সংবাদ শিরোনামঃ

বিশ্বব্যাপী শোক নিন্দা ও প্রতিবাদ ** আওয়ামী লীগকে সমর্থন না করায় বিচারের মুখোমুখি ** তারপরও কেন এই বিদ্যুৎ সঙ্কট ** ধৈর্য ও সাহসিকতার সাথে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে : মকবুল আহমাদ ** সংলাপ সমঝোতার পরিবর্তে সংঘাতের পথে সরকার ** ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দকে মানুষের কল্যাণে কাজ করতে হবে : অধ্যাপক মুজিব ** সরকারের সদিচ্ছার অভাবে পানি পাচ্ছে না বাংলাদেশ ** টাকার বিনিময়ে মনোনয়ন রাষ্ট্রের জন্য ভয়ঙ্কর ** দেশ জাতি ও ইসলামের জন্যই তার এ আত্মত্যাগ ** শেষ বিদায়ের আগে আব্বুর পাশে ** সঙ্কট মোকাবেলায় বেশি বেশি আল্লাহর সাহায্য কামনা করতে হবে ** কুড়িগ্রামে ধানের মণ ৪শ’ থেকে ৫শ’ টাকা॥ হতাশ কৃষক ** শোকার্ত মানুষের ঢল ** কাজী নজরুল ইসলামের একটি অনন্য দিক **

ঢাকা, শুক্রবার, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৩, ১২ শাবান ১৪৩৭, ২০ মে ২০১৬

ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম রেজাউল করিম
২৫ মে, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মবার্ষিকী। নজরুল বাঙালির মননশীলতার অনেকখানি জায়গা জুড়ে বিস্তৃত আছে। আজীবন সংগ্রামী এই কবির জীবনী যেন এক জিয়নকাঠি। মুহূর্তেই জেগে উঠে মন প্রাণ। মৃত্যুর প্রায় অর্ধ শতাব্দী হতে চললেও নজরুল প্রাসঙ্গিক। নজরুলকে অনেক পরিচয়ে পরিচায়িত করা যায়। তিনি একাধারে কবি, সাংবাদিক, সৈনিক, সুরকার, সাহিত্যিক রাজনীতিবিদ তো বটেই। অসংখ্য ধর্মীয় গীত রচনা করে নজরুল হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের প্রিয় পাত্রে পরিনত হয়েছিলেন জীবদ্দশায়। নজরুল কেমন ছিলেন সত্যিকার অর্থে, তেমনি কিছু বিষয় নিয়ে নিম্নে আলোকপাত করার চেষ্টা করেছি।

বিদ্রোহের জয়ডঙ্কা বাজিয়ে ধুমকেতুর মতো যার আগমন তিনি হচ্ছেন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, সুরস্রষ্টা, সাংবাদিক, রাজনীতি সচেতন ব্যক্তি, শিল্পী, সুরকার, প্রাবন্ধিক। নজরুলের কবিতায়, সাংবাদিকতায়, সঙ্গীতের প্রতিটি পরতে পরতে ফুটে উঠেছে নিপীড়িত, বঞ্চিত, খেটে খাওয়া মানুষের কথা। তিনিই প্রথম ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতার কথা বলেছিলেন।

১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মে (১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ) ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন কাজী নজরুল ইসলাম। চুরুলিয়া গ্রামটি আসানসোল মহকুমার জামুরিয়া থানায় অবস্থিত। পিতামহ কাজী আমিনউল্লাহর পুত্র কাজী ফকির আহমদের দ্বিতীয়া পতœà§€ জাহেদা খাতুনের ষষ্ঠ সন্তান তিনি। তার বাবা ছিলেন স্থানীয় এক মসজিদের ইমাম। তারা ছিলেন তিন ভাই এবং বোন। তার সহোদর তিন ভাইও দুই বোনের নাম হল : সবার বড় কাজী সাহেবজান, কনিষ্ঠ কাজী আলী হোসেন, বোনউম্মে কুলসুম। কাজী নজরুল ইসলামের ডাক নাম ছিল “দুখু মিয়া”। ব্রিটিশ শাসিত ভারতের অখণ্ড বঙ্গভূমির বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্ম নিলেও নন্দিত কবিপুরুষ কাজী নজরুল ইসলাম আজ আমাদের জাতীয় কবি। রাজনৈতিক উত্থান-পতনে নানা ভৌগোলিক বিভাজনের সূত্রে এক অর্থে ভিনদেশি হয়েও যে-কারণে তিনি আজ আমাদের জাতীয় কবির মর্যাদায় অভিষিক্ত, এর পেছনে রয়েছে তাঁর প্রতি ও তাঁর সৃষ্টিকর্মের প্রতি আমাদের অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা এবং একই সঙ্গে এদেশের মানুষের সঙ্গে তাঁর নিজের সম্পৃক্ততা, সম্প্রীতি ও আক্ষরিক অর্থেই প্রেমের বন্ধন।

তিনিস্থানীয় মক্তবে (মসজিদ পরিচালিত মুসলিমদের ধর্মীয় স্কুল) কুরআন, ইসলাম ধর্ম, দর্শন এবং ইসলামী ধর্মতত্ত্ব অধ্যয়ন শুরু করেন। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে যখন তার পিতার মৃত্যু হয়, তখন তারবয়স মাত্র নয় বছর। পারিবারিক অভাব অনটনের কারণে তাঁর শিক্ষা বাধাগ্রস্ত হয় এবং মাত্র দশ বছর বয়সে তাকে নেমে যেতে হয় জীবিকা অর্জনে। এ সময় নজরুল মক্তব থেকে নিম্নমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে উক্ত মক্তবেই শিক্ষকতা শুরু করেন। একই সাথে হাজী পালোয়ানের কবরের সেবক এবং মসজিদের মুয়াজ্জিন (আজানদাতা) হিসেবে কাজ শুরু করেন। এইসব কাজের মাধ্যমে তিনি অল্প বয়সেই ইসলাম ধর্মের মৌলিক আচার অনুষ্ঠানের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হবার সুযোগ পান যা তার পরবর্তী সাহিত্য কর্মকে বিপুলভাবে প্রভাবিত করেছে। তিনিই বাংলা সাহিত্যে ইসলামী চেতনার চর্চা শুরু করেছেন বলা যায়।

কৈশোরে বিভিন্ন থিয়েটার দলের সাথে কাজ করতে গিয়ে তিনি কবিতা, নাটক এবং সাহিত্য সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান লাভ করেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কিছুদিন কাজ করার পর তিনি সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। এসময় তিনি কলকাতাতেই থাকতেন। এ সময় তিনি ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। প্রকাশ করেন বিদ্রোহী এবং ভাঙার গানের মত কবিতা; ধূমকেতুর মত সাময়িকী। জেলে বন্দী হলে পর লিখেন রাজবন্দীর জবানবন্দী। এসব সাহিত্যকর্মে সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা ছিল সুস্পষ্ট। ধার্মিক মুসলিম সমাজ এবং অবহেলিত ভারতীয় জনগণেরসাথে তার বিশেষ সম্পর্ক ছিল। পরবর্তীতে তিনি বিংশ শতাব্দীর অন্যতম জনপ্রিয় বাঙালি কবি, সঙ্গীতজ্ঞ, সংগীতস্রষ্টা, দার্শনিক পরিচিতি লাভ করেন। বাংলাভাষার অন্যতম সাহিত্যিক, দেশপ্রেমী এবং বাংলাদেশের জাতীয় কবি। পশ্চিমবঙ্গও বাংলাদেশ দুই বাংলাতেই তাঁর কবিতা ও গান সমানভাবে সমাদৃত। তাঁর কবিতায় বিদ্রোহী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তাঁকে বিদ্রোহী কবি বলা হয়। তার কবিতার মূল বিষয়বস্তু ছিল মানুষের প্রতি মানুষের অত্যাচার এবং দাসত্বের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ। বাংলা মননে কাজী নজরুল ইসলামের মর্যাদা ও গুরুত্ব অপরিসীম। একাধারে কবি, সাহিত্যিক, সংগীতজ্ঞ, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ এবং সৈনিক হিসেবে অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে নজরুল সর্বদাই ছিলেন সোচ্চার। তাঁর কবিতা ও গানে এই মনোভাবই প্রতিফলিত হয়েছে। অগ্নিবীণা হাতে তাঁর প্রবেশ, ধূমকেতুর মতো তাঁর প্রকাশ। যেমন লেখাতে বিদ্রোহী, তেমনই à¦œà§€à¦¬à¦¨à§‡Ñ à¦•à¦¾à¦œà§‡à¦‡ “বিদ্রোহী কবি”।

মক্তব, মসজিদ ও মাজারের কাজে নজরুল বেশি দিন ছিলেননা। বাল্য বয়সেই লোকশিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে একটি লেটো (বাংলার রাঢ় অঞ্চলের কবিতা, গান ও নৃত্যের মিশ্র আঙ্গিক চর্চার ভ্রাম্যমাণ নাট্যদল)। দলে যোগ দেন। তার চাচা কাজী বজলে করিম চুরুলিয়া অঞ্চলের লেটো দলের বিশিষ্ট ওস্তাদ ছিলেন এবং আরবি, ফারসি ও উর্দূ ভাষায় তার দখল ছিল। এছাড়া বজলে করিম মিশ্র ভাষায় গান রচনা করতেন। ধারণা করা হয় বজলে করিমের প্রভাবেই নজরুল লেটো দলে যোগ দিয়েছিলেন। এছাড়া ঐ অঞ্চলের জনপ্রিয় লেটো কবি শেখ চকোর (গোদা কবি) এবং কবিয়া বাসুদেবের লেটো ও কবিগানের আসরে নজরুল নিয়মিত অংশ নিতেন। লেটো দলেই সাহিত্য চর্চা শুরু হয়। এই দলের সাথে তিনি বিভিন্ন স্থানে যেতেন, তাদের সাথে অভিনয় শিখতেন এবং তাদের নাটকের জন্য গান ও কবিতা লিখতেন। নিজকর্ম ববং অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি বাংলা এবং সংস্কৃত সাহিত্য অধ্যয়ন শুরু করেন। একই সাথে হিন্দু ধর্মগ্রন্থ অর্থাৎ পুরাণসমূহ অধ্যয়ন করতে থাকেন। সেই অল্প বয়সেই তার নাট্যদলের জন্য বেশকিছু লোকসঙ্গীত রচনা করেন। এরমধ্যে রয়েছে চাষার সঙ, শকুনী বধ, রাজা যুধিষ্ঠিরের সঙ, দাতা কর্ত, আকবর বাদশাহ, কবি কালিদাস, বিদ্যাভূতুম, রাজপুত্রের গান, বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ এবং মেঘনাদবধ। একদিকে মসজিদ, মাজার ও মক্তব জীবন, অপর দিকে লেটো দলের বিচিত্র অভিজ্ঞতা নজরুলের সাহিত্যিক জীবনের অনেক উপাদান সরবরাহ করেছে। নজরুলের এ সময়কার কবিতার উদাহরণ দেয়া যেতে পারে :

“আমি আল্লা নামের বীজ বুনেছি এবার মনের মাঠে

ফলবে ফসল বেচবো তারে কিয়ামতের হাটে।”

১৯১০সালে নজরুল লেটো দল ছেড়ে ছাত্র জীবনে ফিরে আসেন। লেটো দলে তার প্রতিভায় সকলেই যে মুগ্ধ হয়েছিল তার প্রমাণ নজরুল লেটো ে ড়ে আসার পর তাকে নিয়ে অন্য শিষ্যদের রচিত গান : “আমরা এই অধীন, হয়েছি ওস্তাদহীন /ভাবি তাই নিশিদিন, বিষাদ মনে/নামেতে নজরুল ইসলাম, কি দিব গুণের প্রমাণ”। এই নতুন ছাত্রজীবনে তার প্রথম স্কুল ছিল রানীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুল। এর পরভর্তি হন মাথরুন উচ্চ ইংরেজি স্কুলে যা পরবর্তীতে নবীন চন্দ্র ইনস্টিটিউশন নামে পরিচিতি লাভ করে। মাথরুন স্কুলের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক ছিলেন কুমুদ রঞ্জন মল্লিক যিনি সেকালের বিখ্যাত কবি হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। তার সান্নিধ্য নজরুলের অনুপ্রেরণার একটি উৎস। কুমুদরঞ্জন স্মৃতিচারণ করতে যেয়ে নজরুল সম্বন্ধে লিখেছেন,

“ছোট সুন্দর ছনমনে ছেলেটি, আমি ক্লাস পরিদর্শন করিতে গেলে সে আগেই প্রণাম করিত। আমি হাসিয়া তাহাকে আদর করিতাম। সে বড় লাজুক ছিল।

যাহোক, আর্থিক সমস্যা তাকে বেশি দিন এখানে পড়াশোনা করতে দেয়নি। ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর তাকে আবার কাজে ফিরে যেতে হয়। প্রথমে যোগ দেন বাসুদেবের কবি দলে। এর পর একজন খ্রিস্টান রেলওয়ে গার্ডের খানসামা এবং সবশেষে আসানসোলের চা-রুটির দোকানে রুটি বানানোর কাজ নেন। এভাবে বেশ কষ্টের মাঝেই তার বাল্য জীবন অতিবাহিত হতে থাকে। এই দোকানে কাজ করার সময় আসানসোলের দারোগা রফিজ উল্লাহ’র’ সাথে তার পরিচয় হয়। দোকানে একা একা বসে নজরুল যেসব কবিতা ও ছড়া রচনা করতেন তা দেখে রফিজ উল্লাহ তার প্রতিভার পরিচয় পান। তিনিই নজরুলকে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের দরিরামপুর স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি করে দেন। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি আবার রানীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুলে ফিরে যান এবং সেখানে অষ্টম শ্রেণী থেকে পড়াশোনা শুরু করেন। ১৯১৭ সাল পর্যন্ত এখানেই পড়াশোনা করেন। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের শেষদিকে মাধ্যমিকের প্রিটেস্ট পরীক্ষার না দিয়ে তিনি সেনাবাহিনীতে সৈনিক হিসেবে যোগ দেন। এই স্কুলে অধ্যয়নকালে নজরুল এখানকার চারজন শিক্ষক দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। এরা হলেন উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের সতীশচন্দ্র কাঞ্জিলাল, বিপ্লবী চেতনা বিশিষ্ট নিবারণ চন্দ্র ঘটক, ফারসি সাহিত্যের হাফিজ নুরুন্নবী এবং সাহিত্য চর্চার নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।

নজরুলের জীবনালেখ্য পর্যালোচনা করলে জানা যায়, এদেশের ভূখণ্ডে তিনি পা রাখেন তাঁর কৈশোরেই। দারিদ্র্যকবলিত পরিবারে জন্ম নেওয়া এই কবি-কিশোর আসানসোলের মাথরুন স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণির পাঠ চুকিয়ে কিছুদিন প্রসাদপুরের এক বাঙালি খ্রিস্টান পরিবারে বাবুর্চির কাজ করেন। আবারও আসানসোলে এসে যখন তিনি একটি রুটির দোকানে দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কাজ করছিলেন তখন ঘটনাচক্রে তাঁর সাহিত্য-প্রতিভার পরিচয় পেয়ে কাজী রফিজ উল্লাহ নামে এক পুলিশ কর্মকর্তা তাঁকে পরিবারের সদস্যের মতো নিজ বাড়িতে আশ্রয় দেন। কিছুদিন পরই তিনি ময়মনসিংহের ত্রিশাল থানায় দারোগা হিসেবে বদলি হলে নজরুলকেও সঙ্গে নিয়ে কাজীর সিমলা গ্রামে আসেন। ১৯১৪ সালের জানুয়ারি মাসে পার্শ্ববর্তী দরিরামপুর হাইস্কুলে নজরুলকে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি করে দেওয়া হয়। নিজগুণেই নজরুল বিনাবেতনে লেখাপড়ার সুযোগ পান। বার্ষিক পরীক্ষায় তিনি প্রথম স্থান পেয়ে অষ্টম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে চঞ্চলমতি নজরুল কাউকে না-জানিয়ে তাঁর নিজ গ্রাম চুরুলিয়ায় ফিরে যান। কিন্তু কাজীর সিমলা গ্রাম ও দরিরামপুর স্কুলকে তিনি ভুলে যাননি। ১৯২৬ সালের ১৭-১৮ জানুয়ারি ময়মনসিংহে এক কৃষক-শ্রমিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। আমন্ত্রণ পেয়ে সম্মেলনে যোগ দিতে না-পারলেও কৃষ্ণনগর থেকে পাঠানো এক বাণীতে কবি লেখেন : ‘ময়মনসিংহ জেলার কাছে আমি অশেষ ঋণে ঋণী। আমার বাল্যকালের অনেকগুলো দিন ইহারই বুকে কাটিয়া গিয়াছে... আজও আমার মনে সেইসব প্রিয় স্মৃতি উজ্জ্বল ভাস্বর হইয়া জ্বলিতেছে।’ পরিণত বয়সে আবারো ময়মনসিংহ অঞ্চলে নজরুল অনেক ঘুরেছেন। ভারতীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য হিসেবে তিনি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ঢাকা, বাকেরগঞ্জ, ফরিদপুর ও ময়মনসিংহ জেলার বিস্তৃত অঞ্চল ছিল তাঁর নির্বাচনী এলাকা। জয়লাভ তো দূরের কথা, নির্বাচনে তাঁর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছিল। ভোটপ্রার্থী হিসেবে প্রত্যাখ্যাত হলেও কবি হিসেবে তিনি সর্বত্রই ছিলেন সমাদৃত। নজরুলের স্মৃতিকে অমর করে রাখার জন্য কাজী নজরুল ইসলামের নামে ময়মনসিংহে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে।

বিভিন্ন সময়ে নানা কাজের সূত্রে, তাঁকে দেওয়া সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ও বহু সম্মেলনে যোগ দিতে নজরুল ইসলাম এদেশের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়িয়েছেন। যেখানে তিনি আজ চিরনিদ্রায় শায়িত, সেই ঢাকা শহর ও এর আশপাশের এলাকায় তাঁর কর্মময় দিনগুলোর দিকে তাকানো যাক।

নজরুল প্রথমবারের মতো ঢাকায় আসেন বিতর্কিত তারিখ ১৯২৬ সালের ২৪ জুন (!) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে ২৭-২৮ জুনে অনুষ্ঠিত মুসলিম সাহিত্য সমাজের একটি অধিবেশনে যোগ দিতে। এখানে এসে প্রথমবারের মতো পরিচয় ঘটে কবি ও প্রাবন্ধিক আবদুল কাদির, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের উদ্যোক্তা কাজী আবদুল ওদুদ, আবদুল মজিদ সাহিত্যরতœ ও অন্য অনেকের সঙ্গে। নজরুল সেই সম্মেলনে ইসলামি পুনর্জাগরণ বিষয়ে বক্তব্য রাখার পর গজল গাওয়া ছাড়াও তাঁর ‘খালেদ’ কবিতাটি আবৃত্তি করেন এবং ‘খোশ আমদেদ’ নামে একটি নতুন গান পরিবেশন করেন। চট্টগ্রামের সাপ্তাহিক সম্মিলনী এবং মাসিক যুগের আলো পত্রিকার সম্পাদক দিদারুল আলম এ সময়ে ঢাকায় আসেন। তাঁর অনুরোধে নজরুল আট পক্তির প্রশস্তি লিখে দেন, যা যুগের আলোর একটি সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। ১৯২৮ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে মুসলিম সাহিত্য সমাজের দ্বি-বার্ষিক সম্মেলনে যোগ দিতে নজরুল আবারও ঢাকায় আসেন; ওঠেন ড. কাজী মোতাহার হোসেনের বর্ধমান হাউসের বাসায়। এখানে বসে তিনি ‘এ বাসী আসরে আসিলে কে ছলিতে’ এবং ‘চল চল চল’ গানটি রচনা করেন, যা এখন আমাদের রণসংগীতের মর্যাদা পেয়েছে। এ-সফরে তিনি পরিচিত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির শিক্ষক প্রখ্যাত কবি ও প্রাবন্ধিক বুদ্ধদেব বসু এবং কাজী মোতাহার হোসেনের দূর সম্পর্কের বোন ফজিলতুননেসার সঙ্গে। ফজিলতুননেসা ছিলেন প্রথম মুসলমান নারী, যিনি গণিত শাস্ত্রে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হওয়ার গৌরব অর্জন করেন এবং পরে সরকারি বৃত্তি নিয়ে বিলেতে যান। ফজিলতুননেসার রূপে-গুণে মুগ্ধ হয়ে নজরুল তাঁর প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েন এবং এ-বিষয়ে কাজী মোতাহার হোসেন ও ফজিলতুননেসাকে অনেক চিঠি লিখেন ও বই পাঠান। কাজী মোতাহার হোসেন একটি চিঠিতে ফজিলতুননেসার অনাগ্রহের কথা জানালে নজরুল অনুশোচনা করে এ-বিষয়ে বিরত হন। এরপর হঠাৎ করেই তিনি একই বছরের জুন মাসে আবারো ঢাকায় এলে ঘনিষ্ঠতা জন্মে রানু সোম নামে এক সুকণ্ঠী তরুণীর সঙ্গে, যিনি পরে বুদ্ধদেব বসুর স্ত্রী হওয়ার পর প্রতিভা বসু নামে খ্যাতি অর্জন করেন। সেবারের ঢাকা সফরকালে নজরুল রানু সোমকে তাঁদের বনগ্রামের বাসায় গানের তালিম দিতে শুরু করেন এবং তাঁদের বাসায় বসে তিনি ‘আমার কোন কূলে আজ ভিড?লো তরী এ কোন্ সোনার গাঁয়’ গানটি রচনা করেন। এ-সময়ে তিনি একদল গোঁড়া তরুণের আক্রমণের শিকার হন; তারা লাঠিসোটা নিয়ে নজরুলের ওপর ঝাঁপিয়ে  পড়ে, কিন্তু সৈনিক হিসেবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নজরুলের সঙ্গে তারা পেরে ওঠেনি। রানু সোম পরে কলকাতায় গিয়ে নজরুলের কাছে গান শেখেন এবং নজরুলের প্রচেষ্টায় তিনি গ্রামোফোনে ও বেতারে গান গাওয়ার সুযোগ পান। নজরুলের সঙ্গে রানু সোম ওরফে প্রতিভা বসুর সম্পর্ককে ব্যঙ্গ করে শনিবারের চিঠি পত্রিকায় নজরুলের ‘কে বিদেশী মন উদাসী’ গানটির প্যারোডি ‘কে উদাসী বনগাঁবাসী’ ছাপা হয়।

১৯২৬ সালে ভারতীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্যপ্রার্থী হিসেবে নজরুল নির্বাচনী প্রচারের কাজে ঢাকা হয়ে জয়দেবপুরে গিয়েছিলেন। পথে যেতে যেতে তিনি ‘চাঁদনী রাতে’ নামে কবিতাটি লেখেন। কবি আবদুল কাদিরের বিয়ে উপলক্ষে ১৯৩৪ সালের ২১ অক্টোবর কবি ঢাকায় আসেন এবং ‘বন্ধন’ শীর্ষক ‘অনন্তকাল এ অনন্তলোকে’ আশীর্বাণী রচনা করেন। নারায়ণগঞ্জ সংগীত সংসদের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আববাস উদ্দীনসহ কয়েকজন শিল্পীকে সঙ্গে নিয়ে নজরুল ঢাকা হয়ে নারায়ণগঞ্জে আসেন ১৯৩৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর।

ঢাকা বেতার কেন্দ্রের প্রথম বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে নজরুল ঢাকায় আসেন বুদ্ধদেব বসু ও একদল শিল্পীকে সঙ্গে নিয়ে ১৯৪০ সালের ১৬ ডিসেম্বর। তাঁর রচনা ও পরিচালনায় ‘পূবালী’ নামে একটি সংগীত-বিচিত্রা প্রচারিত হয় ঢাকা বেতার থেকে। পদ্মা নদী পাড়ি দিয়ে আসার সময় রচিত ‘পদ্মার ঢেউ রে’ এবং নৌকায় ভাসমান বেদে সম্প্রদায়ের মেয়েদের দেখে লেখা ‘আমি পূরব দেশের পূরনারী’ গানগুলো সেই সংগীত-বিচিত্রার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৪০ সালের ২৬ মার্চ ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত শচীন সেনগুপ্তের ‘ঝড়ের রাতে’ নাটকের সংগীত পরিচালনায় ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। সংগত কারণে ঢাকায় কাটানো নজরুলের শেষ-জীবনের তথ্যাবলি এ লেখার শেষাংশে তুলে ধরা হলো।

নজরুল প্রথমবারের মতো কুমিল্লায় আসেন ১৯২১ সালের ৪ এপ্রিল। আসার পথে ট্রেনে বসে তিনি লেখেন ‘নীলপরী’ নামে একটি কবিতা। দৌলতপুর যাওয়ার পথে তাঁদের যাত্রাবিরতি ঘটে কান্দিরপাড়ে, সফরসঙ্গী আলী আকবর খানের পরিচিত ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাড়িতে। ইন্দ্র কুমারের স্ত্রী বিরজা সুন্দরীর স্নেহে আপ্লুত হয়ে নজরুল তাঁকে ‘মা’ বলে সম্বোধন করেন; পরে তাঁকে নিয়ে কবিতা লেখেন ও তাঁর নামে বই উৎসর্গ করেন; সে-বাড়িতেই তাঁর ঘনিষ্ঠতা জন্মে বিরজা সুন্দরীর দেবর বসন্তকুমার সেনগুপ্ত ও গিরিবালা দেবীর মেয়ে আশালতার সঙ্গে, যাঁর ডাকনাম ছিল দোলন বা দুলি - নজরুল নিজে যাঁর নাম দিয়েছিলেন প্রমীলা। একই যাত্রায় একদিন পর দৌলতপুর গিয়ে ঘটে আরো এক নাটকীয় এবং অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা। এক বিয়ের অনুষ্ঠানে নজরুল পরিচিত হন আলী আকবর খানের পিতৃহীন ভাগ্নি সৈয়দা খাতুনের সঙ্গে, নজরুল যার নাম দিয়েছিলেন নার্গিস। সেই বিয়ের অনুষ্ঠানে নার্গিসের গান শুনে ও রূপ দেখে তিনি মুগ্ধ হয়ে তাঁর প্রেমে পড়েন। অল্পদিনের মধ্যেই দৌলতপুরে বসে অনেক কবিতা ও গান লিখে ফেলেন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে : ‘অ-বেলায়’, ‘হার-মানা হার’, ‘পাপড়ি খোলা’, ‘অনাদৃতা’। হঠাৎ সিদ্ধান্ত নেন নার্গিসকে তিনি বিয়ে করবেন। খবর পেয়ে কমরেড মুজাফ্ফর আহমেদসহ কবির বহু সুহৃদ বিয়ের ব্যাপারে তাঁকে সাবধানে এগোতে পরামর্শ দেন। তাঁর ও নার্গিসের একান্ত আগ্রহে ১৯২১ সালের ১৭ জুন নজরুল-নার্গিসের ‘আক্ত’ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। অজ্ঞাত কারণে কনের মামা আলী আকবর খান কাবিননামায় শর্ত জুড?ে দেন, নজরুল নার্গিসকে নিয়ে কখনো দৌলতপুর ছেড়ে যেতে পারবেন না। এই অন্যায় আচরণ ও শর্তে মর্মাহত কবি পরের দিনই নার্গিসকে ফেলে রেখে হেঁটে কুমিল্লার কান্দিরপাড়ে পৌঁছেন। কিন্তু এরই মধ্যে দৌলতপুরে বসেই তিনি লিখে ফেলেন ‘বিদায়-বেলায়’, ‘বেদনা-অভিমান’, ‘বিধুরা পথিক-প্রিয়া’, ‘মুকুলের উদ্বোধন’, ‘লাল সালাম’, ‘হারা-মণি’, ‘মানস বধূ’ ও ‘মনের মানুষ’ কবিতাগুলো। কান্দিরপাড়ে প্রমীলার ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে থেকে কবি নার্গিসকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করেন। জুনের শেষ সপ্তাহে তিনি কুমিল্লায় বসে ‘আজি রক্তনিশি ভোরে’, ‘ভিক্ষা দাও’- এ দুটি দেশাত্মবোধক গান এবং ‘আমি এ দেশ হতে বিদায় যেদিন নেব প্রিয়তমা’ - এই প্রেমের গানটি রচনা করেন।

১৯২১ সালের ১৮ নভেম্বর নজরুল আবারও কুমিল্লায় আসেন এবং যথারীতি ওঠেন প্রমীলাদের বাসায়। সেখানে পৌঁছেই ‘বন্দনা গান’ নামে একটি গান লেখেন, যা পরে ‘বিজয় গান’ নামে সাধনা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। একই সময়ে তিনি ‘নিশীথ-প্রীতম’ ও ‘বিজয়িনী’ নামে দুটি কবিতা লেখেন। ব্রিটিশ যুবরাজ প্রিন্স অব ওয়েলসের ভারত সফর উপলক্ষে দেশব্যাপী তখন হরতাল চলছে। কুমিল্লায় একটি মিছিলে কাঁধে হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে তিনি সরকার বিরোধী গান গেয়েছেন, মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং তরুণদের জন্য ‘জাগরণী’ নামে একটি নতুন কোরাস গান লিখে দিয়েছিলেন। সেই গান রচনা ও প্রচারের দায়ে একরাত তাঁকে থানায় আটকে রাখা হয়।   (চলবে)

অন্যান্য মিডিয়া bdnews24 RTNN Sheersha News barta24 Prothom Alo Daily Nayadiganta Jugantor Samakal Amardesh Kaler Kantho Daily Ittefaq Daily Inqilab Daily Sangram Daily Janakantha Amader Shomoy Bangladesh Pratidin Bhorerkagoj Daily Dinkal Manob Zamin Destiny Sangbad Deshbangla Daily Star New Age New Nation Bangladesh Today Financial Express Independent News Today Shaptahik 2000 Computer Jagat Computer Barta Budhbar Bangladesherkhela Holiday Bangladesh Monitor BBC Bangla Pars Today
homeabout usdeveloped by

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ মো. তাসনীম আলম।

এটিএম সিরাজুল হক কর্তৃক হক প্রিন্টার্স ১০/৮ আরামবাগ, ঢাকা-১০০০ হতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। যোগাযোগের ঠিকানাঃ ৪২৩ এলিফেন্ট রোড, বড় মগবাজার, ঢাকা - ১২১৭।

ফোন: ৮৮ ০২ ৪৮৩১৯০৬৫, ই-মেইল: sonarbanglaweekly@gmail.com, weeklysonarbangla@yahoo.com, সার্কুলেশন: ০১৫৫২৩৯৮১৯০, বিজ্ঞাপন: ৪৮৩১৫৫৭১, ০১৯১৬৮৬৯১৬৮, ০১৭৩৪০৩৬৮৪৬।