॥ প্রফেসর আবদুল লতিফ মাসুম॥
ইসলামফোবিয়া বা ইসলামভীতি শব্দটির উৎস নিয়ে নানামুনির নানা মত রয়েছে। অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারি অনুযায়ী এ টার্মটির প্রথম ব্যবহার দেখা যায় ১৯২৩ সালে, ইংরেজি জার্নাল ‘থিউরোজিক্যাল স্টাডিজে’। ১৯৯৭ সালে রানিমেড ট্রাস্ট রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর শব্দটির ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ করা যায়। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান ২০০৪ সালে এক সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলামভীতি প্রতিরোধে পদক্ষেপের কথা বলেন। সেই থেকে শব্দটি ক্রমবর্ধমান ইসলামফোবিয়া বা ইসলামভীতি, বৈরিতা, শত্রুতা ইত্যাদি অর্থে আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত হয়ে আসছে। ২০০১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলা তথা ৯/১১-এর পর শব্দটির প্রায়োগিক ব্যবহার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সাম্প্রতিককালে এটি ব্যবহারে সতর্কতা লক্ষ করা যায়। অন্তত একাডেমিকভাবে ইসলামভীতির ধারণাকে অন্যায়, অযৌক্তিক ও অতিশয় উক্তি বলে প্রকাশ করার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। মোদ্দাকথা বিষয়টি বিতর্কিত। অধিকাংশ বুদ্ধিজীবী এ ধারণাকে বিদ্বেষপ্রসূত বলে মনে করেন। পাশ্চাত্যের নেতিবাচক বুদ্ধিজীবীগণ নানা যুক্তি-তর্কে এর বৈধতা প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। এর প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ব্যবহার ধর্মীয় ডিসকোর্স বা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে সীমিত ছিল। সাম্প্রতিককালে এর ব্যাপ্তি রাষ্ট্র, রাজনীতি, কূটনীতি ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বলয়কে অতিক্রম করেছে। এর কারণ হলো ৯/১১-এর পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথা পাশ্চাত্য কূটনীতির ভাষায় সৌজন্যমূলক শব্দ ব্যবহার করলেও কার্যত তারা ইসলাম, মুসলিম সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার মধ্যে যেসব কার্যক্রম গ্রহণ করেছে, তা মুসলিম জনগোষ্ঠী তথা ইসলামী বিশ্বকে ক্ষুব্ধ করেছে। ফলে ন্যায়-অন্যায়, যৌক্তিক-অযৌক্তিক ও মানবিক অমানবিক বিষয়টি না দেখে একদল মুসলিম সন্ত্রাসের পথ বেছে নিয়েছে। উত্থান ঘটেছে তথাকথিত ইসলামিক স্টেট নামের সন্ত্রাস বাহিনীর। হামলা হয়েছে ইউরোপ-আমেরিকার অনেক শহর ও প্রতিষ্ঠানে। ইসলাম ও মুসলিমবিরোধী শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্রে মুসলমানদের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতিকে দায়ী করেছে। রাষ্ট্র ও জনগোষ্ঠী হিসেবে মুসলমানদের ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে পাশ্চাত্যের একটি অংশ তাদের সভ্যতার জন্য বিপজ্জনক হিসেবে চিহ্নিত করেছে। প্রখ্যাত ইহুদি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এসপি হান্টিংটন ‘সভ্যতার দ্বন্দ্ব’ তত্ত্বের আলোকে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ নির্ণয় করেছেন।
৯/১১-এর ঘটনাবলি, ইঙ্গ-মার্কিন-ইহুদী লবীর নির্লজ্জ আগ্রাসন ও বিশ্বব্যাপী ইসলামবিরোধী প্রচারণার ফলে ইসলাম, মুসলিম, পবিত্রগ্রন্থ এর নেতৃবৃন্দ মারাত্মক ঘৃণা-বিদ্বেষের শিকার হন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্যে ব্যক্তিগতভাবে আক্রান্তের ঘটনা ঘটে। মসজিদও হামলার শিকারে পরিণত হয়। মুসলমানদের পবিত্র গ্রন্থ কুরআনকে জ্বালিয়ে দেওয়ার মতো হাজারো ঘটনা ঘটে। ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক রাসূলে করিম হযরত মুহাম্মদ সা.-এর বিরুদ্ধে অবমাননাকর ঘটনাবলী লক্ষ করা যায়। মুসলিম নারীদের হেজাব নিয়ে অমুসলিম বিশ্বে মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। পাশ্চাত্যের ঘৃণা নতুন রূপে আবির্ভূত হয় ভারত, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার ও নিউজিল্যান্ডে। অন্যান্য বিশ্বশক্তিসমূহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো প্রকাশ্যে বিরোধী ভূমিকা গ্রহণ না করলেও পরোক্ষভাবে ইসলামফোবিয়াকে বিপজ্জনকই মনে করে। প্রাচ্যের চীন দৃশ্যত ফোবিয়ার বিপক্ষে কথা বলে। অথচ তারাই আবার চীনের মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর নির্মম নির্যাতন চালায়। রাশিয়ার নেতা পুতিন কখনো কখনো মুসলমানদের পক্ষে কথা বললেও তার দেশে মুসলিমরা অপমাণিত হয় সবচেয়ে বেশি। অতীতের জার সম্রাট, কমিউনিস্ট নেতৃত্বের মতো পুতিনও মুসলিম নিপীড়নের নীতি গ্রহণ করে। গত সপ্তাহে মস্কোয় যে ভয়াবহ ঘটনা ঘটে, তাকে অনেকে পুতিনের মুসলিমবিদ্বেষী প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই দেখেন। এতসব ঘটনাবলীর পর জাতিসংঘ তথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসলামফোবিয়া জনিত ক্রিয়া প্রতিক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ও তুর্কি নেতা এরদোগানের মতো নেতারা জাতিসংঘে খুবই কঠিন ভাষায় ক্রমবর্ধমান ইসলামফোবিয়ার বিপদ-আপদ সম্পর্কে সতর্ক করেন। এরই প্রেক্ষিতে ২০২২ সালের ১৫ মার্চ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে একটি প্রস্তাব উত্থিত হয়। গৃহীত প্রস্তাবে ইসলামফোবিয়া বা ইসলামভীতিকে প্রতিরোধ করার স্বার্থে ১৫ মার্চকে আন্তর্জাতিক ইসলামভীতি মোকাবিলা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
এরই ধারাবাহিকতায় গত ১৫ মার্চ ২০২৪ অর্থাৎ ইসলামভীতি মোকাবিলার আন্তর্জাতিক দিবসে বিষয়টি নিয়ে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে একটি পর্যালোচনামূলক অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। মেজার টু কমব্যাট ইসলামফোবিয়া ‘ইসলামফোবিয়া মোকাবিলায় পদক্ষেপ’ শিরোনামে একটি নতুন প্রস্তাব গৃহীত হয়। উত্থাপিত প্রস্তাবে ইসলামফোবিয়া মোকাবিলায় জাতিসংঘের একজন বিশেষ দূত নিয়োগ করতে সংস্থাটির মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে ১১৫টি দেশ । তবে পক্ষে ছিল না ভারত, ব্রাজিল, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, ইউক্রেন ও ব্রিটেনসহ ৪৪টি দেশ। এসব দেশগুলো প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট না দিয়ে ভোটদানে বিরত ছিল। উল্লেখ্য যে, ভোটদানে বিরত থাকা এসব দেশে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ব্যাপক হিংসাত্মক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। ফ্রান্সে অনবরত নবীজিকে নিয়ে আপত্তিকর ও অবমাননাকর কার্টুন প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে মুসলমানরা ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নিপীড়নের শিকার হয়েছে। একই কাতারে রয়েছে জার্মানি, ইতালি ও ইউক্রেন। ব্রিটেন একসময়ে সহাবস্থানে থাকলেও ক্রমশ মুসলিমবিরোধী কার্যক্রমে শরিক হচ্ছে। এ সময়ে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী- ঋষি সুনাক। আর ভারতের বিরোধিতার ব্যাপারটি এখন স্পষ্ট। সেখানে মুসলমানরা রীতিমতো ভয়ংকর ভীতির মধ্যে বসবাস করছে। নতুন নাগরিকত্ব আইন পাস করে তাদের নাগরিকত্ব হরনের চেষ্টা চলছে। তাদের মসজিদগুলো আর নিরাপদ নয়। এ সেদিন বিদেশি কয়েকজন মুসলিম ছাত্র গুজরাটে নামায পড়ার অপরাধে হামলার শিকার হয়েছে। সম্ভবত পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় বসবাস করছে ভারতের মুসলমানরা। জাতিসংঘ প্রস্তাবে সদস্য দেশগুলোকে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে বিশেষ করে ইসলামফোবিয়াকে টার্গেট করে অনুকূল পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। পাকিস্তানের উত্থাপিত এ প্রস্তাবে সমর্থক ছিল সকল মুসলিম দেশগুলো। মজার ব্যাপার চীন এ প্রস্তাবের সহযোগী দেশ হিসেবে ভূমিকা পালন করে। ১৯৩ সদস্যের সাধারণ পরিষদ একরকম বিনাবাধায় প্রস্তাবটি গ্রহণ করে। জাতিসংঘে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি তার বিরত অবস্থান থেকে বিরোধিতায় অবতীর্ণ হয়। তিনি প্রস্তাব করেন যে, সহিংসতা ও বৈষম্যের শিকার হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ ও অন্যান্য ধর্ম বিশ্বাসের ব্যাপারেও ‘ধর্মভীতি’ রয়েছে। তাই শুধু একটি ধর্মের মধ্যে ঐ প্রস্তাব সীমাবদ্ধ না রেখে সব ধর্মের প্রেক্ষিতেই তা বিবেচনা করতে হবে। জাতিসংেঘ ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি অবশ্য ইহুদিবিদ্বেষ, ও ইসলামভীতি নিয়ে অনুপ্রাণিত সব ধরনের কর্মকাণ্ডের নিন্দা জানান। ভারতের এ প্রতিনিধি আরও যুক্তি দেনÑ ওই প্রস্তাব গ্রহণ করে এমন নজির স্থাপন করা উচিত হবে না, যাতে কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের ভীতিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। জাতিসংঘ বিভক্ত হয়ে পড়ার শঙ্কার সৃষ্টি হয়। এরকম ধর্মীয় বিষয়ের ঊর্ধ্বে ওঠে নিজের অবস্থান বজায় রাখা জাতিসংঘের জন্য জরুরি। জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস প্রদত্ত তার বক্তৃতায় ইসলামভীতিকে কঠোর ভাষায় নিন্দা জানান। তিনি বলেন, ইসলামভীতির প্রেক্ষিতে পৃথিবীর সকল ইহুদি, খ্রিস্টান ও অন্য ধর্মাবলম্বীরাও ভীতির মধ্যে রয়েছে। মহাসচিব আরো বলেন যে, মুসলমানরা সারা বিশ্বে প্রাতিষ্ঠানিক পক্ষপাতিত্ব, বাধা-বিপত্তি, সম্মান-মর্যাদা ও অমানবিকতার শিকারে পরিণত হচ্ছে। তারা অপব্যাখ্যা, অপমান এবং ডিজিটাল ঘৃণার সম্মুখীন হচ্ছে। গুতেরেস সব ধরনের ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার আহ্বান জানান। তিনি উপস্থিত প্রতিনিধিদের ঘৃণাসূচক বক্তব্য পরিহার, ধর্মীয় স্বাধীনতায় বিশ্বাসী হওয়ার এবং পারস্পরিক সম্মান প্রদর্শনের আহ্বান জানান। গণমাধ্যম এবং অন্যত্র তিনি ঘৃণা না ছড়ানোর আবেদন জানান। স্মরণ করা যেতে পারে যে, মহাসচিব গুতেরেস ২০১৯ সালে ইসলামভীতি প্রতিরোধে বাস্তব পরিকল্পনা গ্রহণ ও আইন প্রণয়নের কথা বলেন, এদিকে জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান ভলকার টার্ক ইসলামভীতি, ইহুদিভীতি, অবসানের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি ইসরাইল কর্তৃক ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় অব্যাহত হামলার নিন্দা জানান। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষ কর্মকর্তা নাজিলা ঘানি তার বার্ষিক প্রতিবেদনে মন্তব্য করেন যে এ ধরনের ঘৃণা প্রতিহত করতে রাষ্ট্রের ভূমিকা রয়েছে। তিনি আরও বলেন, যে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বৈচিত্র্যের মাধ্যেমে ঐক্য অর্জন করতে হবে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। রাষ্ট্র ও সরকারকে তিনি পরামর্শ দেন ঘৃণা-বিদ্বেষ সম্পর্কে তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহের। আস্থা ও বিশ্বাস নির্মাণে রাষ্ট্র ও সরকারকে সহায়তা দিতে হবে। শাসনব্যবস্থার পর্যালোচনা করতে হবে। রাষ্ট্র যেন হিংসা-বিদ্বেষ ছড়ানো ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে বিচারের সম্মুখীন করতে ভয় না পান। স্মরণ করা যেতে পারেÑ জাতিসংঘের আরেকজন মানবাধিকার বিষয়ক কর্মকর্তা আহমেদ শহীদ মন্তব্য করেছিলেন যে, গোটা পৃথিবীতে ইসলাম ও মুসলিমবিদ্বেষ মহামারি আকার ধারণ করেছে।
গোটা পৃথিবী থেকে ঘৃণা-বিদ্বেষের অবসান না হলে এই পৃথিবী বাসযোগ্য থাকবে না। ইতোমধ্যেই বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সরকার সে লক্ষ্যে বিবিধ কার্যব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। ঘৃণাবিরোধী মনোভাব দূরীকরণে নাগরিক সাধারণের ভালো ভূমিকা পালন করতে হবে। সময়ান্তরে গবেষণা ও সমীক্ষার মাধ্যমে বাস্তব কৌশল গ্রহণ করতে হবে। সন্ত্রাস ও ভায়োলেন্সের মতো বিষয়সমূহে কেবলমাত্র ধর্মের সাথে সংযুক্ত করলে বড় ধরনের ভুল করা হবে। রাষ্ট্র ও সমাজের পারিপার্শ্বিক অবস্থা, গণতন্ত্র ও বৈশ্বিক নিরাপত্তার বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে ভারসাম্যপূর্ণ নীতিমালা গ্রহণ করলে, আলোকিত সমাজ আভির্ভূত হলে সুশাসন ও নাগরিক কল্যাণ নিশ্চিত হবে।
লেখক : অধ্যাপক ও ইসলামী চিন্তাবিদ।