বেশি খেয়ে হাড় দুর্বল হচ্ছে মানুষের
॥ হামিম উল কবির ॥
খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনে বাংলাদেশের মানুষের পেটে গ্যাসের সমস্যা দিন দিন বাড়ছে। এটাকে গ্যাস্ট্রিক বা অ্যাসিডিটি সমস্যা বলা হয়ে থাকে। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশই কমবেশি অ্যাসিডিটি সমস্যায় ভুগছেন। এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে মানুষ ছুটছে ডাক্তার ও ওষুধের দিকে। বর্তমানে ওষুধের দোকানে সর্বাধিক বিক্রিত হচ্ছে পেটে গ্যাস ও এর ফলে সৃষ্ট জ্বালা-পোড়া কমানোর ওষুধ। চিকিৎসকরা বলছেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোনো ধরনের ওষুধ ছাড়াই খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন করে এ সমস্যার সমাধান করা যায়। ওষুধ খেয়ে পেটে গ্যাসের সমস্যা সমাধানে হয়তো সাময়িক ফল পাওয়া যায়, কিন্তু এর ফলে শরীরের অন্য ধরনের ক্ষতি বয়ে আনছে। এর মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক সমস্যাটি হচ্ছেÑ হাড় দুর্বল হয়ে ক্ষয়ে যাওয়া এবং পুরুষের প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া। গ্যাস হলেই মানুষ নিজে থেকে ওষুধ খাচ্ছেন আবার সামান্য সুস্থবোধ করতেই নিজের সিদ্ধান্তেই ওষুধ খাওয়া বন্ধ করে দিচ্ছেন। এতে পেটে আলসার হয়ে ক্যান্সারে রূপান্তরিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।
অ্যাসিডিটি কেন হয়?
পাকস্থলিতে অতিরিক্ত অ্যাসিড তৈরি হওয়ায় পেপটিক আলসার হতে পারে। অতিরিক্ত অ্যাসিড পাকস্থলির ওয়ালের (দেয়ালে) সংস্পর্শে আসলে প্রদাহ তৈরি করতে পারে। এছাড়া হেলিকোব্যাকটার পাইলোরি নামক এক ধরনের ব্যাকটেরিয়াও পাকস্থলির মিউকোসাল পর্দাকে নষ্ট করে অ্যাসিডকে পাকস্থলির সংস্পর্শে আসতে দিয়ে প্রদাহের সৃষ্টি করতে সহায়তা করে। এছাড়া পৌষ্টিকতন্ত্র থেকে যদি বেশি পরিমাণে অ্যাসিড ও প্রোটিন পরিপাককারী এনজাইম (পেপসিন) নিঃসৃত হতে থাকে তখনো পেটে আলসার হতে পারে। আবার জন্মগতভাবে কারো পৌষ্টিকতন্ত্রের গঠনগত কাঠামো দুর্বল থাকে। এমন হলে সে মানুষটির পেপটিক আলসার হতে পারে। অ্যাসিডিটির কারণে কারো কারো পেট ফুলে উঠতে পারে, ঘন ঘন ঢেঁকুর ওঠে, বুক জ্বালা-পোড়া করে এবং পেটে অন্যান্য সমস্যা দেখা দেয়। সাধারণত অনেকক্ষণ খালি পেটে থাকলে, অতিরিক্ত চা, কফি খেলে বা মদপান করলে, ধূমপান, দুশ্চিন্তা, অনিদ্রা ইত্যাদি কারণে গ্যাস্ট্রিক গ্ল্যান্ড থেকে প্রচুর অ্যাসিড নিঃসরণ হয় এবং এর ফলে পেটে প্রচুর গ্যাস হয়। আবার মানুষের নানা ব্যস্ততায় তারা সময়মতো খাবার খেতে পারেন না। দিনের পর দিন খাবার খাওয়ায় অনিয়ম করে গেলে পেটে অ্যাসিডিটি বাড়তেই থাকে। শুরুতে অনেকেই এ সমস্যাটাকে পাত্তাই দিতে চান না। বুকজ্বলা শুরু হলেই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই ফার্মেসি থেকে নিজেই ওষুধ কিনে খাওয়া শুরু করেন। এভাবেই একসময় পেটে স্থায়ী সমস্যা হয়ে ওঠে। বেশিরভাগ সময়ই দেখা যায় পেটে গ্যাসের পাশাপাশি পেট খারাপ, পেটে ব্যথা ইত্যাদি শুরু হয়ে যায়।
গ্যাসের কারণে পেট ফুলে যায় কেন?
গ্যাসের কারণে অনেক সময় পেট ফুলে যায়। পেটে সৃষ্ট গ্যাস বের হতে না পারলে পরিপাকতন্ত্রের নালির ভেতর তা জমে যায়। এ কারণে পেট ফুলে ওঠে (এ অবস্থাকে ব্লটিং বলা হয়ে থাকে)। এ কারণে পেটে ব্যথা ও অস্বস্তি হয়ে থাকে। অধিক তৈলাক্ত ও চর্বিযুক্ত খাবার বেশি খেলে, কার্বোনেটেড বা কোমল পানীয় পান করলে, খাদ্য দ্রুত খেলে, স্ট্র দিয়ে জুস বা তরল পান করলে, চুইংগাম খলে, মানসিক চাপ ও উদ্বিগ্নতায় ভুগলে, ধূমপান করলে, পরিপাকতন্ত্রের অভ্যন্তরে ব্লক বা নালি সরু হয়ে গেলে, ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স বা দুধজাতীয় খাবার হজম করতে না পারলে পেটে গ্যাস হয়ে থাকে। বিশিষ্ট গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. মাহমুদ হাসান বলেন, ‘পেট ফাঁপার পেছনে কিছু খাবারও দায়ী। যাদের পেটে গ্যাস বেশি হয়, তাদের কিছু খাবার এড়িয়ে চলা উচিত। যেমন শিম ও শিমজাতীয় খাবার, ব্রকলি, বাঁধাকপি, ফুলকপি, আপেল, দুধ ও দুধজাতসামগ্রী, পেঁয়াজ প্রভৃতি খাবার অনেকের হজম হয় না, এসব খেলে গ্যাস হয়ে থাকে এবং পেট ফুলে যেতে পারে। এসব খাবার এড়িয়ে যাওয়াটাই ভালো।’ তবে তিনি বলেন, ‘এ জাতীয় খাবারগুলো পরিহার করার আগে একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া উচিত। কারণ এ খাবারগুলো শরীরের জন্য খুবই উপকারী।’ গ্যাসের কারণে অনেকের বুক জ্বলতে শুরু করে। যাদের বুকজ্বলা (অ্যাসিড রিফ্ল্যাক্স বা জিইআরডি) রোগ আছে, তাদের পাকস্থলি থেকে কিছুটা অ্যাসিড গলার কাছে চলে আসে। এ অবস্থা প্রতিরোধ করতে রোগীকে বার বার ঢোক গিলতে হয়। তখন ঢোকের মাধ্যমে কিছু বাতাস পাকস্থলিতে প্রবেশ করে। এসব কারণে বুকজ্বলা রোগীদের অতিরিক্ত গ্যাসের সমস্যা দেখা যায়। গ্যাস্ট্রোএনটেরোলজিস্টরা বলছেন, শুধু গ্যাস হলেই বুকজ্বলা সমস্যা নাও হতে পারে। কিন্তু দীর্ঘদিন গ্যাসের সমস্যা চলতে থাকলে পাকস্থলিতে এক ধরনের প্রদাহ (গ্যাসট্রাইটিস) হতে পারে কিংবা হেলিকোব্যাকটর পাইলোরি ব্যাকটেরিয়ায় ইনফেকশন হতে পারে। এর ফলে শেষত পেপটিক আলসার হয়ে থাকে।
গ্যাসের ওষুধ ক্যান্সারের লক্ষণ লুকিয়ে ফেলে
টানা গ্যাস্ট্রিক বা অ্যাসিডিটির ওষুধ সেবন করে গেলে অনেক সময় পেটে সৃষ্ট ক্যান্সারের লক্ষণ প্রকাশ পায় না। যখন কান্সার শনাক্ত হয়, অনেক সময় চিকিৎসকদের করার কিছুই থাকে না। বাংলাদেশের ওষুধ নীতির কারণে গ্যাস্ট্রিকের বিভিন্ন গ্রুপের ওষুধ কিনতে প্রেসক্রিপশনের প্রয়োজন হয় না। এ নীতির কারণে কোনোরকম অস্বস্তিবোধ করলেই মানুষ গ্যাসের ওষুধ কিনে সেবন করতে থাকেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া এ ওষুধ দীর্ঘ সেবন করা উচিত নয়। গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ ক্যান্সারের চিহ্নগুলোকে লুকিয়ে ফেলে। গ্যাসের ওষুধের কারণে রোগী বা ডাক্তার কেউই সহজে বুঝতে পারেন না যে, রোগীর ক্যান্সার হচ্ছে কিনা। এ বিষয়ে সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া টানা গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ সেবন করে গেলে হাড় ক্ষয় হয়ে ভেঙে যেতে পারে।
ওষুধ না খেয়ে কিছু খাবারে অ্যাসিডিটি কমানো যায়
অ্যাসিডিটির সমস্যা নেই এমন মানুষ কমই পাওয়া যাবে। নিয়মিত ওষুধ খেয়েও অনেকে অ্যাসিডিটি কমাতে পারেন না। দীর্ঘসময় অ্যাসিডিটির সমস্যা ধরে রাখলে শেষ পর্যন্ত বড় ধরনের শারীরিক সমস্যা সৃষ্টি হয়। তাই ওষুধের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে কিছু খাবার নিয়মিত খেয়ে গেলে অ্যাসিডিটি কমানো যায় বলে পুষ্টিবিদরা জানিয়েছেন। এর মধ্যে পানি সবচেয়ে উপকারী। সকালে খালি পেটে এবং রাতে ঘুমানোর আগে গরম পানি অ্যাসিডিটি কমাতে সহায়তা করে। সেই সাথে খাওয়া-দাওয়ায় অনিয়ম দূর করা, স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া, শারীরিক পরিশ্রম বাড়িয়ে দেয়া, পানি বেশি পান করলে পেটে গ্যাস কমিয়ে রাখা যায়। পেটের ব্যাপারে প্রথম দিকেই সচেতন না হলে পরবর্তী সময়ে আলসার হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। অ্যাসিডিটি দূর করতে পুষ্টিবিদরা কিছু খাবার নিয়মিত খেতে পরামর্শ দিয়েছেন।
পুদিনাপাতা: পুদিনাপাতার বায়ুনিরোধক ও পেট ঠাণ্ডা রাখার অনেকগুণ আছে। পুদিনাপাতা বুক ও পেট জ্বালা-পোড়া কমায়, পেট ফাঁপা ও বমি ভাব উপশম করে। অ্যাসিডিটির লক্ষণ দেখা দিলেই কয়েকটি পুদিনাপাতা মুখে নিয়ে চিবিয়ে খেয়ে ফেলতে পরামর্শ দিয়েছেন পুষ্টিবিদরা। এটা না পারলে এক কাপ পানিতে ৪ থেকে ৫টি পুদিনাপাতা ফুটিয়ে পান করলে অ্যাসিডিটি কমে যায়। এর সাথে সামান্য মধুও যোগ করলে আরো ভালো ফল পাওয়া যায়।
আদা: আদার রস পাকস্থলির অ্যাসিডকে কমাতে সাহায্য করে। অ্যাসিডিটির সময় এক টুকরো আদা মুখে রাখলে বা এক কাপ পানিতে কয়েক টুকরো আদা কিছুক্ষণ ফুটিয়ে পান করলে অথবা আদার রস করে এক চা-চামচ দিনে ২-৩ বার পান করলে অ্যাসিডিটির পরিমাণ কমিয়ে রাখা যায়।
জিরা: পাকস্থলির অ্যাসিডকে নিরপেক্ষ করতে, পেটের ব্যথা দূর করতে এবং হজমের কাজে জিরা চমৎকার কাজ করে। দেড় কাপ পানিতে এক চা-চামচ করে জিরা-ধনিয়া ও মৌরী গুঁড়া মিশিয়ে খালি পেটে পান করলে অথবা এক গ্লাস পানিতে সামান্য জিরা গুঁড়া মিশিয়ে বা ফুটিয়ে ছেঁকে নিয়ে প্রতি বেলা খাবার পর পান করলে উপকার পাওয়া যায়।
লবঙ্গ: লবঙ্গ পাকস্থলির অ্যাসিডিটি ও গ্যাস দূর করতে সহায়তা করে। ২-৩টি লবঙ্গ মুখে নিয়ে রাখলে বা সমপরিমাণ এলাচ ও লবঙ্গ গুঁড়া গরম পানিতে মিশিয়ে পান করলে বুকজ্বলা দূর হয়। এছাড়া ডাবের পানি পেটের গ্যাস কমাতে কার্যকর ভূমিকা রাখে। হঠাৎ পেটে গ্যাস হয়ে গেলে এক গ্লাস ডাবের পানি শরীরের ভেতর জ্বলা-পোড়া ভাব দূর করতে সাহায্য করে। অতিরিক্ত পরিমাণে রসুন, লবণ, তেল, মরিচ দেয়া খাবার পরিহার করতে পারলে সুস্থ থাকা যায়। সবচেয়ে ভালো আঁশজাতীয় বেশি শাকসবজি খাওয়া।
গ্যাসের ওষুধের ওপর নির্ভরতা দিন দিন বাড়ছে
অ্যাসিডিটিতে আক্রান্ত রোগীদের গ্যাসের ওষুধের ওপর নির্ভরতা দিন দিন বাড়ছে। চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশনের চেয়ে ফার্মেসিতে গ্যাসের নানা ধরনের ওষুধ কিনে নেয়ার পরিমাণ ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, দেশে সর্বাধিক বিক্রিত ওষুধের তালিকায় রয়েছে অ্যাসিডিটি কমানোর নানা ধরনের ওষুধ। দেশে শীর্ষ ওষুধ বিক্রির তালিকায় থাকা ১০ ওষুধের ৬টিই গ্যাস্ট্রো-ইসোফ্যাজিল রিফ্লাক্স ডিজিজ (জিইআরডি বা গ্যাস কমানোর ওষুধ) তালিকার। ঢাকা শহরের একটি ছোট ফার্মেসিতেও দিন শেষে কমপক্ষে ৫ হাজার টাকার গ্যাস কমানোর ওষুধ বিক্রি হয়। বড় বা মডেল ফার্মেসিগুলো এ পরিমাণ ১০ থেকে ২০ হাজার। মানুষের মধ্যে গ্যাসের সমস্যা এত বেশি যে, বেশিরভাগ ডাক্তারের প্রেসক্রিপশনেই গ্যাসের ওষুধ থাকে। বাংলাদেশ ওষুধশিল্প সমিতির তথ্য অনুযায়ী, দেশে ওষুধশিল্পের বর্তমান বাজার ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি। ওষুধশিল্পের গড় প্রবৃদ্ধি ১৯ শতাংশ হলেও গ্যাস্ট্রোনমিক্যাল বা অ্যাসিডিটির ওষুধের প্রবৃদ্ধি ২১.৯৫ শতাংশ। অপরদিকে আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইএমএস হেলথ ও লংকাবাংলা গবেষণা প্রতিবেদনে দেশের ওষুধ বিক্রি সম্বন্ধে বলা হয়েছে, ২০১৭ সালে দেশের বাজারে সর্বাধিক বিক্রিত ১০টি ওষুধের মধ্যে ৬টিই গ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ওষুধ। সর্বাধিক বিক্রিত ওষুধের তালিকায় পঞ্চম স্থানে অ্যান্টিবায়োটিক, ষষ্ঠ স্থানে ইনসুলিন এবং অষ্টম ও নবম স্থানে রয়েছে অ্যান্টি-পাইরেটিক বা প্যারাসিটামল গ্রুপের ওষুধ।
এ পাতার অন্যান্য খবর
- বাংলাদেশের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় যুক্ত হচ্ছে চীন
- আবার পরিবর্তন আসবে হয়তো!
- ২৯ পণ্যের সরকারি মূল্য মানছে না ব্যবসায়ীরা
- ভারত থেকে আমদানি কমেছে
- ফ্যাসিস্ট সরকারকে বিদায় করতে হবে---হামিদুর রহমান আযাদ
- আমাদেরকে ইসলামী আদর্শের দিকেই ফিরে আসতে হবে----মুহাম্মদ সেলিম উদ্দিন
- মানুষ ঠিকমতো মাহে রমাদানও পালন করতে পারছে না--ছাত্রশিবির সভাপতি
- সীমান্তে ২ জনের হতাহতের ঘটনা প্রমাণ করে স্বাধীনতা চরম সংকটে : মির্জা ফখরুল
- ঈদের আগেই উদ্ধারের আশা মালিকপক্ষের
- হজ, ওমরা এবং ট্রাভেল ব্যবসায়ীদের নতুন সংগঠনের আত্মপ্রকাশ