অ ব লো ক ন
ফিলিস্তিন রাষ্ট্র কি আসলেই চায় পশ্চিমারা
॥ মা সু ম খ লি লী ॥
ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্য করার এক প্রস্তাব নিরাপত্তা পরিষদে আমেরিকান ভেটোর কারণে বাতিল হয়ে গেছে। যুক্তরাজ্য ও সুইজারল্যান্ড এ ইস্যুতে ভোটাভুটিতে অংশ নেয়নি। ফ্রান্স, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের মতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশসহ ১২ নিরাপত্তা পরিষদ সদস্য স্বাধীন ফিলিস্তিনের পক্ষে ভোট দিয়েছে। যে যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইল-ফিলিস্তিন দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের জন্য অসলো ও ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি স্বাক্ষরে মধ্যস্থতা করেছে এবং দুই রাষ্ট্র্র সমাধানের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি কথা বলেছে, সেই আমেরিকা কেন রাষ্ট্র্র হিসেবে ফিলিস্তিনের স্বীকৃতির বিরোধিতা করছে। আসলেই কি আমেরিকা ফিলিস্তিন স্বাধীন কোন দেশ হোক সেটি চাইছে না?
কেন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র চাইছে না যুক্তরাষ্ট্র্র
ফিলিস্তিন হলো জাতিসংঘের একটি অ-সদস্য রাষ্ট্র, যা ২০১২ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ দ্বারা গৃহীত একটি প্রস্তাবের মাধ্যমে জাতিসংঘে পর্যবেক্ষকের মর্যাদা লাভ করে। নিরাপত্তা পরিষদের এ প্রস্তাবের বিষয়ে মার্কিন ডেপুটি অ্যাম্বাসেডর রবার্ট উড বলেছেন, মার্কিন ভেটো ‘ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের বিরোধিতাকে প্রতিফলিত করে না, তবে এটি এমন একটি স্বীকৃতি যে দুই পক্ষের (ফিলিস্তিনি ও ইসরাইল) মধ্যে সরাসরি আলোচনার ছাড়া ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা যায় না।’
যারা দেখতে পান যে যুক্তরাষ্ট্র একটি দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানে পৌঁছাতে চায় এবং যারা এর বিপরীতটি দেখেন- এ উভয় পক্ষ আমেরিকান ভূমিকায় হয়তো যুক্তি খুঁজে পেতে পারেন। তবে আমেরিকার এ ভূমিকায় গত ৫ দশকে ইসরাইল নানা অজুহাতে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র্র প্রতিষ্ঠা থেকে দূরে সরে থাকার সুযোগ পেয়েছে। আর সর্বশেষ বলেছে, তারা কোনোভাবেই ফিলিস্তিন রাষ্ট্র মেনে নেবে না।
আমেরিকান কূটনীতিক ও মধ্যপ্রাচ্যনীতি কাউন্সিলের প্রধান জিনা উইনস্টানলি বলেছেন যে, তার দেশ ‘দুই রাষ্ট্র সমাধানকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে।’ প্রশ্ন হলো এরপরও কেন ওয়াশিংটন খসড়া প্রস্তাবে রাজি হয়নি? ৭ অক্টোবর গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা বার বার ফিলিস্তিনি ও ইসরাইলের মধ্যে শান্তিতে পৌঁছানোর উপায় হিসেবে দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের সাথে এগিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। কিন্তু ওয়াশিংটন তেলআবিবের অনুমোদন ছাড়া ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পূর্ণ সদস্যপদে সম্মত হতে অস্বীকার করছে। তাদের বক্তব্য হলো এটি অবশ্যই ‘কূটনীতির মাধ্যমে এবং চাপিয়ে দিয়ে’ বাস্তবায়নের বিষয় নয়। কিন্তু কীভাবে, কত সময়ে সেটি বাস্তবায়ন করা যাবে, সে সম্পর্কে কোনো কথা যুক্তরাষ্ট্রের নেই।
আমেরিকান পররাষ্ট্র্রমন্ত্রী ব্লিঙ্কেন বলছেন, ‘আমরা ইসরাইলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রকে সমর্থন অব্যাহত রাখি।’ আরো এক ধাপ এগিয়ে তিনি উল্লেখ করেন যে, আমেরিকান আইনের অধীনে ফিলিস্তিনের জন্য জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্যতার যেকোনো স্বীকৃতির অর্থ হলো ‘জাতিসংঘে আমাদের সকল সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া এবং এতে এমনকি ফিলিস্তিনিদের ক্ষতি হবে।’
জিনা উইনস্টানলি বিবিসি আরবিকে বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাষ্ট্রের কাঠামো পরিষ্কার না হওয়া এবং ইসরাইলের অনুমোদন ছাড়াই ফিলিস্তিনকে পূর্ণ সদস্য হওয়ার অনুমতি দেওয়াকে অব্যাহতভাবে প্রতিরোধ করে চলেছে। অসলো চুক্তি স্বাক্ষরের এত বছর পরও সেই কাঠামো চূড়ান্ত করা সম্ভব হয়নি।
প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক খাত্তার আবু দিয়াব বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলেছেন, প্রধান সমস্যাটি হলো ইসরাইলের অনুমোদন পাওয়া। যেহেতু ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী আইজাক রাবিনকে হত্যার পর থেকে শান্তির স্বপ্ন এক বা অন্যভাবে ব্যর্থ হয়েছে এবং ইসরাইলের রাজনৈতিক পরিবেশ আরও কঠোর হচ্ছে। সেখানে বসতি স্থাপন বাড়ছে, পশ্চিমতীরে ইসরাইল যে বিচ্ছিন্নভাবে একের পর এক প্রাচীর স্থাপন করে চলেছে এবং অবশ্যই নিষ্পন্ন সীমান্তকে নানাভাবে দখলের আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে। ফলে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের আশা ইসরাইলের সম্মতিক্রমে হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।
৭ অক্টোবরের ঘটনার অনেক আগেই বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে ইসরাইল সরকার ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিষয় প্রত্যাখ্যান করেছে এবং তারা আমেরিকান সর্বশেষ ভেটোকে স্বাগত জানিয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী, ইসরাইল কাটজ, আলজেরিয়া কর্তৃক উপস্থাপিত প্রস্তাবটিকে ‘লজ্জাজনক’ বলে বর্ণনা করেছেন।
নেতানিয়াহু আগেও বলেছিলেন যে, ‘অসলো চুক্তি একটি গুরুতর ভুল, যা পুনরাবৃত্তি করা উচিত নয়’। তিনি মনে করেন যে, ফিলিস্তিনিদের পূর্ণ সার্বভৌমত্ব প্রদান ইসরাইলিদের জীবনের জন্য হুমকিস্বরূপ।
অন্যদিকে মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ আমেরিকান সিদ্ধান্তের নিন্দা করে বলেছে যে, আমেরিকান ভেটো ছিল ‘অন্যায়, অনৈতিক এবং এর মাধ্যমে ফিলিস্তিন জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্যপদ দেয়ার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ইচ্ছাকে অস্বীকার করা হয়েছে।’
প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসও আমেরিকান ভেটোর নিন্দা করেছে এবং এক বিবৃতিতে বলেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘আমাদের ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে এবং তাদের স্বনিয়ন্ত্রণের অধিকার ও তাদের স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে তার অবস্থান পুনরায় নিশ্চিত করেছে।’
ভোট শেষ হওয়ার পর জাতিসংঘে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত রিয়াদ মনসুর বলেন, ‘জাতিসংঘে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের সদস্যপদ কোনো প্রতীকী বিষয় নয়, বরং এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ নাজুক পর্যায়ে ফিলিস্তিনি এবং এ অঞ্চলের জনগণের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ। এটি এমন একটি পদক্ষেপ ছিল, যা ১৯৪৭ সাল থেকে প্রতীক্ষিত। ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর বিভাজনের সিদ্ধান্তের পর থেকে, নাকবার মাধ্যমে এবং বর্তমান দিন পর্যন্ত যে ঐতিহাসিক অবিচার করা হয়েছে, তা ফিরিয়ে আনার জন্য এটি হলো একটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ।’
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বিশ্বাস করেন যে, ‘দুই-রাষ্ট্রীয় সমাধানের দিকে অগ্রগতি করতে ব্যর্থতা সমগ্র অঞ্চলজুড়ে কয়েক মিলিয়ন মানুষের জন্য অস্থিরতা এবং ঝুঁকি বাড়াবে। কারণ তারা সহিংসতার ধ্রুবক হুমকির মধ্যে বসবাস করতে থাকবে।’
নেতানিয়াহু কী চান?
এর আগে নেতানিয়াহু গাজা যুদ্ধের পরে কী করবেন, তার একটি পরিকল্পনা উপস্থাপন করেন। এতে তিনি গাজা উপত্যকার ওপর সম্পূর্ণ সামরিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা এবং অন্যান্য সংস্থা ও পয়েন্টগুলোর নিয়ন্ত্রণ ইউএনআরডাব্লিউকে দিয়ে প্রতিস্থাপন করার কথা বলেছেন। নেতানিয়াহুর প্রস্তাবে দখলকৃত পশ্চিমতীর ও গাজা উপত্যকায় ‘সন্ত্রাসী উপাদান’ (প্রতিরোধ আন্দোলন) শক্তিশালীকরণ ঠেকাতে এবং ইসরাইলের প্রতি তাদের হুমকি নস্যাৎ করতে স্থল, সমুদ্র ও আকাশপথে ‘সমগ্র পশ্চিম জর্ডানীয় অঞ্চল ইসরাইলি নিরাপত্তা তদারকি অন্তর্ভুক্ত করা হবে’ বলে উল্লেখ করা হয়।
টাইমস অফ ইসরাইলের প্রতিবেদন অনুসারে, লক্ষ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে হামাস এবং ইসলামিক জিহাদ আন্দোলনগুলোকে ভেঙে দেওয়া এবং গাজায় এখনো বন্দী সব জিম্মিকে মুক্তি দেওয়া। সংবাদপত্রটি আরো বলেছে যে, ‘ইসরাইল গাজা উপত্যকার সীমানা ফিলিস্তিনের পাশে একটি নিরাপত্তা বাফার জোন প্রতিষ্ঠার জন্য তার বর্তমান প্রকল্পের সাথে এগিয়ে যাবে। এ জোনটি বহাল থাকবে ‘যতক্ষণ পর্যন্ত নিরাপত্তার জন্য এটির প্রয়োজন আছে’।
দেখা যাচ্ছে বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু তার এ অবস্থান থেকে মোটেই সরছেন না। সর্বশেষ কাতারের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব ব্যর্থ হওয়ার পর হামাস প্রধান ইসমাইল হানিয়া গাজা থেকে দখলদার সামরিক বাহিনী প্রত্যাহার ও স্থায়ীভাবে যুদ্ধ বন্ধ ছাড়া বন্দীবিনিময় চুক্তিতে সম্মত না হওয়ার কথা জানান। এরপর নেতানিয়াহুর জবাবে কোনো কিছু আর আড়ালে থাকেনি।
নেতানিয়াহু বলেন, হামাস তার চরম অবস্থান থেকে পিছু হটানোর পরিবর্তে আমাদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করতে চাইছে। ইসরাইলি সরকারকে দেয়া চাপ তাদের উৎসাহিত করে। এর ফলে হামাস কেবল আমাদের অপহৃতদের মুক্তির জন্য তার শর্তগুলো কঠোর করছে। হামাস তার কাছে বন্দী ইসরাইলিদের ফেরত পাঠাতে অস্বীকার করছে। অতএব আমরা হামাসের ওপর অতিরিক্ত এবং বেদনাদায়ক আঘাত করব। আর এটি শিগগিরই ঘটবে।
নেতানিয়াহু এ রকম কথা আগে একাধিকবার বললেও এ সময়ের কথাটি যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। এর আগে হামাস প্রধান উল্লেখ করেন, আমরা রাফাতে প্রবেশের বিরুদ্ধে সতর্ক করছি কারণ এটি আমাদের ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে একটি বড় গণহত্যার কারণ হতে পারে।
এক আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে ইসমাইল হানিয়া মিশর, তুরস্ক, কাতার, ইউরোপীয় দেশগুলো ও অন্যদের আগ্রাসন ও রাফায় দখলদারদের প্রবেশ রোধ করার জন্য পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান। গাজা উপত্যকা থেকে সম্পূর্ণ সেনা প্রত্যাহার এবং গাজা উপত্যকায় আগ্রাসন বন্ধ করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করার জন্যও আহ্বান জানান তিনি।
হানিয়া উল্লেখ করেন, জায়নবাদী শত্রু এরপরও রাফা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে, আমাদের ফিলিস্তিনি জনগণও সাদা পতাকা উত্তোলন করবে না। আর রাফায় প্রতিরোধ শক্তি নিজেকে রক্ষা করতে এবং জনগণের বিরুদ্ধে এ আগ্রাসনের মোকাবিলা করতে প্রস্তুত।
হামাসপ্রধান বলেন, আমাদের অবস্থান প্রথম থেকেই পরিষ্কার। আমরা আমাদের জনগণের বিরুদ্ধে আগ্রাসন বন্ধ করতে চাই। এটি আমাদের জন্য একটি অগ্রাধিকার এবং সেই কারণে আমরা এ শর্তে আলোচনায় প্রবেশ করতে সম্মত হয়েছি- এ আলোচনাগুলো একটি স্থায়ী যুদ্ধবিরতি, একটি ব্যাপক সেনা প্রত্যাহার এবং সব বাস্তুচ্যুতদের প্রত্যাবর্তনের দিকে নিয়ে যাবে। ইহুদিবাদী শত্রুর সাথে একটি বৈধ বিনিময় চুক্তিতে পৌঁছানো যাবে। মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে কয়েক ডজন সেশন এবং কয়েক ডজন কাগজপত্র বিনিময় সত্ত্বেও এ মুহূর্ত পর্যন্ত দখলদারিত্ব গাজা উপত্যকায় যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়নি।
তিনি দৃঢ়তার সাথে উল্লেখ করেন, শত্রুরা চায় তাদের সব বন্দীদের পুনরুদ্ধার করতে এবং তারপর গাজার যুদ্ধ আবার শুরু করতে। কোনোভাবেই এটি ঘটতে পারে না।
ইসমাইল হানিয়ার এ স্পষ্ট বক্তব্যের পর নেতানিয়াহু বলেছেন, আগামী দিনে আমরা হামাসের ওপর সামরিক ও রাজনৈতিক চাপ বাড়াব কারণ এটাই আমাদের জিম্মিদের মুক্ত করার এবং আমাদের বিজয় অর্জনের একমাত্র উপায়।
বাইডেনের গাজা কৌশল
যুক্তরাষ্ট্রের জো বাইডেন প্রশাসনের মূল লক্ষ্য- যেকোনো প্রক্রিয়া ইসরাইলকে টিকিয়ে রাখার জন্য সর্বাত্মক সহযোগিতা দেয়া তাতে সংশয় নেই। ৭ অক্টোবরের পর একাধিকবার ওয়াশিংটন এবং প্রেসিডেন্ট বাইডেন বিষয়টি পরিষ্কার করেছেন। নিরাপত্তা পরিষদে সর্বশেষ ভেটোর পরও ২৬ বিলিয়ন ডলারের বেশি সহায়তা ইসরাইলকে দেয়ার প্রস্তাব কংগ্রেসে পাস হয়েছে।
যদিও ইরানের সাথে সর্বশেষ সংঘাতের পর বাইডেন প্রশাসন ঘোষণা করেছে যে, এটি ইরানের বিরুদ্ধে ইসরাইলের সম্ভাব্য পাল্টা আক্রমণকে সমর্থন করবে না। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নেতানিয়াহুর সাম্প্রতিক পদক্ষেপের প্রভাবকে সীমিত করার একটি প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে গাজা সংকটকে একটি আঞ্চলিক যুদ্ধে পরিণত করতে চায় না বলে উল্লেখ করা হচ্ছে।
তবুও ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগগুলোকে সমর্থন দিয়ে চলেছে ওয়াশিংটন। নেতানিয়াহু তার হাতে ‘ইরান হুমকির’ কার্ডটি ধরে রেখেছেন এবং ২০২৪ সালের নভেম্বরের নির্বাচনের আগে তার কৌশলের জন্য প্রচুর স্পেস তৈরি করেছেন। নেতানিয়াহু সুযোগ পেলেই এক একটি নতুন সংকট শুরু করছেন- যাতে তার লক্ষ অর্জনে বাইডেন প্রশাসন সমর্থন দিতে বাধ্য হয়। গাজা সংকট থেকে মনোযোগ সরে যাওয়ার সাথে সাথে তেলআবিব অবশিষ্ট আঞ্চলিক শক্তিগুলোর নীতিগুলোকে সারিবদ্ধ করার চেষ্টা করতে পারে।
প্রয়োজন সমন্বিত কূটনৈতিক উদ্যোগ
বিদ্যমান অবস্থায় যে দেশগুলো চায় না- ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে উত্তেজনা বাড়াতে এ অঞ্চলের এজেন্ডা নির্ধারণ করা হোক, তাদের উচিত নতুন উদ্যোগ শুরু করা। এর জন্য তুর্কি, সৌদি আরব এবং অন্য উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোকে তাদের দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতাকে আরও জোরদার করতে হবে। আর আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টার দিকে মনোনিবেশ করতে হবে।
এই অর্থে প্রেসিডেন্ট রজব তৈয়ব এরদোগান তুরস্কের পৌর নির্বাচনের পর একটি কূটনৈতিক উদ্যোগ শুরু করতে পারেন। ইসরাইল-ইরানি উত্তেজনা থেকে এ অঞ্চলটিকে বাঁচানোর জন্য বিশ্বনেতাদের সাথে আরও ঘনিষ্ঠভাবে তিনি কাজ করবেন।
যুদ্ধের পর ফিলিস্তিনি-ইসরাইলি সংঘাতের অবসানের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক এবং আরব সংস্থার দ্বারা প্রস্তাবিত দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানের কাঠামোর মধ্যে একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য আন্তর্জাতিক এবং আঞ্চলিক আহ্বান এখন বৃদ্ধি পেয়েছে।
গত নভেম্বরে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিঙ্কেন ঘোষণা করেছিলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘমেয়াদে সংঘাতের অবসান ঘটাতে ‘দুটি পৃথক রাষ্ট্র নির্মাণের ভিত্তি স্থাপনের কাজ শুরু করেছে’ এবং তিনি বিবেচনা করেছিলেন, ‘দুই রাষ্ট্রের সমাধানই একমাত্র। মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির পথ।’ ইইউ পররাষ্ট্রনীতি কমিশনার জোসেপ বোরেল ঘোষণা করেছেন, তারা দুটি ইউরোপীয় দেশ থেকে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের স্বীকৃতির বিষয়ে আলোচনা করার জন্য একটি অনুরোধ পেয়েছে।
অন্যদিকে ইসরাইলি সরকার সর্বসম্মতিক্রমে নেতানিয়াহু কর্তৃক উপস্থাপিত ‘ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের একতরফা স্বীকৃতির’ বিরোধিতা করার জন্য একটি প্রস্তাব অনুমোদন করেছে। ইসরাইল সবসময় চায় যে সৌদি আরব এবং আরব দেশগুলো ফিলিস্তিনিদের সাথে কোনো চুক্তি ছাড়াই তার সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করবে, কিন্তু অক্টোবরের ৭ তারিখের ঘটনা বিশ্বকে দেখিয়েছিল যে, ফিলিস্তিনি ইস্যু জীবিত ও স্থায়ী এবং এটিকে উপেক্ষার প্রতিটি প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবে।
ইতিহাসের ভুলপথে খ্রিস্টান বিশ্ব
দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর রা.-এর আমলে তারই হাতে ঐতিহাসিক জেরুসালেম নগরী তথা ফিলিস্তিন ভূখণ্ড বিনা রক্তপাতে মুসলিম শাসনে আসে। যে চুক্তির ভিত্তিতে জেরুসালেম ইসলামী খেলাফতের অংশ হয়, সে চুক্তিতে খ্রিস্টপক্ষের একটি অন্যতম শর্ত ছিল যে, এ নগরীতে কোনো অবস্থাতেই ইহুদিদের বসতি করতে দেয়া যাবে না। কারণ খ্রিস্টীয় কর্তৃত্বাধীন জেরুসালেমে ইহুদি অনুপ্রবেশ ছিল নিষিদ্ধ।
ইতিহাসের পটপরিবর্তনে নানা শক্তির হাত ঘুরে শেষতক জেরুসালেম ও ফিলিস্তিন ভূখণ্ড তুর্কি ওসমানী খেলাফতের অধীন আছে। ওসমানী খলিফাগণ ঐ চুক্তির মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখেন। কিন্তু ১ম বিশ^যুদ্ধে অক্ষশক্তির পরাজয়ে ইঙ্গ-মার্কিন ষড়যন্ত্রে তুর্কি খেলাফত ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। এ সুযোগে জায়নবাদীরা সুযোগ বুঝে ১৯৩০ সাল থেকে ধীরে ধীরে ফিলিস্তিনে বসতি স্থাপন শুরু করে। যার প্রত্যক্ষ মদদদাতা ছিল খ্রিস্টীয় ব্রিটিশ সাম্রাজ্য। এরপর ১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্র। তারপর... যা ঘটে চলেছে, সবাই জানে।