সংবাদ শিরোনামঃ

গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে মাঠে নামছে জনগণ ** গুরুতর অসুস্থ ড. মাসুদের আবারো ১৪ দিনের রিমান্ড ** সরকার যুক্তি নয় শক্তি দেখাচ্ছে ** গণআন্দোলনের মাধ্যমে অবৈধ সরকারের পতন ঘটানো হবে ** গাজায় দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধবিরতি ** অবৈধ সরকার রাষ্ট্রক্ষমতার অপব্যবহার করে জুলুম নির্যাতন চালাচ্ছে : ছাত্রশিবির ** সংবিধানের কোথায়ও বলা নেই কোনো ধর্মীয় গোষ্ঠী রাজনীতি করতে পারবে না ** মামলা করে চরম হয়রানি করা হচ্ছে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ** ধোঁকা খেলেন ইমরান খান? ** ক্যাট স্টিভেন্স থেকে ইউসুফ ইসলাম ** ব্যক্তি ও মুসলিম উম্মাহর উন্নয়নের জন্য সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালাতে হবে ** এরদোগান কেন মুসলিম বিশ্বের জন্য মডেল ** শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে জিডিপি থেকে ৫-৬ শতাংশ ব্যয় করা দরকার ** সকল ধর্মের মানুষের মধ্যে পারস্পরিক শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে ** ধেয়ে আসছে বান ** পদ্মার ভাঙনে কুষ্টিয়ার ৭ শতাধিক ঘরবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন ** ড. মাসুদকে নির্যাতনের প্রতিবাদ॥ নিঃশর্ত মুক্তি দাবি ** গৃহবধূকে অমানবিক নির্যাতন, মামলা করায় প্রাণনাশের হুমকি **

ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ ভাদ্র ১৪২১, ২ জিলক্বদ ১৪৩৫, ২৯ আগস্ট ২০১৪

রিসেপ তাইয়্যেব এরদোগান

তারেক শামসুর রেহমান
১১ আগস্ট তুরস্কের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এরদোগানের বিজয়ের মধ্য দিয়ে এটা একরকম নিশ্চিত যে, তিনি একুশ শতকে মুসলিম বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় নেতা হিসেবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছেন। গাজায় মুসলমানরা যখন ইসরাইলি হামলায় মারা যাচ্ছিল, তখন অত্যন্ত সাহসী ভূমিকা নিয়েছিলেন এরদোগান। সেখানে ওষুধ ও শিশুখাদ্য পাঠিয়েছিলেন। শুধু তা-ই নয়, সৌদি আরব ও জর্ডান যখন পরোক্ষভাবে গাজায় ইসরাইলি হামলার সমর্থন করেছিল তখন কাতার ও তুরস্ক হামাসের পক্ষে এসে দাঁড়িয়েছিল। এসব কারণে এরদোগানের ভূমিকা এখন মুসলিম বিশ্বে বহুল আলোচিত। ২০০৩ সালে তিনি দেশটির প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২০০৭ সালে সংবিধানে পরিবর্তন এনে সরাসরি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়। এর আগে সংসদ প্রেসিডেন্টকে নির্বাচন করত। সাম্প্রতিক তুরস্ক যে কীভাবে বদলে গেছে, তা না দেখে বিশ্বাস করা যায় না। সেখানকার রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেশটিতে শুধু স্থিতিশীলতাই উপহার দেননি, বরং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে দেশটিকে এমন একটি পর্যায়ে নিয়ে গেছেন, যা বিশ্ব অর্থনীতিতে একটি উঠতি শক্তি। তাই আমার বারবার মনে হয়েছে, বাংলাদেশ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তুরস্ককে (মডেল হিসেবে) অনুসরণ করতে পারে।

 à¦ªà§à¦°à¦¥à¦®à¦¤, দুটো দেশই মুসলিম প্রধান ও দেশ দুটোতে রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের ইতিহাস আছে। তুরস্কের ‘জাতির পিতা’ মুস্তফা কামাল পাশা। তিনি নিজে ছিলেন সেনাবাহিনীর লোক। তার নেতৃত্বেই তুরস্ক অটোমান সাম্রাজ্যের বিলোপ করে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল। ১৯২৩ সালের ২৯ অক্টোবর তুরস্ক প্রজাতন্ত্র হিসেবে জন্মলাভ করে। এর ঠিক ৩৭ বছর পর ১৯৬০ সালে সেনাবাহিনী জেনারেল সিমেল ওরগোলের নেতৃত্বে ক্ষমতা গ্রহণ করে। ১৯৬০ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত সেনাবাহিনী তিনবার ক্ষমতা দখল করেছিল। সর্বশেষ সামরিক অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জেনারেল এভরেন ১৯৮০ সালে। জেনারেল এভরেনের স্বাভাবিক অবস্থানের পর (১৯৮৯) সেনাবাহিনী আর ক্ষমতা গ্রহণ করেনি। এটা সম্ভব হয়েছে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি ও দলটির পূর্ব নাম ইসলামিক ওয়েলফেয়ার পার্টির কারণে। দলটির নেতৃত্ব অত্যন্ত সৎ ও মেধাবী। ওয়েলফেয়ার পার্টির নেতা এরবাকানের স্বাভাবিক মৃত্যু ও দলটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়ার পর জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি নামে আত্মপ্রকাশ করে। দলটির নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট এরদোগান। ২০০২ সালের সংসদ নির্বাচনে দলটি পেয়েছিল ৩৪ ভাগ ভোট, আর ২০১১ সালে সর্বশেষ নির্বাচনে তারা পায় ৪৯ ভাগ ভোট। এ থেকেই বোঝা যায়, দলটির জনপ্রিয়তা কত বেশি। মাঝখানে ২০০৭ সালের নির্বাচনে তারা পেয়েছিল ৪৭ ভাগ ভোট। দলটির জনপ্রিয়তার মূল কারণ হচ্ছে, এর নেতৃত্বের গাড়িতে যারা আছেন তারা কেউই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত নন।

সাবেক শাসকরা দুর্নীতিগ্রস্ত ছিলেন। ফলে দুর্নীতিমুক্ত একটি সমাজ প্রতিষ্ঠায় বর্তমান সরকারের ভূমিকাকে তারা সমর্থন করে। দ্বিতীয়ত, ইসলাম ও গণতন্ত্র যে একে অপরের পরিপূরক এবং ইসলাম গণতন্ত্রের শত্রু নয় কিংবা গণতন্ত্র ইসলামের বিরোধী নয়। ক্ষমতাসীন দল এটা প্রমাণ করেছে। মানুষ এটা মেনে নিয়েছে। এটাই তুরস্কের ঐতিহ্য। কামাল আতাতুর্ক দেশটিকে ধর্ম নিরপেক্ষ দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। তিনি তুরস্ককে একটি আধুনিক ইউরোপীয় রাষ্ট্র হিসেবে গড়তে চেয়েছিলেন। সন্দেহ নেই তাতে তিনি সফল হয়েছেন। তবে একটি বিষয় তিনি বিবেচনায় নেননি। আর তা হচ্ছে মুসলিম ঐতিহ্য। মুসলমানদের তিনি ধর্ম নিরপেক্ষ আদর্শে উদ্বুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। তিনি নিজেকে একজন ইউরোপিয়ান ভাবতেন। তুরস্কে মাদরাসার শিক্ষা ছিল। তা আতাতুর্ক নিষিদ্ধ করেছিলেন। বর্তমান সরকার সীমিত পরিসরে মাদরাসা চালু করেছে। মেয়েদের মাথায় ওড়না বা হিজাব ফিরে এসেছে। এক সময় এ ওড়না ক্যাম্পাসে নিষিদ্ধ ছিল। মেয়েরা ওড়না পরতে পারত না। এখন সেই বাঁধন নেই। নিজের খুশি। কেউ পরে। কেউ পরে না। তবে ক্যাম্পাসে আমি (তুরস্ক সফর ২০১২) শতকরা প্রায় ৯৫ ভাগ মেয়েকেই দেখেছি স্কার্ফ ব্যবহার করে না। ইসলাম ও গণতন্ত্রকে এক করে এরদোগান যে রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছেন তুরস্কে, এটা একটা মডেল। অনেক আরব দেশ, বিশেষ করে ‘আরব বসন্ত’ এরপর তারা এ রাজনীতি গ্রহণ করেছে। এর ফলে দলটি যে পুরোপুরি ইসলামিক শাসনে বিশ্বাসী, তা বলা যাবে না। তারা যথেষ্ট আধুনিকমনস্ক। তারা অনেকটা ফাতেহউল্লাহ্ গুলেনের ভাবধারার অনুসারী (দেখুন,The Vision and Impact of Fethullah Gulen)।

২০০৮ সালে ফরেন পলিসি ম্যাগাজিন ফাতেহউল্লাহ্ গুলেনকে বিশ্বের শীর্ষ বুদ্ধিজীবীদের একজন হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। অত্যন্ত জনপ্রিয় এ বুদ্ধিজীবী তুরস্কের নাগরিক হয়েও তুরস্কে থাকেন না। থাকেন যুক্তরাষ্ট্রে। ইসলাম যে আধুনিকমনস্ক একটি সমাজব্যবস্থা, তা গুলেনের লেখায় পাওয়া যায়। তাই তুরস্কের বাইরে ক্ষমতাসীন পার্টিকে (জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট) আল কায়দার মিত্র বলে চিহ্নিত করার অপপ্রয়াস চালানো হলেও তা ধোপে টেকেনি। বরং তুরস্কের নেতৃত্ব সেই প্রথম থেকেই আল কায়দার কর্মকাণ্ডকে সমালোচনা করে আসছেন এবং এখনও করছেন। মানুষ এটা গ্রহণ করেছে। যে কারণে তুরস্কে কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নেই। মানুষ সন্ত্রাসীদের প্রশ্রয়ও দেয় না। বর্তমান সরকারের এটা একটা বড় সাফল্য। তৃতীয়ত, বর্তমান সরকারের গতিশীল নেতৃত্বের কারণে তুরস্ক অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিশ্বে অন্যতম একটি শক্তিরূপে আবির্ভূত হয়েছে। সারা ইউরোপ যেখানে বড় ধরনের অর্থনৈতিক মন্দার কবলে পড়েছে, সেখানে বিশ্ব মন্দা তুরস্কের অর্থনীতিকে এতটুকুও আঘাত করেনি। বরং ২০১০ সালে যেখানে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছিল ৮.৯ ভাগ, তা ২০১১ সালে ১১ ভাগে উন্নীত হয়েছিল। অনেক ইউরোপীয় দেশের তুলনায় তুরস্কে স্কোর সংখ্যা কম (৯.২ ভাগ)। অথচ স্পেনে ২২.৬, গ্রিসে ১৭.৬, লিথুয়ানিয়ায় ১৫.৫, যুক্তরাষ্ট্রে ৯.১ ও ফ্রান্সে ৯.৯ ভাগ। এ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দলটিকে ক্ষমতায় থাকতে সাহায্য করছে। চতুর্থত, দলটির বড় সাফল্য সেনাবাহিনীকে গণতন্ত্রমুখী করা। ৩৬৫ জন জেনারেল আর ৭ লাখ ২০ হাজার সেনা সদস্যকে নিয়ে যে বিশাল সেনাবাহিনী তুরস্কের, ন্যাটোতে তার অবস্থান দ্বিতীয়। এ সেনাবাহিনী বরাবরই একটি রাজনৈতিক সরকারের জন্য ‘থ্রেট’ বা হুমকি। এরদোগান নিজে একটি কবিতা লিখে সেনাবাহিনীর কাছ থেকে বিরোধিতার সম্মুখীন হয়ে জেলে গিয়েছিলেন। সেদিন তিনি (২০০২) প্রধানমন্ত্রী প্রথমে হতে পারেননি। পরে উপনির্বাচনে বিজয়ী হয়ে পার্লামেন্টে আসেন। সেই সেনাবাহিনীকে তিনি গণতন্ত্রমুখী করেছেন। সেনাবাহিনী এখন গণতন্ত্রের প্রতি ‘কমিটেড’। সেনাবাহিনীর সঙ্গে বৈরিতায় না গিয়ে, তাকে গণতন্ত্রের মূল ধারায় ফিরিয়ে নিয়ে আসতে এরদোগান যে সফলতা পেয়েছেন, তা সমগ্র মুসলিম বিশ্বের জন্য একটি ‘মডেল’। বিশেষ করে ইরাক, তিউনেশিয়া কিংবা ইয়েমেন এ মডেল অনুসরণ করতে পারে। পঞ্চমত, তুরস্কের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দেশটিকে মধ্য এশিয়াসহ মুসলিম বিশ্বে বিনিয়োগ বাড়াতে সাহায্য করছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গেল ২০১২ সালে মুসলিম বিশ্বে তুরস্কের বিনিয়োগ গিয়ে দাঁড়ায় ২২২ বিলিয়ন ডলার। মিসর (১৭৬ মিলিয়ন) ও ইরানের (১৭৬ মিলিয়ন) মতো দেশেও গেল বছর বড় বিনিয়োগ ছিল তুরস্কের। ক্রয় সক্ষমতা অনুযায়ী (পিপিপি) তুরস্কের জিডিপি এখন ১ দশমিক ১১৬ ট্রিলিয়ন ডলার। মাথাপিছু আয় ১৫ হাজার ৩৪০ ডলার, যা যে কোনো ইউরোপীয় দেশের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।

সাম্প্রতিক সময়ে তুরস্ক তার বৈদেশিক নীতিতে কিছুটা পরিবর্তন এনেছে। ইসরাইলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক থাকলেও নানা কারণে এ সম্পর্ক এখন ‘শীতল’। ন্যাটোর সদস্য হলেও সব ইস্যুতে তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত, তা বলা যাচ্ছে না। তবে সিরিয়া সঙ্কটে পশ্চিমা বিশ্বের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল তুরস্ক। তুরস্কের সঙ্গে রয়েছে সিরিয়ার সীমান্ত। সিরিয়ার নাগরিকদের জন্য ‘মানবিক কারণে’ সীমান্ত খুলে দিয়েছিল তুরস্ক। সিরিয়া সঙ্কটে ‘পশ্চিমা হস্তক্ষেপ’ তুরস্ক সমর্থন না করলেও বাশার আসাদ স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ছেড়ে দিলে সঙ্কটের সমাধান হতে পারে, এটাও মনে করে তুরস্ক। সেইসঙ্গে সোমালিয়ার মতো মুসলমান প্রধান দেশের সঙ্কট নিরসনে তুরস্কের ভূমিকা প্রশংসিত হয়েছে। এরদোগান নিজে সোমালিয়া সফর করে একটি মুসলমান প্রধান দেশের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করেছেন। যুদ্ধপীড়িত সোমালিয়া থেকে শত শত শিশুকে তুরস্কের বিভিন্ন স্কুলে উচ্চশিক্ষার সুযোগ করে দিয়েছে তুরস্ক সরকার। এর ফলে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত আল শাহাব গ্রুপের প্রভাব সোমালিয়ায় কিছুটা হ্রাস পাবে। এরই মধ্যে মোগাদিসুতে প্রথম বিদেশী সংস্থা হিসেবে তার্কিশ বিমান লাইন সপ্তাহে দুবার তার ফ্লাইট শুরু করেছে। সোমালিয়ায় তুরস্কের ভূমিকা সেখানে স্থিতিশীলতা ফিরে আসতে সাহায্য করছে। অন্যদিকে তুরস্কের সীমান্তঘেঁষা মুসলিম প্রধান মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করার উদ্যোগ নিচ্ছে তুরস্ক। এক সময় ওই অঞ্চলগুলোর ওপর দিয়েই প্রাচীন ‘সিল্ক রোড’ চলে গিয়েছিল। তুরস্ক এখন সেই ‘সিল্ক রোড’ পুনরুজ্জীবিত করছে। মধ্য এশিয়ার জ্বালানি সম্পদের পূর্ণ ব্যবহার করতে চাইছে তুরস্ক। আর এ লক্ষ্যেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাকু-তিবিলিসি-সাইনহান গ্যাস পাইপলাইন।

রাজনৈতিক সংস্কৃতি, দক্ষ ব্যবস্থাপনা, যোগ্য নেতৃত্ব, অর্থনৈতিক অগ্রগতি তুরস্ককে আজ মুসলিম বিশ্বে শীর্ষ অবস্থান দিয়েছে। এক সময় মালয়েশিয়ার মাহাথির মোহাম্মদকে নিয়ে মুসলিম বিশ্ব স্বপ্ন দেখাত। মাহাথির-পরবর্তী মালয়েশিয়ার নেতৃত্ব সেই প্রত্যাশা শতকরা ১০০ ভাগ পূরণ করতে পারেননি। এ কারণে মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব নিয়ে এখন এরদোগানের কথা ভাবা হচ্ছে। এরদোগান সব গোঁড়ামির ঊর্ধ্বে উঠে শুধু আজ তুরস্ককেই নেতৃত্ব দিচ্ছেন না, বরং মুসলিম বিশ্বের জন্যও একটা ‘ইমেজ’ সৃষ্টি করেছেন। তবে তিনি যে সঙ্কটমুক্ত, তা বলা যাবে না। কুর্দিদের নিয়ে সমস্যা আছে। সেনাবাহিনীও শতকরা ১০০ ভাগ বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। যোগ্য নেতৃত্ব ও সুনির্দিষ্ট নীতির ভিত্তিতে তিনি যদি দেশটিকে পরিচালনা করেন, তাহলে মুসলিম বিশ্বের অন্যতম নেতা হিসেবে তিনি আবির্ভূত হবেন, এটা অস্বীকার করা যাবে না। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তার বিজয়ের পর পশ্চিমা বিশ্বের জার্নালগুলোতে তার সম্পর্কে যেসব মন্তব্য করা হয়েছে, তাতে এ বিষয়টিই ঘুরে-ফিরে আসছে যে, তিনিই মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব দেবেন ২১ শতকে। তবে তুরস্ক নিয়ে ভয়টা যে নেই, তাও বলা যাবে না। বর্তমান তুরস্কের নেতৃত্বের মাঝে ‘অটোমান সাম্রাজ্যের’ একটা ছায়াও দেখতে পাচ্ছেন কেউ কেউ। ইতিহাসের ছাত্রমাত্রই জানেন আজকের তুরস্কের জনগোষ্ঠী একসময় মধ্যযুগে মধ্য এশিয়া থেকে এসেছিল। তাদের বলা হত Oghuz Turks, অর্থাৎ টার্কিস ট্রাইব।

এগারো শতকে এরা ইসলাম গ্রহণ করে এবং এক সময় উরাল হৃদঘেরা অঞ্চল ছেড়ে আজকের পারস্যে বসবাস করতে শুরু করে। এরাই জন্ম দিয়েছিল Great Selijuk সাম্রাজ্যের। এক সময় মালোদের হাতে Selijuk সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। তারপর জন্ম হয় অটোমান সাম্রাজ্যের, যা টিকে ছিল ৬২৩ বছর। এ অটোমান সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ঘটেছিল ইউরোপ পর্যন্ত। ১৯২২ সালের সেপ্টেম্বরে অটোমান সাম্রাজ্যের অবসানের মধ্য দিয়ে আজকের তুরস্কের যাত্রা শুরু।

তুরস্কের রাজনীতি আজ অনেক মুসলিম দেশের জন্য একটি মডেল। অনেক মুসলিম অধ্যুষিত দেশে, বিশেষ করে আরব বিশ্বে ইসলামী জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে (ইরাক, সিরিয়া, ইয়েমেন, লিবিয়া), সেখানে শতকরা ৯৯ ভাগ মুসলমানের দেশ তুরস্কে এ ধরনের জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটেনি। ২০১২ সালে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিতে আমি তুরস্কের এরজুরুম শহরে গিয়েছিলাম। ঐতিহাসিক ইস্তাম্বুল (এ শহরের জনপ্রিয় মেয়র ছিলেন এরদোগান) শহরে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তথা ছাত্রদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছিলাম। তারা সবাই আমার সঙ্গে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন জঙ্গিবাদ আর ইসলাম এক নয় বরং শুদ্ধ ইসলাম চর্চায় জঙ্গিবাদের কোনো স্থান নেই। ক্যাম্পাসে ছাত্রদের দেখেছি তারা নিয়মিত নামাজ পড়ে। রোজা রাখে। তাই সঙ্গত কারণেই তুরস্ক মুসলিম বিশ্বের জন্য একটি মডেল। সারা আরব বিশ্ব যখন একটি বড় ধরনের পরিবর্তনের মুখোমুখি, তখন তুরস্কের স্থিতিশীলতা সারা বিশ্বের দৃষ্টি কেড়েছে। এজন্যই টাইম ম্যাগাজিন তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী এরদোগানকে নিয়ে প্রচ্ছদ করেছিল ২৮ নভেম্বরের (২০১২) সংখ্যায় (ErdoganÕs way). তুরস্কে জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির নেতৃত্বাধীন একটি সরকার (২০০২ সাল থেকে ক্ষমতায়) যে রাজনীতির সেখানে জন্ম দিয়েছে, তার মূল কথাই হচ্ছে- ‘ইসলাম ও গণতন্ত্র’, যা কিনা এখন ‘আরব বসন্ত’-পরবর্তী আরব বিশ্বের রাজনীতির মূল কথা। তিউনেশিয়া, মরক্কো কিংবা মিসরের রাজনীতি এখন ‘ইসলাম এবং গণতন্ত্র’কে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে। নিঃসন্দেহে এটা একটা মডেল। অভিযোগ উঠেছে, জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি কিছুটা ইসলামিক এবং মেয়েদের অধিকার রক্ষায় সচেতন নয়। অথচ আমরা পরিসংখ্যান পেয়েছি, তুরস্কের পার্লামেন্টে মহিলা এমপিদের সংখ্যা ৯ ভাগ থেকে ১৪ দশমিক ১ ভাগে বেড়েছে। কর্মজীবী মহিলাদের সংখ্যাও সেখানে কম নয়, ২৪ ভাগ (পুরুষ ৬৯.৬ ভাগ)। সেনাবাহিনী অতীতে বরাবরই তুরস্কে একটা বড় ভূমিকা পালন করেছে। মোস্তফা কামাল পাশা নিজে ছিলেন সেনাবাহিনীর লোক। তুরস্কের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা স্বীকৃত। এটা নিয়ে বর্তমান সরকারের সঙ্গে সেনাবাহিনীর বিরোধ নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল। এখন এ বিতর্কের অবসান হয়েছে। মহিলাদের হিজাব নিয়ে একটি বিতর্ক আছে (মিসেস এরদোগান নিজে হিজাব পরিধান করেন)। তবে তা ব্যক্তির ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে। এটা এখন বাধ্যতামূলক নয়।

শতকরা প্রায় ৯৯ ভাগ মুসলমান অধ্যুষিত দেশও যে বিশ্বে একটি ‘মডেল’ হতে পারে আজকের তুরস্ক তার বড় প্রমাণ। একটি মুসলমান অধ্যুষিত দেশ যে গণতন্ত্র বিনির্মাণ করে স্থিতিশীলতা উপহার দিয়ে মুসলমান বিশ্বের জন্য একটি দৃষ্টান্ত হতে পারে, তুরস্কের নেতৃত্ব সেটা প্রমাণ করেছেন। একটি ইসলামপন্থী দলও সব ধরনের প্রচারণা উপেক্ষা করে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতে পারে, আজকের তুরস্কের দিকে তাকালেই এ কথাটা মনে হয়ে যায় আমার। সারা দুনিয়ায় মুসলিম বিশ্ব সম্পর্কে একটা সাধারণ ধারণা রয়েছে। মুসলিম বিশ্ব মানেই মনে করা হতো, একনায়কতান্ত্রিক সামরিক শাসন (মিসর, তিউনেশিয়া, ইয়েমেন) কিংবা ক্ষমতালোভী রাজতন্ত্র (গালফভুক্ত দেশগুলো) কিংবা ইসলামিক চরমপন্থীদের উর্বর ভূমি (আফগানিস্তান, সোমালিয়া)। কিন্তু এর বাইরেও একটি ইসলামিক সমাজ ব্যবস্থা যে প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র উপহার দিতে পারে, গত প্রায় ১৬ বছরের তুরস্কের রাজনীতি এটাই প্রমাণ করেছে। তুরস্কের ইসলামমনস্ক একটি নেতৃত্ব, যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির কোনো অভিযোগ নেই, প্রমাণ করেছেন তারাও পারেন দেশটিকে পশ্চিমা বিশ্বের সমমানে দাঁড় করাতে।

এরদোগান প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন। সরাসরি ভোটে তিনি পেয়েছেন ৫২ ভাগ ভোট। অর্থাৎ দ্বিতীয় দফা ভোটেরও আর প্রয়োজন হবে না। এর মধ্য দিয়ে পরপর দুই টার্ম অর্থাৎ প্রায় ২০২৪ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার সুযোগ তিনি পাবেন। মাত্র ৬০ বছরে পা দেয়া এরদোগানের জন্য ২০২৪ সাল পর্যন্ত বয়সটা খুব বেশি হবে না। তবে দেখতে হবে, মুসলিম বিশ্বের জন্য তিনি কী কী করেন। বিশেষ করে গাজা পুনর্গঠন ও গাজায় অর্থনৈতিক সাহায্যের পরিমাণ বাড়িয়ে তিনি একটি বড় অবদান রাখতে পারেন। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ সেটাই প্রত্যাশা করে।

(নতুন বার্তা ডট কমের সৌজন্যে)

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

এ পাতার অন্যান্য খবর

অন্যান্য মিডিয়া bdnews24 RTNN Sheersha News barta24 Prothom Alo Daily Nayadiganta Jugantor Samakal Amardesh Kaler Kantho Daily Ittefaq Daily Inqilab Daily Sangram Daily Janakantha Amader Shomoy Bangladesh Pratidin Bhorerkagoj Daily Dinkal Manob Zamin Destiny Sangbad Deshbangla Daily Star New Age New Nation Bangladesh Today Financial Express Independent News Today Shaptahik 2000 Computer Jagat Computer Barta Budhbar Bangladesherkhela Holiday Bangladesh Monitor BBC Bangla Pars Today
homeabout usdeveloped by

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ মো. তাসনীম আলম।

এটিএম সিরাজুল হক কর্তৃক হক প্রিন্টার্স ১০/৮ আরামবাগ, ঢাকা-১০০০ হতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। যোগাযোগের ঠিকানাঃ ৪২৩ এলিফেন্ট রোড, বড় মগবাজার, ঢাকা - ১২১৭।

ফোন: ৮৮ ০২ ৪৮৩১৯০৬৫, ই-মেইল: sonarbanglaweekly@gmail.com, weeklysonarbangla@yahoo.com, সার্কুলেশন: ০১৫৫২৩৯৮১৯০, বিজ্ঞাপন: ৪৮৩১৫৫৭১, ০১৯১৬৮৬৯১৬৮, ০১৭৩৪০৩৬৮৪৬।