সংবাদ শিরোনামঃ

আন্তর্জাতিক চাপে সরকার ** গুমের সঙ্গে এই সরকার জড়িত ** যেমন কর্ম তেমন ফল ** শ্রমজীবী মানুষের কল্যাণে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে ** উৎপাদন খরচ কমলেও বাড়লো বিদ্যুতের দাম ** গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক : বিএনপি ** প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে নজিরবিহীন বিক্ষোভ, উত্তাল মালয়েশিয়া ** দেশ আতঙ্কিত অথচ সরকার বলছে শান্তিপূর্ণ ** রাষ্ট্র ও সরকারকে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে ** অনুভূতির সাগরে কুরআনের দেশে ** গুম দিবসও গুম হয়ে গেলো! ** ছোটদের বন্ধু নজরুল ** বন্যায় সারাদেশে ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি অপর্যাপ্ত সরকারি সাহায্য ** রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবির কর্মীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা ** যশোরের শার্শায় বাণিজ্যিকভাবে বেদানা চাষ **

ঢাকা, শুক্রবার, ২০ ভাদ্র ১৪২২, ১৯ জিলকদ ১৪৩৬, ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫

এবনে গোলাম সামাদ
৬০০ হিজরিতে মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি বর্তমান বাংলাদেশের একটি বিস্তীর্ণ অঞ্চল দখল করেন। ৬০০ হিজরিকে ধরা চলে ১২০৩ খ্রিস্টাব্দ। তবে এ নিয়ে বিতর্ক আছে। বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারের ইতিহাস এখনো যথাযথভাবে পরীক্ষিত হয়নি। তবে নওগাঁ জেলার পাহাড়পুরের বৌদ্ধস্তূপের মাটি খুঁড়ে পাওয়া গেছে খলিফা হারুন আর রশিদের মুদ্রা। ময়নামতি বৌদ্ধবিহারের মাটি খুঁড়ে পাওয়া গেছে পরবর্তীকালের আব্বাসীয় খলিফাদের মুদ্রা। এ থেকে অনুমান করা চলে, আরব মুসলমান বণিকেরা এ দেশে ব্যবসা করতে আসতেন। তবে তারা এ দেশে ইসলাম প্রচারে উদ্যোগ নিয়েছিলেন কি না সে বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ এখনো পাওয়া সম্ভব হয়নি। বাগেরহাট জেলায় রয়েছে বিখ্যাত ষাটগম্বুজ মসজিদ। ওই অঞ্চলে নিশ্চয় একসময় ছিল বেশ কিছু মুসলমানের বসতি। না হলে অত বড় মসজিদ নির্মাণ সেখানে প্রয়োজন হতো না। বাগেরহাট সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চলেরই অন্তর্গত। বাংলাদেশে বিশেষ করে তার উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে একসময় ছিল মহাযান বৌদ্ধদের বাস। কিন্তু এখন বাংলাদেশে মহাযান বৌদ্ধরা আর নেই। অনেকে অনুমান করেন যে, এসব বৌদ্ধ ইসলাম গ্রহণ করে হয়ে পড়েন মুসলিম সমাজের অংশ। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, কেবল বাংলাদেশ নয়, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়াতেও দলে দলে মহাযান বৌদ্ধরা গ্রহণ করে ইসলাম। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এখন বাস করে সর্বাধিকসংখ্যক ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষ। বাংলাদেশে মধ্য এশিয়া থেকে এসেছিলেন বিন বখতিয়ার। কিন্তু মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াতে বাইরে থেকে কোনো মুসলিম শক্তি গিয়ে রাজত্ব বিস্তার করেনি। এখানে ইসলাম প্রচারিত হয়েছে অত্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে। কোনো ধরনের তরবারির সাহায্য ছাড়াই। ইসলামের এই বিস্তার যথেষ্ট বিস্ময়কর। ইসলাম ধর্মে এমন কিছু আছে, যা এই অঞ্চলের মানুষকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছিল। আমরা জানি, বাংলাভাষায় যত লোক কথা বলেন, তার মধ্যে প্রায় শতকরা ৬০ ভাগ থাকেন বর্তমান বাংলাদেশে। আর বাকি শতকরা প্রায় ৪০ ভাগ থাকেন ভারতে। ভাষা আমাদের জাতিসত্তায় একটি খুবই মূল্যবান উপাদান। কিন্তু নিশ্চয় একমাত্র উপাদান নয়। যদি তা হতো, তবে সম্ভব হতো সব বাংলা ভাষাভাষী মানুষের একটি মাত্র রাষ্ট্রিক পতাকাতলে আসা। কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি। কেননা, বাঙালি হিন্দুরা সব সময়ই চেয়েছেন ভারতীয় মহাজাতির অংশ হয়ে বাঁচতে। কিন্তু বাংলাভাষী মুসলমানরা তা চাননি। চাননি বলেই তারা শেষ পর্যন্ত গড়তে পেরেছেন আজকের বাংলাদেশ রাষ্ট্র। আজকের রাষ্ট্র বাংলাদেশের ভিত্তি হলো বাংলাভাষী মুসলমান। তারা না থাকলে কোনো পৃথক স্বাধীন বাংলাদেশ হতো না। বাংলাদেশে তারা একটি ধর্মসম্প্রদায় মাত্র নন; তারাই হলেন এ দেশের রাষ্ট্রিক বুনিয়াদ। আমাদের জাতিসত্তার বিশ্লেষণে ইসলামকে তাই বাদ দেয়া যায় না। যদিও সেটা করতে চাচ্ছেন অনেকে।

‘বংগ’ নামের উদ্ভব নিয়ে নৃতাত্ত্বিকেরা গবেষণা করেছেন। বেশির ভাগ নৃতাত্ত্বিকের মত হলো, ‘অংগ’, ‘বংগ’ এবং ‘কলিংগ’ নামগুলো আর্য ভাষার নয়। এসব নাম এসেছে চীনা পরিবারভুক্ত কোনো ভাষা থেকে। সাধারণত ‘য়ং’ ধ্বনি চীনা পরিবারভুক্ত ভাষায় নদীর নামের সাথে যুক্ত থাকতে দেখা যায়। যেমন, ইয়ং সিকিয়ং, হুয়ংগো। এদের মতে, গংগা নামটিও এসেছে কোনো চীনা পরিবারভুক্ত ভাষা থেকে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় যে, নদীকে সাধারণ বাংলাভাষায় এখনো বলে ‘গাং’। বংগ বলতে সম্ভবত বুঝাতো একটি নদীকে, আর তার তীরবর্তী মানুষকে। বিষয়টি নিয়ে বেশ কিছুটা আলোচনা করেছেন Irawati Karve নামে একজন ভারতীয় নৃতাত্ত্বিক তার লিখিত India as a Cultural Region নামক প্রবন্ধে। প্রবন্ধটি ছাপা হয় ১৯৬২ সালে T N Madan Ges Gopal Sarana সম্পাদিত Indian Anthropology নামক বইতে। যা প্রকাশিত হয় Asia Publishing House, London থেকে। প্রবন্ধটি যথেষ্ট সুলিখিত। একসময় বংগ বলতে কেবল পূর্ববংগকেই বুঝাত। খুব বেশি দিনের কথা নয়, মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-৭৩) তার ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটকের প্রস্তাবনায় লিখেছেনÑ

অলীক কুনাট্য রঙ্গে মজে লোকে রাঢ়ে বঙ্গে

নিরখিয়া প্রাণে নহি সয়।

অর্থাৎ, মাইকেল মধুসূদনের সময়ও বংগ বলতে প্রধানত বুঝিয়েছে পূর্ববংগকেই। আর রাঢ় বলতে বুঝিয়েছে পশ্চিমবংগকে। ব্রিটিশ শাসনামলে পশ্চিমবংগ বলতে বোঝাতো, ভাগীরথীর পশ্চিমে তখনকার বাংলা প্রদেশের যে অংশ ছিল, তাকে। মধ্যবংগ বলতে বোঝাত ভাগীরথী ও মধুমতি নদীর মধ্যে যে অংশ, তাকে। যমুনা ও মধুমতির পূর্বে তখনকার বাংলার যে অংশ অবস্থিত তাকে বলা হতো পূর্ববংগ এবং পদ্মা নদীর উত্তরে ও যমুনা নদীর পশ্চিমে তখনকার বাংলা প্রদেশের যে অংশ ছিল, তাকে বলা হতো উত্তরবংগ। এভাবে নদীগুলোর সাহায্যে ভাগ করে ব্রিটিশ আমলে বাংলা প্রদেশের ভূগোলকে আলোচনা করা হতো।

চর্যাপদ বলতে বোঝায় কিছুসংখ্যক বজ্রযান (মহাযান বৌদ্ধধর্মের একটি শাখা) বৌদ্ধধর্মের গুরুদের লেখা কিছুসংখ্যক গানকে। এ পর্যন্ত ৪৭টি চর্যাপদ বা গান পাওয়া গেছে। এগুলোকে দাবি করা হয় প্রাচীন বাংলা ভাষার নিদর্শন হিসেবে। ভাষাতাত্ত্বিক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, এদের রচনাকাল খ্রিস্টিয় নবম শতাব্দী। অন্য দিকে, ভাষাতাত্ত্বিক মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ মনে করেন, এদের রচনাকাল খ্রিস্টিয় সপ্তম শতাব্দী। আমরা এই বিতর্কের মধ্যে যাব না। একটি চর্যাপদে বলা হয়েছে-

বাজণাব পাড়ী পঁউলা খাঁলে বাহিউ।

অদঅ বঙ্গালে কেশ লুড়িউ।

আজি ভুসু বঙ্গালী ভইলী।

নিঅ ঘরিণী চণ্ডালী লেলী।

ভুসু হলেন একজন বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্য বা গুরু। এখানে বলা হচ্ছে, ভুসু বাঙালি হিসেবে পরিচিত হতে পারলেন একজন চণ্ডালীকে বিয়ে করে। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, একটি জনসমষ্টি কম করে হাজার বছর আগেও ছিল। হঠাৎ করেই তার উদ্ভব হয়নি। ক’দিন ধরেই পত্রপত্রিকায় পড়লাম, শেখ মুজিবুর রহমান হলেন বাঙালি জাতির জনক। কিন্তু বাঙালি বহুকাল আগে থেকেই ছিল। শেখ মুজিব জন্মেছেন বাঙালি জনসমষ্টির মধ্যে অনেক পরে। হয়েছেন তাদের রাজনৈতিক নেতা। এভাবে বললেই ইতিহাস অবিকৃত থাকে। আর সহজেই হতে পারে বোধগম্য।

ভাষা আমাদের জাতিসত্তার একটি মূল্যবান উপাদান। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন এ দেশে হতে পেরেছিল খুবই ব্যাপকভাবে। সাবেক পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুর পাশে বাংলা পেতে পেরেছিল স্থান। এটা ছিল একটি বিরাট রাজনৈতিক ঘটনা। কিন্তু শেখ মুজিব এই আন্দোলনে কোনো ভূমিকা রাখেননি। প্রথমত, তিনি এ সময় ছিলেন জেলে। জেলে থেকে কোনো আন্দোলন করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। এ ছাড়া এই আন্দোলন থেকে দূরে সরে থাকার হয়তো আরেকটি কারণও ছিল। শেখ মুজিবের অসমাপ্ত আত্মজীবনী পড়লে বোঝা যায়, তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে খুবই শ্রদ্ধা করতেন এবং মান্য করতেন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে। ১৯৫১ সালে ২৪ জানুয়ারি সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘পাকিস্তান জিন্নাহ আওয়ামী লীগ’। ১৯৫২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি সোহরাওয়ার্দী সিন্ধু প্রদেশের হায়দরাবাদ শহর থেকে একটি বিবৃতি দেন। যাতে তিনি বলেন, যে আদর্শের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তদানুসারে উর্দুই হতে হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। সোহরাওয়ার্দী প্রথমে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে ছিলেন না। অনেক পরে তিনি তার মত পরিবর্তন করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পাারে, কেবল সোহরাওয়ার্দী নন, তদানীন্তন পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ জহিরও বলেন, উর্দুকে করতে হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। কেননা, শ্রমিক মজুররা উর্দু ভাষা বোঝে, বাংলা ভাষা বোঝে না। শ্রমিক মজুর দিয়েই করতে হবে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব।

সাধারণভাবে যাদের বলা হয় বাঙালি, তাদের মাতৃভাষা বাংলা এবং তাদের চেহারার মধ্যে আছে কিছু বৈশিষ্ট্য। যেমন এদের গায়ের রঙ কালো। কিন্তু ঘোর কালো নয়। এরা উচ্চতায় মাঝারি আকৃতির (১.৫৮ মিটার থেকে ১.৬৮ মিটারের মধ্যে)। এদের মাথার চুল মসৃণ, শক্ত খরখরে নয়। এদের চোখ আয়ত। আর চোখের তারার রঙ কালো। এদের মুখে দাড়ি-গোঁফের প্রাচুর্য থাকতে দেখা যায়। এদের মাথার আকৃতি মাঝারি। মাথার আকৃতি মাঝারি বলতে বোঝায়, মাথার প্রস্থকে দৈর্ঘ্য দিয়ে ভাগ করে ১০০ দিয়ে গুণ করলে তার পরিমাণ দাঁড়ায় ৭০ থেকে আশির মধ্যে। এদের নাসিকাও হলো মধ্যমাকৃতির। মধ্যমাকৃতির নাসিকা বলতে নাকের অগ্রভাগের প্রস্থকে কপাল থেকে নাকের অগ্রভাগের দৈর্ঘ্যকে ভাগ করে ১০০ দিয়ে গুণ করলে তার অনুপাত দাঁড়ায় ৭১ থেকে ৮৫-এর মধ্যে। এসব কারণে সাধারণভাবে বাঙালি জনসমষ্টিকে এই উপমহাদেশের অন্য জনসমষ্টি থেকে পৃথক করা চলে। চিনে নেয়া যায়। বাংলাভাষী মানুষের জীবনরীতিতে আছে ঐক্য। ধানচাষ এদের জীবিকার প্রধান উপায়। ভাত ও মাছ এদের খাদ্যতালিকার প্রধান অংশ। বাঙালি হিন্দু ব্রাহ্মণরা মাছ খান বলে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যত্র তারা মেছোয়া ব্রাহ্মণ বলে নিন্দিত। কিন্তু বাংলাভাষী হিন্দুরা নন, বাংলাভাষী মুসলমানরাই সৃষ্টি করেছেন আজকের পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশকে। আমাদের জাতিসত্তার ভিত্তি হিসেবে তাই তাদের কথাই পেতে বাধ্য বিশেষ বিবেচনা।

অনেক শব্দের এখন ভুল প্রয়োগ হচ্ছে। যেমন ‘আদিবাসী’ শব্দটি। নৃতত্ত্বে আদিবাসী বলতে বোঝায়, কোনো দেশের আদিম নিবাসীকে। অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী বলতে বোঝায়, সে দেশের কালো মানুষকে। এরা পড়েছিল আদিম প্রস্তর যুগের সাংস্কৃতিক পর্যায়ে। অস্ট্রেলিয়ার সভ্যতা গড়ে তুলেছেন ব্রিটেন থেকে সাদা মানুষ গিয়ে, মাত্র কয়েক শ’ কছর আগে। বিখ্যাত ব্রিটিশ নাবিক ক্যাপটেন কুক অস্ট্রেলিয়া মহাদেশে পদার্পণ করেন ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে। বাংলাদেশে আমরাই হলাম প্রকৃত প্রস্তাবে আদিবাসী। কেননা, আমাদের পূর্বপুরুষ এখানে বন কেটে অথবা পুড়িয়ে পরিষ্কার করে প্রথম আরম্ভ করেন চাষাবাদ। গড়ে তোলেন সমৃদ্ধ জনপদ। যদি আমরা বিন বখতিয়ারকে ধরি আমাদের সভ্যতার সূচনাকারী, তবে সেটাও কম দিনের ঘটনা নয়। প্রায় ৮০০ বছর আগের ঘটনা। বাংলাদেশে এখন যাদের আদিবাসী বলা হচ্ছে, তাদের কেউ-ই আসেননি এত দিন আগে। আর গড়ে তোলেননি কোনো সভ্য জনপদ। যেমন গড়ে তুলেছিলেন আমাদের পূর্বপুরুষ। একদিন সব মানুষই বনে বাস করত। বনে ফলমূল আহরণ করে পশুপাখি শিকার করে আহার্য জোগাড় করত। মানুষের এই অবস্থাকে বলা হয় আহার্য আহরক অবস্থা। এর পরের অবস্থাকে বলা হয়, আহার্য উৎপাদক অবস্থা; যখন থেকে মানুষ আরম্ভ করেছে চাষাবাদ ও পশুপালন। সভ্যতার আরম্ভ ধরা হয় লিপির আবিষ্কার দিয়ে। বাংলাভাষা লেখা হচ্ছে কম করে ১৪০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে। সাঁওতালদের ভাষা কোনো লিখিত ভাষা ছিল না। ঊনবিংশ শতাব্দীতে নরওয়ে থেকে আগত খ্রিস্টান মিশনারি পি ও বোডিং (P. O. Bodding) প্রথম রোমান বর্ণমালায় সাঁওতালি ভাষা লেখার ব্যবস্থা করেন। তিনি প্রথম সঙ্কলন করেন সাঁওতালি ভাষার অভিধান। কিন্তু বিদেশ থেকে খ্রিস্টান মিশনারি আসার অনেক আগে থেকেই বাংলা পরিণত হয়েছিল একটি লিখিত ভাষায়। গড়ে উঠেছিল তার কাব্যসাহিত্য। এ দেশ থেকে মানুষ দূর-দূর দেশে বড় বড় নৌকায় করে বাণিজ্য করতে যেত। কেবল এ দেশের মধ্যেই নিবদ্ধ ছিল না তাদের অর্থনৈতিক কার্যকলাপ। সাঁওতালরা বনে থাকত। পরে তারা শেখে কৃষিকাজ। নীলকর সাহেবরা ছোট নাগপুর অঞ্চল থেকে সাবেক মালদহ জেলায় অনেক সাঁওতালকে নিয়ে আসেন নীল চাষ করার জন্য। সেখান থেকে বিংশ শতাব্দীর শুরুতে সাঁওতালরা তখনকার মালদহ জেলা থেকে আসতে থাকেন রাজশাহী জেলায়। রাজশাহী জেলার তিনটি উপজেলায় (গোদাগাড়ী, তানোর ও পবা) এখন যথেষ্ট সাঁওতালের বাস। বর্তমান রাজশাহী জেলার মোট জনসংখ্যার শতকরা দুই ভাগ নাকি সাঁওতাল। অবশ্য এই পরিসংখ্যান খুব নির্ভরযোগ্য নয়। কিন্তু যদি বলা হয়, সাঁওতালরা হলো এই অঞ্চলের আদিবাসী, তবে অবশ্যই ঐতিহাসিকভাবে ভুল করা হবে। আমাদের জাতিসত্তা গঠনে সাঁওতালরা কোনো ভূমিকা পালন করেনি। তারা এখনো স্থানীয় জনসমষ্টি থেকে থাকে পৃথক গ্রাম গড়ে।

নৃতত্ত্বে জাতি (Ethnie) বলতে বোঝায় এক ভাষায় কথা বলা জনসমষ্টি। ইংরেজ আমলে উপজাতি বলতে বুঝিয়েছে এমন জনসমষ্টিকে, যারা সংখ্যায় খুব কম। আর বাস করে বনেবাদারে ও দুর্গম অঞ্চলে। উপজাতি আর জাতি সমার্থক নয়। জাতিদের আছে নিজস্ব সভ্যতা ও লিখিত ভাষা। তারা গড়ে তুলেছে জটিল অর্থনৈতিক জীবন। কিন্তু উপজাতিরা সেটা করেনি। অনেক উপজাতি এসে বাস করছে সভ্য জনপদের মধ্যে। কিন্তু তারা বজায় রেখেছে তাদেরই প্রাচীন জীবনধারা; অনেক কিছুই। বাংলাদেশে এখন আর দুর্গম বনভূমি নেই। আগে যাদের বলা হতো উপজাতি, তাদের আর ঠিক বলা যায় না উপজাতি। তাদের অনেকেই লেখাপড়া শিখছে বাংলা ও ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে। কিন্তু তবু উপজাতি ও আদিবাসী নিয়ে একদল বামপন্থী করতে চাচ্ছেন বিশেষ রাজনীতি। আর জাগিয়ে তুলতে চাচ্ছেন আমাদের জাতিসত্তা নিয়ে নানা বিভ্রান্তি। তাই আদিবাসী, জাতি ও উপজাতি সম্পর্কে আমাদের থাকতে হবে সুস্পষ্ট ধারণা। শেখ মুজিব ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি রাঙ্গামাটি যান এবং তার বক্তৃতায় বলেন, দেশের সব লোক বাঙালি বলে বিবেচিত হবে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমার (সন্তু লারমা) সাথে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর এমন এক চুক্তি করে, যার ফলে বাংলাদেশের শতকরা ১০ ভাগের এক ভাগ ভূমি বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে (খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান) কম করে ১০টি উপজাতির বাস। এরা হলো চাকমা, মারমা, ত্রিপুরী, তংচঙ্গা, কুকি, মিজো, রিয়াং, বনযোগী ও পাংখো। এদের মধ্যে চাকমাদের ভাষা হয়ে উঠেছে বাংলা। চাকমারা যে ভাষায় কথা বলে, ব্রিটিশ ভাষাতাত্ত্বিক গ্রিয়ার্সন তার বিখ্যাত লিংগুয়িস্টিক সার্ভে অব ইন্ডিয়ায় উল্লেখ করেছেন, চাকমারা বাংলা বলে। যা চট্টগ্রামের বাংলা উপভাষার মতো। কিন্তু অন্যান্য উপজাতির আছে নিজ নিজ কথিত ভাষা। তারা একে অপরের ভাষা বোঝে না। এক উপজাতির লোক আরেক উপজাতির লোকের সাথে কথা বলতে হলে, কথা বলে বাংলা ভাষায়। মারমারা আরাকানি ভাষায় কথা বলেন। মারমাদের সাথে চাকমাদের সদভাব নেই। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের সমস্যা হয়ে উঠেছে খুবই জটিল। কয়েক দিন আগে পত্রিকার খবরে পড়লাম, বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে সেখানে চালাতে হয়েছে গুলিগোলা। কেবল পুলিশ দিয়ে শান্তিরক্ষা সম্ভব হয়নি। সন্তু লারমা ২০০১ সালে গঠন করেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম। বাংলাদেশের তথাকথিত আদিবাসীরা চাচ্ছেন সংবিধানে বিশেষ স্বীকৃতি। কিন্তু সব ‘আদিবাসী’ এক জায়গায় থাকেন না। জনসংখ্যার দিক থেকে তারা বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা এক ভাগের কাছাকাছি। তাদের কথা তুলে আমাদের জাতিসত্তার স্বরূপকে অস্পষ্ট করে তোলার বিশেষ চেষ্টা করা হচ্ছে। যেটা হতে দেয়া যায় না। প্রসঙ্গত বলা যায়, সাবেক পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হয়েছিল ১৯৪৭ সালে র‌্যাডকিফ রোয়েদাদের মাধ্যমে। সেই থেকে তা বাংলাদেশের অংশ হতে পেরেছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম এ দেশের বাংলাদেশের জনসমষ্টি গায়ের জোরে দখল করেনি। এ দশের বামপন্থীরা উপজাতিদের নিয়ে রাজনীতি অনেক দিন আগে থেকেই করছেন। ১৯৫০ সালে নাচোলে তারা ঘটান সাঁওতাল বিদ্রোহ। কিন্তু এই বিদ্রোহের মাধ্যমে সাঁওতালেরা পায়নি কিছুই। কেবল দিয়েছে প্রাণ।      

নয়াদিগন্তের সৌজন্যে।

লেখক : প্রবীণ শিাবিদ ও কলামিস্ট

অন্যান্য মিডিয়া bdnews24 RTNN Sheersha News barta24 Prothom Alo Daily Nayadiganta Jugantor Samakal Amardesh Kaler Kantho Daily Ittefaq Daily Inqilab Daily Sangram Daily Janakantha Amader Shomoy Bangladesh Pratidin Bhorerkagoj Daily Dinkal Manob Zamin Destiny Sangbad Deshbangla Daily Star New Age New Nation Bangladesh Today Financial Express Independent News Today Shaptahik 2000 Computer Jagat Computer Barta Budhbar Bangladesherkhela Holiday Bangladesh Monitor BBC Bangla Pars Today
homeabout usdeveloped by

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ মো. তাসনীম আলম।

এটিএম সিরাজুল হক কর্তৃক হক প্রিন্টার্স ১০/৮ আরামবাগ, ঢাকা-১০০০ হতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। যোগাযোগের ঠিকানাঃ ৪২৩ এলিফেন্ট রোড, বড় মগবাজার, ঢাকা - ১২১৭।

ফোন: ৮৮ ০২ ৪৮৩১৯০৬৫, ই-মেইল: sonarbanglaweekly@gmail.com, weeklysonarbangla@yahoo.com, সার্কুলেশন: ০১৫৫২৩৯৮১৯০, বিজ্ঞাপন: ৪৮৩১৫৫৭১, ০১৯১৬৮৬৯১৬৮, ০১৭৩৪০৩৬৮৪৬।