সংবাদ শিরোনামঃ

মাওলানা নিজামীর শাহাদাত ** আমার প্রতি অবিচার করা হচ্ছে ** সাঁথিয়ায় শহীদ মাওলানা নিজামীর জানাজায় লাখো জনতা ** শহীদ নিজামীকে কান্না দোয়া শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় চির বিদায় জানালো সাঁথিয়াবাসী ** বিচার বিভাগকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চতুর প্রয়াস ** ইতিহাসে বিরল দৃষ্টান্ত : মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নেই ** গণমাধ্যম বিকাশে ভূমিকা রাখবে প্রেস কাউন্সিল ** ধামা চাপা যেন না পড়ে ** কুরআন ও আধুনিক বিজ্ঞান ** নারীর ক্ষমতায়ন ** আমি খুনি নই ** মুক্তিকামী জনতার নেতা মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী ** বরেন্দ্র অঞ্চলে পানি সঙ্কটের অন্যতম কারণ ইউক্যালিপট্যাস গাছ? **

ঢাকা, শুক্রবার, ৩০ বৈশাখ ১৪২৩, ৫ শাবান ১৪৩৭, ১৩ মে ২০১৬

বর্তমান সরকারের আমলে বিচার বিভাগ যে ডাল-ভাতের মতো বিষয়ে পরিণত হয়েছে সে ব্যাপারে নিশ্চয়ই সন্দেহের অবকাশ নেই। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার সাজানো মামলা থেকে শুরু করে রিমান্ডে নিয়ে নিষ্ঠুর নির্যাতন চালানো এবং সর্বোচ্চ আদালতের উদ্দেশে আঙুল ওঠানো পর্যন্ত বিভিন্ন তথ্যের উল্লেখ করলে একই প্রতিষ্ঠিত সত্য অনস্বীকার্য হয়ে উঠবে। প্রসঙ্গক্রমে সর্বশেষ ঘটনাপ্রবাহের দিকে লক্ষ্য করা যায়। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করে দেয়া হাইকোর্ট বেঞ্চের রায়কে কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীনরা যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন তা সরাসরি আদালত অবমাননার পর্যায়ে পড়ে। কিন্তু আফটার অল, দলটি আওয়ামী লীগ। এজন্যই কারো পক্ষে পাল্টা অবস্থান নেয়া সম্ভব হয়নি। এমনকি মাননীয় বিচারপতিরাও নীরবতা অবলম্বন না করে পারেননি। অথচ হাইকোর্ট বেঞ্চের ওই রায়টি কিন্তু চূড়ান্ত কিছু ছিল না। এর বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে যাওয়ার এবং আপিল করার এখতিয়ার বা অধিকার ক্ষমতাসীনদের রয়েছে। এরই মধ্যে সে চেষ্টা শুরুও করেছেন তারা। তা সত্ত্বেও অত্যন্ত অশোভন ভাষায় সর্বোচ্চ আদালতের বিরুদ্ধে শোরগোল তুলেছেন তারা। বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে এ বিষয়ে জাতীয় সংসদের আড়াল নিতেও ভুল হয়নি তাদের। আর একথা তো সবারই জানা যে, সংসদের ভেতরের কোনো কথা বা আচরণকেই আদালত অবমাননা হিসেবে গণ্য করার সুযোগ নেই। এ সুযোগেরই সদ্ব্যবহার করেছেন ক্ষমতাসীনরা। দু-চারজন অবশ্য সীমাও ছাড়িয়ে গেছেন। তারা সংসদের বাইরেও রাগ আর ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

যেহেতু সর্বোচ্চ আদালতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এবং আদালত অবমাননার অভিযোগও ওঠানো হতে পারে সেহেতু বিষয়টি নিয়ে এই মুহূর্তে বেশি কথা না বলাই ভালো। তবু জানিয়ে রাখা দরকার, নি¤œ আদালতের ওপর খবরদারী ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করে নেয়ার পাশাপাশি সর্বোচ্চ আদালতকেও টার্গেট বানিয়ে ছেড়েছেন ক্ষমতাসীনরা। কোনো একটি রাষ্ট্রের ভালো উদাহরণ না থাকা সত্ত্বেও মাননীয় বিচারপতিদের ইম্পিচ বা অভিসংশন করার ক্ষমতা তারা সংসদের হাতে আনার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এটাই ছিল সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মূলকথা। তার আগে পর্যন্ত এজন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেয়ার বিধান কার্যকর ছিল। অর্থাৎ মাননীয় কোনো বা কয়েকজন বিচারপতি অসদাচরণের দায়ে অভিযুক্ত হলে অপসারণসহ তার বা তাদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হলে সেটা নেবে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল। এই কাউন্সিল কাদের সমন্বয়ে গঠিত হবে তারও নির্দেশনা রয়েছে সংবিধানে। কিন্তু সেখানে সকল সদস্য ক্ষমতাসীনদের ইঙ্গিতে চলতে রাজি নাও হতে পারেন বলেই এত মাথাব্যথা। এজন্যই এমন এক সংসদের হাতে তারা সকল ক্ষমতা আনার উদ্দেশ্যে ষোড়শ সংশোধনী পাস করিয়েছিলেন যাতে ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছাই হুকুমের পর্যায়ে উন্নীত হতে পারে।

অমন কোনো উদ্যোগ দেশের সর্বোচ্চ আদালতের তথা গোটা দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গলজনক হবে না বলেই একদিকে সংবিধানে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল, অন্যদিকে হাইকোর্ট বিভাগের বেঞ্চও সংশোধনীটিকে অবৈধ ঘোষণা করে রায় দিয়েছেন। মাননীয় বিচারপতিরা বলেছেন এবং একথা সত্যও যে, কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য ও সমর্থক হিসেবে সংসদে আসার সুযোগ পান বলেই এমপিদের ব্যক্তিগত কোনো চিন্তা বা সিদ্ধান্তের সুযোগ থাকে না। তারা দলের সিদ্ধান্ত মেনে চলতে বাধ্য। একই কারণে মাননীয় বিচাপতিদের বিরুদ্ধে ইম্পিচমেন্টসহ যে কোনো ব্যবস্থা নেয়ার বেলায়ও এমপিরা স্বাধীনভাবে আাইনসম্মত অবস্থান নিতে পারবেন না। তেমন অবস্থায় রাজনৈতিক দলের ইচ্ছাই তাদের জন্য অবশ্যপালনীয় কর্তব্যে পরিণত হবে। আর এভাবে চলতে দেয়া হলে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের মাননীয় বিচারপতিরাও ক্ষমতাসীনদের সেবাদাসগিরি করতে বাধ্য হবেন। না হলে তাদের চাকরি হারাতে হবে। অমন কোনো সম্ভাবনার আশঙ্কা থেকেই হাই কোর্ট বেঞ্চ ষোড়শ সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করেছেন। বলা দরকার, ক্ষমতাসীনরা ক্ষুব্ধ ও অসন্তুষ্ট হলেও বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি সচেতন সাধারণ মানুষও এই রায়ের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। এখন দেখার বিষয়, ক্ষমতাসীনরা আপিল করার সঙ্গে আর কোন ধরনের কত পদক্ষেপ নেন এবং সুপ্রিম কোর্টে রায়টির ঠিক কেমন পরিণতি হয়। তবে বলে রাখা দরকার, সংসদের আড়াল নিয়ে মাননীয় বিচারপতিদের যদি সরকারের সেবাদাসে পরিণত করা হয় তাহলে দেশে স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা বলে কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। আর তেমন অবস্থা দেশ ও জাতির জন্য অত্যন্ত ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে।

ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দেয়া রায়কেন্দ্রিক ঘটনাপ্রবাহ আলোচনা করাই অবশ্য বর্তমান নিবন্ধের উদ্দশ্য নয়। একটি উদ্দেশ্য সর্বোচ্চ আদালতেরই অন্য একটি নির্দেশনার আলোকে কিছু তথ্যকে সামনে আনা। কিছুদিন আগে এরকম একটি নির্দেশনায় ১৬৮টি মামলার পুনঃশুনানির কথা বলা হয়েছিল, যেগুলোর মধ্যে ১৬২টির সঙ্গেই জড়িত রয়েছেন সাবেক বিতর্কিত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। এ নির্দেশনা ঘোষিত হওয়ারও আগে বিচারপতি মানিকের কিছু বক্তব্য ও কর্মকাণ্ড নতুন পর্যায়ে সর্বোচ্চ আদালতের মর্যাদাকে প্রশ্নের সম্মুখীন করেছিল। অঘোষিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এমনকি মাননীয় প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার পদত্যাগও দাবি করেছিলেন। সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে সাংবাদিকদের সামনে রাখা তার সম্পূর্ণ বক্তব্যই ছিল মাননীয় প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে। তিনি বলেছেন, অবসরে যাওয়ার পর রায় লেখা নিয়ে সাম্প্রতিক এক মন্তব্যের মাধ্যমে বিচারপতি সিনহা নাকি সংবিধান লংঘন করেছেন। এ ধরনের মন্তব্য করার কিংবা সে মন্তব্যের আলোকে কোনো রায় বা নির্দেশ দেয়ার অধিকার নাকি প্রধান বিচারপতির নেই। শুধু তা-ই নয়, সাবেক বিচারপতি মানিক অভিযোগ তুলে আরো বলেছেন, প্রধান বিচারপতি নাকি বিএনপির এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্যই অবসরে যাওয়ার পর রায় লেখা নিষিদ্ধ করে তার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন। তার উদ্দেশ্য নাকি সরকারের নাড়ি ধরে টান মারা, সরকারকে সাংবিধানিক বৈধতার সঙ্কটে ফেলে বিএনপিকে সাহায্য করা। এ পর্যন্ত এসেও থেমে যাননি বিচারপতি মানিক। সাংবাদিকদের তিনি জানিয়েছিলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের কোনো এক আপিলের শুনানিতে বিচারপতি সিনহা নাকি স্বীকার করেছেন, স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় তিনিও তার এলাকা সিলেটের কমলগঞ্জে পাকিস্তানপন্থী শান্তিকমিটির সদস্য ছিলেন। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের বিরুদ্ধে ভূমিকা পালন করেছিলেন বলে তার নাগরিকত্বও বাতিল করা উচিত। এসব কারণেই প্রধান বিচারপতির পদে থাকার যোগ্যতা ও অধিকার হারিয়েছেন বিচারপতি সিনহা। তাকে অবশ্যই পদত্যাগ করতে হবে বলেও দাবি জানিয়েছিলেন মিস্টার মানিক। এটা গত ফেব্রুয়ারি মাসের ঘটনা।

বলার অপেক্ষা রাখে না, একজন সাবেক বিচারপতির কাছে এ ধরনের দাবি, বক্তব্য ও কর্মকাণ্ড সকল বিবেচনায় সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। আইন অঙ্গনের বিশিষ্টজনেরাও একই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন। সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন, সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের বক্তব্য ও আচরণ বিচারকসুলভ নয়। দেশের বিচার অঙ্গনকে তিনি বিতর্কিত করে চলেছেন। সর্বোচ্চ আদালত চত্বরে সংবাদ সম্মেলন করা নজীরবিহীন উল্লেখ করে এডভোকেট খন্দকার মাহবুব আরো বলেছেন, মিস্টার মানিক একদিকে রাজনৈতিক মিছিল-সমাবেশ ও টকশো করছেন, অন্যদিকে আবার পুরনো মামলার রায় লিখছেন, যা অত্যন্ত ন্যক্কারজনক। এসব কারণে সাবেক এই বিচারপতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন বার সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন। খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, সরকারের পক্ষে প্রধান আইন কর্মকর্তা হিসেবে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমও তখন বিচারপতি মানিকের বিরুদ্ধেই অবস্থান নিয়েছিলেন। তিনি বলেছেন, মিস্টার মানিক যা করছেন বিশ্বে তার কোনো নজীর নেই। তার এ ধরনের কর্মকাণ্ডে বিচার অঙ্গনের ভাবমর্যাদা নষ্ট হচ্ছে। সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকনও একই সুরে বক্তব্য রেখেছেন ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তিনি অভিযোগ করেছেন, বিচারপতি থাকাকালে মিস্টার মানিক রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট ছিলেন। অবসরে যাওয়ার পর বিভিন্ন রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ ও টেলিভিশনের টকশোতে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে এর প্রমাণ দিয়ে চলেছেন সাবেক এই বিচারপতি। ওদিকে বিএনপির পক্ষ থেকে এক সংবাদ সম্মেলনেও বিচারক জীবনে রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তুলে বলা হয়েছিল, বিচারপতি মানিক আওয়ামী লীগের এজেন্ডা বাস্তবায়নে ভূমিকা পালন করেছেন। অবসরে যাওয়ার পরও তাকে একই ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে।

বলা বাহুল্য, এত কিছুরও পরও বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এমনকি তিনি যে ব্রিটেনের নাগরিক এবং সে তথ্যটি যে তিনি গোপন করেছেন সে ব্যাপারেও কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। আর এর কারণ, অসলেও তিনি আওয়ামী ঘরানার লোক। বিচারপতি মানিককেন্দ্রিক প্রতিক্রিয়া মাঝপথে থেমে গেলেও অন্য একটি বিষয় কিন্তু প্রাধান্যে এসেছিল। সেটা কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়া রায় এবং এ সংক্রান্ত মামলার পুনঃশুনানি। এ বিষয়ে দাবি জানিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন। গত ২ মে তিনি বলেছেন, অবসরে যাওয়ার পর রায় লেখার কারণে মাননীয় প্রধান বিচারপতি ১৬৮টি মামলার পুনঃশুনানির নির্দেশ দিয়েছেন। একই দৃষ্টিকোণ থেকে কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা সংক্রান্ত মামলাটিরও পুনঃশুনানি হওয়া উচিত। কারণ, সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক অবসরে যাওয়ার দীর্ঘ প্রায় ১৬ মাস পর ওই মামলার রায়ে স্বাক্ষর করেছিলেন। সেজন্যই মামলাটি পুনঃশুনানির দাবি রাখে। এ ব্যাপারে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা সুস্পষ্ট মতামত দেবেন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন বলে আশা প্রকাশ করেছেন প্রবীণ এ আইনজীবী।

বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন দল এবং দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরাা এডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেনের দাবি ও বিশ্লেষণকে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। কারণ, তিনি বলেছেন এবং একথাই সত্য যে, কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়া রায়টিতে সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক স্বাক্ষর করেছিলেন দীর্ঘ ১৬ মাস তিনদিন পর। এটা ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ঘটনা। উল্লেখযোগ্য অন্য একটি তথ্য হলো, এটি ছিল একটি বিভক্ত রায়। পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চের সাত সদস্যের মধ্যে তিনজন কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা বাতিল করার ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করেছিলেন। কিন্তু সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক পক্ষ নেয়ায় বিভক্ত সে রায়টিই গৃহীত ও ঘোষিত হয়েছিল। খায়রুল হকের স্বার দেয়ার অধিকারকে কেন্দ্র করে তখনও গুরুতর প্রশ্ন ও বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল। কারণ, ‘সংপ্তি আদেশের’ আকারে রায়টি ঘোষণা করা হয়েছিল ২০১১ সালের ১০ মে। এর সাতদিনের মধ্যেই অবসরে গিয়েছিলেন বিচারপতি খায়রুল হক। দায়িত্ব যেখানে ছিল অবসরে যাওয়ার আগেই সকলের স্বারসহ পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করে যাওয়া সেখানে তিনি নিজে স্বার করতেই সময় নিয়েছিলেন দীর্ঘ ১৬ মাস তিনদিন। সে কারণে রায়ে স্বার দেয়ার অধিকার নিয়ে তো বটেই, অমন কোনো রায়ের বৈধতা ও কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলেন বিশিষ্ট আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেছিলেন, অবসরে যাওয়ার পর রায়টিতে স্বার দেয়ার এখতিয়ারই নেই সাবেক প্রধান বিচারপতির। স্বার দিলে রায়টি বৈধতা হারাবে।

বিশিষ্টজনদের প্রতিক্রিয়ার কারণে শুধু নয়, ইতিহাসের পর্যালোচনায়ও বিষয়টি গুরুত্ব অর্জন করেছিল। একটি রিট আবেদনের শুনানি শেষে ২০০৪ সালের আগস্ট মাসে হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চ কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থাকে বৈধ ঘোষণা করে রায় দিয়েছিল। সে রায়ের বিরুদ্ধে দায়ের করা আপিলের ওপর শুনানি শুরু হয়েছিল ২০১২ সালের ১ মার্চ। প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের সাত সদস্যের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চকে সহায়তা করার জন্য ১০ জন সিনিয়র আইনজীবীকে অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে নিযুক্তি দেয়া হয়েছিল। তাদের মধ্যে একজন ছাড়া প্রত্যেকেই কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার পে যুক্তি তুলে ধরেছিলেন। কিন্তু সংবিধানসম্মত ব্যাখ্যা ও বক্তব্যের পরও এবং পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চের সাত সদস্যের মধ্যে ভিন্নমত থাকা সত্ত্বেও প্রধান বিচারপতি হিসেবে খায়রুল হক কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা বাতিল ঘোষণা করেছিলেন।

অন্য দুটি বিশেষ কারণেও রায়টি প্রথম থেকে ব্যাপকভাবে বিতর্কিত হয়ে এসেছে। প্রথমত, কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা বাতিল করার পাশাপাশি একই রায়ে আবার একথাও বলা হয়েছিল যে, ‘দেশের শান্তি স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার স্বার্থে’ পরবর্তী দুটি সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে পারে। দ্বিতীয়ত, রায়ের নামে যা ঘোষণা করা হয়েছিল তা ছিল একটি ‘সংপ্তি আদেশ’, পূর্ণাঙ্গ রায় নয়। অথচ এ ‘সংপ্তি আদেশের’ ভিত্তিতেই মতাসীনরা তাড়াহুড়ো করে সংবিধান সংশোধন করেছেন এবং কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দিয়েছেন। সব জেনে-বুঝেও প্রধান বিচারপতি হিসেবে খায়রুল হক সুকৌশলে ‘সংপ্তি আদেশ’টিকে প্রাধান্যে এনেছিলেন বলেই মতাসীনরাও সে সুযোগের পরিপূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে পেরেছিলেন। এজন্যই বলা হয়েছিল, স্ববিরোধিতাপূর্ণ রায়টি ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং প্রধান উদ্দেশ্য ছিল মতাসীনদের ইচ্ছা পূরণ করা। তাছাড়া ‘সংপ্তি আদেশের’ আকারে রায়টি ঘোষিত হয়েছিল ২০১১ সালের ১০ মে। অথচ আওয়ামী লীগ সরকার কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে সংবিধান পুনর্মুদ্রণ করে ফেলেছিল তারও অনেক à¦†à¦—à§‡Ñ à§§à§¦ ফেব্রুয়ারি, যখন এমনকি শুনানিই শুরু হয়নি। বিশিষ্ট আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বিষয়টিকে ‘গুরুতর’ উল্লেখ করে এ ব্যাপারে প্রতিকারের দাবি জানালেও প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক কোনো ব্যবস্থা নেননি। সঙ্গত কারণেই তখন প্রশ্ন উঠেছিল, সরকার সত্যি আদালতের ‘রায়ের আলোকে’ ব্যবস্থা নিয়েছিল, নাকি আদালতের আড়ালে বিশেষ কোনো ব্যক্তি সরকারের ইচ্ছা পূরণ করেছিলেন?

সমালোচনায় বলা হয়েছিল, মামলার রায়ে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মতো সংবিধানের এমন কোনো বিষয়কে বাতিল করা সমীচীন হয়নি, যার সঙ্গে দেশের সর্বোচ্চ আইন প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠান ‘সার্বভৌম’ জাতীয় সংসদ জড়িত রয়েছে। কারণ, সংশোধনীসহ সংবিধান সংক্রান্ত সকল বিষয়ে এখতিয়ার রয়েছে কেবল সংসদের। প্রবীণ আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদ হাইকোর্ট বিভাগকে কিছু মতা দিয়েছে সত্য কিন্তু তাই বলে সংসদে পাস হওয়া কোনো সংশোধনী বাতিল করার মতা দেয়নি। ত্রয়োদশ সংশোধনী ছিল দেশের সর্বোচ্চ আইন প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠান জাতীয় সংসদে পাস হওয়া একটি ‘অ্যাক্ট অব পার্লামেন্ট’। সেটা বাতিল বা সংশোধন করার এখতিয়ারও একমাত্র সংসদেরই, বিচারপতিদের নয়। এজন্যও আর একটি ‘অ্যাক্ট অব পার্লামেন্ট’ই দরকার ছিল। এ ব্যাপারে বিচারপতিদের রায় চূড়ান্ত হতে পারে না। কিন্তু প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক তাদের সীমা অতিক্রম করেছিলেন, অন্যদিকে মতাসীনরাও পরিস্থিতির সুযোগ নিতে ভুল করেননি।

প্রসঙ্গক্রমে বিচারপতি খায়রুল হক সম্পর্কিত কিছু তথ্যও নতুন করে আলোচিত হয়েছে। এসবের মধ্যে বেশি আলোড়ন তুলেছিল বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত একটি রিপোর্ট। ২০১২ সালের ৩০ মে প্রকাশিত ওই রিপোর্টে জানা গেছে, ২০০৯ সালে সাবেক এই প্রধান বিচারপতি আওয়ামী লীগ সরকারের কাছ থেকে ১০ লাখ ৩৭ হাজার ২৫০ টাকা পেয়েছিলেন। এই পরিমাণ টাকার চেকটি পৌঁছে দিয়েছিলেন একজন তরুণ সংসদ সদস্য, যিনি সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং যাকে নিয়ে বিশেষ কিছু কারণে রাজনৈতিক অঙ্গনে জোর আলোচনা রয়েছে। ঘটনাটা ২৭ জুলাইয়ের (২০০৯)। সোনালী ব্যংকের সুপ্রিম কোর্ট শাখায় বিচারপতি খায়রুল হকের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে চেকটি জমা দেয়া হয়েছিল। এটা ইস্যু করা হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে। জমা হওয়ার দিনই খায়রুল হক নয় লাখ টাকা উঠিয়েছিলেন। পরদিন ২৮ জুলাই তিনি নিজে আরো ২০ হাজার টাকা উঠিয়েছিলেন। অন্যকে দেয়া তার একটি অ্যাকাউন্ট পেয়ী চেকের মাধ্যমে একই দিন ওঠানো হয়েছিল আরো ৩৮ হাজার ৬০০ টাকা। কথা উঠেছিল নানা কারণে। একটি কারণ হলো, ওই টাকা পাওয়ার কিছুদিন আগে, ২০০৯ সালের ২১ জুন বিচারপতি খায়রুল হক এক ‘ঐতিহাসিক’ রায়ে ঘোষণা করেছিলেন, জিয়াউর রহমান নন, শেখ মুজিবুর রহমানই স্বাধীনতার ঘোষক। খায়রল হক তখন হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি ছিলেন। অমন একটি রায় দেয়ার পর পর এত বিপুল পরিমাণ টাকা পাওয়ায় বিশেষ ইঙ্গিতসহ গুঞ্জন ওঠা ছিল খুব স্বাভাবিক। এ নিয়ে কথা না বাড়ানোই ভালো।

কিন্তু যে কথাটি না বললেই নয় তা হলো, কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা বাতিল করাসহ বিভিন্ন রায়ের মাধ্যমে সব মিলিয়েই সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক দেশ ও জাতিকে ভয়ঙ্কর সঙ্কট ও হানাহানির মুখে ঠেলে রেখে গেছেন। একই কারণে কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়া মামলাটির পুনঃশুনানি করার দাবিকে  দেশপ্রেমিকরা যথার্থ মনে করেন। মাননীয় প্রধান বিচারপতি প্রবীণ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে মামলাটির পুনঃশুনানি করার ব্যবস্থা করলে দেশ ও জাতির জন্য নতুন সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। বলা দরকার, বিষয়টি যাতে ধামাচাপা না পড়ে সেদিকে লক্ষ্য রাখছেন সচেতন সকলেই।

অন্যান্য মিডিয়া bdnews24 RTNN Sheersha News barta24 Prothom Alo Daily Nayadiganta Jugantor Samakal Amardesh Kaler Kantho Daily Ittefaq Daily Inqilab Daily Sangram Daily Janakantha Amader Shomoy Bangladesh Pratidin Bhorerkagoj Daily Dinkal Manob Zamin Destiny Sangbad Deshbangla Daily Star New Age New Nation Bangladesh Today Financial Express Independent News Today Shaptahik 2000 Computer Jagat Computer Barta Budhbar Bangladesherkhela Holiday Bangladesh Monitor BBC Bangla Pars Today
homeabout usdeveloped by

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ মো. তাসনীম আলম।

এটিএম সিরাজুল হক কর্তৃক হক প্রিন্টার্স ১০/৮ আরামবাগ, ঢাকা-১০০০ হতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। যোগাযোগের ঠিকানাঃ ৪২৩ এলিফেন্ট রোড, বড় মগবাজার, ঢাকা - ১২১৭।

ফোন: ৮৮ ০২ ৪৮৩১৯০৬৫, ই-মেইল: sonarbanglaweekly@gmail.com, weeklysonarbangla@yahoo.com, সার্কুলেশন: ০১৫৫২৩৯৮১৯০, বিজ্ঞাপন: ৪৮৩১৫৫৭১, ০১৯১৬৮৬৯১৬৮, ০১৭৩৪০৩৬৮৪৬।