সংবাদ শিরোনামঃ

স্থানীয় সরকার ধ্বংসের নীলনকশা ** কেন মানুষ অথৈ সাগর পাড়ি দিচ্ছে, দায় কার? ** দেশকে রাজনীতিহীন করার ষড়যন্ত্র ** গণতন্ত্রহীনতা দেশকে সঙ্কটের দিকে নিয়ে যাবে ** আফগানিস্তানে শান্তির সম্ভাবনা ** গণতন্ত্র পুনঃরুদ্ধারে ভোটাধিকারের সুযোগ দিতে হবে : বিচারপতি আব্দুর রউফ ** নরেন্দ্র মোদির সফর : বাংলাদেশের প্রত্যাশা! ** গণতন্ত্র ছাড়া দেশের উন্নতি কখনই সম্ভব নয় ** নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন প্রয়োজন ** সোনা নয়, সোনালী ফাঁস ** নিখোঁজ আর গুম ** জগতসেরা পর্যটক ইবনে বতুতা ** বোরো ধানের বাম্পার ফলন হলেও কৃষকের মুখে হাসি নেই ** কুষ্টিয়ায় পারিবারিক কলহে নৃশংস হত্যাকাণ্ড বাড়ছে **

ঢাকা, শুক্রবার, ৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪২২, ৩ শাবান ১৪৩৬, ২২ মে ২০১৫

জগতসেরা পর্যটক ইবনে বতুতা

ইকবাল কবীর মোহন
ইবনে বতুতা। পুরো নাম মুহাম্মদ বিন আব্দুল্লাহ। দুনিয়ার সেরা পর্যটকের সেরা তিনি। দেশ সফরের অভিজ্ঞতায় তাঁর জুড়ি নেই। তখনকার যুগে উড়োজাহাজ ছিল না, ছিল না বাষ্পচালিত কোনো ইঞ্জিনও। রকেট, ট্রেন কিংবা দ্রুতগামী সমুদ্রযান সে যুগে ছিল বিরল। তাই কখনও পায়ে হেঁটে, কখনও বা ঘোড়া অথবা উটে চড়ে যাতায়াত করতে হতো। মানুষ ধীরে চলা নৌকা ভাসিয়ে কোথাও যেতে পারতো। তবে এভাবে দেশের পর দেশ, শহরের পর শহর ঘুরে বেড়ানো কল্পনাই করা যেতো না। অথচ সে সময়  ইবনে বতুতা এই কল্পনার কাজটিই সাধন করেছেন অনায়াসে। এটাই ছিল তাঁর বিস্ময়। অদম্য উৎসাহ, বুকভরা সাহস এবং প্রচণ্ড মনোবলের কারণে তিনি দুর্গম গিরিপথ মাড়িয়ে ছুটে চলেছেন এক দেশ থেকে অন্য দেশে। অসীম সাহসের সাথে লড়েছেন সমুদ্রের ভয়ঙ্কর তরঙ্গমালার সাথে। ঝড়-তুফানের রাগ উপেক্ষা করে চলেছেন তিনি। হিংস্র প্রাণীর ভয়-ভীতিকে পেছনে ফেলে ইবনে বতুতা একের পর এক দেশ ভ্রমণ করেছেন। তাঁর এই বিস্ময়কর সফরগাঁথা পৃথিবীর মানুষকে হতবাক করেছে। তাইতো তিনি একাই একটা ইতিহাসে পরিণত হয়েছেন। অসাধ্য সাধনের কাজে তাঁর এই সাহস ও উদ্যম মনোবল আজও দুনিয়ার শতকোটি মানুষের কাছে প্রেরণার বিষয় হয়ে জাগরুক আছে। এই বিস্ময়কর প্রতিভার জীবন কাহিনী জানতে তাই কার না ইচ্ছে করে।

ইবনে বতুতা এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। সেটা আজ থেকে প্রায় সোয়া ছয়শো বছর আগের কথা। ১৩০৪ সাল। ২৪ ফেব্রুয়ারি মরক্কোর তানজিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। শিশুকাল থেকে তিনি ছিলেন বেশ উদ্যমী ও সাহসী। ছোটবেলায় মনে হয়েছিল ভবিষ্যতে তিনি বড় কিছু হবেন। আর হলোও তাই। তিনি দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ পর্যটকের খ্যাতি অর্জন করে ইতিহাসের পাতায় তাঁর নাম লেখালেন স্বর্ণাক্ষরে। তিনি প্রায় সবকটি মুসলিম দেশ, বিশেষ করে আরব দেশ সফর করেন। তাছাড়াও কনস্টান্টিনোপল, সিংহলও চীন সফর করে বিস্ময়ের সৃষ্টি করেন। ইবনে বতুতার দেশ ভ্রমণের সোনালী অধ্যায়ের গোড়াপত্তন হয়েছিল মাত্র ২২ বছর বয়সে।

ইবনে বতুতা একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান। দেশ ভ্রমণের সূচনাতে তিনি হজ্ব পালনের সিদ্ধান্ত নিলেন। এ জন্য তিনি মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজন সবার মায়া ছেড়ে মক্কার পথে পাড়ি জমান। কা’বা শরীফে যাবার পথে তিনি এশিয়া ও আফ্রিকার অনেক দেশ, শহর-বন্দর ও পবিত্র স্থান ঘুরে দেখার সৌভাগ্য লাভ করেন। পথিমধ্যে বিচিত্র অভিজ্ঞতা ও অনেক বিপদ আপদের সম্মুখীন হন তিনি। সফর শুরু করার  কয়েকদিন পর তিউনিসের এক কাফেলার সাথে তাঁর পরিচয় ঘটে। তাদের সাথে আলজিয়ার্সে এসে এক বেদনাবিধূর ঘটনার শিকার হন তিনি। তাঁর একজন সফরসঙ্গী মারা গেল। তিনি নিজেও জ্বরে পড়লেন। তাই তিনি শারীরিক দিক থেকে বেশ দুর্বল হয়ে পড়েন। কিন্তু মনের বল হারালেন না তিনি। এই অবস্থায় তিনি আবারো যাত্রা শুরু করলেন। পথিমধ্যে বৃষ্টিতে ভিজে আবারো জ্বরে আক্রান্ত হলেন বতুতা। জ্বর বাড়লো। অথচ কিছুতেই দমলেন না তিনি। মনের জোরে তিনি এগিয়ে চললেন।

এক সময় তিনি আলেকজান্দ্রিয়ায় এসে পৌঁছলেন। মিসরের মনোরম বন্দর এটি। পৃথিবীর অন্যতম বন্দর এই আলেকজান্দ্রিয়া। তার রয়েছে চারটি সিংহ দরজা। এখানে স্থাপিত বিশ্ববিখ্যাত বাতিঘর ইবনে বতুতাকে মুগ্ধ করলো। ঘোড়ায় চড়ে আরো অগ্রসর হয়ে তিনি পৌঁছলেন ভামিয়াটা শহরে। এখানে নীলনদের পানির স্পর্শ পেয়ে ইবনে বতুতা নিজেকে ধন্য মনে করলেন। সেখানকার মানুষ ঘরে বসেই নীলনদ থেকে পানি তুলছে দেখে তিনি আরেকবার বিস্মিত হলেন। তারপর কায়রো এসে ফেরাউনের আবাসভূমি প্রত্যক্ষ করলেন। এখানে বহু নামকরা শিক্ষাকেন্দ্র ও পবিত্র স্থান দেখে তার নয়ন জুড়িয়ে গেল। কায়রোতে দাইর আত-তীন দরগায় প্রিয়নবী মুহাম্মদ (সা.) এর কাঠের গামলার অংশ, সুরমা ব্যবহারের একটি শলাকা, পাদুকা এবং সেলাই করার একটি সূচ দেখে ইবনে বতুতা সীমাহীন খুশি হলেন। এখানে হজরত আলী (রা.) হাতের লেখা একখণ্ড কুরআন শরীফও তিনি দেখতে পেলেন। মিসরে ইবনে বতুতা হজরত ইবরাহিম (আ.) ইসহাক (আ.) এবং ইয়াকুব (আ.) রওয়াজা পরিদর্শন করেন। এখানে কুরআনে বর্ণিত অভিশপ্ত লুত জাতির স্মৃতি বহনকারী ডেড সি তাঁর জানার খোরাক মেটাল। হজরত ঈশা (আ.)-এর জন্মস্থান পবিত্র বেথেলহেম পরিদর্শন করে তিনি এক কূপের কাছে গিয়ে থমকে দাঁড়ান। এটি সেই কূপ যেখানে হজরত ইউসুফ (আ.)কে তাঁর সৎ ভাইয়েরা মেরে ফেলার জন্য ফেলে দিয়েছিল। কূপ থেকে পানি পান করে কুরআনে বর্ণিত সেই স্মৃতির পুরোটাই উপভোগ করেন তিনি। মদীনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা করে ইবনে বতুতা তাবুকের মরু পথে এগিয়ে চললেন। এই যাত্রাপথ ছিল বিপদে ভরা। এখানে তাঁকে মরু ঝড় সাইমুমের সাথে লড়াই করতে হয়। কথিত আছে এই পথে পানির অভাবে অনেক যাত্রীর মৃত্যু হয়। তবে এখানে আছে আলহিজর নামে একটি কূপ। কিন্তু মহানবী (সা.) এই কূপের পানি পান করতে নিষেধ করেছেন। ইবনে বতুতা এই বিদপসঙ্কুল পথ মাড়িয়ে তার কাফেলাসহ মদীনায় গিয়ে পৌঁছলেন। মদীনায় এসে মহানবী (সা.)-এর রওজা স্পর্শ করে তিনি অনাবিল প্রশান্তি লাভ করেন। মদীনায় থাকলেন চারদিন। এ সময় মদীনার মুসলমানের একান্ত ভালোবাসা, আতিথেয়তা ও সান্নিধ্য পেয়ে ইবনে বতুতা মুগ্ধ হন। তারপর তিনি রওয়ানা হলেন কা’বার দিকে। পথিমধ্যে বদর নামক গ্রামে এসে থমকে দাঁড়ান তিনি। এই বদর প্রান্তরে আল্লাহ তাঁর প্রিয়নবীকে গায়েবী সাহায্য দিয়ে বিজয়ী করেছিলেন। বদরের খেজুর বাগান ও ঝরণার অপূর্ব সৌন্দর্য দেখে ইবনে বতুতা মুগ্ধ হন। তারপর মক্কায় এসে হজ্বব্রত পালন করে জীবনের পরম প্রাপ্তি লাভ করেন।

হজ্ব পালন করে নতুন এক জীবনের সন্ধান পেলেন ইবনে বতুতা। এবার তিনি নেমে পড়লেন তাঁর নতুন সফরে। পৌঁছলেন ইরাকে। মুসলিম ঐতিহ্য ও ইতিহাসের সুন্দরতম নগরী ইরাকের বাগদাদ। এই দেশ হজরত আলী (রা.) এর স্মৃতি বহন করছে। এখানে নবীজীর জামাতার মাজার জিয়ারত করেন ইবনে বতুতা।  বিখ্যাত ফারসি কবি শেখ শাদীর মাজারও ইরাকের সিরাজ নগরে। ইরাকে আছে কুফা নগরী। হজরত আলী (রা.) এর খেলাফতের রাজধানী এই কুফা। ইসলামের অনেক স্মৃতির শহর এই কুফা। ইবনে বতুতা এখানে কারবালার মাঠ পরিদর্শন করেন এবং ইমাম হোসেনের মাজার জিয়ারত করেন। তারপর আবারো তিনি মক্কায় ফিরে এসে হজ্বব্রত পালন করেন এবং জেদ্দায় গিয়ে পৌঁছান। সেখান থেকে জাহাজে চড়ে সমুদ্রপথে পৌঁছান ইয়েমেনে। ইয়েমেনের এডেন তখনও পৃথিবীর বিখ্যাত সমুদ্র বন্দর। দুনিয়ার বড় বড় বন্দর থেকে পণ্যবাহী জাহাজ এখানে এসে ভিড়তো। ইয়েমেন সফর শেষে ইবনে বতুতা পৌঁছান ওমানে। তারপর বাহরাইন। এতেও জগৎটাকে ঘুরে দেখার স্বপ্ন তাঁর মিটলো না। বিচিত্র দেশের নানা প্রকৃতি তাকে আকৃষ্ট করলো। এবার তিনি ছুটলেন আনাতোলিয়া, কনস্টান্টিনোপল ও উজবেক রাজ্য সফরে। সেখান থেকে ইবনে বতুতা আফগানিস্তান ও সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর করে ইবনে বতুতা ভারতবর্ষে আসেন। ভারতে আসার পথে হিন্দুকুশ পর্বত অতিক্রম করতে গিয়ে তিনি বিপদের সম্মুখীন হন। হিন্দুকুশে বরফের পর বরফ মাড়াতে হয়। তিনি দেখলেন বরফে তাঁর উটের পা দেবে যাচ্ছে। তাই তিনি এই বিপদ থেকে উদ্ধার পাবার জন্য এক অদ্ভূত উপায় বের করলেন। তিনি উটের সামনে কম্বল বিছিয়ে দিলেন। উট সামনে এগুলো আবার সামনে কম্বল দিলেন্ এভাবে হিন্দুকুশ পর্বত হয়ে তিনি এসে পৌঁছলেন ভারতে।

ভারতে এসে বিচিত্র অভিজ্ঞতায় পূর্ণ হলো তাঁর ভাণ্ডার। হিন্দুদের সতীদাহ প্রথা তার মনেকে ভারাক্রান্ত করলো। কারো স্বামী মারা গেলে স্বামীর সাথে স্ত্রীকেও দাহ করার নাম সতীদাহ। একদিনের ঘটনা। ইবনে বতুতা দেখলেন, দামী পোশাক ও অলঙ্কার পরে তিনজন মহিলা ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছে। তাদের পেছনে যাচ্ছে আত্মীয়-স্বজন ও বাদক দল। তাঁরা মাইল তিনেক দূরে গিয়ে একটা অন্ধকার জায়গায় এসে দাঁড়াল। বিধবারা সেখানে গিয়ে তাদের পোশাক ও অলঙ্কার খুলে ফেলল এবং তা গরিবের মধ্যে বণ্টন করে দিলো। তারা তাদের দেহকে মোটা কাপড় দিয়ে জড়িয়ে ফেলল। পাশেই জ্বলছিল আগুন। তাতে তিলের তেল ঢেলে দেয়া হলো। আগুন আরো জোরে জ্বলে উঠলো। এমনসময় বাদকের দামামা বেজে উঠল। আর অমনি বিধবারা একে একে আগুনে গিয়ে আত্মহুতি দিলো। এই করুণ দৃশ্য দেখে ইবনে বতুতা জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন। তার সঙ্গীরা তাকে পরে সুস্থ করে তুলল। এমনি আরো অনেক অভিজ্ঞতা ইবনে বতুতা অর্জন করলেন ভারতে। ভারতের পর তিনি মালদ্বীপ ঘুরে বাংলাদেশে আগমন করেন। এ দেশের সুজলা-সুফলা গ্রাম, সবুজ বনানী ও বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা তিনি তাঁর জীবন কাহিনীতে সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। ইবনে বতুতা মেঘনার তীরে তীরে ঘুরে বেড়িয়েছেন। নদীতে নানা রংয়ের পাল তোলা নৌকা চলার দৃশ্য তাঁকে মুগ্ধ করে।

ইবনে বতুতা দামেস্কে ভ্রমণের সময় বিয়ে করেন। তার একটা ছেলে সন্তানও জন্ম হয়েছিল। কিন্তু ছেলেকে তিনি দেখেননি। দেশÑবিদেশে ঘোরাঘুরি করার কারণে ছেলের মুখ দেখার সৌভাগ্য তার হয়নি। তবে তিনি এক সময় তার দেশ মরক্কোর জন্য পাগলপারা হয়ে উঠলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য তার। মরক্কো ফিরে গিয়ে দেখলেন তার সোনার ছেলেটি আর বেঁচে নেই। এতে তিনি মর্মাহত হন। এভাবে ধর্মপ্রাণ ইবনে বতুতা অনেক দেশ সফর করে এক সময় ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। ইবনে বতুতার জীবনে আরো অনেক মর্মন্তুদ ঘটনা ঘটেছে। তারপরও তিনি দমে যাননি। দুনিয়ার অধিকাংশ দেশ ঘুরে তিনি যে ইতিহাস তৈরি করেন তা আজও দুনিয়ার অনেকের বিস্ময়ের উদ্রেক করে।

অন্যান্য মিডিয়া bdnews24 RTNN Sheersha News barta24 Prothom Alo Daily Nayadiganta Jugantor Samakal Amardesh Kaler Kantho Daily Ittefaq Daily Inqilab Daily Sangram Daily Janakantha Amader Shomoy Bangladesh Pratidin Bhorerkagoj Daily Dinkal Manob Zamin Destiny Sangbad Deshbangla Daily Star New Age New Nation Bangladesh Today Financial Express Independent News Today Shaptahik 2000 Computer Jagat Computer Barta Budhbar Bangladesherkhela Holiday Bangladesh Monitor BBC Bangla Pars Today
homeabout usdeveloped by

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ মো. তাসনীম আলম।

এটিএম সিরাজুল হক কর্তৃক হক প্রিন্টার্স ১০/৮ আরামবাগ, ঢাকা-১০০০ হতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। যোগাযোগের ঠিকানাঃ ৪২৩ এলিফেন্ট রোড, বড় মগবাজার, ঢাকা - ১২১৭।

ফোন: ৮৮ ০২ ৪৮৩১৯০৬৫, ই-মেইল: sonarbanglaweekly@gmail.com, weeklysonarbangla@yahoo.com, সার্কুলেশন: ০১৫৫২৩৯৮১৯০, বিজ্ঞাপন: ৪৮৩১৫৫৭১, ০১৯১৬৮৬৯১৬৮, ০১৭৩৪০৩৬৮৪৬।