মার্চ স্বাধীনতার মাস। ১৯৭১ সালের মার্চের দিনগুলো অধিকার আদায়ের দাবিতে দেশ ছিল উত্তাল। রাজপথের প্রতিবাদ মিছিল পরিণত হয়েছিল প্রতিরোধ যুদ্ধের দুর্ভেদ্য মুক্তি বাহিনীতে। পোস্টার-ব্যানারের বদলে হাতে গর্জে উঠেছিল বারুদভরা রাইফেল। মানবিক মর্যাদা, গণতন্ত্র, সামাজিক ন্যায়বিচার ও অর্থনৈতিক বৈষম্যমুক্ত একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের জন্য হাসিমুখে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছেন অকুতোভয় মুক্তিপাগল জনতা। তারা ৯ মাসের যুদ্ধে বিজয় ছিনিয়ে এনেছিলেন। তাদের ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে বাংলাদেশ, কিন্তু যুদ্ধ আজো শেষ হয়নি। লক্ষ্য থেকে আমরা এখনো অনেক দূরে। মানবিক মর্যাদা, গণতন্ত্র আর সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যমুক্তির সংগ্রাম চলছে ৫৩ বছর ধরে।
আমরা মনে করি, এ লড়াইয়ে বিজয়ের জন্য সবার আগে প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, কোনো অদৃশ্য শক্তির ষড়যন্ত্রের কারণে এখনো শেষ হয়নি পক্ষ-বিপক্ষ দ্বন্দ্ব। এ কারণে জাতীয় ঐক্য-সংহতি প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন পূরণ হয়নি। গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার রক্ষার প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলো একটি সর্বজন গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্তে আজো আসতে পারেনি। এ অনৈক্যের ফাঁকফোকর দিয়ে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন শক্ত শিকড় গেড়ে বসে মহীরুহ রূপ নিচ্ছে দিন দিন। ফলে স্বৈরশাসকদের নির্যাতন-নিষ্পেষণ বাড়ছে। সাথে সাথে বাড়ছে অর্থনৈতিক বৈষম্য। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কাছে স্বাধীনতার স্বপ্ন আজো অধরাই রয়ে গেছে। তাই তো অর্থনীতিবিষয়ক লেখক এমএ খালেক একটি সহযোগী দৈনিকের মতামতের কলামে লিখেছেন, ‘স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা কতটা বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছি, তা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করা যেতেই পারে। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মত অর্থাৎ গণতান্ত্রিক পন্থায় সরকার গঠনের প্রক্রিয়া কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে, তা সহজেই অনুমেয়। দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক বৈষম্য আজ কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে, তা কি আমরা ভেবে দেখি?’
আমরা মনে করি, এমন ভাবনা শুধু একজন এমএ খালেকের নয়, এদেশের অধিকারবঞ্চিত প্রতিটি মানুষের। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) গৃহস্থালি আয় ও ব্যয় জরিপ অনুসারে, আয়ের গিনি সহগ (যা আয়বৈষম্যের একটি জনপ্রিয় পরিমাপ) ২০০০ সালে শূন্য দশমিক ৪৫০ থেকে ২০২২ সালে শূন্য দশমিক ৪৯৯-তে উন্নীত হয়েছে। সম্পদের বৈষম্যের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আরও খারাপ। অক্সফামের একটি প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২১ সালে সবচেয়ে ধনী ১ শতাংশ বাংলাদেশি জাতীয় সম্পদের ১৬ দশমিক ৩ শতাংশের মালিক ছিলেন। আর সবচেয়ে দরিদ্র ৫০ শতাংশ মানুষের মালিকানা ছিল মাত্র ৮ দশমিক ৬ শতাংশ। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, প্রকৃত অর্থনৈতিক বৈষম্যের চিত্র পরিসংখ্যান ব্যুরোর সমীক্ষার চেয়ে খারাপ বলে মনে করা হয়। গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা ছাড়া রাষ্ট্রব্যবস্থায় জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা হয় না, রাজনীতি দুর্বৃত্তায়নমুক্ত করাও সম্ভব নয়। এ সত্য উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হলে আমাদের চলমান মুক্তিসংগ্রাম ব্যর্থ হতে পারে- এমন আশঙ্কাও অমূলক নয়। বরং স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব চাণক্য জালে বন্দি হওয়ার ভয়ও আছে। কারণ আমরা নিশ্চয়ই ভুলে যাইনি এ আপ্তবাক্য- ‘স্বাধীনতা অর্জন করার চেয়ে রক্ষা করা বেশি কঠিন।’ যতদিন যাচ্ছে, আশঙ্কার কালোমেঘ ততই যেন ঘনীভূত হয়ে এগিয়ে আসছে। তাই স্বাধীনতা দিবসের এ মাসে আমাদের নতুন করে শপথ নিতে হবে- আমরা কোনো আধিপত্যবাদী শক্তির কাছে মাথানত করব না। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে কারো সাথে আপস করব না। মানবিক মর্যাদা, গণতন্ত্র আর সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যমুক্তির সংগ্রাম থেকে কোনো শক্তিই আমাদের বিচ্যুত করতে পারবে না। ঐক্য ও জাতীয় সংহতির সিসাঢালা প্রাচীর গড়ে আমরা সামনে এগিয়ে যাবো, মুক্তির সোনালি সুদিন আনব, ইনশাআল্লাহ।
এ পাতার অন্যান্য খবর
এ বিভাগ বা পাতায় আর কোন সংবাদ, কবিতা বা অন্যকোন ধরণের লেখা পাওয়া যায়নি।