সংবাদ শিরোনামঃ

সিটি নির্বাচন হতে যাচ্ছে একতরফা! ** কামারুজ্জামানের কবর জিয়ারতে শেরপুরে হাজারো মানুষের ঢল ** আওয়ামী লীগ মরিয়া ** শহীদী কাফেলায় মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ** গণতন্ত্রহীনতায় অরক্ষিত অর্থনীতি ** সরকার সিটি নির্বাচনকে পুরোপুরি রাজনৈতিককরণ করেছে ** অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করা হোক ** পহেলা বৈশাখের ‘লীলা’ ** আমার সন্তানের কি দোষ ** ফারাক্কা বাঁধের কারণে সাতক্ষীরার ২৭টি নদী এখন মরা খাল ** যাদের কাছে কোনো পুঁজি নেই তারাই সমালোচনা করে জনপ্রিয়তা অর্জন করতে চায়: মনজুর আলম **

ঢাকা, শুক্রবার, ১১ বৈশাখ ১৪২২, ৪ রজব ১৪৩৬, ২৪ এপ্রিল ২০১৫

॥ মোহাম্মদ উবাইদুল্লাহ॥
আমি নরসিংদীর খরস্রোতা পাহাড়িয়া নদী। বেলাব উপজেলার আড়িয়াল খাঁ নদ থেকে আমার জন্ম হয়। সেখান থেকে আমি মনোহরদী, বেলাব, শিবপুর, রায়পুরা উপজেলার কমবেশী ৩৫টি গ্রামের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে রায়পুরা উপজেলার ডৌকারচর দিয়ে পুনরায় আড়িয়াল খাঁ নদে পতিত হয়েছি। খুব বেশি দীর্ঘ না হলেও আমার বুকে জমা কথামালা কিন্তু কোনোও মহাকাব্যের চেয়ে কম নয়! আমি সময়ের মতো শুধু বয়েই চলেছি নিরবধি। থামলেই যেন আমার মৃত্যু হবে। আমার বুকে বয়ে চলা ঘোলাটে পানি যখন গ্রামের বধূরা কলসিতে করে নিয়ে যায়, তখন আমার প্রাণটা গর্বে ভরে ওঠে। পাশাপাশি আমার কিছু দুঃখ গাঁথাও আছে। হাজারো বছর ধরে বহমান এই আমি এখন পানিশূন্য এক সংকীর্ণ নালায় পরিণত হয়েছি। দীর্ঘ ২২ কিলোমিটার লম্বা পাহাড়ী উপত্যকায় আমার মূল ভূমি চলে গেছে অবৈধ দখলদারদের কবলে। দখলদাররা আমার তলদেশে ধানের চাষাবাদ করে আমার স্বাভাবিক নাব্যতা নষ্ট করে দিচ্ছে। যার ফলে, ১০০ কিলোমিটার অববাহিকায় সৃষ্টি হয়েছে মারাত্মক সেচ সঙ্কট। ব্যাহত হচ্ছে সাধারণ চাষাবাদ। মূলতঃ উজানে পুরনো ব্রহ্মপুত্র নদসহ আমার উৎস নদ-নদীর সাধারণ প্রবাহ বিনষ্ট হবার কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। পানি সঙ্কটের কারণে অববাহিকায় জমিগুলোতে চাষাবাদ করতে পারছে না কৃষকরা। শত শত একর জমি সেচের অভাবে অনাবাদী থেকে যাচ্ছে। স্বাধীনতা উত্তরকালে আমায় খননের জন্য সরকারিভাবে হাজার হাজার টন গম বরাদ্দ দেয়া হলেও মাটি কাটার নামে সাধারণ মানুষের আইওয়াশ করা হয়েছে। আত্মসাৎ করা হয়েছে বরাদ্দকৃত গমের সিংহভাগ।

আমার জন্ম সম্পর্কে তেমন কিছুই জানি না। তবে আমার উৎস সম্পর্কে এলাকার প্রবীণজনেরা বলে, আমি নরসিংদীর পাহাড়ী ভূমির প্রায় সমবয়সী একটি নদী। আমার প্রস্থ ছিল ১০০ মিটার, গভীরতা ছিল ৭ মিটার। বর্ষাকালের জুলাই-আগস্ট মাসে আমার পানি প্রবাহের পরিমাণ ছিল প্রতি সেকেন্ডে ১৫০০ ঘন মিটার। প্রতিদিন কত নাম না জানা পশু পাখীর তৃষ্ণা মেটে আমার পানি পান করে! পার হতে মাঝে মাঝে ঠুসঠাস করে পাকা তাল এসে যখন পড়ে, তখন আমার বেশ মজা লাগে। কখনও কখনও মনটা খুব খারাপ হয়ে যায় যখন তুমুল বৃষ্টিতে আমার দু’পাড় উপচে পানির ধারা লোকালয়ে ঢুকে পড়ে। আমি বড়ই নিরুপায়! আমার করার কিছুই থাকে না কারণ আমি যে প্রকৃতির অংশ। এমন নিয়মেই যে চলছি আমি জন্ম হতে আজ পর্যন্ত। যাইহোক, আমার আনন্দের আর সীমা থাকে না যখন আমি লোকালয় ছেড়ে আবার পূর্বের স্থানেই ফিরে আসি। সাধারণ মানুষের মুখে হাসি দেখলে যে আমার মনও তৃপ্ত হয়।

আমার পানি দিয়ে নরসিংদীর মনোহরদী, বেলাব, শিবপুর ও রায়পুরার শত শত একর জমিতে সেচ দেয়া হতো। আমাকে কেন্দ্র করে দু’পাড়ে চাষাবাদ করা হতো শাক-সব্জী, ধান, পাটসহ বিভিন্ন ফসলাদী। এসব এলাকায় প্রচুর সংখ্যক ফসল ফলতো। উৎপাদিত ফসলের উদ্বৃত্ত অংশ রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রেরণ করা হতো। আজ আমি শুকিয়ে নালায় পরিণত হওয়ায় পাহাড়ী অঞ্চলের বিশাল ভূমিতে সেচের অভাবে সাধারণ চাষাবাদে বিঘেœà¦° সৃষ্টি হয়েছে। আমার যে রাগ হয় না তা বললে ভুল হবে। মাঝে মাঝে কিছু বিবেকহীন মানুষ আমার গা ঘেঁষে পায়খানা নির্মাণ করে। যার ফলে আমি প্রতিনিয়ত দূষিত হই। কিছু কিছু স্বার্থপর এবং অর্থলোভী মানুষের কারণেও আমার বুকটা কষ্টে নীল হয়ে যাচ্ছে। তারা আমার দুই পাড়ে কল কারখানা নির্মাণ করে; সেইসব কারখানার দূষিত এবং বিষাক্ত বর্জ্য পদার্থ আমার বুকে ফেলে। আমি তখন নিজেকে খুব অসহায় মনে করি। আমার যে করার কিছুই নেই। যদি কথা বলতে পারতাম, তবে নিশ্চয়ই আমার সাধ্যমত প্রতিবাদ করতাম।

কবে কখন আমার সৃষ্টি হয়েছিল তা নির্দিষ্ট করে কেউ বলতে পারেনি। তবে ভূতাত্ত্বিকদের মতে, নরসিংদীর পাহাড়ী ভূমির সাথে আমার সৃষ্টির সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত। পাহাড়ী ভূমির সৃষ্টি হয়েছিল আজ থেকে ৬ হাজার বছর পূর্বে। কারো কারো মতে, ১০ হাজার বছর পূর্বে নরসিংদীর পাহাড়ী ভূমির সৃষ্টি হয়েছিল। সে সময়ে বেলাব উপজেলার আড়িয়াল খাঁ নদ থেকে পাহাড়িয়া নদীর জন্ম হয়। এক সময়ে আমার উপর দিয়ে জাহাজ চলাচল করতো । এখনো বর্ষা মৌসুমে আমায় বেয়ে নৌকা দিয়ে মনোহরদী, বেলাব, শিবপুর ও রায়পুরায় হাট-বাজার থেকে মালামাল পরিবহন করা হয়। প্রাপ্ত তথ্য মতে, ১৭ শতকের ভূমিকম্পের সময় নদীর আকৃতির কিছুটা পরিবর্তন ঘটে। এরপরই আমার পানি প্রবাহ কিছুটা কমে যায়।

সাম্প্রতিককালে এলাকার লোকজন মহাউৎসবে আমার তলদেশ দখল করে নেয়। দখলদাররা আমার কিনারে উচু অংশের মাটি কেটে মূল স্রোতে ফেলে জমির প্রশস্থতা বৃদ্ধি করায় মূল প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়ে এখন একটি নালায় পরিণত হয়েছি। চোখের সামনে আমার উপর এই দখলদারিত্ব দেখেও স্থানীয় প্রশাসন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না। এই দখলদারিত্ব অব্যাহত থাকলে অচিরেই খরস্রোতা এই আমি একটি মরা নদীতে পরিণত হবার আশঙ্কা বোধ করছি।

তবে আমি আশাহীন নই। আমি জানি যে রাত্রির পরে আলো আসবেই, আলো আসতেই হবে। এক সময় সবই আগের মতো সুন্দর, সুষ্ঠু হবে। আমি সে দিনটি দেখতে চাই। সে দিনটির অপেক্ষার প্রহর গুনে যাই। আমি সেই জেলের কথা বলতে চাই যে প্রতিদিন আমার বুক থেকে মাছ ধরে নিয়ে বাজারে বিক্রি করে, তারপর তার পরিবারের জন্য চাল, ডাল নিয়ে হাসি মুখে বাসায় ফিরে। আমি অগণিত হতভাগা যাত্রীদের কথা বলতে চাই যারা দু’চোখে হাজারো স্বপ্ন নিয়ে, হাজারো আশা নিয়ে পাড়ি দিয়েছে গন্তব্যের দিকে কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে যাদের প্রাণ পাখী উড়ে গেছে আমার এই পানিতে ডুবেই।

তবে আমি আশাহীন হইনা কখনও। বীজ থেকে যেমন নব প্রাণের সূচনা হয়, তেমনি আমিও কষ্টকে পেছনে ফেলে নবরূপে জেগে উঠতে চাই। আমাকে যে জাগতেই হবে, আমি যদি ভেঙ্গে পড়ি, তবে হাজারো মানুষের কি হবে যারা আমার উপর নির্ভর করে বাঁচে। একটা বিষয় আমি খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারি। আমি যেমন সবার মঙ্গল কামনা করি, তেমনি নিশ্চয়ই আরও লাখ লাখ মানুষ আছে যারা অন্যের ভালো চায়, যারা নিপীড়িতের জন্য কিছু করতে চায়, যারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে সিংহের মতো গর্জে ওঠে, যারা অনাচার দেখলেই পথে নামে, যাদের মন দুঃখীর জন্য কাঁদে। এমন মানুষ নিশ্চয়ই আছে। থাকতেই হবে।

আমি জানি গাছের গোড়ায় যে জল দেয়, সে গাছের ফল খেতে পারে না। তবে আমার মনে একটি দুঃখ আছে। আমার শত বছরের লালিত স্বপ্ন ছিল নিজের সত্ত্বা নিয়ে টিকে থাকবো, অকাতরে বিলিয়ে দেব অন্যের উপকারার্থে। কিন্তু সে সুযোগ মনে হয় আর হবে না। আজকে আমার অবস্থা হয়েছে দেখতে অনেকটা সুরু ফিতার মতো। আমাকে দেখলে আজ সত্যিই কি কেউ নদীবলে স্বীকার করবে! তোমাদের জন্য আমার বর্তমান অবস্থার ছবি সংযুক্ত করলাম। আশাকরি দেখলেই তোমাদের কোনো প্রতিক্রিয়া হবে নিশ্চই। আমার সংস্পর্শে আসা অগণিত দর্শনার্থীদের কাছে পেয়ে আকারে ইঙ্গিতে অনেকবার কথা বলতে চেষ্টা করেছি। চেষ্টা করেছি- আমাকে নিয়ে একটি মনোরম প্রামাণ্য চিত্র বানানোর আকুতি জানাতে। কিন্তু আমি তাদের ভাষা বুঝলেও তারা কেউ আমার চোখের বা মনের ভাষা বুঝেনি বা বোঝার চেষ্টা করেনি। আসলে কেউ বুঝতে চায়না যে, আমারও একটা জীবন আছে! আমি এও জানি ভোগে সুখ নেই, ত্যাগেই প্রকৃত সুখ। আমি শুধু সেবা দিয়ে যাচ্ছি। আমার কাজ আমি করেই যাব ! তবু তোমাদের হুশ হবেনা!!

যখন ছোট ছোট নিস্পাপ শিশুরা আমার বুকে রাজহাঁসের মতো সাঁতরে বেড়ায়, তখন আমার বুকে জমে থাকা কষ্টের পাথরের স্তূপ থেকে যেন একটি একটি করে টুকরা সরে যেতে থাকে। আমি যেন ভারমুক্ত হয়ে যাই। মনে হয় যেন পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্য এসে জড়ো হয়েছে আমার মাঝে। তখন আমার খুশিতে কাঁদতে ইচ্ছে হয়। বাচ্চারা যখন উঠে বাড়ির দিকে রওনা হয়, তখন আমার মন তাদের জন্য খুব কাঁদে। মনে হয় আরেকটু সময় পানিতে থাকলে কিইবা ক্ষতি হত?

রাত্রি আমায় বিষণœ করে না। আমি বরং আনন্দের ভেলায় ভাসি যখন চাঁদ এসে আমার সাথে দেখা করে। আমায় আলিঙ্গনে ভরিয়ে দেয়। যতক্ষণ চাঁদ আকাশে থাকে, ততক্ষণ আমি তাকে পরম আদরে আমার বুকে আগলে রাখি। চাঁদ যখন চলে যাবার সময় হয়, তখন আমার মন একটু খারাপ হয় ঠিকই কিন্তু একটি অন্যরকম ভালোলাগাও কাজ করে এই ভেবে যে পরবর্তী রাতে চাঁদ নিশ্চয়ই তার অপরূপ সৌন্দর্য নিয়ে আবার আমার কাছে আসবে! 

অনেক কথা বলে ফেললাম। তবে একটি কথা না বললেই নয়। বৃদ্ধা মা যেমন সুঁই সুতা নিয়ে সোয়েটার বুনে যায়, আমিও তেমনি নীরবে স্বপ্নের জাল বুনে যাই। কারণ আমি জানি যে আমার স্বপ্নই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে যেমনটি রেখেছে অগণিত মানুষদেরকে। আমি জানি যে পৃথিবীতে স্বপ্ন দেখা কতটা গুরুত্বপূর্ণ! স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেয়াটা কতটা আনন্দের!

লেখক : সিইও, নরসিংদীবিডি ডট কম।

ই-মেইল : obyd_777@yahoo.com

অন্যান্য মিডিয়া bdnews24 RTNN Sheersha News barta24 Prothom Alo Daily Nayadiganta Jugantor Samakal Amardesh Kaler Kantho Daily Ittefaq Daily Inqilab Daily Sangram Daily Janakantha Amader Shomoy Bangladesh Pratidin Bhorerkagoj Daily Dinkal Manob Zamin Destiny Sangbad Deshbangla Daily Star New Age New Nation Bangladesh Today Financial Express Independent News Today Shaptahik 2000 Computer Jagat Computer Barta Budhbar Bangladesherkhela Holiday Bangladesh Monitor BBC Bangla Pars Today
homeabout usdeveloped by

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ মো. তাসনীম আলম।

এটিএম সিরাজুল হক কর্তৃক হক প্রিন্টার্স ১০/৮ আরামবাগ, ঢাকা-১০০০ হতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। যোগাযোগের ঠিকানাঃ ৪২৩ এলিফেন্ট রোড, বড় মগবাজার, ঢাকা - ১২১৭।

ফোন: ৮৮ ০২ ৪৮৩১৯০৬৫, ই-মেইল: sonarbanglaweekly@gmail.com, weeklysonarbangla@yahoo.com, সার্কুলেশন: ০১৫৫২৩৯৮১৯০, বিজ্ঞাপন: ৪৮৩১৫৫৭১, ০১৯১৬৮৬৯১৬৮, ০১৭৩৪০৩৬৮৪৬।