রমজানের শিক্ষা

ইঞ্জিনিয়ার ফিরোজ আহমাদ
মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর রংগে দুনিয়াকে সাজানো। আল্লাহর রং মানে আল্লাহর গুণাবলী। আল্লাহর গুণে মানুষ তৈরি হলে সে উত্তম মানুষ তৈরি হয়। উত্তম মানুষ সেইই যে আল্লাহর উত্তম বান্দাহ। উত্তম বান্দাহ সেই ব্যক্তি যে আল্লাহকে বেশি করে ভয় করে। আল্লাহকে যে ভয় করে সেই মুত্তাকী বা পরহেজগার। মুত্তাকি হতে হলে যে সব গুণাবলী দরকার তারমধ্যে রোজা অন্যতম। প্রতি বছরে একবার করে রমজান মাস আসে আমাদেরকে রোজার প্রশিক্ষণ দিতে। রোজার তাৎপর্য জানাতে গিয়ে স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামিন, তাঁর কালামে পাকে বলেন- ইয়্যা আইয়্যুহাল্লাজিনা আমানু কুতিবা আলাইকুমুস সিয়ামু কামা কুতিবা আলাল্লাজিনা মিন কাবলিকুম লায়াল্লাকুম তাত্তাকুন। মানে হলো- পূর্ববর্তীদের মতো তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে হে ঈমানদারগণ। উদ্দেশ্য এর দ্বারা সম্ভবতঃ তোমরা মুত্তাকি বা পরহেজগার হতে পারবে। (সূরা বাকারা : ১৮৩) পরহেজগার বা মুত্তাকি যাতে আমরা হতে পারি সে জন্য রোজার আইন চালু করা হয়েছে। রোজা শুধু ফরজ নয়। এটি ইসলামের তৃতীয় রোকন বা ভিত্তি। ইসলামী চরিত্র তথা ইসলামী সমাজ বা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার তৃতীয় অতি গুরুত্বপূর্ণ খুঁটি বা রোকন হলো এই সিয়াম বা রোজা। আল্লাহ পাক দীর্ঘ একটি মাসব্যাপী সুবেহ সাদেক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত খানা পিনা বা যৌন কর্ম না করার নির্দেশ দিয়েছেন। প্রতিদিন ১৪/১৫ ঘণ্টার দৈহিক ও যৌন পিপাসার সংযম করতে হয়। এটাকে বাহ্যিকভাবে উপবাসের অনুষ্ঠান বলা হয়। কিন্তু এর আসল তাৎপর্য হলো এর দ্বারা মুত্তাকি হওয়া। প্রতিটি কাজে আল্লাহকে ভয় করে চলাকেই মুত্তাকি বলে। মুত্তাকির পরিচয় দিতে গিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর একটি হাদীস প্রনিধানযোগ্য। এক সাহাবী মুত্তাকি কি জিনিস তা জানতে চেয়েছেন। রাসূল (সা.) তাদের জিজ্ঞাসা করলেন- “তোমরা কি কখনও কাটায় ঘেরা উঁচুপাহাড়ে উঠেছ?” তিনি জবাব দিলেন- “উঠেছি”। রাসূল (সা.) বললেন- ‘কিভাবে উঠেছ?’ সাহাবী বললেন- ‘গায়ের কাপড়-চোপড় গুছিয়ে আট সার্ট হয়ে খুবই সাবধানে হুঁশিয়ারীর সাথে সামনে বাড়তে হয়।’ রাসূল (সা.) বললেন- “ইহাই মুত্তাকি।” মুত্তাকির পরিচয় দিতে গিয়ে রাসূল (সা.) যে বিষয়টি বুঝিয়েছেন তা হলো- ‘সতর্ক জীবন।” মুত্তাকি বা পরহেজগারী বলতে দাড়ি, টুপি, পাগরী বা লম্বা জামার মধ্যে সীমাবদ্ধ কিছু বহির্দৃশ্য নয়। মুত্তাকি হলো সতর্ক জীবন তথা হিসাব নিকাশ করে চলার নাম মুত্তাকী। একজন ঈমানদার যখন তার পরিপূর্ণ জীবন কাল হিসাব নিকাশ করে চালায় সেই মুত্তাকি হয়।

হিসাব নিকাশ করে চলা মানে কি? এর জবাব বুঝাতে রাসূল (সা.) এর আরো একটি হাদীস প্রনিধানযোগ্য। রাসূল (সা.) বলেছেন- “কিয়ামতের দিন মানুষের পা এক বিন্দু সামনে বাড়তে দেয়া হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না তার কাছ থেকে ৫টি প্রশ্নের উত্তর না নেয়া হবে। তা হলো- (১) তোমার জীবনকাল কিভাবে কাটিয়েছ? (২) তোমার যৌবনের শক্তি সামর্থ্য কিভাবে ব্যয় করেছ? (৩) তুমি আয় কোথা থেকে করেছ? (৪) কোথায় তা ব্যয় করেছ? (৫) তুমি যে জ্ঞান লাভ করেছ সে অনুযায়ী আমল করেছ কি? (তিরমিজি)।” জীবন-যৌবন, আয়-ব্যয়, আর এলেম-আমল সবকিছুতেই পরহেজগারী বা হিসাব নিকাশ থাকতে হবে। পরহেজগার লোক সালাতে দাঁড়িয়ে বলে আর ওয়াদা করে যে “আমরা কেবল তোমারই গোলামী করি এবং কেবল তোমারই সাহায্য চাই” (সূরা ফাতিহা)। নামাজ থেকে ফিরে এসে সে তার ঘর সংসার পরিবার, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি সর্বত্র শুধুই আল্লাহর বিধান মেনে চলে। সে তার জীবন আর অর্থ বাজী রেখে আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ করে। একজন পরহেজগার লোকের স্বাভাবিক চরিত্র হলো যে সে আল্লাহর বিধানের অনুসারী হবে শুধু। সে জানে যে ইসলামই কেবলমাত্র আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য জীবন বিধান। তার পরকালীন জীবনের মুক্তির সাথে এই দুনিয়ার সমস্ত কর্মকাণ্ড জড়িত। পরকালে খোদাকে পেতে হলে এই দুনিয়াতেই, বাস্তব জীবনেই খোদাকে সাথী বানাতে হবে। দিনে ৫ বার সালাত পড়ে, রমজানে রোজা পালন করে, বা হজ করে, জাকাত দিয়ে কিছু অনুষ্ঠান সেরেই পরহেজগার থাকা যায় না। খোদাকে সর্বদা প্রভু মেনে নিয়ে চলা অত সহজ নয় যত সহজ সালাত, রোজা, হজ, জাকাতের অনুষ্ঠান সমাপ্ত করা।

পরহেজগার বা খোদাভীরুতার প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন- “হে ইমানদার লোকেরা তোমরা আল্লাহকে তেমন ভয় কর যেমন ভয় তাকে করা উচিৎ। তোমরা আল্লাহর অনুগত বান্দাহ না হয়ে মরিওনা।” আল্লাহর অনুগত বান্দাহকেই বলে মুসলিম। মুসলমান যে হয় সে তো খোদাকে ভয় করেই চলে। সে বিশ্বাস করে যে দুনিয়ার মানুষ না দেখলেও আল্লাহ পাক সব কিছু দেখেন। আল্লাহর ফেরেস্তা তার আমল আখলাক সবই অডিও, ভিডিও করছে। জবাবদিহি আল্লাহর কাছে একদিন করতেই হবে। সে শুধু আল্লাহর ভয়, আল্লাহর আনুগত্য করেই সঠিক আমল করতে তৎপর থাকে।

হজ- জাকাত আর সালাতের মতো রোজা পালন করার পর ইমানদার তার জীবনে, কথায় - কাজে, রাজনীতি-সমাজনীতিতে সর্বদা ঐ সব এবাদতের মূল দাবি বাস্তবায়নে সদা সতর্ক থাকে।

আমরা মুসলমান। আমরা সালাত, রোজা করি। আমরা উত্তম জাতি। কিন্তু আজ আমরা পরাজিত ও বিপর্যস্ত। আমরা হাজার দলে ভাগাভাগি। আমরা নিঃশক্তি। কেন এই পরিণতি? আজ অবশ্যই আমাদেরকে ভেবে দেখতে হবে। আমরা কোথায় যাচ্ছি। যতই চিন্তা করি সর্বত্রই এক জবাব। আজ আমাদের মাঝে খোদা ভীতি আর খোদা প্রেম বিলীন হয়ে গিয়েছে। তাই আমাদেরকে পুনরায় খোদার পথে ফিরে আসতেই হবে। ইসলামকেই শুধু আঁকড়িয়ে ধরতে হবে।