নিবেদিতপ্রাণ ইসলাম প্রচারক : মাওলানা আব্দুল আউয়াল

মো. মকবুল হোসেন সরকার
মাওলানা আব্দুল আউয়াল জৌনপুরী ১২৮৩ হিজরী ১৮৬৬ সাল সন্দ্বীপে আসরের নামাজের সময় বজরায় (নৌকায়) জন্মগ্রহণ করেন। মাওলানা আব্দুল আউয়ালের পিতা মাওলানা কারামত আলী মন্তব্য করেন তাঁর সন্তান একদিন প্রখ্যাত লেখক হবে।

পবিত্র কুরআন শরিফ হিফয করার পর মাওলানা আউয়াল রামাযানের তারাবীহ-এর নামাজে সর্বপ্রথম ১০ দিনে পুরো কুরআন খতম করেন জৌনপুরের মোলা-টোলা মসজিদে (১২৯৮ হিজ./১৮৮১ সাল)। ওস্তাদ হাফেজ আহসান, তাঁর ভাই মাওলানা মুহসিন ও ভগ্নিপতি মাওলানা মুসলিহ উদ্দিন বড় জামাআতে মুকতাদীরূপে মাওলানা আউয়ালের এই কুরআন খতম শুনে খুবই খুশি হন।

তিনি লক্ষেèৗতে গিয়ে ইসলামের ওপর লেখাপড়া শুরু করেন।

উচ্চশিক্ষার জন্য মক্কা শরীফ গমন : উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি মক্কা শরীফে গমন করেন এবং সেখানে দু’বছর অবস্থান করেন। মাওলানা আউয়াল জৌনপুরী পবিত্র মক্কায় পৌঁছে মাওলানা রহমাতুল্লাহ হিন্দী প্রতিষ্ঠিত মাদরাসায় এ সাওলাতিয়ায় ভর্তি হন। সেখানে তিনি মাদরাসার অধ্যক্ষ মাওলানা রহমতুল্লাহ, মাওলানা নূর, মাওলানা হাফেজ আব্দুল্লাহ মক্কী ও অন্যদের নিকট ফিকহ শাস্ত্রের মূলনীতি, হাদিস, অভিধান সংকলন ও আরবি সাহিত্য শিক্ষা করেন। অতঃপর মক্কায় বসতি স্থাপনকারী প্রখ্যাত হাদিস তাফসীরবিদ মাওলানা আব্দুল হক এলাহাবাদী মুহাজির ও মক্কীর নিকট হাদিস তাফসীর ও আরবি সাহিত্য শিক্ষা করেন এবং হাদিসের চল্লিশটি কিতাব সনদ লাভ করেন। মক্কায় থাকাকালে তিনি দুইবার হজ্ব করেন। একবার মদিনায়  নবীজীর রওজা মুবারক যিয়ারত করেন।

জৌনপুরে প্রত্যাবর্তন : প্রায় দু’বছর (১৮৮৮-৮৯) পবিত্র মক্কায় জ্ঞানচর্চা করে মাওলানা আউয়াল জৌনপুরী ১৩০৭ হিজরি মোতাবেক ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে জৌনপুরে প্রত্যাবর্তন করেন। মাওলানা জৌনপুরীর ইচ্ছা ছিল আনুষ্ঠানিক পড়াশোনা শেষ করার পরেও কিছুদিন আরব দেশে অবস্থান করবেন। অতঃপর মুসলিম দেশসমূহ যেমন মিসর, সিরিয়া ইত্যাদি সফর করবেন। কিন্তু ভাগ্যে তা ছিল না। হঠাৎ দেশ থেকে খবর আসল যে, তাঁর বড় ভগ্নিপতি মাওলানা মুসলিহ উদ্দিন পাবনায় ইন্তিকাল করেছেন (১৮৮৯)। তাঁকে সেখানে দাফন করা হয়েছে। সাত বছর বয়সে মাওলানা জৌনপুরীর পিতৃবিয়োগের পর থেকে বড় বোনই তাঁর ভরণপোষণ করে আসছিলেন। মাওলানা জৌনপুরীর পড়াশোনার ব্যয় তিনিই নির্বাহ করতেন। তাই ভগ্নিপতির মৃত্যু সংবাদে তিনি বিচলিত হন এবং বড় বোন ও ভাগনে ভাগ্নিদের লালন-পালনের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন।

দেশে ফেরার সময় তাঁর উস্তাদ আব্দুল হক মুহাজির এ মক্কী এলাহাবাদী বলেছিলেন : আল্লাহ আবার তোমাকে এখানে (মক্কায়) ফিরিয়ে আনবেন। বস্তুত তাই হলো। তিনি আবার ১৩২৫/১৯০৭ সালে পবিত্র মক্কায় গমন করেন। ১৮৮৯ সালে পবিত্র মক্কা  থেকে জৌনপুরে প্রত্যাবর্তনের পর মাওলানা জৌনপুরী প্রতি জুমুবার দিন স্থানীয় মসজিদে ওয়াজ নসীহত করতেন। উপর্যুপরি কয়েক জুমুআয় তিনি এই হিদায়েতের কাজ অব্যাহত রাখেন।

বাংলা আসামে ইসলাম প্রচার : ১৩০৭ হিজরির রবিউল আউয়াল মাসের প্রথম দিকে অর্থাৎ ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে মাওলানা আব্দুল আউয়াল জৌনপুরী ইসলাম প্রচার এবং মুসলিম জনসাধারণের ধর্মীয় চিন্তাধারা ও আচার অনুষ্ঠান সংস্কারের উদ্দেশ্যে পূর্ববাংলায় পদার্পণ করেন। প্রথমে তিনি ঢাকার চকবাজার শাহী মসজিদে ওয়াজ করেন। অতঃপর শহরের মহল্লায় মহল্লায় ওয়াজের মাহফিল শুরু হয়। ঢাকার নিকটবর্তী বিভিন্ন এলাকায় তিনি ওয়াজ নসীহত করেন। হযরত মাওলানা আব্দুল আউয়াল জৌনপুরী (রহ.) বাংলা ও আসামে ইসলাম ধর্ম প্রচারে বিশেষ অবদান রাখেন। দেশে ফিরে মাওলানা জৌনপুরী তাঁর বাল্যকালীন ওস্তাদের কন্যাকে বিয়ে করেন (১৮৯০/৯১)।

কিতাব লেখার কাজে আত্মনিয়োগ :

উর্দু ও আরবি ভাষায় তার প্রখর জ্ঞান ছিল। তিনি হাদিস, ফিকাহ, শরিয়াহ এবং মাসলা মাসায়েলের উপর ১২১টি বই রচনা করেন। তন্মধ্যে ৬৩টির তথ্য ড. মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ তাঁর রচিত “মাওলানা আব্দুল আউয়াল জৌনপুরী (রহ.) আরবি সাহিত্য ও হাদিসে তাঁর গভীর অনুরাগ চিল। আরবি, ফার্সি, উর্দু ও বাংলা এ ক’টি ভাষায় তিনি অনর্গল কথা বলতে পারতেন। তিনি কম খেতেন ও কম ঘুমাতেন। তিনি চমৎকার অনেক আরবি কবিতা রচনা করেন। জীবনের ৫৫ বছরের মধ্যে ৩৩ বছর ইসলাম ধর্ম প্রচার ও বই প্রকাশনার কাজে তিনি আত্মনিয়োগ করেন।

ইন্তিকাল : মাওলানা আব্দুল আউয়াল জৌনপুরী (রহ.) ১৩৩৯ হিজরি ১২ শাওয়াল ১৯২১ সালের ১৮ জুন শনিবার রাতে কলকাতায় ইন্তিকাল করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মানিকতলায় তাঁর দীর্ঘদিনের ভক্ত ঢাকার আব্দুর রহমান খানের বাগানে তাঁকে দাফন করা হয়। কলিকাতা আলিয়া মাদরাসার অবসরপ্রাপ্ত মাওলানা বেলায়েত হুসাইন বর্ধমানী নাখোদা মসজিদে তাঁর নামাজে জানাজা পড়িয়েছিলেন। তিনি বাইয়্যাৎপ্রাপ্ত হন পিতা মাওলানা কেরামত আলীর নিকট থেকে। তিনি ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) ৩৮তম বংশধর। তাঁর উল্লেখযোগ্য শিষ্যদের মধ্যে ভাওয়ালের প্রখ্যাত ইসলামী ব্যক্তিত্ব আলহাজ্ব সুফী হযরত আহমদ পঞ্চায়েত (রহ.) অন্যতম।