॥ প্রফেসর ড. আবদুল লতিফ মাসুম ॥
বিজেপি তথা নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকে একের পর এক মুসলিমবিরোধী কার্যক্রম, আইন ও ইস্যু তৈরি করে আসছেন। চরম হিন্দুত্ববাদ এবং মুসলিমবিদ্বেষকে সম্বল করে ১৯৪৭ সালের পর থেকে ভারতের রাজনীতিকদের একাংশ নানা নামে-ধামে দীর্ঘকাল তাদের নেতিবাচক প্রচার অব্যাহত রেখেছে। ১৯৯২ সালে অযোধ্যার তথাকথিত রাম জন্মভূমি ইস্যুকে কেন্দ্র করে তারা মোগল বংশের প্রথম পুরুষ জহির উদ্দীন মোহাম্মদ বাবরের প্রতিষ্ঠিত মসজিদকে ধ্বংস করে। সেদিন সমগ্র ভারতে কমপক্ষে পাঁচ হাজার মসজিদ ধ্বংস হয় বা শাহাদাত বরণ করে। কংগ্রেস রাখঢাক করে মুসলিমবিদ্বেষ লালন করলেও বিজেপি ভদ্রতা-সভ্যতা-সৌজন্যের তোয়াক্কা করেনি। ১৯৮৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিজেপি মাত্র দুটি আসনে জয়লাভ করেছিল। কিন্তু রাম জন্মভূমি আন্দোলনের সময় আবার এ দলের শক্তি বৃদ্ধি পায়। একাধিক রাজ্য নির্বাচনে জয়লাভ এবং জাতীয় স্তরের নির্বাচনে ভালো ফল করার পর অবশেষে ১৯৯৬ সালে বিজেপি সংসদে বৃহত্তম দলে পরিণত হয়। যদিও সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে না পারায় এ দলের সরকার মাত্র ১৩ দিন স্থায়ী হয়েছিল। ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে গুজরাটের দীর্ঘকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি পুনরায় বিপুল ভোটে জয়ী হয়। সে সময়ে গুজরাটে সময়কালের বীভৎস মুসলিমবিরোধী দাঙ্গা ঘটে। সেই থেকে নরেন্দ্র মোদির প্রধানমন্ত্রিত্বে বিজেপি সরকার ভারতে ক্ষমতাসীন রয়েছে। এখন ভারতের অধিকাংশ রাজ্যে বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার রয়েছে। এসব সরকার মুসলিমবিদ্বেষ লালন করছে। দাঙ্গা-হাঙ্গামা, মুসলিম নিধন ও মুসলিমবিরোধী প্রচার নিত্যদিনের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারতের একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অধিকৃত কাশ্মীরের সংবিধান স্বীকৃত বিশেষ মর্যাদা বিলোপ করা হয়েছে। বিভক্ত হয়েছে এ রাজ্য মুসলিম ও হিন্দু সীমারেখায়। মুসলমানদের শিক্ষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের এমন কোনো অংশ নেই, যা হিন্দুত্ববাদী সরকারের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেয়েছে। অবশেষে আইন করে মুসলমানদের বিতাড়নের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এমনই একটি আইন হচ্ছে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন- সিএএ (Citizen Amendment Act 2019)। গত ১১ মার্চ সন্ধ্যায় কেন্দ্রীয় সরকার থেকে এ আইন বাস্তবায়নের ঘোষণা দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে এ আইন পাস করে। শুরু থেকেই এ আইনটি ‘অনুপ্রবেশকারী মুসলমান বিতাড়ন’ প্রক্রিয়া বলে অভিহিত হয়ে আসছে। সারা ভারতে প্রবলভাবে এ আইনবিরোধী আন্দোলন হয়েছে। দিল্লিতে দীর্ঘদিন অবরোধ চলেছে। দাঙ্গাও হয়েছে। বিক্ষোভ-সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছে শতাধিক মানুষ। সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, এ আইন কার্যকর করা নিয়ে ভারতজুড়ে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। আইনটি নিয়ে এরই মধ্যে আসামসহ উত্তর-পূর্ব ভারতে বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। আসামে বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীরা আইনের অনুলিপি পুড়িয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। রাজ্যটিতে ধর্মঘট পালন করেছে বিরোধীদলগুলো। পশ্চিমবঙ্গেও বড় ধরনের বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ আইনে বলা হয়েছে, ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে যেসব হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন ও পার্সি ধর্মীয় সংখ্যালঘু সাম্প্রদায়িক নির্যাতন ও নিপীড়নের কারণে ভারতে চলে এসেছেন, তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। বিরোধিতাকারীদের অভিযোগ, আইনটি ভারতের সংবিধানের পরিপন্থী। কেননা এ আইনে ধর্মীয় কারণে নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্য করা হচ্ছে। অন্যদিকে বিজেপির বক্তব্য, এ আইনে কারও নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হবে না। যারা ধর্মীয় বৈষম্যের কারণে এ দেশে চলে এসেছেন, তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। স্পষ্টত আইনটি মুসলিম বিতাড়নের হীন উদ্দেশ্যেই প্রণয়ন করা হয়েছে। বিতর্কিত এ আইন ভারতে তো বটেই, বিদেশেও আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। সিএএ’র ঠিক আগে ভারতের আসাম রাজ্যে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) তৈরি করা হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল, অবৈধভাবে ভারতে ঢোকা বিদেশিদের চিহ্নিত করে ফেরত পাঠানো। কিন্তু প্রতিবেদন পেশের পর দেখা যায়, রাজ্যে মুসলমানের চেয়ে হিন্দু অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা বেশি। তখন আসামে এনআরসির রূপায়ণ বাতিল হয়ে যায়। যদিও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ২০১৯ সালে বলেছিলেন, ‘এক-দুই করে বলছি, প্রথমে নাগরিকত্ব বিল আনা হবে। তা পাস করা হবে। ধর্মীয় কারণে তিন দেশ থেকে চলে আসা সংখ্যালঘুদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। তারপর এনআরসি হবে এবং সেটা হবে সারা দেশের জন্য।’ অমিত শাহ গত ১০ ফেব্রুয়ারিও বলেছিলেন, লোকসভা ভোটের আগেই সিএএ কার্যকর করা হবে। দৃশ্যত আগামী জাতীয় নির্বাচনে মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দুবিদ্বেষকে প্রাতিষ্ঠানিকতা দেওয়ার প্রয়াস এটি। সেই উদ্দেশ্যেই লোকসভা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে-ভাগে আইনটি সারা দেশে চালু করা হলো। ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিজ্ঞপ্তি জারি করার দিন থেকেই তিন দেশ থেকে ভারতে আসা বাসিন্দারা নাগরিকত্ব পেতে আবেদন করতে পারবেন। আইনটি কার্যকর হওয়ার পর আবারও দেশজুড়ে বিক্ষোভ-সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে। আইনটি জারির রাতেই আসামের বিভিন্ন প্রান্তে সিএএ’র অনুলিপি পোড়ানো শুরু হয়। বিভিন্ন আদিবাসী সমাজের মানুষ একত্র হয়ে রাজ্যের রাজধানী গৌহাটিতে আইনের অনুলিপি পোড়াতে শুরু করেন। এ পরিস্থিতিতে রাজ্যজুড়ে চূড়ান্ত পর্যায়ের সতর্কতা জারি করা হয়েছে। আসামে প্রাথমিকভাবে বিক্ষোভের নেতৃত্ব দেয় পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে বিদেশি অনুপ্রবেশবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া সংগঠন অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (আসু)। আসুর প্রধান উপদেষ্টা সমুজ্জ্বল ভট্টাচার্য স্থানীয় প্রচারমাধ্যমকে বলেন, ‘সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন আমরা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারব না। বিজেপি সরকার আজ আসামের মানুষকে সবচেয়ে বড় ধরনের ধাক্কা দিল। এর ফলে আমাদের জাতিগত পরিচয় ও সংস্কৃতি চাপের মধ্যে পড়ল।’ ২০১৯ সালে আইনটি পাস হওয়ার পরও এর বিরোধিতায় রাজপথে নেমেছিলেন আসামের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সবস্তরের মানুষ। আসামের অন্যতম প্রধান বিরোধীদল কংগ্রেসও কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়েছে। বিধানসভায় কংগ্রেসের নেতা দেবব্রত সইকীয়া বলেছেন, কোনো অবস্থাতেই সিএএ মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। কারণ ১৯৮৫ সালের ‘আসাম অ্যাকর্ড’কে সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে ঠেলে দিয়েছে এ আইন। ‘আসাম অ্যাকর্ড’ বা আসাম চুক্তি বলছে, ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের আগে যারা এসেছেন, তারাই স্বীকৃত ভারতীয় নাগরিক। ওই তারিখের পর যারা এসেছেন, তারা নন। অন্যদিকে সিএএ বলছে, ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের আগে যারা এসেছেন, তারাই স্বীকৃত নাগরিক। অর্থাৎ সিএএ স্বীকৃত নাগরিকের শেষ তারিখ আরও ৪৩ বছর বাড়িয়ে দিয়েছে। এতেই আপত্তি উত্তর-পূর্ব ভারতের মানুষের। আসামসহ উত্তর-পূর্ব ভারতে প্রধানত আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষের বক্তব্য, সিএএ বাস্তবায়িত হলে ৪৩ বছর ধরে উত্তর প্রদেশে বসবাস করছেন এমন মানুষ যারা আদিবাসী নন, তারা আদিবাসী অঞ্চলে জমি কিনতে পারবেন এবং স্থায়ীভাবে বসবাস করতে পারবেন। তারা প্রধানত হিন্দু বাঙালি। এতে জমির ওপর আদিবাসীদের একাংশ তাদের দখল হারাবেন। যদিও এ আইনে আদিবাসী অঞ্চলে জমি কেনাবেচার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। কিন্তু তা যথেষ্ট নয় বলে মনে করছে উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন সংগঠন। আসামের মুখ্যমন্ত্রী বিজেপি নেতা হিমন্ত বিশ্বশর্মাও যে আইনটি বাস্তবায়ন নিয়ে রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার আশঙ্কা করেছেন, তা ইতোমধ্যে প্রমাণ হয়েছে। তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, যেসব রাজনৈতিক দল সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের (সিএএ) বিরোধিতা করবে এবং প্রতিবাদ হিসেবে ধর্মঘটের ঘোষণা দেবে, তাদের রাজনৈতিক প্রতীক বাতিল করতে নির্বাচন কমিশনে আবেদন জানানো হবে। তার এ মন্তব্য থেকে আইনটির রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে প্রয়োগের আশঙ্কা সত্য হতে যাচ্ছে। এদিকে আইনটি কার্যকর করার কঠোর সমালোচনা করেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘কেন চার বছর ফেলে রাখার পর এ সময়ই সিএএ বাস্তবায়িত হতে চলেছে, তা আমরা বুঝতে পারি। সামনেই রমযান মাস শুরু হতে চলেছে, তারপরই আসছে দোল, তারপর রামনবমী। এ সময় এটা চালু করা হচ্ছে।’ তবে এ আইনের জন্য পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে কোনো সমস্যায় পড়তে হবে না বলে রাজ্যবাসীকে আশ্বস্ত করেছেন মমতা।
ভারতের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকমহল ইতোমধ্যেই এ আইনকে মুসলিম নির্যাতনের অজুহাত হিসেবে দেখছেন। তবে ভারত সরকার বলছে, কারো নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার জন্য এ আইন তৈরি হয়নি, বরং দেওয়ার জন্য তৈরি হয়েছে। আইনটির প্রায়োগিক পর্যায়ে দীর্ঘকাল উৎকণ্ঠিত মুসলমানদের উদ্বেগ আরও ঘনীভূত হয়েছে। তারা আশঙ্কা করছে, অনুপ্রবেশকারী বলে তাদের চিহ্নিত করা হবে। সংবাদ মাধ্যমে ইতোমধ্যেই এ আইনটি ‘অনুপ্রবেশকারী মুসলমান বিতাড়ন আইন’ বলে চিহ্নিত হয়েছে। দীর্ঘকাল ধরে লালিত মুসলিমবিদ্বেষই এ আইন তৈরির পটভূমি নির্মাণ করেছে। হিন্দুত্ববাদীদের অভিযোগ প্রতিবেশী মুসলিম রাষ্ট্রগুলো হিন্দুদের বিতাড়ন করেছে। ওইসব দেশে এখনো যেসব হিন্দু বসবাস করছে, তারা নিরাপদ নয়। তাই মুসলমানদের বিশ্বাস করা যায় না। তারা অমুসলমানদের ‘শরণার্থী’ হিসেবে গ্রহণ করছে। মুসলিমদের বলছে ‘অনুপ্রবেশকারী’। মজার ব্যাপার আসামে যে ১৯ লাখ নাগরিকের তালিকা তৈরি করা হয়েছিল, এতে দেখা গেছে ১২ লাখই হিন্দু। সুতরাং বিষয়টি ব্যুমেরাং হয়েছে বিজেপিওয়ালাদের জন্য। আসামে মুসলিম জনগোষ্ঠী নানা ধরনের নিপীড়ন, নির্যাতনের মোকাবিলা করছে। আসামে নাগরিকপঞ্জির মূল কারণ ছিল ‘অসমীয়া জাতীয়তাবাদ’। এর পোশাকি নাম ছিল, ‘বাঙালি খেদাও আন্দোলন’। এখন এটি ‘মুসলিম খেদাও আন্দোলন’-এ পরিণত হয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় মুসলমানদের শুধুমাত্র নাগরিকত্বই কেড়ে নেওয়া হয়নি, তাদের নেওয়া হয়েছে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে অর্থাৎ- বন্দিশিবিরে।
ভারত জন্ম থেকেই ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলছে। বলা হয়, সকল ধর্মের, বর্ণের, জাতের, গোত্রের, লিঙ্গের ও অভিন্নমতের মানুষ- সকলই সমান। অথচ আজকের ভারত একটি ধর্মান্ধ হিন্দু রাষ্ট্র বৈ কিছু নয়। ভারতের দেশপ্রেমিক ও ধর্মীয় সহনশীলতায় বিশ্বাসী মানুষ এ আইনি বিভাজনের বিরোধিতা করছেন। ভারতের নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অমর্ত্য সেন এবং মানবতাবাদী অরুন্ধতি রায়ের মতো বিদ্বজনরা প্রতিবাদ করছেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, এ নীতি অব্যাহত রাখলে বিভাজিত হবে ভারত। এর অস্তিত্ব বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। বৈচিত্র্যের মাধ্যমে যে ঐক্য এতদিন ভারতের সীমানা পাহারা দিয়েছে, তা হবে ভঙ্গুর।