ড. রেজাউল করিম হত্যার প্রতিবাদে উত্তাল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

রাবি সংবাদদাতা : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে (৬১) কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। গত ২৩ এপ্রিল শনিবার সকাল সাড়ে ৭টায় মহানগরীর শালবাগান বটতলা মোড় এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। নিজ বাসার সামনে থেকে মাত্র ১০০ গজ দূরে তাকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এ ব্যাপারে থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন নিহতের পুত্র। এই ঘটনার প্রতিবাদে রাবি ক্যাম্পাস ছিল বিক্ষোভে উত্তাল।

ড. রেজাউল করিমের ডাক নাম মুকুল। তার গ্রামের বাড়ি রাজশাহীর বাগামারার দরগামাড়িয়ায়। সেখানে তার একটি গানের স্কুল আছে। তিনি রাজশাহীর শালবাগানে বাসা নিয়ে থাকতেন। নিহত রেজাউল করিমের বোনের জামাই মাহাবুব আলম সাংবাদিকদের জানান, অন্যান্য দিনের মতোই সকাল সাড়ে ৭টার দিকে বাড়ি থেকে বের হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে শালবাগান বটতলা মোড়ে বাসের জন্য অপো করছিলেন তিনি। এ সময় মোটরসাইকেলযোগে হেলমেট পরা দুই যুবক পেছন থেকে তার গলাতে কোপ দেয়। এতে তিনি মাটিতে পড়ে যান এবং ঘটনাস্থলেই মারা যান। এ বিষয়ে বোয়ালিয়া মডেল থানা পুলিশের ওসি শাহাদাত হোসেন জানান, ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। নগর পুলিশের কর্মকর্তাদের সন্দেহ, যেভাবে ব্লগারদের হত্যা করা হচ্ছে এই ঘটনার সঙ্গে তার মিল আছে। ফলে এর পেছনে জঙ্গি সংগঠনের সম্পৃক্ততার সন্দেহ করা হচ্ছে। তবে ড. রেজাউল করিমের কোন রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার বিষয়ে এখনো কিছু জানা যায়নি। প্রত্যদর্শীরা জানান, অধ্যাপক রেজাউল করিমের মাথার নিচে ঘাড় ও মুখের চোয়ালে তিন থেকে চারটি কোপের জখম রয়েছে। তার মধ্যে একটি কোপ ডানের পাশের চোয়াল হয়ে মুখ পর্যন্ত গেছে। এদিকে, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে দুপুর পৌনে একটার দিকে অধ্যাপক রেজাউল করিমের লাশ তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। বিকালে নগরীর শালবাগানে প্রথম জানাজা এবং সন্ধ্যেয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে দ্বিতীয় জানাজা শেষে রাজশাহীর বাগামারার দরগামারিড়ায় গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। গ্রামের বাড়িতে তৃতীয় জানাজা শেষে বাদ এশা লাশ দাফন করা হয়। প্রফেসর এএফএম রেজাউল করিম সিদ্দিকী ১৯৫৫ সালের জানুয়ারিতে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৮৩ সালে ইংরেজি বিভাগে প্রভাষক পদে যোগদান করে ২০০৬ সালে প্রফেসর পদে উন্নীত হন। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, এক কন্যা ও এক পুত্র রেখে গেছেন।

নিহতের পুত্রের মামলা দায়ের : প্রফেসর রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। গত ২৩ এপ্রিল শনিবার বিকেল ৪টার দিকে নিহত শিকের ছেলে সৌরভ হোসেন বাদী হয়ে বোয়ালিয়া থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। নগরীর বোয়ালিয়া থানার ওসি জানান, মামলায় অজ্ঞাতনামাদের আসামি করা হয়েছে। মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রফেসর রেজাউল করিম সিদ্দিকী বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার উদ্দেশে সকালে বাসা থেকে বের হন। এ সময় আগে থেকে ওঁৎ পেতে থাকা অজ্ঞাতনামা সন্ত্রাসীরা মোটরসাইকেলে করে এসে পেছন দিক থেকে তাকে কুপিয়ে ফেলে রেখে যায়। সকাল পৌনে ৮টার দিকে রাজশাহীর শালাবাগান এলাকায় নিজ বাসা থেকে একটু দূরে প্রফেসর রেজাউলের ওপর এ হামলার ঘটনা ঘটে। হামলাকারীরা মোটরসাইকেলে করে এসে হামলায় অংশ নেয়। তারা প্রফেসর রেজাউলকে পেছন থেকে কুপিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে ফেলে রেখে চলে যায়।

এর আগে ২০১৪ সালের ১৫ নভেম্বর দুপুরে খুন হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক একেএম শফিউল ইসলাম। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে ফেরার পথে বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন চৌদ্দপাই এলাকায় নিজ বাসার সামনে দুর্বৃত্তদের হামলায় তিনি নিহত হন। তারও আগে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরো দু’জন শিক ড. ইউনুস ও ড. তাহের আহমদ নিহত হন।

উত্তাল রাবি শিকদের প্রতিবাদ : শিক নিহতের ঘটনায় গত ২৩ এপ্রিল শনিবার বিশ^বিদ্যালয় ক্যাম্পাস উত্তাল হয়ে ওঠে। এই হত্যার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক মুহম্মদ মিজানউদ্দিন ও প্রো-ভিসি অধ্যাপক চৌধুরী সারওয়ার জাহান। একই সাথে তারা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করারও আহ্বান জানান। এর আগে হত্যার ঘটনা ছড়িয়ে পড়লে রাবি শিক্ষার্থীরা সকাল সোয়া ১০টা থেকে পৌনে ১১টা পর্যন্ত ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ করে রাখে।

এছাড়া রোববার রাবিতে পূর্ণ দিবসসহ তিনদিন কাস বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক সমিতি। প্রফেসর রেজাউলের নৃশংস হত্যাকাণ্ডে গভীর শোক প্রকাশ এবং এ ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী শিক গ্রুপ (সাদা দল)। সাদা দলের ভারপ্রাপ্ত আহবায়ক প্রফেসর ড. মোহা. এনামুল হক স্বারিত এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, প্রফেসর রেজাউল করিমের মতো একজন গুণী ও নিরীহ মানুষকে এভাবে নির্মমতার শিকার হতে হবে এটা আমরা কল্পনাও করতে পারছি না। এ ঘটনাই প্রমাণ করে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কি ভয়ঙ্কর অবনতি ঘটেছে! অবিলম্বে হত্যাকারীদের গ্রেফতার করে ফাঁসির দাবি জানিয়ে সাদা দলের নেতৃবৃন্দ বলেন, বেশ কয়েক বছর ধরে একের পর এক এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিকরা অপমৃত্যুর শিকার হচ্ছেন। কিন্তু কোন ঘটনারই সুষ্ঠু ও নিরপে বিচার না হওয়ার ফলে দুষ্কৃতকারীরা পার পেয়ে যাচ্ছে। শিকবৃন্দ আরো উল্লেখ করেন যে, দ্রুততম সময়ের মধ্যে এ ঘটনার যথাযথ বিচার না হলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তুলতে বাধ্য হবে। শিকবৃন্দ মরহুমের রূহের মাগফিরাত কামনা করেন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। প্রফেসর ড. রেজাউলের নৃশংস হত্যাকাণ্ডে গভীর শোক প্রকাশ এবং এ ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতীয়তাবাদী শিক ফোরাম। ফোরামের সভাপতি প্রফেসর ড. কে বি এম মাহবুবুর রহমান এবং সাধারণ সম্পাদক প্রফেসর ড. আমজাদ হোসেন স্বারিত এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, অবিলম্বে প্রফেসর রেজাউলের হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত এবং ঘটনায় দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। আমরা মনে করি আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনীকে দলীয় বাহিনীর মতো ব্যবহারের ফলেই সংশ্লিষ্টরা বারে বারে এ ধরনের ঘৃণ্য ঘটনা ঘটানোর সাহস পাচ্ছে। মরহুমের রূহের মাগফিরাত কামনা করেন এবং তাঁর শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।

নগর জামায়াত ও রাবি শিবিরের বিবৃতি : রাবি শিক ড. এএফএম রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন নগর জামায়াতের আমীর প্রফেসর আবুল হাশেম ও রাবি শিবিরের সভাপতি শোয়েব শাহরিয়ার, সেক্রেটারি হাসান তারিক ও সাংগঠনিক সম্পাদক লাবিব আবদুল্লাহ। পৃথক বিবৃতিতে বলেন, একের পর এক শিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে এবং তাদের স্বাভাবিক চলাচল ও শিক্ষা কার্যক্রমের ব্যাঘাত ঘটছে। এভাবে চলতে থাকলে উত্তরবঙ্গের সর্বোচ্চ এ বিদ্যাপীঠের শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বিঘিœà¦¤ হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয় তার বহুকষ্টে অর্জিত সুনাম হারাবে। আর পরিকল্পিতভাবে প্রকৃত অপরাধীকে আড়াল করার জন্য বা তা রাজনৈতিক প্রতিপকে দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার জন্য ঘটনার পরপরই নানা ধরনের অপপ্রচার ও প্রপাগাণ্ডা চালানো হয়। নেতৃবৃন্দ অবিলম্বে হত্যাকারীদের চিহ্নিত করে দ্রুত গ্রেফতারের দাবি জানান।  এদিকে রাজশাহীর আইনৃঙ্খলার অবনতিতে জনমনে চরম উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে।

চট্টগ্রাম : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক ড. এএফএম রেজাউল করিম সিদ্দিকী হত্যার তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ জানিয়ে এর দ্রুত বিচার দাবি করেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক সমিতি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক সমিতির সভাপতি প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আবুল মনছুর ও সাধারণ সম্পাদক ড. কাজী এস এম খসরুল আলম কুদ্দুসী এক যৌথ বিবৃতিতে বলেছেন,  একের পর এক প্রগতিশীল শিক ও বুদ্ধিজীবী হত্যা করে প্রতিক্রিয়াশীলরা বাঙালি সত্ত্বার ওপর আব্যাহতভাবে আঘাত হানছে যা একাত্তরের বুদ্ধিজীবী হত্যার কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। এ হত্যাকাণ্ড কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না উল্লেখ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক সমিতির নেতৃবৃন্দ বলেন, এই ন্যক্কারজনক হত্যাকাণ্ডে সমগ্র শিক সমাজ দারুণভাবে ব্যথিত হয়েছে এবং সকল স্তরের শিকদের মাঝে ব্যাপক ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে।

নেতৃবৃন্দ অবিলম্বে প্রতিক্রিয়াশীলদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান ও সকল মুক্তমনা শিক, কবি, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীকে সার্বিক নিরাপত্তা প্রদানের জন্য সরকারের প্রতি জোর দাবিসহ সচেতন নাগরিকদের প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার আহ্বান জানিয়েছেন। সরকারিভাবে এবং সামাজিকভাবে প্রতিক্রিয়াশীলদের প্রতিহত করতে না পারলে বাংলাদেশে মুক্তিবুদ্ধির চর্চা ব্যাপকভাবে ব্যাহত হবে বলেও নেতৃবৃন্দ আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

উল্লেখ্য, এর আগের দিন গত ২২ এপ্রিল শুক্রবার সকালে দিবাগত রাতে নগরীর নাইস ইন্টারন্যাশনাল হোটেলে দু’জন যুবক-যুবতীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। জন নিরাপত্তা ও জানমালের নিরাপত্তার স্বার্থে শিক্ষার এই মহানগরীতে বহুমাত্রিক আইনশৃঙ্খলা রাবাহিনী নিয়োজিত থাকলেও মাত্র দু’দিনের ব্যবধানে এখানে তিন তিনটি নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটে গেল।