৪টি স্থল করিডোর, ২টি বন্দর ও রেল ট্রানজিটের পর এবার
ভারতকে তেতুলিয়া করিডোর!
॥ জামশেদ মেহ্দী॥
কথায় বলে, যত পায় তত চায়। প্রায় ১৬ বছর আগে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ভারত বাংলাদেশের কাছ থেকে শুধু চেয়েই এসেছে। আর বাংলাদেশ সরকারও শুধু দিয়েই যাচ্ছে। ভারতের এ চাওয়ার যেমন বিরাম নেই, তেমনি বাংলাদেশও দিতে দিতে কোনো সময় ক্লান্ত হয় না। ভারতের সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল উত্তর-পূর্ব ভারতের ৭ রাজ্যের (সেভেন সিস্টার্স) স্বাধীনতা সংগ্রাম। সে সমস্যা সমাধানের চাবিকাঠি ছিল বাংলাদেশের হাতে। আওয়ামী লীগ সরকার ১৬ বছর আগে ক্ষমতায় আসার পর সে চাবি ভারতের নিকট হস্তান্তর করেছে। দ্বিপক্ষীয় বা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক গড়ে তোলা এবং সেটা রক্ষা করা একটি দেয়া-নেয়ার ব্যাপার। পৃথিবীর সব দেশ এ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে যতই বন্ধুত্বের বুলি কপচাক না কেন, উভয় দেশের মধ্যে দেয়া-নেয়ার ক্ষেত্রে ইকুইলিব্রিয়াম বা ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত না হলে সম্পর্ক যেমন গড়ে ওঠে না, তেমনি ঘনিষ্ঠও হয় না। উত্তর-পূর্ব ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম দমনের যে চাবিকাঠি ছিল বাংলাদেশের হাতে, সেটিকে ভারত বাংলাদেশের বার্গেইনিং বা দরকষাকষির ক্ষেত্রে ট্রাম্প কার্ড বলা যেতে পারে।
উত্তর-পূর্ব ভারতের নিরাপত্তার সমস্যাটি সমাধান হওয়ার পর ভারত চাইল ট্রানজিট। ওরা এটিকে ট্রানজিট বললেও এটি আসলে করিডোর। এক দেশ থেকে আরেক দেশে যাওয়ার নাম ট্রানজিট। কিন্তু একই দেশের একটি অঞ্চল থেকে আরেকটি অঞ্চলে যাওয়ার জন্য যদি অন্য দেশের ভেতর দিয়ে যেতে হয়, তাহলে অন্য দেশের মধ্য দিয়ে যাওয়ার রাস্তা-ঘাটকে বলে করিডোর। পৃথিবীতে করিডোর প্রদান বা ব্যবহারের কোনো নজির নেই। যেহেতু বিষয়টি করিডোর, তাই ঐ করিডোর শব্দটিকে আড়াল করার জন্য ভারত এবং বাংলাদেশের ভারতপ্রেমী গোষ্ঠী কত নতুন নতুন পরিভাষাই না আমদানি করেছে। কখনো বলা হয়েছে ট্রান্সশিপমেন্ট আবার কখনো কখনো বলা হয়েছে কানেক্টিভিটি। তবে ঘুরেফিরে ব্যাপারটি ঐ করিডোরেই ঠেকেছে। সেই করিডোরও ভারত পেল। বাংলাদেশের ৪টি পয়েন্ট থেকে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতে প্রবেশের ৪টি করিডোর দেওয়া হয়।
৪টি রুটে করিডোর তো তারা পেল। কিন্তু এবার এলো নতুন ফর্দ নিয়ে। এটি হলো, তাদের ট্রান্সশিপমেন্টের জন্য চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহার। এসব আবদার তারা বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই করে আসছিল। কিন্তু বিএনপি বা এরশাদ সরকার ঐ সুবিধা দেয়নি। এমনকি আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় সরকারও (১৯৯৬) বিরূপ জনমত লক্ষ করে ঐ সুবিধা দিতে সাহস পায়নি। কিন্তু তৃতীয় মেয়াদে এসে (২০০৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত) তারা এ বন্দর সুবিধা দেয়।
বন্দর সুবিধা বলতে কী বোঝায়? ধরা যাক কলকাতার কোনো পণ্য ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পরিবহন করা হবে। সেক্ষেত্রে সেই পণ্য কলকাতা বন্দরে জাহাজ বোঝাই করা হবে। অতঃপর ঐ জাহাজটি সমুদ্রপথে চট্টগ্রাম বা মংলা বন্দরে এসে ঐ পণ্য খালাস করবে। তারপর সেখান থেকে ট্রাক বা লরিযোগে উত্তর-পূর্ব ভারতের ৭টি রাজ্যে প্রেরণ করা হবে। বিদেশ থেকে আগত ভারতীয় পণ্যের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটবে। তবে চট্টগ্রাম বা মংলা বন্দর থেকে কোন দেশের ট্রাক বা লরি ঐ পণ্য নিয়ে সেভেন সিস্টার্সে যাবে, সেই ব্যাপারটি এখনো ক্লিয়ার নয়। এছাড়া ভারত যেহেতু বিশাল একটি দেশ এবং তার মালামাল পরিবহনও একটি বিশাল ব্যাপার, তাই ভারত দাবি করেছে যে, চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরের একটি বিশেষ অংশ শুধুমাত্র ভারতীয় পণ্য হ্যান্ডলিংয়ের জন্য বরাদ্দ করা হোক। এ বিষয়টি সম্পর্কে কোনো স্পষ্ট সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে কিনা, সেটা আমাদের জানা নেই। যাই হোক, আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের এ তৃতীয় বৃহত্তম দাবিটিও মেনে নেয়।
জনগণ; বিশেষ করে শিক্ষিত মানুষজন ভেবেছিলেন, করিডোর প্রদান পর্ব বুঝি এখানেই শেষ হলো। কিন্তু না। এখন দেখা যাচ্ছে, ঐ ৪টি করিডোর নিয়েও তারা সন্তুষ্ট নয়। এখন আবার তারা আরেকটি পয়েন্ট থেকে করিডোর পাওয়ার দাবি তুলেছে। এ করিডোরটির নাম ভারতীয়রাই দিয়েছে তেঁতুলিয়া করিডোর। এ করিডোর প্রদান বিষয়টি দুই দেশের মধ্যে কোন্ পর্যায়ে রয়েছে, সেটি আমাদের জানা নেই। কিন্তু জলপাইগুড়ির ঐ সীমান্ত এলাকায় লোকসভার নির্বাচনে বিজেপি প্রার্থী এলাকাবাসীর নিকট ওয়াদা করেছেন, যদি তিনি নির্বাচিত হন, তাহলে তেঁতুলিয়া করিডোর নির্মিত হবে। সাংবাদিকরা বিজেপি প্রার্থীকে প্রশ্ন করেছিলেন, বাংলাদেশ কি তেঁতুলিয়া করিডোর প্রদানে সম্মত হয়েছে? উত্তরে তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরকারের সাথে ইতোমধ্যেই এ বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়েছে। ভারতের লোকসভা নির্বাচন শেষ হলে বাংলাদেশ এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেবে।
ভারতীয়দের কাছে এ প্রস্তাবিত রুটের পোশাকি নাম ‘তেঁতুলিয়া করিডোর’- যে পথে চলাচলের অধিকার পেলে পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চলে একটা বিস্তীর্ণ অংশের মানুষের কলকাতা যাতায়াত করাটা অনেক সহজ হয়ে যাবে বলে তারা মনে করে। এখন রাজগঞ্জ, মেখলিগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকার মানুষকে শিলিগুড়ি হয়ে ঘুরপথে পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতায় যেতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে সোয়া চার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে পারলে সেই দূরত্বটা প্রায় একশো কিলোমিটার কমে যাবে। সাথে সময় ও খরচ বাঁচবে, রাস্তায় শিলিগুড়ির মতো ব্যস্ত শহরকেও এড়িয়ে যাওয়া যাবে। এজন্যই দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে এ ‘করিডোর’র অধিকার বা ‘রাইট টু প্যাসেজ’ চাইছে ওখানকার মানুষ। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, জলপাইগুড়ির এ আসনে বর্তমানে লোকসভার সদস্য রয়েছেন বিজেপির জয়ন্ত রায়। এবারো তিনিই বিজেপির প্রার্থী এবং তিনিই বলেছেন যে, এবার তেঁতুলিয়া করিডোর নির্মিত হবে।
জলপাইগুড়ি আসনে বিজেপি প্রার্থী জয়ন্ত রায়ের প্রচারণাকালে বিবিসি বাংলাকে জয়ন্ত রায় বলেন, ‘অবশ্যই আলোচনা শুরু হয়েছে। হলদিবাড়ি-চিলাহাটি রেল সংযোগ যদি আমরা চালু করতে পারি, তাহলে এ করিডোরও অবশ্যই পারব।’ তার বক্তব্য, এ করিডোর আসলে জলপাইগুড়ির মানুষের খুবই দরকার- কারণ এটা হলে কলকাতার সঙ্গে ওই জেলার দূরত্ব প্রায় ১০০ কিলোমিটার কমে যাবে।
প্রস্তাবিত করিডোরটা হলো মূলত জলপাইগুড়ির রাজগঞ্জ ব্লকে চাউলহাটি নামে একটি গ্রাম থেকে শুরু হয়ে, বাংলাদেশের তেঁতুলিয়ার মধ্য দিয়ে সোয়া চার কিলোমিটার দীর্ঘ একটি রাস্তা হবে- যা অন্য পারে গিয়ে মিশবে উত্তর দিনাজপুর জেলার চোপড়া ব্লকে। রাস্তার অনেকটা অংশ বাংলাদেশের ভেতরে তৈরিও হয়ে আছে- এখন বিজেপি নেতারা চাইছেন ‘সেটার কাজ শেষ করে তা ভারতীয়দের ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হোক।’
উল্লেখ করা যেতে পারে যে, গত বছর ত্রিপুরাসহ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর জন্য ৪টি করিডোর অনুমোদন করেছে বাংলাদেশ। অনুমোদিত ওই চারটি রুট হলো- চট্টগ্রাম বন্দর-আখাউড়া-আগরতলা, মংলা বন্দর-আখাউড়া-আগরতলা, চট্টগ্রাম-বিবিরবাজার-শ্রীমন্তপুর ও মংলা বন্দর-বিবিরবাজার- শ্রীমন্তপুর। এক সংবাদ সম্মেলনে ত্রিপুরার শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী সান্তনা চাকমা বলেছেন, ভারতীয় ব্যবসায়ীদের পণ্য পরিবহনের জন্য চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের বিষয়ে বাংলাদেশ ও ভারত একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। ত্রিপুরাসহ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোয় পণ্য পরিবহনের জন্য ৪টি রুটের অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। এসব রুটে যান চলাচল ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে।
ইতোমধ্যেই যে ৪টি রুটে ভারতকে বাংলাদেশ করিডোর দিয়েছে সে সম্পর্কে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যে কানেক্টিভিটি সৃষ্টি হয়েছে, তার ফলে ত্রিপুরা রাজ্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার গেটওয়েতে পরিণত হয়েছে।
এ করিডোর সম্পর্কে বুয়েট প্রফেসর বিশিষ্ট যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ড. মো. শামসুল হক বলেন, এ করিডোর দেওয়ার ফলে উত্তর-পূর্ব ভারত থেকে পশ্চিমবঙ্গ বা অন্যান্য প্রদেশে যেতে পাড়ি দিতে হতো ১৭৫০ কিমি. পথ। এখন করিডোরের ফলে সেটি কমে হয়েছে মাত্র ৫৫০ কিমি. পথ। অর্থাৎ তাদের ১২০০ কিমি. পথ কম মাড়াতে হচ্ছে। করিডোর প্রদানের পূর্বে এ ১৭৫০ কিমি. পথ অতিক্রম করতে ব্যয় হতো ৩৬ ঘণ্টা। এখন ব্যয় হবে মাত্র ১০ ঘণ্টা। অর্থাৎ তাদের ট্রাভেল টাইম বেঁচে গেল ২৬ ঘণ্টা। যেহেতু দূরত্ব এবং সময় উভয়ই কমে যাওয়ার অবশ্যম্ভাবী ফল হিসেবে মানুষের ভ্রমণ এবং মাল পরিবহনের খরচও বিপুল পরিমাণে কমে গেল।
আরেকটি করিডোর দেওয়া হয়েছে, যেটা মোদি সরকার তাদের ল্যান্ডমার্ক অ্যাচিভমেন্ট হিসেবে প্রচার করছেন। সেটি হলো আখাউড়া-আগরতলা রেল ট্রানজিট। আখাউড়া-আগরতলা রেল ট্রানজিটের দৈর্ঘ্য মাত্র ১২ মাইল। আগরতলার নিশ্চিন্তপুরে ভারতীয় রেলস্টেশন স্থাপিত হয়েছে। এখন এটি উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রথম আন্তর্জাতিক রেলস্টেশন এবং ইমিগ্রেশন কেন্দ্র। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ মোহাম্মদ সিকান্দার খান প্রশ্ন তুলেছেন, ভারতকে তো আমরা সবই দিলাম। যা চাচ্ছে, তাই দিলাম। এখন তেঁতুলিয়া করিডোর চাচ্ছে, তাও সম্ভবত দেওয়া হবে। ভারতীয় নেতৃবৃন্দ এবং সংবাদপত্রে উল্লাস প্রকাশ করে বলা হচ্ছে যে, এ রেল ট্রানজিটের ফলে বদলে যাচ্ছে সমগ্র উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ভাগ্য।
আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক উত্তর-পূর্ব ভারতের ৭টি রাজ্যের স্বাধীনতা সংগ্রাম দমনে ভারতকে সাহায্য করা, ৪টি স্থল করিডোর দেওয়া, একটি রেল করিডোর দেওয়া, চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহার করতে দেওয়া এবং সেখান থেকে মালামাল ট্রান্সশিপমেন্টের অনুমতি দেওয়া- এ সবকিছু অবহেলিত এবং পশ্চাৎপদ সেভেন সিস্টার্সের ভাগ্য দারুণভাবে বদলে দেবে। কিন্তু বিনিময়ে বাংলাদেশ পেলো কী? কী পেলো সেটি বিধৃত হয়েছে নিচের কবিতার কয়েকটি লাইনে।
‘রিক্ত আমি, সিক্ত আমি
দেওয়ার কিছু নাই;
আছে শুধু ভালোবাসা
দিয়ে গেলাম তাই’।
কিন্তু আসমুদ্র হিমাচল ভারতের কি তাই বলে কিছুই দেওয়ার নেই? তারা কি শুধু সীমান্তে বাংলাদেশিদের গুলি করে মারবে? তারা কি তিস্তার পানি আটকে দিয়ে উত্তরবঙ্গকে মরুভূমি বানাবে? আরো ৫ টি অভিন্ন নদীর পানি ন্যায্যভাবে বণ্টন না করে বাংলাদেশকে পানিতে মারবে? তারপরও কি আমরা সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেনের ভাষায় বলবো, ‘ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক স্বামী-স্ত্রীর মতো’?
এ পাতার অন্যান্য খবর
- দুঃশাসনের গ্রাসে পরিবেশ বিপর্যয়ের কবলে দেশ
- ঢাকা-দোহা ১০ চুক্তি সই
- বিপদে-আপদে জনগণের পাশে দাঁড়াতে হবে : শফিকুর রহমান
- বাড়ছে জামায়াতে ইসলামীর প্রভাব
- বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির কড়া সমালোচনা যুক্তরাষ্ট্রের
- আদালত চত্বর থেকে রাজশাহী নগর জামায়াতের সেক্রেটারিসহ আটক ১০
- সারা দেশে ইসতিস্কার নামায
- ঈদের পর ফের অস্থির নিত্যপণ্যের বাজার