পাকিস্তানে তিন দিনের সফরকালে তার সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতার জন্য আটটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করেছেন। আর ১০ বিলিয়ন ডলারে বাণিজ্য বাড়াতে একমত হয়েছেন। পাকিস্তানে থাকার সময় রাইসি ইসলামাবাদ, লাহোর এবং করাচিতে বাণিজ্য, সংযোগ, জ্বালানি এবং জনগণের মধ্যে যোগাযোগ সম্পর্কিত বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করার জন্য বেশ কয়েকটি আনুষ্ঠানিক বৈঠক করেন।
২৩ এপ্রিল সাংবাদিকরা আমেরিকান পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র বেদান্ত প্যাটেলকে এ সফর সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে জবাবে তিনি বলেন, বিস্তৃতভাবে আমরা ইরানের সাথে ব্যবসায়িক চুক্তি বিবেচনা করে যে কাউকে নিষেধাজ্ঞার সম্ভাব্য ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিই। তবে শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান সরকার তাদের নিজস্ব বিদেশ নীতি অনুসরণের ব্যাপারে কথা বলতে পারে।’
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য ইরানের সাথে জড়িত থাকার বিরুদ্ধে ইসলামাবাদকে ক্রমাগত সতর্ক করেছে। পাইপলাইন প্রকল্পটি সম্পূর্ণ করার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাধা হলো মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ভয়। নিষেধাজ্ঞা ছাড়াও এ পাইপলাইন নির্মাণ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল থেকে দীর্ঘমেয়াদি বেইল-আউট প্যাকেজ পাওয়ার ক্ষেত্রে পাকিস্তানের সম্ভাবনাকে বিপন্ন করতে পারে। আইএমএফ তাদের কর্মসূচির অধীনে থাকা দেশগুলোর জন্য জাতিসংঘ বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো প্রভাবশালী সদস্য রাষ্ট্র দ্বারা আরোপিত আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞাকে গুরুত্বের সাথে নেয়। এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা পরোক্ষভাবে আইএমএফ থেকে আর্থিক সহায়তার শর্তাবলিকে প্রভাবিত করতে পারে।
পাকিস্তান এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে পাইপলাইন নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে মওকুফের অনুরোধ করেনি। ইসলামাবাদ সম্ভবত জানে যে, বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে এ ধরনের মওকুফ পাওয়া অসম্ভব।
পাইপলাইনটি যদি উল্লেখযোগ্য মার্কিন বিরোধিতা ছাড়াই অগ্রসর হয়, তবে এটি ইরানের সাথে অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততা এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য ভারতের সুযোগগুলোকে বাড়িয়ে তুলতে পারে। সে সাথে এর কৌশলগত মিত্রদের কাছ থেকে প্রতিক্রিয়ার ভয় কমিয়ে দিতে পারে।
কেন ইরান ও পাকিস্তান পাইপলাইন গুরুত্বপূর্ণ
এ মুহূর্তে ইসলামাবাদ নিষেধাজ্ঞার কারণে বিলম্বিত ইরানি প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ প্রকল্পকে পুনরুজ্জীবিত করা নিয়ে সবচেয়ে উদ্বিগ্ন বলে মনে হচ্ছে। এ চুক্তিতে ইরানের বিশাল অফশোর সাউথ পার্স ফিল্ড থেকে পাকিস্তানের বৃহত্তম শহর করাচি পর্যন্ত একটি পাইপলাইন নির্মাণ করা হবে।
পাকিস্তানি বিশ্লেষকদের মতে, ইরানি নেতার এ সফর অনেক আগেই পরিকল্পনা করা হয়েছিল এবং এর একটি ভিন্ন উদ্দেশ্য ছিলÑ বহু বিলম্বিত ইরান-পাকিস্তান গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্পের সাথে যুক্ত আইনি সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা। রাইসি এ বিষয়ে কোনো কথা না বললেও ইরানের তেলমন্ত্রী জাভেদ ওজি পাকিস্তানে ইরানের গ্যাস রপ্তানি দ্রুত চালু করার বিষয়ে ইসলামাবাদের আগ্রহের ওপর জোর দেন। তিনি পাকিস্তানের পেট্রোলিয়াম প্রতিমন্ত্রী মুসাদিক মাসুদ মালিকের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন। যুক্তরাষ্ট্রের অসন্তোষ উপেক্ষা করে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র দপ্তর ‘শান্তি পাইপলাইন’ সম্পূর্ণ করার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
২০০৯ সালের জুনে ইরান ও পাকিস্তান ২,৭৭৫ কিলোমিটার দীর্ঘ গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্পে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। ইরান প্রকল্পের দক্ষিণ পার্স গ্যাস ক্ষেত্র থেকে ইরান-পাকিস্তান সীমান্তের কাছে শহর গাবদ পর্যন্ত প্রায় ১,১৭২ কিলোমিটার বিস্তৃত তার অংশ সম্পন্ন করেছে। এর বিপরীতে পাকিস্তান তার বেলুচিস্তান হয়ে সিন্ধু পর্যন্ত বিস্তৃত ৭৮১ কিলোমিটার অংশে কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেনি। এ অগ্রগতি না হওয়ার পেছনে মূল কারণ হলো ইরানের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা। ২০১৭ সালে কঠোর কাটসা আইন প্রবর্তন ইরানের সাথে ইসলামাবাদের বাণিজ্যের সম্ভাবনাকে আরও বাধাগ্রস্ত করেছে।
মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আন্তর্জাতিক বাজারে ইরানের যথেষ্ট অপরিশোধিত তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস সম্পদ ব্যবহার করার ক্ষমতাকে উল্লেখযোগ্যভাবে সীমিত করেছে। এ সীমাবদ্ধতা মোকাবিলায় ইরান অত্যাধুনিক চোরাচালান নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে, যা কোম্পানি ও মধ্যস্থতাকারী রাষ্ট্রগুলোকে জড়িত করে গোপনে তার অপরিশোধিত তেল বিক্রি করতে সহায়তা করে।
প্রাকৃতিক গ্যাসের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পরিস্থিতি তেহরানের জন্য আরও প্রতিকূল। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ১,২০৩ ট্রিলিয়ন ঘনফুট প্রমাণিত প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ থাকা সত্ত্বেও বিশ্ব রপ্তানিতে ইরানের অংশ মাত্র ১ শতাংশ। ইরানকে তার প্রাকৃতিক গ্যাস রপ্তানির জন্য শুধুমাত্র ভৌত পাইপলাইনের ওপর নির্ভর করতে হয়, যা তার বাজারকে প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে সীমাবদ্ধ করে। তুরস্ক, ইরাক, আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান মিলে ইরানের ৯৫ শতাংশের বেশি প্রাকৃতিক গ্যাস রপ্তানির গন্তব্য।
এ কারণে ইরানের প্রাকৃতিক গ্যাসের বাজার সম্প্রসারণের জন্য শান্তি পাইপলাইনের সমাপ্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইরানের জন্য এ পাইপলাইন সুরক্ষিত করা নিছক একটি অর্থনৈতিক আবশ্যিকতা নয়, বরং এটির জ্বালানি রপ্তানিকে বৈচিত্র্যময় করার এবং ভূ-রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতার দ্বারা আরোপিত অর্থনৈতিক চাপ কমানোর জন্য একটি কৌশলগত প্রয়োজন।
পাকিস্তানে পাইপলাইন প্রকল্পের প্রথম ৮০ কিলোমিটারের সমাপ্তি ইসলামাবাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রভাব ফেলবে। এটি পাকিস্তানের জ্বালানি সংকটের প্রশমন করতে পারে এবং সম্ভাব্য আর্থিক সংকটের ঝুঁকি কমাতে পারে। তবে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এবং আইএমএফ সমর্থনকে হুমকির মুখে ফেলার আশঙ্কা প্রকল্পের ভবিষ্যৎকে জটিল করে তুলছে।
এ সফরের গুরুত্বপূর্ণ দিক
ইরানের সফরটি দুটি গুরুত্বপূর্ণ সৌদি সফরের মাত্র কয়েকদিন পর এসেছেÑ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফয়সাল বিন ফারহান দ্বিপাক্ষিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ইসলামাবাদ সফর করেন। তারপর আসেন উপপ্রতিরক্ষামন্ত্রী তালাল আল-ওতাইবা, যিনি পাকিস্তানে প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত দ্বিপাক্ষিক প্রকল্পগুলো চূড়ান্ত করতে শীর্ষ সামরিক কমান্ডারদের সাথে দুই দিন অতিবাহিত করেছিলেন। এর মাত্র তিন সপ্তাহ আগে সৌদির ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের ছোট ভাই প্রতিরক্ষামন্ত্রী খালিদ বিন সালমান পাকিস্তানের বার্ষিক সামরিক কুচকাওয়াজে সম্মানিত অতিথি ছিলেন, যার মধ্যে পারমাণবিক বোমা বহনে সক্ষম ক্ষেপণাস্ত্রও ছিল।
১৯৭০ এবং ১৯৮০-এর দশকে পাকিস্তান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির জন্য সৌদি আর্থিক সহায়তা পেয়েছিল এ ধারণার করণে যে পাকিস্তানি ক্ষেপণাস্ত্র দেশটিকে একটি ‘পারমাণবিক ছাতা’ দেবে। এ গোপন বোঝাপড়া আপাতদৃষ্টিতে উভয় দেশের নেতৃত্বে প্রতিটি পরিবর্তনের পরে পুনর্নবীকরণ হয়েছে। গত মাসে প্রধানমন্ত্রী শরীফ ক্ষমতায় আসার পরপরই সেনাপ্রধান জেনারেল মুনির সৌদি আরবে বেশ কিছু দিন কাটিয়েছেন। এ সময় তিনি এমবিএস এবং অন্য শীর্ষ কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করেছেন।
চলমান গাজা সঙ্কট এবং ইসরাইলের সাথে ইরানের সাম্প্রতিক উত্তেজনা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে এ সফর দেখা গেলেও প্রতিটি ভ্রমণের এজেন্ডা সম্ভবত কয়েক মাস আগে থেকে পরিকল্পনা করা হয়েছিল। পাকিস্তানের অস্থির অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এখনো এর মূল চালক বলে মনে হচ্ছে। আগামী সপ্তাহে বিনিয়োগ আলোচনা এগিয়ে নিতে শাহবাজ শরীফ এক মাসের মধ্যে দ্বিতীয়বারের মতো সৌদি আরব সফর করতে পারেন। প্রথম সফরের সময় তিনি মক্কায় ওমরাহ পালনের পর পরিকল্পিত ৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ প্যাকেজ নিয়ে আলোচনা করতে এমবিএসের সাথে দেখা করেন। পাকিস্তানি মিডিয়া আরও জানায় যে, এমবিএস শিগগিরই পাকিস্তান সফর করবে, যদিও এটি রিয়াদের আমন্ত্রণকে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করার একটি ব্যাখ্যা হতে পারে।
ভারতের সাথে উত্তেজনা
পারমাণবিক প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের সাথে ইসলামাবাদের অব্যাহত উত্তেজনা সম্ভবত কূটনীতির ওপর প্রভাব ফেলেছে। পুনর্নির্বাচনের জন্য প্রচারণা চালানোর সময় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে মুসলিমবিরোধী ঘৃণা ছড়ানোর অভিযোগ আনা হয়েছে। এটি ভারতের মুসলিম প্রতিবেশীকে ক্ষুব্ধ করেছে। তদুপরি শাহবাজ শরীফের ভাই ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ বর্তমানে পাকিস্তানের প্রধান বাণিজ্যিক অংশীদার এবং ভারতের কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বী চীনে পাঁচ দিনের ‘ব্যক্তিগত’ সফরে রয়েছেন।
ইরান দক্ষিণ এশিয়ায় একসময় ভারতের অন্যতম কৌশলগত অংশীদার ছিল। একদিকে চীনের সাথে দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত চুক্তি; অন্যদিকে ইসরাইলের সাথে বিশেষ সম্পর্ক তৈরি তেহরান-দিল্লি সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলে। ইরানের শীর্ষ নেতৃত্ব একসময়ের নীরবতা ভেঙে কাশ্মীরের বিষয়ে সমর্থন ঘোষণা করেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ এর স্বীকৃতি দিয়ে বলেছেন, কাশ্মীরেও ভারতীয় নৃশংসতা অব্যাহত রয়েছে, ইরান সর্বদা কাশ্মীরিদের পক্ষে আওয়াজ তুলেছে এবং কাশ্মীরিরা অবশ্যই তাদের মৌলিক অধিকার পাবে।
২০০৫ সালের প্রথম দিক থেকে চীন ও পাকিস্তান মধ্যপ্রাচ্যের অপরিশোধিত তেল পশ্চিম চীনে নিয়ে যাওয়ার জন্য একটি ট্রান্স-হিমালয়ান পাইপলাইন স্থাপনের প্রস্তাব নিয়ে কাজ শুরু করে। বেইজিং পাইপলাইন প্রকল্পে অংশ নেওয়ার জন্য তেহরান ও ইসলামাবাদকে বলেছে। এ বিষয়ে পাকিস্তানের সাথে ইরান দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষর করতে ইচ্ছুক। আগস্ট ২০১০ সালে ইরান বাংলাদেশকে এ প্রকল্পে যোগদানের আমন্ত্রণ জানায়।
আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি ইরানের জনগণের আধ্যাত্মিক প্রধান হিসেবে আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির স্থলাভিষিক্ত হন। খামেনি ১৯৮০-এর দশকের গোড়ার দিকে জম্মু ও কাশ্মীর সফর করেন এবং শ্রীনগরের জামে মসজিদে খুতবা দেন। ১৯ নভেম্বর ২০১০ সালে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আলী খামেনি বিশ্বব্যাপী মুসলিমদের কাছে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জম্মু ও কাশ্মীরের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন করার জন্য আবেদন করেছিলেন, বিরোধটিকে বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের চলমান সংঘাতের সাথে সমান করে।
২০১৭ সালে ইরানের নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি বলেছিলেন যে, কাশ্মীরিরা নিপীড়িত হচ্ছে। তিনি মুসলিম বিশ্বের কাছে ‘কাশ্মীরের জনগণকে প্রকাশ্যে সমর্থন করতে এবং রমজানে মানুষের ওপর হামলাকারী নিপীড়ক ও অত্যাচারীদের প্রত্যাখ্যান করার’ আহ্বান জানান। ২০১৯ সালে ভারত তার শাসিত কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন কেড়ে নেওয়ার পর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান কাশ্মীর ইস্যুতে পাকিস্তানের অবস্থানকে সমর্থন করার জন্য ইরানের সর্বোচ্চ নেতাকে ধন্যবাদ জানান।
পাকিস্তান ইরান কাছাকাছি আসার ক্ষেত্রে ভারত ফ্যাক্টরটিও গুরুত্বপূর্ণ। দেশটির অতিমাত্রায় ইসরাইলমুখী হওয়াটাকে তেহরান মেনে নিতে পারছে বলে মনে হয় না।
অবিশ্বাস সংশয়ের পর্ব পেরিয়ে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতি সৌদি আরব, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখলেও ইরানের ব্যাপারে সতর্ক থাকার প্রবণতা দেখা যায়। বিগত বছরগুলোয় আফগানিস্তানে গৃহযুদ্ধের চতুর্থ পর্যায়ে তালেবানদের পাকিস্তানের নিরঙ্কুশ সমর্থন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে। পরিবর্তিত নিরাপত্তা পরিবেশে, পাকিস্তান ও ইরান আন্তর্জাতিক অভিনেতাদের চাপকে আমলে না নিয়ে তাদের সম্পর্ক জোরদার করছে।
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ও ইরানের সাথে তার নিজস্ব সম্পর্কের বিষয়ে পাকিস্তান নিরপেক্ষতার নীতি গ্রহণ করে এবং এ অঞ্চলে উত্তেজনা কমানোর জন্য পরবর্তীতে অ-যুদ্ধহীন ভূমিকা পালন করে। ইরান ও পাকিস্তানকে কিছু ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষক মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বিস্তারের জন্য প্রতিযোগী হিসেবে বর্ণনা করেছেন, যারা যুক্তি দেন যে পারমাণবিক অস্ত্রধারী ইরান পাকিস্তানকে আরও উত্তেজিত করতে পারে। উভয় দেশেরই পারস্পরিক অবিশ্বাসের ইতিহাস রয়েছে, একে অপরের সীমানার মধ্যে ধর্মীয় ও জাতিগত বিদ্রোহীদের সমর্থন করার জন্য একে অপরকে অভিযুক্ত করে। সেই অবিশ্বাসের পর্ব পেরিয়ে তারা আস্থার কৌশলগত সম্পর্ক নির্মাণ এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে।
এর মধ্যে সামরিক বাহিনী এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, রাইসির সফরকালে পাকিস্তানের শক্তিশালী সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনির ইরানের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। তারা ‘পারস্পরিক স্বার্থের বিষয়গুলো; বিশেষ করে আঞ্চলিক শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং সীমান্ত নিরাপত্তা’ নিয়ে আলোচনা করেছেন।
বিবৃতিতে রাইসিকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে যে, সামরিক বাহিনীর মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ইরান ও পাকিস্তান ‘উভয় দেশ ও অঞ্চলের জন্য শান্তি ও স্থিতিশীলতা অর্জন করতে পারে।’
ইরান পাকিস্তানের কৌশলগত সমীকরণের বিরাট প্রভাব পড়তে পারে মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়াÑ দুই অঞ্চলেই। দেখার বিষয় হলো, এ সম্পর্ককে যারা ইতিবাচকভাবে দেখে না, তারা কতটা বাধা তৈরি করতে পারে। আর সে বাধা অতিক্রম করে দুই দেশ কতটা সামনে এগোতে পারে।




এ পাতার অন্যান্য খবর

এ বিভাগ বা পাতায় আর কোন সংবাদ, কবিতা বা অন্যকোন ধরণের লেখা পাওয়া যায়নি।

অন্যান্য মিডিয়া bdnews24 RTNN Sheersha News barta24 Prothom Alo Daily Nayadiganta Jugantor Samakal Amardesh Kaler Kantho Daily Ittefaq Daily Inqilab Daily Sangram Daily Janakantha Amader Shomoy Bangladesh Pratidin Bhorerkagoj Daily Dinkal Manob Zamin Destiny Sangbad Deshbangla Daily Star New Age New Nation Bangladesh Today Financial Express Independent News Today Shaptahik 2000 Computer Jagat Computer Barta Budhbar Bangladesherkhela Holiday Bangladesh Monitor BBC Bangla Pars Today
homeabout usdeveloped by

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ মো. তাসনীম আলম।

এটিএম সিরাজুল হক কর্তৃক হক প্রিন্টার্স ১০/৮ আরামবাগ, ঢাকা-১০০০ হতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। যোগাযোগের ঠিকানাঃ ৪২৩ এলিফেন্ট রোড, বড় মগবাজার, ঢাকা - ১২১৭।

ফোন: ৮৮ ০২ ৪৮৩১৯০৬৫, ই-মেইল: sonarbanglaweekly@gmail.com, weeklysonarbangla@yahoo.com, সার্কুলেশন: ০১৫৫২৩৯৮১৯০, বিজ্ঞাপন: ৪৮৩১৫৫৭১, ০১৯১৬৮৬৯১৬৮, ০১৭৩৪০৩৬৮৪৬।