৫৪ নদীর পানি প্রত্যাহার, নদী ও খাল-বিল দখলে বাড়ছে খরা ও মরুকরণ
মরণ ফাঁদে বাংলাদেশ
॥ সাইদুর রহমান রুমী ॥
অভিন্ন নদীপ্রবাহের ওপর প্রণীত আন্তর্জাতিক নিয়মনীতি অগ্রাহ্য করে উজান থেকে পানি প্রত্যাহার করছে প্রতিবেশী ভারত। বাংলাদেশের বড় নদীতে একের পর এক ফারাক্কা ও টিপাইমুখসহ একাধিক বাঁধ ও গ্রোয়েন নির্মাণ করে সুজলা-সুফলা আমাদের দেশকে শুষ্ক করে ফেলছে।
একদিকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে শাসকদলীয় দুষ্কৃতকারী নেতা-কর্মী ও তাদের মদদপুষ্ট প্রভাবশালীদর মাধ্যমে নদী, খাল-বিল দখলের মহোৎসবে পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে গোটা দেশ। অন্যদিকে ভারতের নিষ্ঠুর ও নির্মম পানি আগ্রাসন দেশ ও জাতিকে সামগ্রিকভাবে বিপন্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। চলমান তীব্র দাবদাহ, অনাবৃষ্টি, ভূপৃষ্ঠের পানির স্তর নেমে যাওয়া, খরা ও লবণাক্ততায় হা-হুতাশ করছে ভুক্তভোগী মানুষ, সেই সাথে প্রাণিকুলও। মারাত্মক পরিবেশ ও প্রতিবেশ বিপর্যয়ের মুখে কোটি কোটি মানুষ। তারা জীবন-জীবিকা হারানোর সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে পতিত হয়েছে।
পরিবেশবিদ আর আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে প্রবাহে বয়ে আসা পলিমাটি হাজার হাজার বছর ধরে জমে গড়ে তুলেছিল পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ এ বাংলাদেশ। এ দেশের মানুষের জীবন-জীবিকা সবকিছুতেই ছিল নদীর প্রভাব। একসময় এ নদীর বুকেই ভেসে চলেছে বড় বড় বাণিজ্যিক জাহাজ, লঞ্চ, নৌকা। এদেশের সকল শহর, নগর, হাট-বাজার, গঞ্জ সবই গড়ে উঠেছিল নদীর পাড়েই। নদীর পাড়ের মানুষের জীবন-জীবিকা নিয়ে তৈরি হয়েছে কত গান, কবিতা, উপন্যাস আর চলচ্চিত্র। তবে সেসব এখন অতীত। তিল তিল করে শেষ করে দেয়া হয়েছে এদেশের নদীগুলো। বাংলাদেশ এখন নদী বিপর্যয়ের দেশ।
গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের মোট নদনদী ছিল প্রায় সাতশ’, যার মোট আয়তন প্রায় ২৪ হাজার কিলোমিটারের বেশি। বর্তমানে এ সংখ্যা কমে মাত্র ২৩০টিতে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ স্বাধীনতার পর থেকে গত ৫০ বছরে হারিয়ে গেছে ৫২০টি নদী। বর্তমানে দেশে নামকাওয়াস্তে যে ২৩০টি নদী রয়েছে তার মাঝে ৫৭টি আন্তর্জাতিক। এর মধ্যে ৫৪টি ভারতে ও তিনটি মিয়ানমারে উৎপত্তি। তবে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে নদীর সংখ্যা বর্তমানে ৪০৫টি। কাগজে-কলমে মূলত অনেক নদীর হিসাব দেখা গেলেও বাস্তবে দেশে মাত্র হাতেগোনা কয়েকটি নদী জীবিত রয়েছে, যার অধিকাংশই আবার নানাবিধ হুমকির মধ্যে রয়েছে।
৫৪টি নদী থেকে ভারতের পানি প্রত্যাহার
সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের অভিন্ন ৫৪টি নদীর মাঝে ভারত একতরফাভাবে বাংলাদেশকে কেয়ার না করে সবগুলো নদী থেকেই তার ইচ্ছেমতো পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করছে। একতরফা পানি প্রত্যাহার করা হচ্ছে। এতগুলো নদীর মাঝে পানিবণ্টন নিয়ে ভারতের সাথে চুক্তি রয়েছে শুধু গঙ্গা নিয়ে। ভারত এ চুক্তিটিও মানছে না বলে অভিযোগ দীর্ঘদিনের। আর আরেকটি বড় নদী তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে চুক্তি করা হবে বলে ভারত মুলা ঝুলিয়ে রেখেছে স্বাধীনতা পরবর্তী বিগত গত পাঁচ দশক ধরে। ১৯৭৭ সালের গঙ্গা চুক্তি অনুযায়ী শুকনো মৌসুমে বাংলাদেশকে কমপক্ষে ৩৫ হাজার কিউসেক পানি দেওয়ার বাধ্যবাধকতা ছিল ভারতের। ১৯৮২ সালে তা পরিবর্তন করে শুকনো মৌসুমে নজিরবিহীন কম প্রবাহ হলে তা ভাগাভাগির ফর্মুলা বের করা হয়। ১৯৯৬ সালের চুক্তিতেও এমন বিধান রয়েছে।
১৯৯৭ সালে শুকনো মৌসুমে বাংলাদেশ গঙ্গা থেকে ১০ হাজার কিউসেক পানি পেতেও ব্যর্থ হয়। পরে তা নেমে আসে ৩ হাজার কিউসেকের নিচে। নদী রক্ষা বিষয়ক সংগঠন ‘রিভারাইন পিপল’-এর সাধারণ সম্পাদক শেখ রোকন এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘গঙ্গা চুক্তির ফলে বাংলাদেশের ৪৫ হাজার কিউসেক পানি পাওয়ার কথা। তবে ভারত বর্তমানে এ চুক্তির ধারে-কাছেও নেই। শুকনো মৌসুমে বাংলাদেশ পানি তেমন পায়ই না। ফারাক্কা ব্যারাজ পয়েন্টে পানি পরিমাপ করা হয়, সেখানেই শুষ্ক মৌসুমে পানি থাকে না। গঙ্গার উৎপত্তি হিমালয় থেকে। কিন্তু গঙ্গার উজানে উত্তরপ্রদেশ, বিহারসহ আরো অনেক প্রদেশে ভারত ইতোমধ্যে ইচ্ছেমতো অনেক বাঁধ ও ড্যাম দিয়ে নিজেরা ব্যবহার করছে এ নদীগুলোর পানি। বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত ভারতের এ এক নিষ্ঠুর আচরণ। বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর থেকে বিভিন্ন সময় এ নিয়ে ভারতকে অনুরোধ করলেও তা কানেই তুলছে না। অথচ বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার এ অমীমাংসিত বিষয়গুলোর কোনো সমাধান না করেই ভারতকে ট্রানজিট, বন্দরসহ বিভিন্ন করিডোর ব্যবহারের অনুমতি দিয়ে দিয়েছে। এতকিছু দেয়ার ফলে বাংলাদেশ অন্তত বহুল প্রতীক্ষিত তিস্তা থেকে পানি পাবে বলে আশা করেছিল। কিন্তু চতুর কেন্দ্রীয় মোদি সরকার পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা সরকার রাজি নয় মর্মে অজুহাত দেখিয়ে তা-ও বছরের পর বছর ঝুলিয়ে রেখেছে।’
জানা যায়, স্বাধীনতার পর ১৯৮৩ সালে তিস্তা নিয়ে প্রথম একটি সমঝোতা হয়, যার পানি ৩৯ শতাংশ ভারত ও ৩৬ শতাংশ বাংলাদেশের পাওয়ার কথা ছিল। বাকি ২৫ শতাংশের বড় অংশ বাংলাদেশে ব্রহ্মপুত্র পর্যন্ত তিস্তার গতিপথকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজন। কিন্তু ভারত তা কখনোই মানেনি। বরং তিস্তার পানি দেয়ার কথা বলে ভারতের বহু আকাক্সিক্ষত সড়ক, রেল, নৌ ট্রানজিট বাংলাদেশ থেকে আদায় করে নিয়েছে। ফারাক্কার ভয়াবহতার পাশাপাশি তিস্তা বা ফেনী নদীর পানির ন্যায্য হিস্যাও বাংলাদেশের মানুষ পায়নি। বরং বরাক নদী ভারতের উজানে টিপাই বাঁধ সুরমা-কুশিয়ারা-মেঘনার প্রবাহকে শুকিয়ে দেয়া হয়েছে।
মরুকরণের পথে বাংলাদেশ
ভারত থেকে প্রবেশ করা ছোটবড় প্রায় ৫৪টি নদীর সবগুলোর পানিই প্রত্যাহার করে নেয়ায় বাংলাদেশ ক্রমাগত মরুকরণের পথে। নদীগুলো শুকিয়ে ধু-ধু বালুচর হয়ে গেছে। আর আস্তে আস্তে পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় নদীতে সাগর থেকে নোনা পানি প্রবেশ করছে। এ নোনা পানিতে স্বাদু পানির মাছ, জলজ উদ্ভিদগুলো মারা পড়ছে। ফি বছর কমছে কৃষিজমির উর্বরতা। পরিবেশবিদদের ব্যাপক বিরোধিতার পরও অতি সম্প্রতি ভারতকে খুশি করতে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে পুরো সুন্দরবনকেই বিপন্ন করে দেয়া হয়েছে। এভাবে বাংলাদেশ এক চতুর্মুখী পরিবেশ আগ্রাসনের শিকার।
দেশের বাইরে ভারতের আগ্রাসনের পাশাপাশি দেশের ভেতরে নদীগুলোতে আগ্রাসন চালাচ্ছে সরকারি মদদপুষ্ট প্রভাবশালী দলীয় নেতাকর্মীরা। ফলে বিগত কয়েক দশকে অনেকগুলো নদী বেদখল-ভরাট আর দূষণে পরিণত হয়েছে মরাখালে। পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, রাজধানী ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যার দুই পাড় দখল করে দুই হাজারেরও বেশি শিল্প কারখানা গড়ে উঠেছে। এছাড়া কারখানার তরল বর্জ্যে নদী দূষণ চলছেই। অন্যদিকে খোদ ঢাকা শহরে ৫৬টি খালের অস্তিত্ব থাকলেও তার সবই এখন মৃতপ্রায়। সবগুলোই দখলের মহোৎসবে ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। চারপাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু নদীর সঙ্গে সংযুক্ত ছিল ওই খালগুলো। ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কাছে এসব খালের দায়িত্ব তুলে দেয়া হয়। এরপর ঢাকার বিভিন্ন এলাকার খালগুলোর সীমানা চিহ্নিত করে খালের পাড় থেকে অবৈধ সব স্থাপনা উচ্ছেদ, পাড় বাঁধাই ও ওয়াকওয়ে নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয়। এছাড়া খাল খনন বা পুনঃখনন করে খালে পানির ধারণক্ষমতা বাড়ানো, সবুজায়ন ও সাইকেল লেন নির্মাণের উদ্যোগও নেয়া হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এখন পর্যন্ত একটি খালের পূর্ণাঙ্গ সীমানা নির্ধারণ কিংবা দখলমুক্ত করাও যায়নি। ডিএসসিসির তালিকাভুক্ত এসব খাল হলোÑ জিরানী, বাসাবো, কদমতলা, খিলগাঁও বাগিচা, মান্ডা, কাজলাপাড়, শ্যামপুর, তিতাস, উত্তর কুতুবখালী, মৃধাবাড়ী, মাতুয়াইল, ডিএনডি এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক খাল। আর ডিএনসিসির তালিকাভুক্ত খালগুলো হলোÑ কাঁটাসুর, রামচন্দ্রপুর, কল্যাণপুর, রূপনগর, মিরপুর দিয়াবাড়ী, ইব্রাহিমপুর, বাউনিয়া, বাইশটেকী, সাংবাদিক কলোনি, আবদুল্লাহপুর, দ্বিগুণ, বেগুনবাড়ী, শাহজাদপুর, সুতিভোলা, কসাইবাড়ী, মহাখালী, ডুমনি, উত্তরা দিয়াবাড়ী, বোয়ালিয়া, গোবিন্দপুর ও নরাইল খাল। এ খালগুলো বর্তমানে শুধু কাগজ-কলমেই রয়েছে। প্রত্যেক এলাকার দলীয় প্রভাবশালীরা যার যার নিজেদের মতো করে এসব দখল করে নিয়েছে। এমনকি এগুলোর অনেকগুলোয় প্লট আকারে বিক্রি করা শেষ হয়ে গেছে।
ভারতের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনায় একসময়ের দেশের বৃহত্তম নদী প্রমত্তা পদ্মা বর্তমানে শীর্ণ খালের রূপ নিয়েছে। পদ্মা মরে যাবার সাথে সাথে এর শাখা প্রশাখা নদনদী বড়াল, মরা বড়াল, মুছাখান, ইছামতি, ধলাই, হুরাসাগর, চিকনাই, গড়াই, মাথাভাঙ্গা, ভৈরব, নবগঙ্গা, চিত্রা, বেতা কালিকুমার, হরিহর, কালিগঙ্গা, কাজল, হিসনা, সাগরখালি, চন্দনা, কপোতাক্ষ, বেলাবতসহ পঁচিশটি নদনদীর অস্তিত্ব শেষ করে দেয়া হয়েছে।
সম্প্রতি এক হিসাবে দেখা গেছে, শুধু এক দিনাজপুরের মানচিত্র থেকেই হারিয়ে যেতে বসেছে ২১টি নদী। পুনর্ভবা, আত্রাই, ধলেশ্বর, গর্ভেশ্বর, ইছামতি, ছোট যমুনা, তুলাই, কাঁকরা,ঢেপাসহ দিনাজপুরে ছিল মানচিত্রে প্রবহমান ২১টি নদী। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী, হালদা, মাতামুহুরী, সিলেটের সুরমা, যশোরের কপোতাক্ষসহ দেশের অনেক নদীর পাড় দখল করে স্থাপনা নির্মাণ এবং নদীতীর ভরাটের কারণে নদীগুলো নাব্য হারিয়ে বর্তমানে বিলুপ্তির পথে। কুমিল্লার এতিহ্যবাহী গোমতী এখন মরা খাল। অনেক জায়গায় পুরোটা ভরাট করে প্লট বিক্রির বিজ্ঞাপন লাগিয়েছে স্থানীয় দলীয় ভূমিদস্যুরা। পরিবেশবিদরা জানান, বর্তমান নদীসমূহের মধ্যে ১৭টি একেবারেই নদীর চরিত্র হারিয়ে, শুকিয়ে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। তন্মধ্যে কিশোরগঞ্জের নরসুন্দা, রাজবাড়ী এবং ফরিদপুরের ভূবনেশ্বর, হবিগঞ্জের বিবিয়ানা ও বরাক, শরীয়তপুরের পালং, কুমিল্লা এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বুড়ি নদী, নোয়াখালীর হরিহর, যশোরের মুক্তেশ্বরী, খুলনার হামকুমরা, সাতক্ষীরার মরিচাপ, লক্ষ্মীপুর এবং নোয়াখালীর বামনী, বগুড়ার মানস, নাটোর এবং পাবনার বড়াল, নাটোর ও পাবনার চিকনাই, কুষ্টিয়ার হিসনা, রাজশাহী-নাটোরের মুসাখান ও কুষ্টিয়া-মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা-ঝিনাইদহ-যশোর-খুলনা-বাগেরহাটের ভৈরব। পঞ্চগড়-বগুড়া-নীলফামারী-রংপুর-সিরাজগঞ্জের করতোয়া, পাবনা-মানিকগঞ্জ-ঢাকা-মুন্সীগঞ্জের ইছামতি, কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ-মাগুরা-নড়াইল-পিরোজপুরের কালিগঙ্গা, কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ-মাগুরা-ফরিদপুর-মাদারীপুরের কুমার, নড়াইল-চুয়াডাঙ্গা-ঝিনাইদহের চিত্রা, যশোর এবং খুলনার ভদ্রা, নেত্রকোনার সৌমেশ্বরী ও নড়াইলের নবগঙ্গাসহ এসব নদী মৃত্যুর প্রহর গুনছে। দেশে নদী দখলের ভয়াবহ চিত্রের সামান্য একটি ছিটেফোঁটা চিত্র দেখা যায় সম্প্রতি কুষ্টিয়ায়। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় এক নেতার প্রচ্ছন্ন সহযোগিতায় স্থানীয় সরকার দলীয় নেতারা কোনো ধরনের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে কোনো ধরনের ইজারা না নিয়ে কুষ্টিয়ার ২১টি বালুমহাল দখল করে বছরের পর বছর বালু উত্তোলন করে যাচ্ছে বলে জেলা রাজস্ব বিভাগ সম্প্রতি ভয়াবহ এক অভিযোগ করেছে। মূল নদীতে ভারতে বাঁধের কারণ বাংলাদেশের বিখ্যাত বিলগুলোও শেষ হয়ে যাচ্ছে। এর মাঝে রয়েছে চলনবিল, বিল হালতি, বিল হিলনা, মহানগর, বিলভাতিয়া, উথরাইল, খিবির বিল, চাতরা, মান্দার বিল, বিলকুমলী, পাতি খোলা, অঙ্গরা, চাঙ্গা, দিকমী, পারুল, সতী, মালসী, ছোনী, বাঘনদী, পিয়ারুল, মিরাট, রক্তদহ, কুমারীদহ, খুকসী, জবায়ের বিল, বাঁধ বাড়িয়াসহ অনেক বিল। ভারতের পানি আগ্রাসনের কারণে নাব্য হারিয়ে মানচিত্র থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে রংপুর অঞ্চলের শতাধিক নদনদীও। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে ঐ অঞ্চলের পরিবেশ, কৃষি এবং নিম্নআয়ের মানুষের সামাজিক জীবনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে। তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, দেশের উত্তর জনপদের প্রাচীনতম জনপদ রংপুর অঞ্চলের রংপুর, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী জেলায় আছে অসংখ্য নদনদী। এ নদীর অধিকাংশেই নাব্য না থাকায় মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, এসব নদীগুলোর মধ্যে ৩-৪টি বাদে প্রায় সবক’টি নদীই এখন মৃতপ্রায়। ভারত একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে নেয়ার ফলে বাংলাদেশের ১১২ মাইল দীর্ঘ বিখ্যাত তিস্তা নদী শুকিয়ে এখন মৃতপ্রায়। এলাকাভিত্তিক অনেক এহিত্যবাহী নদীগুলোর নাম পর্যন্ত বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম জানে না। আর এ নদীগুলোর ন্যায্য হিস্যা আদায়ে গঠিত ভারত-বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশন এখন নদীগুলোর মতোই অতীত ইতিহাস।
লবণাক্ততা বাড়ছে দক্ষিণাঞ্চলে
দেশের খুলনা অঞ্চলে বছরের পর বছর ধরে খুবই কম বৃষ্টিপাত, উজানের নদী থেকে পানিপ্রবাহ একেবারে কমে যাওয়া এবং বঙ্গোপসাগর থেকে বেশি পরিমাণে পানি ওপরে উঠে আসায় নদনদীগুলোয় মাত্রাতিরিক্ত হারে বেড়েছে লবণাক্ততা। নদী-খালের লবণাক্ততা এতটাই বেড়েছে যে এ পানি কোনো কাজে ব্যবহার করা যাচ্ছে না। বহু আগেই তা সেচের উপযোগিতা হারিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, উজানে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় নদনদীতে পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ায় প্রতি বছরই লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। উজান থেকে একটি নদী দিয়েই খুলনার নদনদীতে পানি প্রবাহিত হয়, যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। অন্যদিকে সাগর থেকে একাধিক নদনদীর মাধ্যমে বেশি পরিমাণে লবণাক্ত পানি ওপরে উঠে আসছে। উজানের সামান্য মিঠাপানি সাগরের লবণাক্ত পানিকে মিঠাপানিতে পরিণত করতে পারছে না। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে শুষ্ক মৌসুমে উত্তরাঞ্চলেও লবণাক্ততা বাড়ছে। এতে শুষ্ক মৌসুমে খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের উপকূলীয় এলাকায় ফসল উৎপাদন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। লবণাক্ততার কারণে হাত-পায়ে সাদাটে ঘা, গর্ভকালীন নারীর ভ্রƒণ নষ্ট হওয়া, জরায়ু রোগে আক্রান্তসহ নানা শারীরিক সমস্যা দেখা দিয়েছে। খুলনা লবণাক্ততা ব্যবস্থাপনা ও গবেষণা কেন্দ্রের এক তথ্যে জানা গেছে, গত ৫০ বছরে দেশে লবণাক্ত জমি বেড়েছে প্রায় ২৬.৭ শতাংশ।
ন্যায্যতা প্রাপ্তির জন্য প্রয়োজন চুক্তি
পানি এবং আন্তর্জাতিক নদী বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী মো. ইমামুল হক বলেছেন, ‘ন্যায্যতার জন্য চুক্তি থাকতে হবে। ১৯৯৭ সালে আন্তর্জাতিক নদী ব্যবহারের যে কনভেনশন, ভারতের একগুয়েমী স্বভাবের কারণে তা হয়ে উঠছে না।’ একই কথা বলেন নদী গবেষক আলতাফ পারভেজ। তিনি বলেন, ‘যৌথ নদী ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন। তিনি মনে করেন, প্রতিটি নদী নিয়ে চুক্তির মাধ্যমে ভাটি অঞ্চলে নদীর অধিকারে স্বীকৃতি আদায় করতে হবে।’ এ বিষয়ে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান বলেছেন, প্রভাবশালীদের অবৈধ দখল, দূষণ আর নাব্য সংকটের কারণে নদী আজ হারিয়ে যাচ্ছে, শুকিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা ৫০ হাজার নদী দখলদারের তালিকা তৈরি করেছি। অন্যদিকে পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার সাবেক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী ম. ইমামুল জানান, বর্তমানে প্রায় এক হাজার ছয়শ’ বিল শুকনো মৌসুমে হারিয়ে যায়, ভারত পানি প্রত্যাহার করলে মৃতপ্রায় পুরনো ব্রহ্মপুত্র পানির অভাবে সম্পূর্ণ শুকিয়ে যাচ্ছে। ব্রহ্মপুত্রের ভাটিতে পানি কমে গেলে বর্তমানের প্রমত্ত যমুনা ক্ষীণকায় হয়ে যাবে। যমুনা নাব্য হারালে দেশের পরিবেশ ও জলবায়ু মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে। তিনি বলেন, সবকিছু বিবেচনায় জরুরি ভিত্তিতে বাংলাদেশের অস্তিত্ব রক্ষায় নদী বাঁচাও আন্দোলন জরুরি। নদী গবেষকরা বলছেন, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের এসব পরিকল্পনা দেখেও না দেখার ভান করছে। ডেল্টা প্ল্যান নামে একটি প্ল্যানের কথা বলা হচ্ছেÑ যাতে দেশব্যাপী নদী ড্রেজিংয়ের পরিকল্পনা করা হয়েছে। উজানে ভারতের অনিয়মের কোনো প্রতিবাদ না করে দেশে শত শত কোটি টাকা খরচ করে নদী খনন করে কতটুকু সুফল পাওয়া যাবে, তাই নিয়ে তারা সন্দিহান। বিশিষ্ট নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, ভারত আন্তর্জাতিক নিয়মের তোয়াক্কা না করে উৎস ও উজানে গঙ্গার ওপর অসংখ্য প্রকল্প নির্মাণ করে পানি সরিয়ে নিচ্ছে। যার ফলে ফারাক্কা পয়েন্টে যথেষ্ট পানি পৌঁছাতে পারছে না। এসব প্রাণঘাতী প্রকল্প অপসারণ করা ছাড়া গঙ্গা-পদ্মায় স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে আনার অন্য কোনো বিকল্প নেই।
পরিবেশবিদ ও নদী বাঁচাও আন্দোলনের আহ্বায়ক এডভোকেট এনামুল হক বলেন, ভারত আন্তর্জাতিক আইন রীতিনীতি এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন করে গঙ্গাসহ অভিন্ন নদীগুলোর পানি একতরফাভাবে সরিয়ে নিচ্ছে। এখনো আগ্রাসী নীতি চালিয়ে যাচ্ছে। এভাবে বাংলাদেশকে ঠেলে দিয়েছে ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে।
এ পাতার অন্যান্য খবর
- নানামুখী সংকটে দেশের অর্থনীতি
- জন্ডিসে আক্রান্ত শিশুদের ৮০ শতাংশই হেপাটাইটিসে সংক্রমিত
- ক্ষোভ-বিক্ষোভ উত্তেজনা উদ্বেগ
- প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন উপজেলা নির্বাচন : শুরু ৮ মে
- চীন-বাংলাদেশের সম্পর্ক মধুর কেন?
- ঐক্যবদ্ধভাবে বাংলাদেশকে সমৃদ্ধ জনপদে পরিণত করতে হবে : ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ
- ঢাকার ফুটপাত দখলে জড়িতদের তালিকা চাইলেন হাইকোর্ট
- মাওলানা আবদুস শাকুরের ইন্তেকালে আমীরে জামায়াতের শোক
- প্রবীণ সাংবাদিক জিয়াউল হকের ইন্তেকাল
- চরমোনাই দরবার শরীফের বিল্লাহ আল মাদানির পাশে মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান