এডভোকেট সাবিকুন্নাহার মুন্নী : প্রবাদ আছে, ‘মাছের পচন শুরু হয় মাথা থেকে’। সেই দৃষ্টিতে কোনো জাতির শিক্ষকসমাজ জাতির মস্তিষ্ক বা জাতির বিবেক। তাদের স্থান ও মর্যাদা থাকে সবার ওপরে। তাদের মাঝেই যখন অবক্ষয় শুরু হয়ে যায়, তখন জাতির পতন আর ঠেকায় কে?
সম্প্রতি দেশে উচ্চশিক্ষার পাদপীঠ স্থানে এমন কিছু শিক্ষক নামের কলঙ্ক ঠাঁই পেয়েছেন, যারা শিক্ষক হিসেবে গোটা জাতির সুনাম-সুখ্যাতিকে কলঙ্কিত করছেন। শিক্ষকের মর্যাদাকে ভূলুণ্ঠিত করছেন। এসব দলীয় নষ্ট রাজনীতির সারথিরা প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে যাচ্ছেতাইভাবে ব্যবহার করছেন পৈতৃক সম্পত্তি ও প্রতিষ্ঠানের মতো।
আগামী প্রজন্মের মেধার লালন বিকশিতকরণের স্থানে রক্ষক হয়ে ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। সম্প্রতি ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম, ইসলামী, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং সিরাজগঞ্জে মনসুর আলী মেডিকেল কলেজে ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে।
তাদের দ্বারা সংঘটিত একের পর এক ঘটে যাওয়া কুকীর্তিগুলো অভিভাবক ও দেশের সচেতন সমাজকে শঙ্কিত করে তুলেছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র নেতাদের ন্যক্কারজনক ঘটনা ছাপিয়ে এখন পত্রপত্রিকায় শিক্ষকসমাজের নৈতিক অধঃপতনের সংবাদগুলো গোটা জাতিকে বিস্মিত করেছে। শিক্ষকসমাজের এহেন কেলেঙ্কারিতে প্রশ্ন উঠেছে আজ সর্বমহলে- এই কি হচ্ছে পিতৃতুল্য শিক্ষকসমাজের চরিত্র?
গত কয়েকদিন ধরে পত্রিকার হেডিংগুলোই শুধু তুলে ধরলাম
দেশে শিক্ষার সর্বোচ্চ পাদপীঠ বলে খ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ভয়ঙ্কর এক যৌন নিপীড়নের চিত্র উঠে এসেছে-
# বিএসএমএমইউ অধ্যাপকের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির মামলা : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) এক অধ্যাপকের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ এনে মামলা করেছেন তার এক নারী সহকর্মী। গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে শাহবাগ থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে এ মামলা করেন বিএসএমএমইউয়ের অন্য একটি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ওই নারী। (দৈনিক প্রথম আলো : ৭ ফেব্রুয়ারি)।
# চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ; চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ, তদন্ত কমিটি গঠন। (১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ইউএনবি)।
# এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগে তোলপাড়।
যৌন হয়রানির অভিযোগ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বরখাস্ত। প্রাথমিকভাবে যৌন হয়রানির অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় শিক্ষককে একাডেমিক সব কার্যক্রম থেকে বরখাস্ত করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। (দ্য ডেইলি স্টার বাংলা)।
# ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ ছাত্রীর।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের এক অধ্যাপকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি ও মানসিক নিপীড়নের অভিযোগ করেছেন একই বিভাগের এক ছাত্রী। ওই শিক্ষকের ‘কৃতকর্মের’ সুষ্ঠু তদন্তসাপেক্ষে তার বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন অভিযোগকারী ছাত্রী। (দৈনিক প্রথম আলো : ১০ ফেব্রুয়ারি)।
# সিরাজগঞ্জে মনসুর আলী মেডিকেল কলেজের শিক্ষক ডা. রায়হান শরীফ কর্তৃক ছাত্রকে গুলি।
মনসুর আলী মেডিকেল কলেজে ছাত্রকে গুলি করলেন শিক্ষক। (৪ মার্চ বাংলা নিউজ)। শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজে ক্লাস চলাকালে আরাফাত আমিন তমাল নামে এক ছাত্রের ওপর গুলি চালিয়েছেন ডা. রায়হান শরীফ নামে এক শিক্ষক। গুলিটি ওই ছাত্রের ঊরুতে লেগেছে। শিক্ষার্থীদের কাছে জানা যায়, কথায় কথায় তিনি পিস্তল বের করতেন, থামাননি কেউ। গ্রেফতারের পর তার জবানবন্দিতে যে তথ্য উঠে আসে, তা শুনে হাসব কী কাঁদব- বুঝতে পারছি না। তিনি জানান, হিন্দি সিনেমা দেখে পিস্তল রাখতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন।
# কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানির ঘটনায় দিনভর বিক্ষোভ- দুই শিক্ষককে বাধ্যতামূলক ছুটি। (দৈনিক সংগ্রাম-১৪ মার্চ)। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীকে যৌন হয়রানি ও হেনস্তার ঘটনায় দুই শিক্ষককে অনির্দিষ্টকালের জন্য বাধ্যতামূলক ছুটি দেওয়া হয়েছে। গতকাল বুধবার (১৩ মার্চ) বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সঞ্জয় কুমার মুখার্জী গণমাধ্যমকে এ তথ্য নিশ্চিত করেন। তারা হলেন- বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবসম্পদ ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক রেজুয়ান আহমেদ শুভ্র ও একই বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সাজন সাহা।
# জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীর আত্মহত্যায় তোলপাড়- ছাত্র শিক্ষক গ্রেফতার।
আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আগে নিজের ফেসবুক পেজে দীর্ঘ একটি লেখা পোস্ট করেন অবন্তিকা।
তিনি লেখেন, ‘আমি যদি কখনো সুইসাইড করে মারা যাই, তবে আমার মৃত্যুর জন্য একমাত্র দায়ী থাকবে আমার ক্লাসমেট আম্মান সিদ্দিকী, আর তার সহকারী হিসেবে তার সাথে ভালো সম্পর্ক থাকার কারণে তাকে সাপোর্টকারী জগন্নাথের সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম।’
এসব অভিযোগ যদি সত্য প্রমাণ হয়, তাহলে বুঝতে হবে যারা শিক্ষকতা করছেন তাদের নীতি-নৈতিকতার মারাত্মক অধঃপতন হয়েছে। এটা হওয়া মোটেও উচিত নয়। একজন শিক্ষকের নীতি-নৈতিকতায় ঘাটতি দেখা দিলে এবং তা যদি শিক্ষার্থীর ক্ষতির কারণ হয়, তাহলে তার প্রভাব গোটা সমাজে পড়বে। তাই এ ধরনের ঘটনা যেন না ঘটে, সেজন্য কার্যকর ও ত্বরিত পদক্ষেপ নিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে একের পর এক ঘটে যাওয়া ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে অবশ্যই দেশের প্রচলিত আইন ও বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। না হলে এ ধরনের অপরাধ বাড়তেই থাকবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এ ধরনের অনৈতিকতা ও বিকৃতি সচেতন সমাজকে দারুণভাবে চিন্তিত করেছে, উদ্বেগের মধ্যে ফেলেছে। আগামী প্রজন্মকে রক্ষার দায়িত্ব আজ কাদের হাতে গিয়ে পড়েছে। বিগত কয়েক বছর ধরে এ ধরনের ঘটনা প্রায়ই ঘটতে দেখা যাচ্ছে। কোনোটা খবরের পাতায় সংবাদ হয়ে আসছে আর অধিকাংশই হয়তো খবরের অগোচরেই রয়ে গেছে। এসব ঘটনার মূল কারণ হচ্ছে- শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে অধিকাংশই এখন মেধা ও নৈতিকতার পরিবর্তে দলীয় পরিচয় প্রাধান্য পাচ্ছে। যার কারণে মানুষ গড়ার আঙিনায় এখন মানুষ হওয়া তো দূরের কথা, দিন দিন অমানুষ তৈরি হচ্ছে।
হাস্যকর মনে হয়, যখন এ ধরনের শিক্ষকরাই নিজেদের পিতার মতো দাবি করে, হিজাব ও নিকাবের বিরুদ্ধে কণ্ঠ উচ্চকিত করে। গত দেড় দশক ধরে অধিকাংশই নিয়োগ পাচ্ছে এমন সব ধর্ষণে সেঞ্চুরি করা মানিক-রতনরা। এখানে হয়তো কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান এসেছে। প্রকৃত হিসাব পেলে দেখা যাবে বাংলাদেশের কোনো প্রতিষ্ঠানের নামই হয়তো বাদ পড়বে না। কারণ প্রায় প্রতিটি নিয়োগেই দীর্ঘ হচ্ছে এমন মানিক-রতনদের মিছিল।
সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় বলতে হচ্ছে, দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো যেন আজ নিপীড়ন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। মানুষ গড়ার কারিগর যখন নিজেই হন কলুষিত হৃদয়ের, তখন আলোর মশাল থাকবে কার হাতে, আর জাতিকে পথ দেখাবেই-বা কে?
এ কীসের আলামত। এ অবস্থায় আগামী প্রজন্মের নিরাপত্তা কার কাছে ও কোথায়? জবাব দেয়ার মতো সৎ সাহস রেসপন্সিবল কোনো অথরিটির আছে কি?
লেখক : নির্বাহী পরিচালক, মানবাধিকার ও আইনী সুরক্ষা কেন্দ্র(মাসুক)- মাসুক।