অ ব লো ক ন
মোদি-বাইডেন-ট্রাম্প নির্বাচনী সমীকরণ
মাসুম খলিলী : ২০২৪ সালের দুই আলোচিত ইস্যু হলো ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন। ১৯ এপ্রিল থেকে ১ জুন পর্যন্ত ভারতে এবং নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হওয়ার কথা। এ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দুই দেশেই নানা সমীকরণ গড়ে উঠছে। ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক ভাবাদর্শের বাইরেও ব্যক্তিগত সম্পর্ক এক্ষেত্রে বিবেচ্য হয়ে উঠছে। ২০২০ সালের আমেরিকান নির্বাচনেও এবারের মতো বাইডেন-ট্রাম্প ছিলেন দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। আর সেবার নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রবাসী ভারতীয়দের সমাবেশে ট্রাম্প সরকারের আবারো দরকার বলে মন্তব্য করেছিলেন। মোদির জন্য দৃশ্যত বেমানান এ পক্ষপাতপূর্ণ অবস্থান বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর দু’দেশের সম্পর্কে কিছুটা বিব্রতকর অবস্থা তৈরি করে।
প্রথম রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন ট্রাম্পের সাথে মোদি দৃঢ় সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন। উভয়েরই শক্তিশালী জাতীয়তাবাদী সার্টিফিকেট রয়েছে। একজন শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদ আর অন্যজন হিন্দুত্ববাদের সমর্থন উপভোগ করেন। তারা জীবনের চেয়েও বড় ব্যক্তিত্বের অধিকারী বলে তাদের সমর্থকরা মনে করেন। ট্রাম্প ও মোদি উভয়েই ক্ষমতায় গেলে ভারত-মার্কিন সম্পর্ক আগের চেয়ে আরও শক্তিশালী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
ভারতে পাল্লা ভারী মোদির
যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের আগেই ভারতের ক্ষমতায় কারা যাবেন, তা নিশ্চিত হয়ে যাবে। এ পর্যন্তকার রাজনৈতিক ধারা অনুসারে অলৌকিক কিছু না ঘটলে নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদির নেতৃত্বে বিজেপি জোট আবার ক্ষমতায় আসবে। এর মধ্যে বিজেপির প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক শক্তির অন্যতম প্রধান মুখ অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে মমতার তৃণমূলের বড় নেতাদের বিরুদ্ধে মামলার খড়ক ঝুলছে। পরিস্থিতি বিবেচনা করে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নিতীশ কুমার বিজেপির সাথে হাত মিলিয়েছেন। বিরোধীপক্ষ ‘ইন্ডিয়া’ জোট গঠন করে একটি চাঙ্গা অবস্থা নিয়ে আসতে চাইলেও বলা মুশকিল তারা কতটা সফল হতে পারবে।
মার্চ ২০২৪-এ পরিচালিত ভারতের দুটি শীর্ষ সংস্থার জরিপের উভয়টিতে বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটের পক্ষে অধিক জনসমর্থন দেখানো হয়েছে। নিউজ১৮-এর জরিপ অনুসারে, এনডিএ’র সমর্থন রয়েছে ৪৮ শতাংশ, বিরোধী ‘ইন্ডিয়া’ জোটের সমর্থন রয়েছে ৩২ শতাংশ আর অন্যরা পাবে ২০ শতাংশ ভোট। এপিবি নিউজ/সি ভোটারের জরিপ অনুসারে, ৪৬ শতাংশ এনডিএ’র প্রতি এবং ৩৯ শতাংশ সমর্থন রয়েছে বিরোধী ইন্ডিয়া জোটের প্রতি। এই জরিপে ৬ শতাংশ অন্য দলগুলোর পক্ষে সমর্থন দেখানো হয়েছে। সব জরিপ সামনে রাখলে মনে হয়, বিজেপি জোট বিরোধীরা এনডিএ’র বিপরীতে মধ্য একক প্রার্থী মনোনয়ন দিতে পারলে দুই পক্ষের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্ভাবনা রয়েছে। আর সেটি সম্ভব না হলে এনডিএ জোট আবারও একচেটিয়া জয় পেতে পারে।
অনিশ্চয়তার দোলাচলে মার্কিন নির্বাচন
যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচন হতে এখনো ৭ মাসের মতো সময় বাকি। এর মধ্যে দুই দলের প্রার্থী অনেকটাই চূড়ান্ত। আদালতের কোনো খড়গ না নামলে বাইডেনের সাথে ট্রাম্পের প্রতিদ্বন্দ্বিতা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ২১ মার্র্চ থেকে ৭ এপ্রিল ২০২৪ পর্যন্ত সময়ে তিনটি প্রধান জরিপের দুটিতে ট্রাম্পকে অগ্রগামী দেখানো হয়েছে। একটিতে এগিয়ে আছেন বাইডেন। ‘রিয়েল ক্লিয়ার পলিটিক্স’র জরিপ অনুসারে ট্রাম্প ৪৫.৫ শতাংশ সমর্থনে এগিয়ে রয়েছেন, যেখানে বাইডেনের সমর্থন রয়েছে ৪৫.৩ শতাংশ। রেস টো দি ডব্লিউএইচের জরিপে ৪৫.৪ শতাংশ ভোটে বাইডেনকে অগ্রগামী দেখানো হয়েছে, যেখানে ট্রাম্পের সমর্থন দেখানো হয়েছে ৪৪.৯ শতাংশ। ডিসিশন ডেস্ক এইচকিউ/দি হিলের জরিপ অনুসারে ৪৪.৭ শতাংশ সমর্থন নিয়ে ট্রাম্প এগিয়ে আছেন আর বাইডেনের পক্ষে সমর্থন রয়েছে ৪৪.২ শতাংশ। এ তিন জরিপের গড় হিসাবে বাইডেন ও ট্রাম্প সমান ৪৫ শতাংশ সমর্থন ভোগ করছেন। এখানে ১০ শতাংশ সিদ্ধান্তহীন যে ভোটার, তাদেরই নির্বাচনের ফল নির্ধারণ করার কথা।
আমেরিকান নির্বাচনের হাড্ডাহাড্ডি ধরনের লড়াইয়ে কয়েকটি ইস্যু নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। এর মধ্যে শীর্ষ ইস্যু হলো ইসরাইল-গাজা যুদ্ধ। এ যুদ্ধে বাইডেন প্রশাসন পলিসিগতভাবে নেতানিয়াহু সরকারকে পুরোপুরি সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। তবে আমেরিকান জনমত এ যুদ্ধের ব্যাপারে ইসরাইলের বিপক্ষে যাওয়ার প্রবণতার কারণে নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো দেয়ার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র পিছিয়ে এসেছে। তবে বাইডেন প্রশাসন পরিষ্কার জানিয়েছে, এটি ইসরাইলকে সমর্থন করার ক্ষেত্রে ওয়াশিংটনের কোনো বিচ্যুতি নয়। যেটি প্রথম দিকে নেতানিয়াহু উল্লেখ করেছিলেন। ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশ হওয়া তেলআবিবকে অস্ত্র সহায়তা দেয়ার হিসাব দেখলে বোঝা যায় আমেরিকার ইসরাইল সরকারের সমালোচনা যতটা রেটরিক বা কথাবার্তায় রয়েছে ততটা বাস্তবে নেই।
আইপ্যাক বা জায়োনিস্ট লবি আর্থিক ও অন্যান্য প্রভাব বিস্তার করে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনকে যতটা প্রভাবিত করতে পারে, ততটা না হলেও চীনা ও ভারতীয় লবি এক্ষেত্রে কিছু ভূমিকা রাখতে পারে। নরেন্দ্র মোদি ভারতের নির্বাচনের আগে এ ধরনের কোনো ভূমিকা নেবেন বলে মনে হয় না। এমনকি গতবার ট্রাম্পের পক্ষে নির্বাচনী সমাবেশ আয়োজনের পরবর্তী ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার কারণে এবার কতটা প্রত্যক্ষ ভূমিকা মোদি নেবেন, তাতে সন্দেহ রয়েছে। তবে মোদির সাথে যে ট্রাম্পের ইকুয়েশন অনেক ভালোভাবে জমবে, তাতে সন্দেহ নেই।
আমেরিকায় জায়োনিস্ট লবির প্রভাব যুক্তরাষ্ট্রের দুই প্রধান দলের মধ্যে সমভাবে সক্রিয় থাকলেও ট্রাম্প ছিলেন ইসরাইলের ব্যাপারে খোলামেলা। বাইডেন কথা কম বলে নীতিতে যতটা ভূমিকা রাখেন, ট্রাম্প সেই ধরনের কৌশলের ধার ধারেন না। তবে ট্রাম্পের যে ভোট ভিত্তি তার দুই-তৃতীয়াংশ ইসরাইলকে সমর্থন দেয়ার ব্যাপারে অনেকখানি কট্টর। সে তুলনায় ডেমোক্রেট সমর্থকদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ইসরাইলকে এভাবে সমর্থন করা পছন্দ করছেন না। তবে বাইডেন প্রশাসনে সরাসরি ইহুদি বা জায়োনিস্ট সমর্থক যত কর্মকর্তা রয়েছেন, ততটা ট্রাম্প প্রশাসনে ছিলেন না। ট্রাম্প শাসনের সময় তার জামাতা ইহুদি ধর্মাবলম্বী জারেদ কুশনার অনেকটা এককভাবে মধ্যপ্রাচ্য নীতি ডিল করার কারণে ট্রাম্পকে অধিকতর ইসরাইলপন্থী বলে মনে হয়েছিল। ট্রাম্প প্রশাসন আরবদের ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়ার আব্রাহাম চুক্তির ব্যাপারে অনেকখানি বেপরোয়া নীতি নেয়। আর বাইডেন প্রশাসন গাজা যুদ্ধের ব্যাপারে তার চেয়ে এক ধাপ বেশি সক্রিয় নীতি বাস্তবায়ন করছে।
দিল্লির ইসরাইল কানেকশন
সাধারণভাবে মধ্যপ্রাচ্যের ব্যাপারে ভারতের দীর্ঘসময়ের অনুসৃত ভারসাম্যপূর্ণ নীতি থেকে সরে এসে নরেন্দ্র মোদি ইসরাইলের সাথে কৌশলগত সম্পর্ক নির্মাণ করেছে। এর পেছনে ট্রাম্প প্রশাসনের সক্রিয় ভূমিকা ছিল বলে মনে করা হয়। তবে বাইডেন প্রশাসনের দিল্লির ইসরাইলপন্থী নীতির ব্যাপারে কোনো আপত্তি না থাকলেও রাজনৈতিকভাবে ট্রাম্পের প্রতি অনুরক্তি বাইডেন প্রশাসন মেনে নিতে চায় না। এছাড়া কট্টর হিন্দুত্ববাদী নীতি ডেমোক্রেটদের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার উচ্চকিত রাখার ঘোষিত নীতির সাথে যায় না। এরপরও ভারতের সাথে কৌশলগত লেনদেন বাইডেন প্রশাসন বজায় রেখেছে। এমনকি দিল্লির রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ব্যাপারে নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়ে প্রকারান্তরে রাশিয়াকে সহায়তা করা এবং মস্কো থেকে কম দামে তেল কেনার পরও বাইডেন প্রশাসন কোনো অ্যাকশনে যায়নি। এস৪০০ কেনা নিয়ে তুরস্ককে নিষেধাজ্ঞা দিলেও ভারতের ব্যাপারে তেমন কোনো পদক্ষেপ ওয়াশিংটনের দেখা যায়নি। এসব ক্ষেত্রে জায়োনিস্ট লবির ভূমিকা থাকতে পারে।
আর এ একই কারণে শেষ পর্যন্ত ভারতীয় নির্বাচনের ব্যাপারে ওয়াশিংটন কোনো ভূমিকা পালন না করলে সেটি নরেন্দ্র মোদির পক্ষে যাবে। মোদির পররাষ্ট্রনীতির একটি কৌশলী দিক হলো চীনের সাথে প্রকাশ্য বৈরিতার মধ্যেও ভেতরে ভেতরে এক ধরনের সমঝোতা বজায় রেখে চলা। ভারতে চীন এখনো বড় এক বাণিজ্যিক ও বিনিয়োগ অংশীদার। মোদির অতি ঘনিষ্ঠ আদানি গ্রুপের সাথে বিনিয়োগ ও ব্যবসায়িক অংশীদারিত্ব তৈরি হওয়ার মধ্য দিয়ে বিজেপি শাসনের সাথে বেইজিংয়ের একটি সেতুবন্ধ সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করা হয়। ফলে অরুণাচল, তিব্বত আর কাশ্মীর নিয়ে দু’দেশের মধ্যে কোনো নিষ্পত্তি না হওয়া অথবা দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব বিস্তার নিয়ে পরস্পর একে অপরের বিরদ্ধে লড়ে গেলেও একটি মাত্রার মধ্যে তা সীমিত থাকছে।
মোদির কূটনীতির বৈচিত্র্যময় দিকটি হলো ইসরাইলের সাথে যে কৌশলগত সম্পর্ক তৈরি করা হয়েছে, তার মাধ্যমে দিল্লি বার বারই আমেরিকান নীতিকে প্রভাবিত করতে সক্ষম হচ্ছে। এর সর্বশেষ উদাহরণ হলো বাংলাদেশ নিয়ে আমেরিকান নীতির আকস্মিক পরিবর্তন নিয়ে সাবেক কূটনীতিক পিনাক রঞ্জনের বহুলালোচিত সাম্প্রতিক বক্তব্য। জায়োনিস্ট লবিকে কাজে লাগানো ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী ভারতীয় ডায়াসপুরার মাধ্যমে আমেরিকান রাজনীতি ও প্রশাসন নির্বিশেষে এক ধরনের প্রভাব বজায় রাখতে পারছে ভারতের মোদি প্রশাসন। এছাড়া বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের মতো বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানের ভারতীয় বংশোদ্ভূত নির্বাহীদের প্রভাবকে কাজে লাগাতে পারে দিল্লির সাউথ ব্লক।
অথচ বৈশ্বিক রাজনীতিতে পশ্চিমাদের প্রধান প্রতিপক্ষ ব্রিকস ও হংকং-সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার মতো পাল্টা প্রতিষ্ঠানের প্রধান উদ্যোক্তদের মধ্যে রয়েছে ভারত। এতে দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের চীনবিরোধী নীতির পুরো সুবিধা নিয়েও বেইজিংয়ের সাথে বোঝাপড়া বজায় রাখতে পারছে।
ট্রাম্পে চীনের উদ্বেগ, ভারত উৎফুল্ল
বেশ কয়েক বছর ধরে চীন-মার্কিন সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। ট্রাম্পের চীনবিরোধী বাড়তি শুল্কারোপ বাইডেন তার প্রেসিডেন্সিজুড়ে অব্যাহত রেখেছেন। ফক্স নিউজের সানডে মর্নিং ফিউচারের সাথে এক সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প ঘোষণা করেন যে, তিনি যদি পুনরায় নির্বাচিত হন, তবে চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক ৬০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে।
তদুপরি যেহেতু ট্রাম্প তার প্রথম রাষ্ট্রপতির সময় মার্কিন নিরাপত্তার সাথে আপস করতে পারে এমন চীনা কোম্পানিগুলোয় বিনিয়োগ করতে মার্কিন সংস্থাগুলোকে নিষিদ্ধ করেছিলেন। সম্ভবত তিনি তার দ্বিতীয় প্রশাসনের সময়ও একই কাজ করবেন। চীনা অর্থনীতিতে কিছুটা শ্লথগতি সৃষ্টি এবং যুব বেকারত্বের হার ১৪.৯ শতাংশে রয়ে গেছে। ফলে চীনের সংকটাপন্ন অর্থনীতিকে উদ্দীপিত করতে এবং রপ্তানি বাড়াতে বিদেশি তহবিলের প্রয়োজন। এ অবস্থায় বেইজিংয়ের জন্য ট্রাম্পের এজেন্ডা শুধুমাত্র চীনের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে না, একই সাথে আমেরিকান প্রযুক্তি সংস্থার ওপর চীনে বিনিয়োগে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ২০৩০ সালের মধ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় বিশ্বনেতা হওয়ার বেইজিংয়ের উচ্চাকাক্সক্ষাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
ট্রাম্প সব আমদানিতে ১০ শতাংশ বেসলাইন শুল্ক চাপাতে চাইলেও চীনা আমদানির ওপর আরোপিত উচ্চ শুল্ক ভারতের জন্য বিশাল বাণিজ্যের সুযোগ সৃৃষ্টি করবে। মার্কিন অর্থনীতির চীনা অর্থনীতি থেকে ক্রমবর্ধমানভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার ফলে মার্কিন সংস্থাগুলো অন্য কোথাও পণ্য সরবরাহের মাধ্যমে তাদের সরবরাহ শৃঙ্খলে বৈচিত্র্য আনতে চাইবে। আর তিনটি কারণে ভারতের সামনে চীনের বিকল্প হবার সুযোগ আসতে পারে।
প্রথমত, যেভাবে চীনের বৈশ্বিক বাণিজ্য নেটওয়ার্ক তৈরির পরিকল্পনা বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অধীনে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বেইজিংয়ের প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছে, তাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক আরও বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে পারবে দিল্লি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সর্বদা ‘চীনের প্রতি ভারসাম্য’ হিসাবে ভারতকে লালন-পালন করতে আগ্রহ দেখিয়ে আসছে এবং এটি নিরাপত্তা গ্রুপ কোয়াডের মাধ্যমে চীনের প্রভাব নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, যার চার সদস্য হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান ও অস্ট্রেলিয়া।
দ্বিতীয়ত, ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে ট্রাম্প চীনা আমদানির ওপর ২৫ শতাংশ শুল্কারোপ করে চীনের বিরুদ্ধে একটি অভূতপূর্ব বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু করেন। বেইজিং মার্কিন পণ্যের ওপর নিজস্ব শুল্কারোপ করে প্রতিশোধ নিলেও সেটি তেমন কার্যকর হয়নি। আর চীনা আমদানির ওপর করারোপ করে আমেরিকান স্বার্থ রক্ষা করার যে কথা বলা হচ্ছিল, সেটি পুরোপুরি হয়নি। মার্কিন অর্থনীতি চীনা আমদানির ওপর অনেক বেশি নির্ভর করে বলে, মার্কিন ভোক্তা ও সংস্থাগুলোকে পণ্যের জন্য বেশি মূল্য দিতে হয়েছে। তবে ২০১৯ সাল নাগাদ ট্রাম্পের শুল্কের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আনুমানিক ৩ লাখ কর্মসংস্থান হয়েছে। আর একই সাথে ২০২০ সালে শুল্কের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৩১৬ বিলিয়ন ডলার খরচ করতে হওয়ায় মার্কিন অর্থনীতি সংকুচিত হয়েছে।
এসব কারণে দ্বিতীয় ট্রাম্প প্রশাসন নিয়ে উদ্বিগ্ন বেইজিং। ২০১৮ সাল থেকে চীন আত্মনির্ভরশীলতার নীতি গ্রহণ করে ট্রাম্পের বাণিজ্য যুদ্ধের প্রভাব হ্রাস করার চেষ্টা করেছে। এর অর্থ হলো উচ্চ প্রযুক্তি, বৈদ্যুতিক এবং স্বয়ংচালিত শিল্পগুলায় চীনের উৎপাদনের ইনপুটগুলোর আমদানি হ্রাস।
তবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ওপর নির্ভরতা হ্রাস করার জন্য চীনের ক্ষমতা অত্যন্ত সীমিত। চীনা নেতৃত্ব এটি জানেন এবং বিশেষজ্ঞরা অনুমান করেন যে, সান ফ্রান্সিসকোয় এশিয়া-প্যাসিফিক অর্থনৈতিক সহযোগিতার বৈঠকে শি কেন যোগ দিয়েছিলেন তার একটি প্রধান কারণ ছিলÑ পশ্চিমের সাথে সম্পর্ক মেরামত করা এবং চীনে প্রয়োজনীয় বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করা। এ নিয়ে বাইডেন প্রশাসনের সাথে শি জিনপিনের একটি সমঝোতার খবরও কোনো কোনো গণমাধ্যমে বলা হচ্ছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ট্রাম্প যদি আবার জয় পান, তাহলে বেইজিংয়ের উদ্বেগ দীর্ঘমেয়াদি উৎকণ্ঠায় পরিণত হতে পারে।
একসময় ট্রাম্প চীনা ক্লাসিক সান জু’স আর্ট অব ওয়ার থেকে একটি আইকনিক বাক্যাংশ টুইট করেছিলেন যেখানে বলা হয়, ‘যুদ্ধের সর্বোচ্চ শিল্প হলো যুদ্ধ না করে শত্রুকে পরাস্ত করা।’ তবে সান জু-এর আরেকটি বাক্য ছিল এরকম, ‘যখন আপনি একটি সেনাবাহিনীকে ঘিরে ফেলবেন, তখন একটি আউটলেট মুক্ত রাখুন। মরিয়া শত্রুকে খুব বেশি চাপ দেবেন না।’
ট্রাম্প প্রশাসনের প্রথম মেয়াদে সান জু-এর উদ্ধৃত বাক্যটিকে ট্রাম্প কাজে লাগিয়েছিলেন। নটিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মালয়েশিয়া ক্যাম্পাসের ব্যবসায়িক অর্থনীতির সহকারী অধ্যাপক চি মেং টান দ্বিতীয় মেয়াদে জয়ের সম্ভাবনাকে সামনে রেখে বলেছেন, ট্রাম্পের উপলব্ধি করা উচিত যে, চীনের প্রতি ওয়াশিংটনের বর্ধিত আগ্রাসন কেবল তাইওয়ানের নিরাপত্তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। কিছু সময়ের জন্য তাইওয়ানের সাথে একত্রিত হওয়ার বেইজিংয়ের আকাক্সক্ষাটি মূলত ‘এক চীন নীতি’ বৈধ করার লক্ষ্যে একটি জাতীয়তাবাদী অনুশীলন ছিল। কিন্তু তাইওয়ানকে অধিগ্রহণ করার প্রয়োজনীয়তা সেমি কন্ডাক্টর প্রযুক্তিতে দ্বীপ রাষ্ট্রের অগ্রগতি এবং চীনের বর্তমান অর্থনৈতিক দুর্দশার কারণে ঐতিহাসিক উদ্দীপনাকে অতিক্রম করে অর্থনৈতিক আকাক্সক্ষায় চলে গেছে।
চি মেং টান মনে করেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) বেইজিংয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, এটি চীনকে বড় অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিগত ও সামরিক সুবিধা প্রদান করবে। আর চীন যদি ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের এআই নেতা হতে চায়, তাহলে তাকে সেমি কন্ডাক্টর চিপগুলো হাতে পেতে হবে। ওয়াশিংটনের বাধার কারণে চীন যদি বাণিজ্যের মাধ্যমে এ অ্যাক্সেস করতে না পারে তবে তারা তাইওয়ান আক্রমণ করে জোর করে এ প্রযুক্তি অর্জন করতে পারে।
আর সত্যি সত্যি যদি তেমন কিছু ঘটে, তবে এটি পুরো বৈশ্বিক রাজনীতিতে টালমাটাল এক অবস্থা তৈরি করবে, যার বড় রকমের প্রভাব পড়তে পারে দক্ষিণ এশিয়ায়। আর এজন্য ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের দুই দেশেরই আগামী নির্বাচন অতি গুরুত্বপূর্ণ দুটি ঘটনা। ইসরাইলের গাজা যুদ্ধ আর রাশিয়ার ইউক্রেন যুদ্ধ আগে থেকেই বিশ্ব পরিস্থিতিকে উত্তপ্ত আগ্নেয়গিরিতে রূপান্তরের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। মোদি ট্রাম্পের আরেকবার ক্ষমতারোহণ সেটিকে আরো একটি অনাকাক্সিক্ষত বিস্ফোরণের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
এ পাতার অন্যান্য খবর
এ বিভাগ বা পাতায় আর কোন সংবাদ, কবিতা বা অন্যকোন ধরণের লেখা পাওয়া যায়নি।