রেজি : ডিএ ৫১৭ ॥ ৬৩ বর্ষ : ৬ষ্ঠ সংখ্যা ॥ ঢাকা, শুক্রবার, ২0 বৈশাখ ১৪৩১ ॥ ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী ॥ ৩ মে ২০২৪

॥ হারুন ইবনে শাহাদাত ॥
বাংলাদেশ স্মরণকালের এক সংকট অতিক্রম করছে। গণতন্ত্রহীনতার রাজনৈতিক সংকটের সাথে যোগ হয়েছে পরিবেশ বিপর্যয়ের প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এদেশের মানুষ বন্যা, খরা, সাইক্লোনের মতো দুর্যোগের সাথে পরিচিত। কিন্তু এবার এসেছে নতুন বিপদ তীব্র তাপপ্রবাহ। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, এ প্রভাব এখনই নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হলে সবুজ-শস্য-শ্যামল নদীমাতৃক বাংলাদেশে মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হবে। কিন্তু কেন এ দুর্যোগ? পরিবেশ বিপর্যয় এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য মানুষই দায়ী- এ নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। মূলত মানবসমাজের নেতারাই দায়ী। যারা সরকারে আছেন এবং রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন, তাদের স্বৈরশাসন (প্রাকৃতিক নিয়মবিরোধী আচরণ) মানুষকে মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত করছে। স্বৈরশাসন এবং প্রাকৃতিক আইন বা নিয়মবিরোধী আচরণ ধারণাটি নতুন মনে হলেও আসলে নতুন নয়। মানবসভ্যতার ইতিহাস, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান এবং তাওরাত, ইঞ্জিল ও পবিত্র কুরআনসহ আসমানি গ্রন্থগুলো এ বার্তা দিয়ে আসছে সৃষ্টির সূচনাকাল থেকেই। এর একটি বিশেষ ইসলামী পরিভাষা আছে। মানে এ বিশ্বজাহানের সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের বিধান বা সাধারণ স্বতসিদ্ধ প্রাকৃতিক নিয়ম বলে প্রচার করা হয় সেই পরিভাষাটির বদলে।
তারা আল্লাহর দেয়া বিধান না মেনে নিজেরা বিধান রচনা করেন। তাদের মনগড়া প্রভুর বা নেতার রচিত বিধান অনুসরণ করেন। তাদের বোঝাতে পবিত্র আসমানি গ্রন্থগুলোয় সেই পরিভাষা উল্লেখ করা হয়েছে। সেই পরিভাষাটির বদলে আধুনিক বিজ্ঞান যাকে প্রাকৃতিক নিয়মের ব্যত্যয় বলে প্রচার করে। অর্থাৎ ‘আল্লাহর বিধান’ কথাটি ‘প্রাকৃতিক নিয়ম’ শব্দের আড়ালে লুকিয়ে প্রচার করে। কিন্তু এ সত্য সবাই স্বীকার করেন, মানুষ উন্নয়নের নামে আল্লাহর বিধানের ব্যত্যয় ঘটিয়েই যুগে যুগে বিপর্যয় ডেকে এনেছে। মানবতার ইতিহাসের সেই ধ্বংসস্তূপগুলো দেখে তা থেকে শিক্ষা নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন আল্লাহ রাব্বুল আলামিন।
প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে পৃথিবীর অনেক বড় বড় সভ্যতা হারিয়ে গেছে। অনেক সবুজ-শ্যামলসমৃদ্ধ জনপদ পরিণত হয়েছে মরুভূমিতে। নয়তো মহাপ্লাবনে পড়েছে বালিচাপা। কিন্তু কেন আসে এমন বিপর্যয়? এ প্রশ্নের উত্তর আধুনিক বিজ্ঞান ও পবিত্র কুরআন একই ভাষায় দিয়েছে। অর্থাৎ বিপর্যয় আসে মানুষের বেপরোয়া, স্বৈরাচারী আচরণের কারণে। পবিত্র কুরআনের সূরা রূমের ৪১-৪২নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘মানুষের কৃতকর্মের কারণে সমুদ্রে ও স্থলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়ে, যার ফলে তাদেরকে কোনো কোনো কর্মের শাস্তি তিনি (আল্লাহ) আস্বাদন করান, যাতে তারা ফিরে আসে। বলুন, তোমরা জমিনে ভ্রমণ কর অতঃপর দেখ, পূর্ববর্তীদের পরিণাম কী হয়েছে! তাদের (বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের) অধিকাংশই ছিল মুশরিক ।’ অর্থাৎ স্বৈরাচারী শাসন বা রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন যুগে যুগে বিভিন্ন জনপদে মানবসভ্যতার ধ্বংস ডেকে এনেছে- যে কথা আধুনিক বিজ্ঞান স্বীকার করেছে। মরুকরণ প্রক্রিয়া দুঃশাসনের ফলে  কীভাবে আসে সে প্রসঙ্গে  Encyclopaedia Britannica-এ বছরের মার্চ মাসে তার আপডেট অনলাইন সংস্করণে এ প্রসঙ্গে লিখেছে, 'Desertification, the process by which natural or human causes reduce the biological productivity of dry lands (arid and semiarid lands). Declines in productivity may be the result of climate change, deforestation, overgrazing, poverty, political instability, unsustainable irrigation practices, or combinations of these factors. The concept does not refer to the physical expansion of existing deserts but rather to the various processes that threaten all dry land ecosystems, including deserts as well as grasslands and scrublands. সহজ কথায় মরুকরণ প্রক্রিয়ার দিকে কোনো জনপদ বা ভূখণ্ড যাচ্ছে কিনা, তার লক্ষ্মণগুলো হলো- জমিগুলো শুষ্ক বা আধা শুষ্ক হয়ে যাবে এর ফলে উৎপাদনক্ষমতা কমে যাবে, জলবায়ু পরিবর্তন হবে। এর কারণে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হতে পারে, আবার রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে যখন বন উজাড়, দরিদ্রতা ও টেকসই সেচব্যবস্থা ভেঙে পড়লেও এমন বিপর্যয় আসতে পারে। এখানে প্রাকৃতিক ও মানবিক দুটি কারণই উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, প্রাকৃতির বৈরী আচরণের জন্য মানুষের স্বৈরাচারী বেপরোয়া আচরণ ও অনাচারই প্রধানত দায়ী।
বাংলাদেশ কেন সংকটে? মরুকরণের করালগ্রাসে কেন পরিণত হতে যাচ্ছে এ ব-দ্বীপ। এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েও বিজ্ঞানী, রাজনীতি বিশ্লেষক ও রাজনৈতিক নেতারা সরকারের দিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করছেন। সাধাণত খোলা চোখে দেখলে এর সাথে গণতন্ত্রহীন স্বৈরশাসন এবং সরকারকে দায়ী করার অর্থ ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক’ বলে মনে হলেও বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা।
 কী সেই ভিন্ন কথা
 দেশের পরিবেশ বিপর্যয়ের জন্য সরকার ও ক্ষমতাসীনরা প্রধানত দুভাবে দায়ী। প্রথমত, তারা নিজেদের স্বার্থে, ব্যক্তিগত লাভের জন্য পরিবেশের ক্ষতি করছে। দ্বিতীয়, ক্ষমতায় টিকে থাকতে প্রভাবশালী দেশ ও ব্যক্তিদের সুবিধা দেয়ার জন্য পরিবেশ ও প্রতিবেশ ধ্বংস করছে। লেখক ও বুদ্ধিজীবী বদরুদ্দীন উমর মনে করেন, ক্ষমতাসীনদের লোভের দিন দিন মাত্রা আরও বেড়েছে। দখল, শোষণ, লুটপাটের ক্ষমতা শুধু ক্ষমতাবানের থাকে। আর বাংলাদেশে ক্ষমতার প্রধান উৎস রাজনীতি। তাই দেখা যায় বেশিরভাগ সময় নদী দখল, বালু তোলা, বন উজাড়, পাহাড় কাটার সঙ্গে রাজনীতিবিদরা জড়িত। আর পরিবেশদূষণে জড়িত রাজনীতির ছত্রছায়ায় থাকা ব্যবসায়ীরা।
একাধিক সূত্রে প্রকাশ, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন (এনআরসিসি) অনেক কাটাছেঁড়ার পর ৬৪টি জেলার ৩৭ হাজার ৩৯৬ অজানা অবৈধ নদী দখলদারের নাম ও তথ্য প্রকাশ করেছিল, যাদের বেশিরভাগই প্রভাবশালী ব্যবসায়ী এবং রাজনীতিবিদ। এ রিপোর্ট প্রকাশের পর নদী কমিশনকে কতটা চাপে পড়তে হয়েছিল, তা কারো অজানা নয়। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান মনজুর আহমেদ চৌধুরী নদীখেকোদের বিরুদ্ধে সাহসী অবস্থান নিয়েছিলেন। তিনি রাজনীতিক, প্রভাবশালী, বিত্তশালী, আমলা যারাই নদীর ক্ষতি করেছেন,তাদের সম্পর্কে কঠোর সমালোচনা করেছেন। ক্ষেত্রবিশেষে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছেন।
সর্বশেষ গত বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর বিশ্ব নদী দিবসের আলোচনায় বলেছেন, ‘মেঘনা নদী থেকে অবৈধভাবে যারা বালু উত্তোলন করছেন, তাদের সঙ্গে চাঁদপুরের একজন নারী মন্ত্রীর সম্পর্ক আছে।’ এরপর মাস না পেরোতেই কমিশনের চেয়ারম্যান মনজুর আহমেদ চৌধুরীর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রায় দেড় বছর বাকি থাকতেই বাতিল করেছে সরকার। নদীখেকোদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেওয়ার কারণে তাকে চেয়ারম্যান পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
শুধু নদী দখল নয়, দূষণের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ সরকার। ক্ষমতাসীন প্রভাবশালীদের কলকারখানার বর্জ্য অবাধে পড়ছে নদনদী খাল-বিল, ফসলি জমিতে। পুরনো গাড়ির বিরুদ্ধে বার বার অভিযানের পরও দেখা যায়, বিশেষ কায়দায় ক্ষমতাসীনদের সুবিধা দিয়ে কালো ধোঁয়া ছড়িয়ে মহারাজরা বেশে চলছে। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করে ইট পোড়ালে বন উজাড় করতে হয় না, ইটভাটার ধোঁয়ার কারণেও পরিবেশে পড়ে না বিরূপ প্রভাব, কিন্তু এক্ষেত্রেও সরকারের ব্যর্থতা ষোলোআনা বিভিন্ন প্রতিবেদন সূত্র বলছে।
ক্ষমতাসীন দলের সাথে যুক্ত থাকলে রাজধানীসহ শহর-নগরে ভবন নির্মাণের সময় বিল্ডিং কোড না মানলেও হয়, রেলের জমি, সরকারি খাসজমি, পুকুর, খালসহ জলাধার দখল করে বাড়ি, কলকারখানা নির্মাণ করাও তাদের জন্য কোনো ‘অপরাধ নয়’। তাদের জন্য আইন, ‘কাজীর গরু কিতাবে’ থাকাই যথেষ্ট।
গাছ পরিবেশ রক্ষা করে। কিন্তু সরকারের উদাসীনতায় পরিবেশ উপযোগী নয়, এমন গাছে ভরে আছে রাজধানী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ জসীম উদ্দিনের নেতৃত্বে ঢাকা নগরে গাছের বৈচিত্র্য নিয়ে গত বছরের ডিসেম্বরে একটি গবেষণা হয়েছে। রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, এসব এলাকার ৫৮ শতাংশ গাছই বিদেশি প্রজাতির। শোভাবর্ধক উদ্ভিদ আছে ৩৩ শতাংশ। শালের সঙ্গে অনেক সহ-উদ্ভিদ আছে যেমন চালতা, আমলকী, গান্ধী গজারি, সিন্দুরি, মেন্দা। এসব প্রজাতির কোনো গাছই এখন লাগানো হয় না। নগরীতে আবাসিক এলাকা আছে, কলকারখানা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতালসহ নানা ধরনের প্রতিষ্ঠান আছে। এসব এলাকার কোথায় কী ধরনের গাছ লাগাতে হবে, তার সঠিক পরিকল্পনা নেই দুই সিটির কারো। সড়কদ্বীপ কিংবা উদ্যানে যেসব গাছ আছে, এর একটি বড় অংশ বিদেশি প্রজাতির। এসব বিদেশি গাছ লাগানোর একটি বড় উদ্দেশ্য, তাতে বেশি অর্থ লাগে। ঠিকাদারের লাভের বিষয়টিই সেখানে মুখ্য। দেশজুড়ে চলছে দাবদাহ। রাজধানীতে এর প্রভাব অনেক বেশি।
রাজধানীবাসীর জন্য বিপদ ডেকে আনছেন কারা
আশঙ্কা করা হচ্ছে এখনই সতর্ক না হলে মরুকরণ প্রক্রিয়ার এ বিপদ ভবিষ্যতে ঠেকানো সম্ভব হবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক দীর্ঘমেয়াদি সমীক্ষা চালিয়ে ‘ঢাকার বায়ুমণ্ডলে গ্যাসের অস্তিত্ব চিহ্নিত ও পরিমাপকরণ’ শীর্ষক ওই গবেষণা প্রতিবেদন গত ১৬ এপ্রিল প্রকাশ করেছেন। এতে বলা হয়েছে, গবেষকরা দেখেছেন, ঢাকার বাতাসে পাঁচ ধরনের গ্যাস জমা হচ্ছে, যা শহরবাসীর নানা রোগবালাই এবং সমস্যা বাড়ানোর পাশাপাশি বাতাসকে আরও উত্তপ্ত করে তুলছে। পাঁচ ধরনের গ্যাস হচ্ছে কার্বন মনোক্সাইড, নাইট্রিক অক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড, ভোলাটাইল অর্গানিক কম্পাউন্ড ও ওজোন। এসব গ্যাস ১০ থেকে ৪০০ বছর পর্যন্ত শহরের বাতাসে রয়ে যেতে পারে।
প্রশ্ন হলো- এই গ্যাস কি এমনি এমনি তৈরি হচ্ছে, নাকি কেউ এ জন্য দায়ী। আর দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দায়িত্ব যে সরকারের, সেই সরকারই-বা কী করছে? ঢাকার বাতাসের উত্তাপ বাড়ানোর জন্য যে পাঁচ ধরনের ক্ষতিকর গ্যাস দায়ী, তা ময়লার ভাগাড়, ইটভাটা, যানবাহন ও শিল্পকারখানার ধোঁয়া থেকে তৈরি হচ্ছে।  তাপপ্রবাহের সঙ্গে যুক্ত হওয়া এসব ক্ষতিকর গ্যাসের কারণে রাজধানীর আবহাওয়া অসহনীয় হয়ে উঠেছে। রাজধানীর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা কোথাও কোথাও ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করেছে। অন্যদিকে ঢাকার পার্শ্ববর্তী জেলা শেরপুর ও মাদারীপুরের তাপমাত্রা কমে ৩৫ ও ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে এলেও ঢাকায় তখন দেখা যায় তাপমাত্রা ছিল ৩৮ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর দেশের সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রা ছিল চুয়াডাঙ্গায় ৪২ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক বিজ্ঞানীদের প্যানেল আইপিসিসির সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাতাসে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা নির্ধারিত মানমাত্রার চেয়ে বেশি থাকলে তাপমাত্রা দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিরিক্ত বাড়ে। আর ওজোন, কার্বন মনোক্সাইড, নাইট্রিক অক্সইড, নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড গ্যাস বাড়লে তাপমাত্রা আরও দশমিক ৫ থেকে ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়বে। শহর এবং গ্যাসপ্রবণ এলাকাগুলোয় তাপমাত্রা বৃদ্ধির পরিমাণ আরও বেশি বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। অর্থাৎ আবহাওয়াগত কারণে কোনো এলাকার তাপমাত্রা যে পরিমাণে বাড়ে, তার সঙ্গে ওই গ্যাসগুলো যোগ হলে উত্তাপ আরও বেড়ে যায়।
প্রচণ্ড দাবদাহের এ পরিস্থিতিতে দরিদ্র মানুষের বিপদগুলো চিহ্নিত করতে ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব রেডক্রস (আইএফআরসি) বাংলাদেশ গত ২৪ এপ্রিল ‘তাপপ্রবাহ : বাংলাদেশ, আগাম সতর্কতা ব্যবস্থা’ শীষর্ক এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে কোন রাজধানীর কোন এলাকায় তাপমাত্রা কেমন, তা চিহ্নিত করার পাশাপাশি মূলত চারটি সূচক আমলে নিয়ে একটি মানচিত্র তৈরি করেছে আইএফআরসি। প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে নগর পরিকল্পনাবিদ ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ‘রাজধানীর ৯০ শতাংশ এলাকা গ্রীষ্মকালের প্রায় পুরোটা সময় উষ্ণ বা তাপীয় দ্বীপে পরিণত হচ্ছে।’
বন, পাহাড় এবং জলাশয় বহুল অঞ্চলে তাপমাত্রা কম
আবহাওয়াবিদরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের তাপমাত্রার পাথর্ক্য প্রসঙ্গে জানান, তাপমাত্রা প্রবাহের যে তিনটি পদ্ধতি রয়েছে পরিবহন, পরিচলন এবং বিকিরণ- এ তিনটি পদ্ধতির মধ্যে সমভূমি হওয়ার কারণে এ অঞ্চল দিয়ে পরিবহন পদ্ধতিতে তাপ প্রবাহিত হয়। ফলে সরাসরি তাপ লাগার কারণে পুরো অঞ্চলের তাপমাত্রা বেশি থাকে।
মূলত ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের কারণে বছরের এ সময়ে চুয়াডাঙ্গাসহ বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোয় বরাবরই অসহনীয় তাপমাত্রা বিরাজ করে। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, বাংলাদেশের বেশিরভাগ স্থানেই মার্চ, এপ্রিল ও মে মাসে সূর্যের কিরণ বা রশ্মি লম্বালম্বিভাবে এসে পড়ে। অল্প কিছু এলাকায় বাঁকাভাবে পড়ে।
আবহাওয়াবিদ ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক বলেন, ‘এপ্রিল মাসে সূর্য থেকে বাংলাদেশের অবস্থান অন্য সময়ের তুলনায় সবচেয়ে কাছাকাছি থাকে। যার কারণে সূর্যের তাপ বেশি পড়ে এ অঞ্চলে। চুয়াডাঙ্গা জেলাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যশোর, কুষ্টিয়া, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট এবং উত্তরাঞ্চলের রাজশাহী, দিনাজপুর, নওগাঁ এলাকার বাতাস উত্তপ্ত থাকার আরেকটি কারণ হলো ‘লু হাওয়া’। বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ভারতের দিল্লি, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান। এ সময় ওখানের তাপমাত্রা ৪২ থেকে ৪৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মাঝে ওঠানামা করে। ময়মনসিংহ এলাকায় হাওড়ের মতো বিশাল জলাধার আছে। তাছাড়া পাহাড়ের পাদদেশে হওয়ায় ওখানে মাঝে মাঝে বৃষ্টিপাত হয়। তাই তাপমাত্রা কম। চট্টগ্রাম ও সিলেটে নিয়মিত বৃষ্টি হওয়ায় গরম কম অনুভূত হওয়ার একটা প্রধান কারণ। আর যদি বনাঞ্চলের হিসাব করি, ওইসব অঞ্চলে বনায়ন বেশি এবং আশপাশে জলাধার আছে। বঙ্গোপসাগর থেকে যে জলীয়বাষ্প বাংলাদেশে প্রবেশ করে, সেটা পাহাড়ি এলাকায় বাধাপ্রাপ্ত হয়। তখন ওই জলীয়বাষ্প সমৃদ্ধ বাতাসের ঊর্ধ্বগমন ঘটে বা উপরের দিকে যায়। তারপর ওই বাতাসের ভেতরে যে পানির কণা থাকে, তা ঘনীভূত হয়ে মেঘ তৈরি করে। মেঘ তৈরির পর তা পাহাড়ের সম্মুখভাগে বৃষ্টিপাত ঘটায় ও তাপমাত্রা কমায়।’ তাছাড়া পাহাড়ি অঞ্চলের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, পাহাড়ের একদিকে সূর্যের আলো পড়লে অন্যদিকে ছায়া পড়ে। আর পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে বাতাস প্রবাহিত হয়। দুই পাশের মানে উত্তপ্ত বাতাস ও ঠাণ্ডা বাতাস মিশ্রিত হয়ে সেখানকার তাপমাত্রা একটু কম রাখে।’
 এবার যে কথা বলছে না কেউ
তাপপ্রবাহের মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। স্কুল-কলেজ বন্ধ, মানুষের কর্মক্ষমতা ও সময় কমেছে। এর বিশ্লেষণ হচ্ছে নানা আঙ্গিকে কিন্তু অন্যান্য বছরের মতো করে এবার ভারতের নদী আগ্রাসন মোকাবিলায় সরকারের নতজানু পররাষ্ট্রনীতির কথা তেমন জোরালোভাবে উচ্চারিত হচ্ছে না। সরকার টিকে আছে ভারতের আশীর্বাদে। তাই সরকারের পক্ষে ভারতের মোকাবিলায় দেশের স্বার্থ রক্ষা করা কঠিন। এজন্য সমস্যা সমাধানে দরকার গণতান্ত্রিক সরকার। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনরত ৬৫টি দলের নেতা-কর্মীরাও মনে করেন, দেশ বাঁচাতে সবার আগে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। স্বৈরাচার হটাতে হবে। না হলে ফারাক্কা, তিস্তাসহ আন্তর্জাতিক নদীগুলোর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় হবে না।
সূত্রে প্রকাশ, ভারতের ফারাক্কা বাঁধের পর থেকেই দেশের প্রধান নদীগুলো স্বাভাবিক প্রবাহ হারিয়ে বর্ষায় বন্যায় ভাসাচ্ছে এবং শুষ্ক মৌসুমে খরায় মারছে। সরকারি পরিসংখ্যানেই নদনদীর সংখ্যা ৭০০ থেকে কমে এখন ৪০০-তে নেমেছে। বেসরকারি পরিসংখ্যানে দেশের নদীর সংখ্যা ১৫০০-এর বেশি। এর মধ্যে এখন এ সংখ্যা ২৩০ থেকে ২৫০-এ দাঁড়িয়েছে। গত কয়েক দশকে হারিয়ে গেছে প্রায় ৫৫০টি নদী। বর্তমানের ২৩০টির মধ্যে ৫৯টি আন্তর্জাতিক নদী। এগুলোর মধ্যে ৫৪টি ভারত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করে ভারতের ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে পানিপ্রবাহ অন্যদিকে নেয়ায় গত চার দশকে ১৭ হাজার কিলোমিটার নদীপথ কমে গেছে। স্বাধীনতার পর বিআইডব্লিউটিএ’র এক জরিপের তথ্যমতে, বাংলাদেশে নদীপথের মোট দৈর্ঘ্য ছিল ২৪০০০ কিলোমিটার। কিন্তু এখন সেটা কমে দাঁড়িয়েছে ৭০০০ কিলোমিটারে। পরিবেশবাদীরা বলছেন, বাংলাদেশে গত প্রায় চার দশকে ৫০ থেকে ৮০টা নদী, শাখা নদী এবং উপ-নদীর অস্তিত্ব বিলীন হয়েছে।
সূত্রে প্রকাশ, আন্তর্জাতিক নিয়মনীতির প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ভারত আন্তর্জাতিক নদীতে তিন হাজার ৬০০টি বাঁধ তৈরি করেছে। হিমালয়ের ভাটিতে বাংলাদেশের উজানে এসব বাঁধ ছাড়াও আরো এক হাজার বাঁধের নির্মাণকাজ চলছে পুরোদমে। ভারত-বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত অভিন্ন নদীগুলো আন্তর্জাতিক নদী হিসেবে চিহ্নিত। এসব নদীর উজানে কিছু করতে হলে আন্তর্জাতিক আইন মেনেই করতে হবে। কিন্তু ভারত এ আইনের কোনো তোয়াক্কাই করছে না। বাংলাদেশে প্রবাহিত ৫৫টি নদীর উৎস ভারতে। বাংলাদেশে প্রবাহিত আন্তর্জাতিক নদীর সংখ্যা ৫৮। এর মধ্যে ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশকারী ৫৫টি নদী আছে।
পানিসম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। এ কথাটার অর্থ আমরা বুঝতে পারছি না। নদী থেকে যে দেশের জন্ম, সেখানে নদী যদি না থাকে, তাহলে তার অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। ফারাক্কার বিরূপ প্রভাবে পদ্মায় পানি কমে গেছে। এতে বরেন্দ্র অঞ্চলে অবস্থিত দেশের বৃহত্তম গঙ্গা-কপোতাক্ষ (জিকে) সেচ প্রকল্প বন্ধ হয়ে গেছে। এতে কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ ও মাগুরা জেলার ১ লাখ ৯৭ হাজার ৫০০ হেক্টর জমির ধান চাষ হুমকির মুখে। ফারাক্কা বাঁধের ফলে তিস্তার বুকে ধু-ধু বালুচর। এতে উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত দেশের বৃহত্তম তিস্তা সেচ প্রকল্পও বন্ধ হয়ে গেছে। নীলফামারী, রংপুর ও দিনাজপুর জেলার ৫ লাখ ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে চাষবাদ হচ্ছে না। নদনদীতে পানি না থাকায় উত্তরাঞ্চল মরুকরণের দিকে দ্রুত ধাবিত হচ্ছে। ফারাক্কার মরণ ছোবলে দেশের ভাটি অঞ্চলও এখন পানিশূন্য। বৃহত্তর সিলেটের সুরমা, কুশিয়ারাসহ অন্যান্য নদী মৃত্যুমুখে। সিলেটের হাওরে পানি নেই। মিঠা পানির মাছ কমে যাচ্ছে। ওই অঞ্চলের কৃষিতে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। পানির অভাবে দেশে লতার মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা নদী হারিয়ে যাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে দেশের ভূ-প্রকৃতির চিত্র। বাংলাদেশের সর্বত্রই নদীর বুকে এখন ধু-ধু বালুচর।
পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, এ ধারা অব্যাহত থাকলে শুধু নদী নয়, গোটা দেশই ভরে যাবে ধু-ধু বালিতে। ত্বরান্বিত হবে মরুকরণ প্রক্রিয়া, অতএব সাবধান হওয়ার এখনই সময়।

অন্যান্য মিডিয়া bdnews24 RTNN Sheersha News barta24 Prothom Alo Daily Nayadiganta Jugantor Samakal Amardesh Kaler Kantho Daily Ittefaq Daily Inqilab Daily Sangram Daily Janakantha Amader Shomoy Bangladesh Pratidin Bhorerkagoj Daily Dinkal Manob Zamin Destiny Sangbad Deshbangla Daily Star New Age New Nation Bangladesh Today Financial Express Independent News Today Shaptahik 2000 Computer Jagat Computer Barta Budhbar Bangladesherkhela Holiday Bangladesh Monitor BBC Bangla Pars Today
homeabout usdeveloped by

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ মো. তাসনীম আলম।

এটিএম সিরাজুল হক কর্তৃক হক প্রিন্টার্স ১০/৮ আরামবাগ, ঢাকা-১০০০ হতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। যোগাযোগের ঠিকানাঃ ৪২৩ এলিফেন্ট রোড, বড় মগবাজার, ঢাকা - ১২১৭।

ফোন: ৮৮ ০২ ৪৮৩১৯০৬৫, ই-মেইল: sonarbanglaweekly@gmail.com, weeklysonarbangla@yahoo.com, সার্কুলেশন: ০১৫৫২৩৯৮১৯০, বিজ্ঞাপন: ৪৮৩১৫৫৭১, ০১৯১৬৮৬৯১৬৮, ০১৭৩৪০৩৬৮৪৬।