রোজার তাৎপর্য

অধ্যাপক মিজানুর রহমান
রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের সওগাত নিয়ে প্রতি বছরের ন্যায় আবারো আমাদের মাঝে ফিরে এসেছে মাহে রমজান। মুসলমানদের হৃদয়ে আনন্দের হিল্লোল বয়ে যাচ্ছে। চারদিকে সাজ সাজ রব পড়ে গেছে। মসজিদগুলোকে চমৎকারভাবে সাজানো হয়েছে। মসজিদে জনতার ঢল নেমেছে। চলছে সর্বত্র সওয়াব অর্জনের প্রতিযোগিতা। টুপির দোকানে টুপি বিক্রির পরিমাণ বেড়ে গেছে। জায়নামাজ, তসবিহ ও আতর বিক্রির দোকানগুলো সজীব হয়ে উঠেছে। ফসল কাটার পূর্বে ভরা ক্ষেত দেখে কৃষকের মনে যে আনন্দ, আজ মুসলমানদের মনের আনন্দ তার চেয়েও বেশি। কারণ বছর ঘুরে আবার যে এসেছে মাহে রমজান।

এ আনন্দের à¦•à¦¾à¦°à¦£Ñ à¦®à¦¹à¦¾à¦¨à¦¬à§€ (সা.) বলেছেন-

“যে ব্যক্তি ইমান ও এতেহেসাবের সাথে রোজা রাখবে তার অতীতের গুনাহ-অপরাধ মাফ করে দেয়া হবে।”

“রোজাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহর কাছে মিশকের সুগন্ধি থেকেও উত্তম”।

“এ মাসে যদি কেউ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য আপন ইচ্ছায় কোন নফল নেকী করে, সে অন্যান্য মাসের ফরজ ইবাদতের সমান সওয়াব পাবে। আর যে একটি ফরজ আদায় করবে সে অন্যান্য মাসের সত্তরটি ফরজের সমান সওয়াবের হকদার হবে”

হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ বলেন, রোজা খাছ করে আমার জন্য রাখা হয়। আর আমিই এর প্রতিদান দেব। রাসূলুলাহ (সা.)-এর পবিত্র মুখ নিঃসৃত বাণীগুলো কোন ইমানদারকে আনন্দে উদ্বেলিত না করে পারে না। তাইতো অন্য মাসের তুলনায় এ মাসের মর্যাদা অনেক বেশি।

এ মাসে এত করুণা, ক্ষমা, সওয়াব ও মর্যাদার পিছনে মৌলিক কোন কারণটি নিহিত রয়েছে?

এ মাসে এমন কোন বিষয় বা ঘটনা  রয়েছে যা এ মাসকে মহামান্বিত করেছে?

যে কোন বিরাট আয়োজন ও অতি মর্যাদার পিছনে অবশ্যই একটি বিশেষ ঘটনা বা বিশেষ কারো আগমন উপলক্ষ্য হয়ে থাকে।

হ্যাঁ, এ মাসেই বিশ্বের সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘটনা ঘটেছিল। মহাবিশ্বের বিস্ময় আল কুরআন এ মাসেই নাজিল হয়েছিল। আর এ মহিমান্বিত কুরআনের মাধ্যমে সর্বকালের সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হজরত মুহাম্মদ (সা.) কে রেসালাতের মহান আসনে অভিষিক্ত করা হয়। মহান আল্লাহ বলেন-“রমজান এমন মাস যাতে কুরআন নাজিল করা হয়েছে যা সমগ্র মানব জাতির জন্য পথ নির্দেশিকা আর তা এমন সুস্পষ্ট উপদেশবলিতে পরিপূর্ণ, যা সঠিক ও সত্য পথ প্রর্দশন করে এবং যা সত্য মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য নিরুপণকারী” (সূরা বাকারা : ১৮৫)।

মহান আল্লাহ আরো বলেন, “অবশ্যই আমি এ কুরআনকে লাইলাতুল কদরে নাজিল করেছি। আপনি জানেন লাইলাতুল কদর কি? তা হচ্ছে এমন রাত যা হাজার মাস হতে উত্তম” (সূরা কদর : ১-৩)

তা হলে সুস্পষ্ট পবিত্র কুরআনের কারণেই একটি রাত হাজার মাসের চেয়েও উত্তম হয়ে গেল আর এ মাসটিও অন্যান্য মাসের তুলনায় বিশেষ বৈশিষ্টে বৈশিষ্টমণ্ডিত হলো। যে কুরআনের কারণে রমজানের এত বড় মর্যাদা, আমাদেরকে সর্বপ্রথম সে কুরআনের নিকেই মনোসংযোগ করতে হবে। এ জন্য কুরআন শিখতে হবে, বুঝতে হবে, মানতে হবে, প্রচার করতে হবে এবং সাথে সাথে কুরআন প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ করতে হবে। তাহলেই রমজান আমাদের জীবনকে সার্থক করে তুলবে এবং রোজার হক আদায় করা সম্ভব হবে।

রোজার সাথে কুরআনের আর কুরআনের সাথে রমজানের রয়েছে গভীর সম্পর্ক। রোজার উদ্দেশ্য জানতে পারলে আমরা এ সম্পর্কটি বুঝতে পারব এবং রোজার সঠিক তাৎপর্য উপলদ্ধি করতে পারব। মহ্না আল্লাহ বলেন-“হে ইমানদার লোকেরা, তোমাদের উপর রোজাকে ফরজ করা হয়েছে যেমনি ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। সম্ভবত তোমরা খোদাভীতি অর্জন করতে পারবে” (সূরা বাকারা : ১৮২)। তাহলে সুস্পষ্ট, রোজার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে  তাকওয়া অর্থাৎ খোদাভীতি অর্জন। এটা এমন একটি ভয় যা মানুষকে খারাপ কাজ হতে ফিরিয়ে রাখে, চরিত্রকে নির্মল করে। একজন রোজাদার আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় রোজা পালন করে, আল্লাহর ভয়ে গোপনেও কিছু খায় না, রোজার সওয়াব নষ্ট হয় এমন অনেক বিষয় পরিহার করে-এভাবে রোজা বান্দাকে আল্লাহর হুকুম মানতে অভ্যস্ত করে। দীর্ঘ এক মাসের কঠিন সাধনার মাধ্যমে সে সৎ পথে চলতে অভ্যস্ত হয় এবং অন্যায় ও অসৎ কাজের ব্যাপারে তার মধ্যে একটা ঘৃণাবোধ সৃষ্টি হয়। ফলে সে নির্মল চরিত্রের একটি পূর্ণাঙ্গ মানুষে পরিণত হয়। এখানে উল্লেখ্য, পবিত্র কুরআন এ মানুষটিকেই মুত্তাকি বলেছে। সিয়াম সাধনাই মানুষকে মুত্তাকি বানায়। আর পবিত্র কুরআন থেকে যথার্থ কল্যাণ লাভ করতে হলে মুত্তাকি হতে হবে। আল্লাহ বলেন “এটা আলাহ তায়ালার কিতাব, এতে কোন প্রকার সন্দেহ নেই। এটা জীবন যাপনের ব্যবস্থা মুত্তাকিদের জন্য” (সূরা বাকারা : ১-২)। পবিত্র কুরআন মুত্তাকিদের পথ দেখায় আর রোজা সেই মুত্তাকি তৈরি করে। তাই রমজান এবং কুরআন উদ্দেশ্য-লক্ষের দৃষ্টিকোণ থেকে  একই সূত্রে গাঁথা।

কিন্তু রোজা সবাইকে মুত্তাকী করে না। আর সবাই রমযানের কল্যাণ ও বরকত লাভেও সমর্থ হয় না। যে রোজা মানুষকে ভালো হতে উৎসাহিত করে না, যে রোজার মাধ্যমে মানুষ খারাপ কাজ পরিহার করতে শেখে না-সে রোজা যথার্থ রোজা নয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন,“যে ব্যক্তি রোজা রেখে মিথ্যা কথা বলা ও মিথ্যা আচরণ হতে বিরত হলো না তার ক্ষুধার্থ ও তৃষ্ণার্ত থাকায় আল্লাহর কোনই প্রয়োজন নাই” (বুখারী)।

তাহলে কার রোজা যথার্থ রোজা? মহানবী (সা.) বলেন, “ইমান ও আত্মপর্যালোচনার সাথে যে রোজা রাখবে তার অতীতের গুনাহ মাফ করে দেয় হবে।” কাজেই মাগফিরাত ও নাজাত পেতে হলে ইমানের পাশাপাশি আমাদের কথা ও আচরণগুলোকে নিজেদের নিখুত পর্যালোচনা করতে হবে এবং খারাপ আচরণগুলো বর্জন করতে হব্ েতাহলেই রোজা আমাদের সৌভাগ্যের দুয়ার খুলে দেবে। এ ধরনের রোজাদারদের জন্যই মহানবী (সা.) “রাইয়ান” নামক জান্নাতের উন্মুক্ত দরজার সুসংবাদ দিয়েছেন।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, নির্বাহী সদস্য, বরিশাল সংস্কৃতিকেন্দ্র

e-mail: mizan.econ@gmail.com