রেজি : ডিএ ৫১৭ ॥ ৬৩ বর্ষ : ৭ম সংখ্যা ॥ ঢাকা, শুক্রবার, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১ ॥ ১ জিলকদ ১৪৪৫ হিজরী ॥ ১০ মে ২০২৪

আইএমএফের চাপে কমানো হচ্ছে টাকার মান, বাড়বে ডলারের দাম

মূূল্যস্ফীতি দ্বিগুণের আশঙ্কা

॥ উসমান ফারুক ॥
তিন বছরে ডলারের খরচ কমিয়ে অর্ধেকে নামিয়ে আনা হলেও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ছে না। যদিও সরকার দাবি করছে, এ সময়ে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বেড়েছে। এতে বাংলাদেশের অর্থনীতির তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে সবাই। রিজার্ভ দেখভালের দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকও বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে বলে মনে করছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। অর্থনীতির প্রধান এ সমস্যা সমাধানে আইএমএফ বলেছে টাকার মান আরো কমিয়ে ফেলতে। সংস্থাটি মনে করছে, মূলত অর্থপাচার বন্ধ না হওয়ায় রিজার্ভ বাড়ছে না। উপায়ন্তর না পেয়ে টাকার মান কমাতে রাজি হয়েছে সরকার। ফলে বছর শেষে ডলারের বিপরীতে টাকার মান আরো দুর্বল হয়ে ১৩৫ টাকায় নামতে পারে বিনিময় হার। এতে মূল্যস্ফীতির পাগলাঘোড়া আরো তীব্র গতিতে ছুটে ১০ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশে উঠতে পারে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি ২৫ শতাংশে উঠতে পারে। ডলার আরো দামি হলে কাঁচামাল আমদানি করতে না পেরে বন্ধ হবে কলকারখানা। কর্মসংস্থান হারিয়ে বেকারের সংখ্যা বেড়ে যাবে। এমনিতেই গত তিন মাসে এক লাখ ২০ হাজার বেকার বেড়েছে দেশে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এককেন্দ্রিক সরকারে জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা না থাকায় আর্থিক খাত খাদের কিনারে চলে গেছে। জনকল্যাণের চেয়ে অর্থপাচারকারীদের সহযোগিতা করছে প্রশাসন ও সরকারে থাকা দুর্নীতিবাজরা। অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম হওয়ায় বৈদেশিক রিজার্ভ দিন দিন কমে যাচ্ছে। আর্থিক খাতের দুর্নীতিবাজরা ফুলেফেঁপে মোটাতাজা হচ্ছে। এটি সম্ভব হয়েছে গণতন্ত্রের অভাবে শক্তিশালী বিরোধী রাজনৈতিক দল না থাকায়। অন্যদিকে সরকার বিরোধীদলকে নির্মূল করতে ব্যস্ত। এভাবে বিরোধী রাজনৈতিক দল নির্মূল করতে গিয়ে অর্থনীতি, সাধারণ মানুষ ও দেশকে খাদের কিনারায় নিয়ে গেছে সরকার। চলমান অর্থনৈতিক সংকট সমাধানের একমাত্র উপায় হচ্ছে রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা পুনরুজ্জীবিত করা। সব রাজনৈতিক দল এক না হলে খাদের কিনারায় যাওয়া অর্থনীতি যেকোনো সময় ভঙ্গুর হয়ে যাবে।
তলানিতে রিজার্ভ : বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, প্রায় তিন বছর আগে ২০২১ সালের আগস্ট মাসে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলার। এখন নিট রিজার্ভ নেমেছে মাত্র ১৬ বিলিয়ন ডলারের ঘরে। অর্থাৎ এ সময়ে রিজার্ভ কমেছে তিন ভাগের দুই ভাগ বা ৩২ বিলিয়ন ডলার। যেকোনো দেশের আর্থিক অবস্থান ও স্থিতিশীলতার প্রধান মানদণ্ড হচ্ছে তার বৈদেশিক মুদ্রা তথা সম্পদের পরিমাণ কত। বৈদেশিক মুদ্রাই বিভিন্ন দেশে ও অভ্যন্তরে বিভিন্ন সম্পদে বিনিয়োগ করা থাকে।
এ বিনিয়োগের বিপরীতে বছর শেষে লাভ আসে। আবার বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দেনদরবারে, হঠাৎ কোনো ঝুঁকি সামলাতে এ রিজার্ভ অর্থনীতিকে সহায়তা করে থাকে। এ কারণে যে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ যত বেশি, তার সক্ষমতা তত বেশি। দেশটির মুদ্রার মান তত বেশি শক্তিশালী হয়। এতে আমদানি বাণিজ্যে তত বেশি লাভবান হয় দেশটি। আবার বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বেশি হলে বিদেশি বিনিয়োগ বেশি আসে। কারণ হচ্ছে, তখন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা মনে করেন, প্রয়োজনে ইচ্ছেমতো অর্থ তারা ফিরিয়ে নিতে পারবেন। কিন্তু ডলার সংকটে গ্রামীণফোনের লভ্যাংশ নিজ দেশে নিতে পারছেন না বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। আর সংকট এতটাই গভীরে নেমেছে যে, উড়োজাহাজ পরিচালনাকারী সংস্থাগুলো বাংলাদেশ থেকে টিকিট বিক্রির টাকাও নিতে পারছেন না।
এমন প্রেক্ষাপট গত প্রায় তিন বছর ধরেই চলছে বাংলাদেশে। সময় পার হলেও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি চোখে পড়ছে না। বাধ্য হয়ে ২০২১ সালে বাংলাদেশ ঋণ চায় আইএমএফের কাছে। ঋণ চুক্তিতে যাওয়ার পরও দুই বছরে আইএমএফের দেওয়া লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রিজার্ভ উন্নীত করতে পারেনি বাংলাদেশ। ঋণের তৃতীয় কিস্তি অনুমোদনের শর্ত ছিল নিট রিজার্ভ অন্তত ২০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা। কিন্তু বাংলাদেশ এখন নিট রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করছে না। গ্রস হিসাবে রিজার্ভ দেখাচ্ছে ২০ বিলিয়ন ডলারের কম। আইএমএফ বলেছে, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো নিট বা প্রকৃত রিজার্ভ তথ্য প্রকাশ করতে।
আরো কমবে টাকার মান
রিজার্ভ বাড়াতে না পারলে বাংলাদেশ ঋণের টাকাও দিতে পারবে না আইএমএফকে। অর্থ ফেরত পেতে এবার সংস্থাটি নিজ উদ্যোগেই ঋণের সমপরিমাণ রিজার্ভ বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। এজন্য ডলারের বিপরীতে টাকার মান আরো কমানোর কথা বলেছে সরকারকে। টাকার মান না কমালে ঋণের তৃতীয় কিস্তি ছাড় করবে না সংস্থাটি তা সরকারকে জানিয়েও দিয়েছে।
উপায়ন্তর না দেখে ডলারের বিপরীতে টাকার মান আরো কমাতে আইএমএফের প্রস্তাবে রাজি হয়েছে সরকার। এতে চলতি বছর শেষে টাকার মান ডলারের বিপরীতে আরো দুর্বল হয়ে ১৩৫ টাকায় নামতে পারে বিনিময় হার। বর্তমানে ডলারের বিপরীতে বিনিময় হার ব্যাংকে ১১০ টাকা। আমদানি পর্যায়ে তা ১১৫-১১৬ টাকা ও খোলাবাজারে ১১৮ টাকা।
গত প্রায় সাড়ে চার মাস ধরে টাকার বিনিময় হার একই অবস্থানে রয়েছে। টাকার এ মান ধরে রাখা নিয়ে আইএমএফ ও অর্থনীতিবিদরা সমালোচনা করে আসছেন। অন্যান্য দেশ; এমনকি প্রতিবেশী ভারতের মুদ্রা রুপির মানও ওঠানামা করছে। সেখানে বাংলাদেশে টাকার মান জোর করে ধরে রাখা হচ্ছে। টাকার এ মান ধরে রাখা নিয়ে ব্যবসায়ীরাও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছেন। তারা শঙ্কার মধ্যে রয়েছেন না জানি কখন আবার কত পড়ে যায়।
তথ্যানুযায়ী, গত তিন বছরে পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মান কমেছে বাংলাদেশি টাকার। আইএমএফের শর্ত মানলে বছর শেষে ডলারের বিপরীতে টাকার মান ১৩৫ টাকা ছুঁবে বিনিময় হারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, টাকার মান ধরে রাখা হচ্ছে কৃত্রিমভাবে। এখন শঙ্কা জাগছে, বিনিময় হারের ওপর নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিলে টাকার মান ১৩৫ টাকার ওপরেও চলে যেতে পারে।  আইএমএফের লক্ষ্যমাত্রা পূরণের চেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশের মুদ্রার মান কমে যাওয়া।
টাকার মান আরো দুর্বল করতে আইএমএফ শর্ত দিয়েছে বিনিময় হার বাজারের ওপরে ছেড়ে দিতে। বর্তমানে ডলারের বিপরীতে টাকার মান নির্ধারণ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ডলারের দর ঘোষণা করছে ব্যাংক খাতের দুটি সংগঠন ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন এবিবি (এসোসিয়েশন অব ব্যাংকারস, বাংলাদেশ) আর বাফেদা (বাংলাদেশ ফরেইন এক্সচেঞ্জ ডিলারস এসোসিয়েশন)। আইএমএফ বলেছে, এ পদ্ধতি তুলে দিতে হবে। এখন থেকে ডলারের বিপরীতে টাকার মান নির্ধারণ করা হবে আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে। এজন্য সংস্থাটির উদ্যোগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ২০ কর্মকর্তাকে সম্প্রতি ভারতে অবস্থিত আইএমএফের আঞ্চলিক কার্যালয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে আনা হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়ে টাকার মান আরো কমে গেলে মধ্যবিত্ত, নিম্ন আয় ও দরিদ্র শ্রেণির জীবন চালানো দুরূহ হয়ে পড়বে। সংসার খরচ বেড়ে যাবে, কিন্তু আয় বাড়বে না। এতে বর্তমান মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশ থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে বৃদ্ধি পাবে। সরকারি হিসাবেই খাদ্য মূল্যস্ফীতি এখন সাড়ে ১২ শতাংশে রয়েছে। বেসরকারি হিসাবে তা ২০ শতাংশের ওপরে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাজার সিন্ডিকেটের কারণে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৩০ শতাংশের ঘর ছুঁয়ে যেতে পারে।
বন্ধ হবে শিল্প
ডলারের সংকটে কাঁচামাল আমদানি করতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা। তিন বছর আগেও যেখানে প্রতি মাসে গড়ে আট থেকে সাড়ে আট বিলিয়ন ডলারের পণ্য বাংলাদেশে আসতো, এখন তা আসছে মাত্র সাড়ে পাঁচ বিলিয়ন ডলার। ৮৫০ কোটি ডলারের আমদানি পণ্য নেমে হয়েছে ৫৫০ কোটি ডলারে। অর্থাৎ গড়ে ৩৫০ কোটি ডলারের পণ্য কম আসছে দেশে।
স্থানীয় মুদ্রায় তা ৪০ হাজার কোটি টাকার ওপরে। এক মাসে এ পরিমাণ অর্থের কাঁচামাল দেশে আসছে না। বাংলাদেশে আসা কাঁচামালের সঙ্গে আরো ৪০ শতাংশ মূল্য যুক্ত হয়। সে হিসাবে প্রতি মাসে দেশের অর্থনীতিতে আরো ১৫০ কোটি ডলার যোগ হতো। ফলে প্রতি মাসে অর্থনীতি প্রায় ৫৮ হাজার কোটি টাকা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। প্রতি বছরে ছয় লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কমে যাচ্ছে দেশের। যেখানে বর্তমানে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকার ১৩ লাখ কোটি টাকা।
শিল্পোদ্যোক্তারা বলছেন, ডলার সংকটের কারণে উৎপাদন সক্ষমতার ২০ থেকে ২৫ শতাংশ কাজে লাগাতে পারছেন না তারা। অর্থাৎ সক্ষমতার চেয়ে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ উৎপাদন কম হচ্ছে তাদের। এ পরিমাণ উৎপাদন কমে যাওয়ায় মুনাফায় থাকতে পারছেন না তারা। অনেকই শ্রমিক ছাঁটাই করে কোনোমতে টিকে আছে বড়রা। আর ক্ষুদ্র ও মাঝারি অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠানই বন্ধ হয়ে গেছে। কতগুলো বন্ধের উপক্রম হয়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যারা দেশে বিনিয়োগ না করতে পারে তারাই অর্থপাচার করে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন।
অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা বলছেন, বিনিয়োগের জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি। রাজনীতিতে গণতন্ত্র না থাকায় পথ হারিয়েছে অর্থনীতি। জবাবদিহি না থাকায় আর্থিক খাতে বিশৃঙ্খলা চরম পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে। এ কারণে সুদহার, বিনিময় হার, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দর নিয়ে সরকার স্থির থাকতে পারছে না। গত কয়েক বছরে হুহু করে বেড়েছে এ কয়টি খাতের মূল্য। এতে ব্যবসায়িক খরচ বেড়ে যাচ্ছে শিল্পোদ্যোক্তাদের। অর্থনীতির এ সংকট সামাল দিতে একমাত্র উপায় হচ্ছে জবাবদিহিমূলক প্রশাসন ও আর্থিক খাতে সঠিক নেতৃত্ব। সরকার যদি সাধারণ মানুষের কল্যাণে কাজ না করে, তাহলে রাজনীতিতে গণতন্ত্র ফেরাতে সুশীল সমাজ, শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদদের বিকল্প ভাবতে হবে।



এ পাতার অন্যান্য খবর

অন্যান্য মিডিয়া bdnews24 RTNN Sheersha News barta24 Prothom Alo Daily Nayadiganta Jugantor Samakal Amardesh Kaler Kantho Daily Ittefaq Daily Inqilab Daily Sangram Daily Janakantha Amader Shomoy Bangladesh Pratidin Bhorerkagoj Daily Dinkal Manob Zamin Destiny Sangbad Deshbangla Daily Star New Age New Nation Bangladesh Today Financial Express Independent News Today Shaptahik 2000 Computer Jagat Computer Barta Budhbar Bangladesherkhela Holiday Bangladesh Monitor BBC Bangla Pars Today
homeabout usdeveloped by

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ মো. তাসনীম আলম।

এটিএম সিরাজুল হক কর্তৃক হক প্রিন্টার্স ১০/৮ আরামবাগ, ঢাকা-১০০০ হতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। যোগাযোগের ঠিকানাঃ ৪২৩ এলিফেন্ট রোড, বড় মগবাজার, ঢাকা - ১২১৭।

ফোন: ৮৮ ০২ ৪৮৩১৯০৬৫, ই-মেইল: sonarbanglaweekly@gmail.com, weeklysonarbangla@yahoo.com, সার্কুলেশন: ০১৫৫২৩৯৮১৯০, বিজ্ঞাপন: ৪৮৩১৫৫৭১, ০১৯১৬৮৬৯১৬৮, ০১৭৩৪০৩৬৮৪৬।