সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ

ইরান স্পষ্টত বিশ্বকে বার্তা দিল ‘যা ইচ্ছা তা করা যায় না’

‘হামাস, হিজবুল্লাহ, হুথি গোষ্ঠীর পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের জনগণ এখন ইরানের পক্ষে। ইসরাইল এ হিসাব কষেই যুদ্ধে যাবে না আপাতত,’ বলছিলেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ। ইসরাইলে ইরানের হামলা এবং হামলা-পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে জাগোনিউজের পক্ষ থেকে মতামত নেওয়া হয় এ বিশ্লেষকের।
ইরানকে ধৈর্যসীমা অতিক্রম করতে বাধ্য করা হয়েছে উল্লেখ করে ড. ইমতিয়াজ বলেন, ‘ইরানের ওপর বেশ কয়েকবার হামলা হয়েছে। ইরানের শীর্ষ জেনারেল কাশেম সোলাইমানিকে মেরে ফেললো যুক্তরাষ্ট্র। দামেস্কে ইরানের কনস্যুলেটে যেভাবে হামলা করে বেশ কয়েকজনকে হত্যা করেছে ইসরাইল, তা সম্পূর্ণভাবে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন।
ইসরাইল ইরানের ছয়জন বিজ্ঞানীকে হত্যা করেছে বিভিন্ন সময়। আসলে ইরানের ধৈর্যসীমা ভেঙে দিয়েছিল ইসরাইল। বাধ্য হয়েই ইরান এ হামলা চালিয়েছে। ইরান স্পষ্টত বিশ্বকে বার্তা দিল, ‘যা ইচ্ছা তা করা যায় না। তোমরা যা ইচ্ছা তাই করবা আর আমরা মেনে নেব, এটি আর চলতে পারে না। আবার দীর্ঘদিন থেকেই সামরিক শক্তির একটি জানান দিয়ে আসছিল। বলছিল, আমার এই আছে, ওই আছে। ইসরাইলে হামলার মধ্য দিয়ে তার প্রকাশ ঘটালো ইরান।’
ইরান স্পষ্ট করে বলে দিল, আমি আর থেমে থাকবো না। জর্ডানের মধ্যেও ড্রোন হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকজন সেনা মারা যায়। যাতে ইরানের ওপর দোষ চাপায় যুক্তরাষ্ট্র। তার মানে খেয়াল রাখতে হবে ইরান সেই অবস্থায় গেছে। বিভিন্ন দেশে হামলা করার ক্ষমতা সে রাখে।
এভাবে ঘোষণা দিয়ে হামলা ইরানের জন্য নজিরবিহীন মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘ইসরাইল, আমেরিকা সবাই জানতো যে ইরান হামলা করতে যাচ্ছে। আমেরিকা-ইসরাইলও প্রস্তুত ছিল। এমনভাবে হামলা করা হয়েছে, যেখানে কোনো মানুষ মারা যায়নি। ইরান ইসরাইলকে এ হামলার মধ্য দিয়ে বুঝিয়ে দিল, তুমি তোমার কাঠামো পরিবর্তন করো। তা না করে ইসরাইল যদি পাল্টা হামলা করে, তখন ইরান বিশ্বকে দেখাবে, দেখো, আমরা প্রথমবার হামলা করে কোনো মানুষ হত্যা করিনি।’
‘সম্প্রতি গাজায় ৩০ হাজারের বেশি মানুষকে হত্যা করেছে ইসরাইল। অথচ আমাদের হামলায় একজনও মরেনি। একইভাবে ইসরাইলের আয়রন ডোম ভেদ করার যে ক্ষমতা আছে সেটাও দেখাতে পারলো। আমার কাছে মনে হয়েছে বড় আকারের যুদ্ধে গেলে ইসরাইল ভয়ঙ্কর ভুল করবে। কারণ ওই অঞ্চলের বিশাল সমর্থন আছে প্যালেস্টাইনের পক্ষে। ইরান প্যালেস্টাইনের পক্ষেই কাজ করছে। মধ্যপ্রাচ্যের দু-একটি দেশের সরকার হয়তো ইসরাইলের পক্ষে আছে। যেমন জর্ডানের রাজা ইসরাইলের পক্ষে থাকতে পারে। কিন্তু জর্ডানের জনগণের মধ্যে রাজার ব্যাপক অস্তিত্ব আছে, বলে মনে হয় না। জর্ডানে তিন হাজারের মতো আমেরিকান সৈন্য আছে। তারাই রাজাকে দেখভাল করে। তার কোনো জনপ্রিয়তাও নেই।’
‘রাজা জর্ডানের লোকও নন। তিনি এসেছেন সৌদি আরব থেকে। শরিফ আল মক্কার দুই সন্তান হাসান এবং হোসাইন। একজন ইরাকে যান, যাকে বহু আগেই হত্যা করা হয়। আরেকজন জর্ডানের রাজা। অনেকেই বলছেন, এ রাজাই শেষ। তার সঙ্গে জনগণের কোনো সম্পর্ক নেই। আমেরিকা ও ইসরাইলের দখলদারি জিইয়ে রেখে এ রাজা শাসন করছে। মধ্যপ্রাচ্যের জনগণ প্যালেস্টাইনদের পক্ষে আছে বলেই সরকারগুলো পশ্চিমাঘেঁষা হলেও ইরানের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারছে না। এ কারণে আমি মনে করি না যে ইসরাইল বড় আকারে যুদ্ধে যাবে। তবে আগের পলিসি মতে অতর্কিত হামলা করতে পারে। তবে এটি করলেও এখন বিপদ!’
‘কারণ ইরান স্পষ্ট করে বলে দিল, আমি আর থেমে থাকবো না। জর্ডানের মধ্যেও ড্রোন হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকজন সেনা মারা যায়। যাতে ইরানের ওপর দোষ চাপায় যুক্তরাষ্ট্র। তার মানে খেয়াল রাখতে হবে ইরান সেই অবস্থায় গেছে। বিভিন্ন দেশে হামলা করার ক্ষমতা সে রাখে। হামাস, হিজবুল্লাহ, হুথি গোষ্ঠীর পাশাপাশি সে অঞ্চলের জনগণ এখন ইরানের পক্ষে। ইসরাইল এ হিসাব কষেই যুদ্ধে যাবে না।’
আমার কাছে মনে হয় না, ইসরাইল পাল্টা হামলা করবে। এরই মধ্যে ইসরাইলের বিমানবন্দরগুলো খুলে দিয়েছে। স্কুলও খুলছে। ইরানও বলেছে, পাল্টা আক্রমণ না হলে এটিই শেষ। একটি নতুন মঞ্চ তৈরি হলো মধ্যপ্রাচ্যে।
যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে দেখছে এ হামলার ঘটনা? বলেন, ‘ইরানের এ হামলা ইসরাইল একা প্রতিহত করেনি। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স সবাই মিলে নেমে ঠেকিয়েছে। তার মানে ইসরাইলের একার কোনো শক্তি নেই। যুক্তরাষ্ট্র প্রসঙ্গে দুটি বিষয় এখানে দেখা দরকার। একটি হচ্ছে ডোনাল্ড ট্রাম্প কীভাবে দেখবে? তার ওপর নির্ভর করে জো বাইডেন এগোবে না থামবে, তা দেখার আছে। নির্বাচনের বছরে বড় আকারের যুদ্ধে গেলে জো বাইডেনকে পছন্দ করবে সেখানকার জনগণ, আমি তা মনে করি না। এমনিতেই গাজায় গণহত্যা বন্ধের দাবিতে যুক্তরাষ্ট্রের বহু মানুষ রাস্তায় নেমেছে। জিউসরাও নেমেছে। ডেমোক্রেটিক দল এখন কঠিন অবস্থায় আছে।’
দ্বিতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ কী করবে? আমেরিকার মিডিয়া কিন্তু ইরান-ইসরাইলের ঘটনায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। একটি পক্ষ হয়তো ইসরাইলকে পাল্টা হামলা করতে উসকে দিচ্ছে। আবার আরেকটি পক্ষ ইসরাইলকে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে বলছে। জো বাইডেন ইসরাইলের পক্ষে যুদ্ধে গেলে বাধার সম্মুখীন হবেন এখন। মূলধারার মিডিয়া ইসরাইলের পক্ষে থাকলেও জনগণ কিন্তু মাঠে নামেনি। জনগণ এখন চিন্তিত ইসরাইলের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে। কারণ এমন নিরাপত্তা বলয় ভেদ করে হামলা সহজ কথা নয়। ভবিষ্যতে ইরান তো আরও ভয়ঙ্কর ব্যবস্থা নেবে।
‘ইসরাইল ইরানকে আবার টেস্ট করবে কিনা, সেটাও দেখার বিষয়। নেতানিয়াহু সেটা করতে পারবেন না এখন। আর তা যদি হয়, তাহলে নেতানিয়াহুর ক্ষমতায় থাকাটাও মুশকিল হবে। তার বিরুদ্ধে ইসরাইলের জনগণ রাস্তায় নেমেছে বেশ আগেই। দুর্নীতির অভিযোগও আছে। আবার একেবারে কিছুই যদি না করে, তাহলে নেতানিয়াহুর পতন নিশ্চিত হয়ে যাবে। সব শেষে বলা যায়, ইরানের এ হামলা মধ্যপ্রাচ্যে নতুন মাত্রা এবং ইসরাইলের জন্য হুমকি তৈরি করলো।’ জাগোনিউজ।