সোনার বাংলা ডেস্ক : ফরিদপুরের মধুখালীতে সেদিন কী ঘটেছিল? বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, কৃষ্ণপুর গ্রামে সর্বজনীন কালীমন্দিরের পাশে অবস্থিত ৬৯নং পঞ্চপল্লী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শৌচাগার নির্মাণ প্রকল্পটি জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হচ্ছে। শৌচাগার নির্মাণ প্রকল্পের কাজ পায় ফরিদপুরের মাহিদা এন্টারপ্রাইজ নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। পরে সাব- কন্ট্রাক্টে ওই কাজ বাগিয়ে নেন নওয়াপাড়া ইউনিয়ের চোপেরঘাট গ্রামের সাব-ঠিকাদার মো. জালাল শেখ। স্থানীয় একটি সূত্র ও নিহতের পরিবার বলছে, শৌচাগার নির্মাণকাজ শুরু করার পর থেকেই স্থানীয় ইউপি সদস্য অজিৎ কুমার সরকার ওই কাজে নানাভাবে বাধা সৃষ্টি করেন। গত ঈদের আগে অজিতের লোকজন নির্মাণকাজের স্থলে গিয়ে নগদ টাকা চাঁদা দাবি করেন। চাঁদা না দিলে মারধরেরও হুমকি দেন। পরে নির্মাণকাজের রড নিয়ে যেতে গেলে এতে বাধা দেন শ্রমিক (ঘটনাস্থলে নিহত) আশরাফুল খান। পরে ওই যুবকরা উত্তেজিত হয়ে আশরাফুলসহ অন্য শ্রমিকদের প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে চলে যান। পরে পুরো ঘটনাটি আশরাফুল মুঠোফোনে তার বাবা মো. শাহজাহান খানকে জানান। ভয়ে শাহজাহান খান তার দুই ছেলেকে পঞ্চপল্লী থেকে বাড়ি ফিরিয়ে নেন। পঞ্চপল্লীতে কাজে যেতে বারণ করেন। তবে ঈদের পরে সাব-ঠিকাদার জলিল শেখের অনুরোধে আবার কাজে যোগ দেয় দুই সহোদর আশরাফুল ও আরশাদুল। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার দিন ১৮ এপ্রিল বিকালে ১নং ওয়ার্ড মেম্বার অজিৎ কুমার সরকারের নির্দেশে পার্শ্ববর্তী জাননগর গ্রামের বাসিন্দা বিনয় সাহা একদল যুবক নিয়ে স্কুলের ভেতর প্রবেশ করেন এবং নির্মাণকাজের এক বান্ডিল রড ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন। তখন নির্মাণ শ্রমিকদের সঙ্গে তাদের ধস্তাধস্তি-ধাক্কাধাক্কি হয়। পরে দুই পক্ষই নানা বাজে ভাষায় গালমন্দ করতে থাকেন।
এদিন সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে মন্দিরে সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালাতে যান স্থানীয় প্রভাষ কুমার মণ্ডলের ছোট ভাইয়ের স্ত্রী তপতী রানী মণ্ডল। তিনি প্রতিদিনই মন্দিরে সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালান। ঘটনার বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তপতী রানী মণ্ডল বলেন, ‘আমি মন্দিরে সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালাতে গিয়ে নির্মাণ শ্রমিকদের মন্দিরের সামনে বটগাছের নিচে দেখতে পাই। তারা উচ্চৈঃস্বরে কথা বলছিল। মনে হলো কারো সাথে ঝগড়া করছিল। তবে তারা কাকে এবং কার সঙ্গে ঝগড়া করছিল, তা আমি বুঝতে পারিনি’। তপতী রানী আরও বলেন, ‘বৃহস্পতিবার (১৮ এপ্রিল) সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালানোর পর আমি আবার গোবর-খড় আনতে মন্দিরের সামনে যাই। তখন সাতজন নির্মাণ শ্রমিক স্কুলের মধ্যেই ছিলেন।’
চাঁদা ও হুমকির বিষয়ে আরশাদুলের মা শারমিন বেগম বলেন, ‘ওদের কাছে ওই এলাকার কিছু ছেলে এসে চাঁদা চায়। টাকা না দিলে মারধরের হুমকি দেয়। কাজ করতে দেবে না বলে শাসিয়ে যান। আশরাফুল ওর বাবাকে এ ঘটনা জানায়। পরে ওদের বাড়ি নিয়ে আসি। ওরা আমার ছেলেদের জান নিয়ে নেবে জানলে আর পাঠাতাম না। আল্লাহ আমি খুনিদের বিচার চাই। আল্লাহ তুমি ওদের বিচার কইরো।’
ঘটনার বিষয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মাহিদা এন্টারপ্রাইজের কর্ণধার মনজিল শেখ জানান, সন্ধ্যার পর শ্রমিকরা আমাকে ফোন করে জানান, স্কুলের পাশে মন্দিরে কে বা কারা আগুন দিয়েছে। তারা মন্দিরে গিয়ে আগুন নেভানোর কাজ করেন। এরপর উত্তেজিত গ্রামবাসী শ্রমিকদের স্কুল কক্ষে আটকে রেখেছে বলে জানানো হয়।
প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয়রা জানান, বৃহস্পতিবার (গত ১৮ এপ্রিল) সন্ধ্যায় আগুনের সূত্রপাত কীভাবে হলো, তা এখনো তারা নিশ্চিত জানেন না। আগুন নেভানোর কাজে শ্রমিকরাও সহায়তা করেন। পরে কয়েকজন উত্তেজিত জনতা স্কুলের নির্মাণ শ্রমিকদের সন্দেহ করা শুরু করেন। ঘটনার পরে একে একে কৃষ্ণপুর, জাননগর, সীধলাজুড়ি ও তারাপুর গ্রামের অধিকাংশ মানুষ ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন। রাত ৮টার দিকে সাব-ঠিকাদার নসিমন ভরে রড নিয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। ততক্ষণে হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি উগ্র দল নির্মাণ শ্রমিক আশরাফুল, আরশাদুল, সিরাজ শেখ, আনোয়ার হোসেনকে মারধরের উদ্দেশ্যে ঘিরে ফেলে। পরে সাব-ঠিকাদার জলিল শেখ ও নসিমন চালক মো. লিটন খানসহ সব শ্রমিকদের ওই নসিমনের দড়ি দিয়েই বেঁধে ফেলা হয়।
স্থানীয় প্রভাষ কুমারের ফোন পেয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন ১নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য অজিৎ কুমার সরকার। তিনি এসে শ্রমিকদের স্কুলের শিশু শ্রেণিকক্ষে ঢোকান। যেখানে নির্মাণ শ্রমিকরা দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছিলেন। পরে ২নং ওয়ার্ডের মেম্বার লিংকন বিশ্বাস ঘটনাস্থলে আসেন। তখন হিন্দু সম্প্রদায়ের উত্তেজিত একটি উগ্র দল ‘ধর ধর’ বলে ইটপাটকেল, রড, বাঁশ ও কাঠ দিয়ে রুমের দরজা জালানা ভাঙতে শুরু করে। আশরাফুলকে একজন শাসিয়ে রড দিয়ে প্রথমে আঘাত করেন। তার সাথে অন্যরা যোগ দেয় সাথে সাথেই হামলায় আশরাফুল ও আরশাদুল ঘটনাস্থলেই মারা যান। তাদের বাড়ি নওপাড়া ইউনিয়নের চোপেরঘাট গ্রামে। গুরুতর আহত হন আনোয়ার হোসন ও সিরাজ শেখ।
হামলা থেকে বেঁচে ফেরা নসিমন চালক মো. লিটন মোল্লা বলেন, চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান তখন ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে কারও কথা না শুনেই লোহার পাইপ দিয়ে আশরাফুলকে পেটাতে শুরু করেন। তিনি বলতে থাকেন তোর কত বড় সাহস, তুই মন্দিরে আগুন দিস। দাঙ্গা সৃষ্টি করিস, এসব বলতে বলতে মেরে আশরাফুলকে মাটিতে ফেলে দেন। পরে শ্রমিক আনোয়ারকেও মারধর করেন। মেম্বার অজিৎ কুমারও আরশাদুলকে কাঠ দিয়ে পেটাতে থাকেন।
নিহত আশরাফুল ও আরশাদুলের বড় চাচা আব্দুর রাজ্জাক খান বলেন, আমার ভাতিজাদের পিটিয়ে মাথা দুইভাগ করে ফেলা হয়। মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙে দেয়া হয়। লাশ ধরলে মাঝ থেকে ভেঙে পড়ে। আমরা চেয়ারম্যান ও মেম্বারের শাস্তি চাই। হিন্দুরা প্রথমে মারধর করেনি। চেয়ারম্যান এসেই মার শুরু করেন। পরে স্থানীয়রা হামলে পড়ে। দুটি নিরীহ প্রাণ কেড়ে নেয়।
হামলার শিকার আরেক প্রত্যক্ষদর্শী সাব-ঠিকাদার জালাল শেখ বলেন, আমরা উপস্থিত হলে শ্রমিকদের হাতে বালতি, পানি ও জগ দেখতে পাই। তারা আগুন নেভানোর কাজ করেছে। তখন হিন্দুরা শ্রমিকদের সন্দেহ করে এবং গালাগাল করতে থাকে। তারা বলে, এতদিন আগুন ধরলো না আজ ধরলো কেন? ৪ শ্রমিককে রশি দিয়ে বেঁধে রুমে নিয়ে যায়। ঘটনার বিষয়ে সকাল থেকে অভিযুক্ত চেয়ারম্যান শাহ আসাদুজ্জামান তপনের মুঠোফোনে ফোন দিলে নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।
মামলা ও গ্রেপ্তার: পঞ্চপল্লীতে হামলা ও হত্যার ঘটনায় তিনটি মামলা হয়েছে। মন্দিরে আগুন দেয়ার ঘটনায় তপতী রানী মণ্ডল বাদী হয়ে মামলা করেছেন। দুই শ্রমিক হত্যার ঘটনায় একটি মামলা হয়েছে। আসামি অজ্ঞাতনামা। এছাড়া পুলিশের কাজে বাধা এবং পুলিশ হত্যাচেষ্টায় মধুখালী থানার উপপরিদর্শক সংকর বালা বাদী হয়ে একটি মামলা করেছেন। এই মামলার এজাহার সূত্রে জানা গেছে, ঘটনার দিন রাতেই গোবিন্দ সরকার ও অনয় ভাদুরী নামে দুজনকে আটক করে পুলিশ। পরে তাদের গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়।
হামলায় অংশ নিয়েছিলেন যারা: কৃষ্ণপুর, জাননগর, সীধলাজুড়ি ও তারাপুর মিলে গঠিত পঞ্চপল্লী। এ পাঁচ গ্রামের সবাই সনাতন ধর্মের। হামলার দিন আশপাশের ৫ গ্রামের অন্তত ২ হাজার লোক অংশ নেয়। একটি মামলার এজাহারে হামলায় অংশ নেয়া ও পুলিশের ওপর হামলায় ৩১ জনকে আসামি করা হয়। তারা হলেনÑ গোবিন্দ সরকার, অনয় ভাদুরী, কাঙ্গাল মণ্ডল, কালিপদ মণ্ডল, রবীন্দ্রনাথ মণ্ডল, কেশব মণ্ডল, সজিব মণ্ডল, মঙ্গল সরকার, প্রেম কুমার মণ্ডল, অনিল কুমার বালা, অসিম বিশ্বাস, কৃষ্ণ বিশ্বাস, হরিচন্দ্র অধিকারী, গোবিন্দ বালা, সজিব মণ্ডল, সুফল ওরফে মুক্ত, মানিক মণ্ডল, গোপাল সরকার, পলাশ সরকার, মনি কুমার বিশ্বাস, উজ্জ্বল দাস, কৌশিক জোয়ার্দ্দার, বিপ্লব মণ্ডল, গণেশ বসু, মিল্টন সরকার, হৃদয় বিশ্বাস, মনোজিৎ বালা, গৌতম মণ্ডল, মিহির সরকার, উজ্জ্বল মিত্র ও রাজ কুমার সরকার। ঘটনাস্থলে উপস্থিত ১নং ওয়ার্ড গ্রাম পুলিশ সদস্য অমৃত কুমার বসু বলেন, বিনয় সাহা মূলহোতা। সে এখানে কেন এলো। তাকে কে এখানে ফোন করে আনলো? সে সন্দেহজনক ব্যক্তি। তার চরিত্রই ভালো না। সে ধর্মীয় উসকানিমূলক কাজকর্ম করে। সে ঘটনার সময় নেতৃত্ব দিয়েছে। মেম্বার-চেয়ারম্যানের সঙ্গে সেও রুমের ভেতরে ছিল। তার ওখানে কাজ কী? ২নং ওয়ার্ড গ্রাম পুলিশ সদস্য সুজিত অধিকারী বলেন, ঘটনার সময় অসিম বিশ্বাসের হাতে গোড়ালি ছিল। সে খুব উত্তেজিত ছিল। গোবিন্দা নামের ছেলেটি মধুখালী থানার ওসির সঙ্গে অনেক বাকবিতণ্ডা করেছে। গোবিন্দ এলাকায় তরুণদের মধ্যে নেতৃত্ব দেয়।
চেয়ারম্যান শাহ আসাদুজ্জামান তপনের খুঁটির জোর কোথায়?
সোনার বাংলা ডেস্ক : গত১৮ এপ্রিল সন্ধ্যায় ফরিদপুর জেলার মধুখালী উপজেলার ডুমাইন ইউনিয়নের পঞ্চপল্লী গ্রামে একটি মন্দিরে আগুন লাগার ঘটনাকে কেন্দ্র করে কোনো তদন্ত-প্রমাণ ছাড়াই দুই সহোদর মুসলিম ভাইকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনার সরাসরি অংশ নিয়েছে ডুমাইন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শাহ আসাদুজ্জামান তপন ও ইউপি সদস্য অজিৎ কুমার সরকার। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, চেয়ারম্যান শাহ আসাদুজ্জামান তপনই আশরাফুলকে শাসিয়ে রড দিয়ে প্রথমে আঘাত করেন।
এ চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস, দুর্নীতির একাধিক অভিযোগ পাওয়া গেছে। গত ২০২৩ সালে ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আশিকুর রহমান চৌধুরীর ওপর হামলা ও গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনায় ডুমাইন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহ আসাদুজ্জামান তপনকে বরখাস্ত করা হয়েছিল। তাকে বরখাস্ত করে প্রকাশিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ইউপি চেয়ারম্যান শাহ আসাদুজ্জামান তপনের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্প আশ্রয়ণ-২-এর কার্যক্রমে বাধা প্রদান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর হামলা ও সরকারি গাড়ি ভাঙচুরে ইন্ধনসহ বিভিন্ন ঘটনায় জড়িত থাকায় স্বীয় পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হলো। গত বছরের ৪ মে আশিকুর রহমান চৌধুরী উপজেলার ডুমাইন ইউনিয়নের নিশ্চিন্তপুর গ্রামে আশ্রয়ণ প্রকল্পের কাজ দেখতে গেলে স্থানীয়রা তার ওপর হামলা করে। এ ঘটনায় করা মামলায় পুলিশ ইতোমধ্যে ইউপি চেয়ারম্যান তপনকে গ্রেফতারও করেছিল। পরে কোর্টের আদেশে পদ ফিরে পেয়েছেন।
সূত্রে প্রকাশ, শাহ আসাদুজ্জামান তপন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণেরও বাইরে এ চেয়ারম্যান। প্রশ্ন হলোÑ তাহলে তার খুঁটির জোর কোথায়?