বিলম্বিত ভোরের কবি মুহাম্মদ রেজাউল করিম

মো. আব্দুল হাই আল হাদী
আধুনিক বাংলা কবিতায় আবেগ-উচ্ছ্বাসের কালের সাথে নিজের সম্পৃক্ততা সন্নিবদ্ধ করেও আশ্চর্যরকমভাবে যিনি নিজেকে অনেকটা সংগোপনে রেখে বোধের আড়ালে নয় বোধের জগতে কাব্য-চর্চা করে যাচ্ছেন তিনি অন্যতম কবি মুহাম্মদ রেজাউল করিম। ইংরেজি সাহিত্যে উচ্চ শিক্ষিত, নিভৃতচারী, মিতভাষী এই কবি কল্পনা অনুকরণের অথবা বানোয়াট আর্তযন্ত্রণার ক্ষয়ের জগতে নিজেকে বন্দী করেননি বরং একান্ত অভিজ্ঞতাপ্রসূত নিজ অভিব্যক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন তার কবিতায়। ফলে পরাবাস্তব অন্ধকারের চিত্র তার কবিতায় মেলে না। আধুনিক কবিতায় যেখানে অনেক কবিদের আবেগ-উচ্ছ্বাস ছানি ফেলেছে কবিতার à¦¦à§‡à¦¹à§‡Ñ à¦†à¦¸à§à¦¤à¦°à¦£ ফেলেছে চর্মে, সেখানে কবি রেজাউল করিমের নিজের কাল, সমাজ ও পেছনের বয়ান, নতুনের আহ্বান, প্রেম-ভালোবাসার মতো নানা জাতের মানুষী ঢং বা আবেগ আর মুক্তির অভিপ্রায় এক চমৎকার শৈল্পিক ব্যঞ্জনা লাভ করেছে। ‘বোধের আড়ালে বোধ’, ‘ফুটুক তবে ফালগুন’ এবং ‘বিলম্বিত ভোর’ তার প্রকাশিত তিনটি কাব্যগ্রন্থ। ৩০ টাকা মূল্যের ৪৬ পৃষ্ঠার প্রথম কাব্যগ্রন্থে ৪০টি, ৬০ টাকা মূল্যের ৪০ পৃষ্ঠার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থে মোট ৩২টি এবং ৮০ টাকা মূল্যের ৪৭ পৃষ্ঠার তৃতীয় কাব্যগ্রন্থে ৪১টি কবিতা রয়েছে। বিচিত্র প্রবণতার এই কবিতাগুলোর কিছু কবিতা অসাধারণ সংবেদী হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে বাংলার প্রকৃতি ও নাগরিক জীবনের অন্তর্দাহসহ বৈশ্বিক অনাচার তার অনেক কবিতায় যেমন বিমূর্ত রূপ লাভ করেছে তেমনি তিনটি কাব্যেরই বেশ কিছু কবিতাতেই কবির নৈরাশ্যবোধ প্রকট রূপ লাভ করেছে। যেমনÑ

ঘোলা জল সম্মুখে আমার

অন্ধকারে কৈ মাছ

পেঁচা ডাকে ঝোঁপ ঝাড়ে

চোখে চোখে হলুদ ছায়া।

(বাঁকা বাঁশ : বোধের আড়ালে বোধ)

ব্যক্তিক হতাশা ‘বিলম্বিত ভোর’ কাব্যের অনেক কবিতাতেই আস্বাদনযোগ্য :

ধরা পড়ে যাই কুয়াশার জালে

ব্যাকুল গন্ধ ওড়ে দুপুরের, বিকেলের

কবে আর খুঁজে পাই সাগরের আলো

তৃষানল পুড়ে কেবল সুবাসিত বুক।

(বিলম্বিত ভোর)

হতাশা ও নৈরাশ্য জীবনের একমাত্র অবলম্বন নয়। তাই হতাশা ও নৈরাশ্যের উত্তরীয় ব্যবচ্ছেদ করে আশার সঞ্চার, মুক্তির স্বপ্ন আর আহ্বান ধ্বনিত হয়েছে তার বেশ কিছু কবিতায়। যেমন :

ঘুমন্ত চোখ শুধু ডুবে যায় অন্ধকারে

দুরন্ত স্বপ্ন সব ফিরে আসে ঘরে।

(দুরন্ত স্বপ্ন : বোধের আড়ালে বোধ)

কবিতার ভাব ও প্রকরণগতশৈলীর দিক থেকে অসাধারণ একটি সুন্দর কবিতা ‘নিশান সবুজ’। কবিতার কয়েকটি চরণ এখানে উদ্ধৃত না করে পারছি নাÑ

উড়াল দেবো à¦à¦‡à¦¬à¦¾à¦°Ñ à¦¶à§‡à¦· উড়াল

ঝরে যাবে কারাগার বিশাল

ধ্বনিত হবে বিজয়সুর

উড়বে পত পত নিশান সবুজ।

(নিশান সবুজ : বিলম্বিত ভোর)

বাঙালির জাগরণ, বাঙালির স্বাধীন হয়ে ওঠার মূলমন্ত্র ও প্রেরণা থেকে যেন বিচ্যুতির একটা অন্ধকার গ্রাস করছে আমাদের। আর তা থেকে উৎরে ওঠার জন্য চাই টগবগে নিঃশ্বাস। শত হতাশা আর নৈরাশ্যবোধ থেকেই সৃষ্টি হয় জাগরণ। সেই নবজাগরণের একটি আহ্বান ও স্বর্ণালী অতীতকে স্মরণ করিয়ে দেয়ার একটি অসীম প্রেরণা তার কবিতায় ফুটে উঠেছে। এই ঢঙের একটি অসাধারণ কবিতা ‘ওরা পর্বত কঠিন’। কবি শোষকের বিরুদ্ধে এখানে সোচ্চার। শোষকদের চিনিয়ে দিতে কবির স্পষ্ট à¦˜à§‹à¦·à¦£à¦¾Ñ à¦¶à§‹à¦·à¦•à¦°à¦¾

‘সমুদ্র মন্থন করে তুলে নেয় সব (ওরা পর্বত কঠিন : ফুটুকু তবে ফালগুন)

কবিরা সমাজ-দেশ-ভাষার ঊর্ধ্বে, আবার তারা সমাজের-দেশের-সকল মানুষের। ফলে মানুষের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা থাকে। আর এই দায়বদ্ধতার পরোক্ষ কাজ আছে কবির অনেক কবিতাতেই। ফলে তার কবিতায় আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতিসহ ব্যক্তিক সম্পর্কের নিজ অন্তরের সৎ অনুভূতিগুলো প্রকাশ পেয়েছে। এ হচ্ছে কবির বেঁচে থাকার দায়। আর বেঁচে থাকলে কবিদের এটুকু দায় না সেরে উপায় নেই।

নবীন কবিদের মধ্যে যে বালকসুলভ দৃষ্টিভঙ্গি à¦¥à¦¾à¦•à§‡Ñ à¦¬à¦¿à¦¶à§‡à¦· করে প্রেমের কবিতা দিয়ে কবি-জীবনের শুরু, রেজাউল করিমের প্রথম কাব্যে সে বিষয়টি অনুপস্থিত। তবে এ ধারার পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থে। যদিও তিনটি গ্রন্থের অনেক কবিতাই প্রেম নিয়ে। কিন্তু এই প্রেম কিশোর-কিশোরীর উচ্ছ্বাসে ভরা, হাঁস হয়ে জলে সাঁতার কাটা, মেঘ হয়ে আকাশে উড়া বা নিতান্তই রোমান্টিক এমন কিছু নয় বরং প্রতিদিনের বেঁচে থাকার ভেতরে একটু একটু করে উন্মোচন আর আস্বাদনের মধ্যে যে মানব-মানবীয় প্রেম সেই প্রেমের কথা বলেছেন কবি রেজাউল করিম। এ সংক্রান্ত কবিতাগুলোর মধ্যে ‘বোধের আড়ালে বোধ’ কাব্যের ভোর/আকাশ ছুঁয়েছ তুমি/চুম্বক টান/দাঁড়াও পাথর কঠিন/এসো তবে নদীর ঢেউ, ‘ফুটুক তবে ফালগুন’ কাব্যের ওগো মেয়ে ডাক দাও/ আঁধারের কুসুম/স্বর্ণমিনার, ‘বিলম্বিত ভোর’ কাব্যের চাই জল গভীর/চন্দ্রথালা/নিশান সবুজ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

নিঃসঙ্গতা, একাকিত্ব আর জীবনের করুণতম সন্ধিক্ষণের অসাধারণ সব চিত্রকল্প তার কাব্যে বাঙময় হয়ে উঠেছে। আবার আন্তঃগোপনে দগ্ধ হওয়ার বেদনা থেকে মুক্তির আহ্বানও যুগপৎভাবে দৃষ্টিগ্রাহ্য হয় অনেক কবিতায়Ñ)

খোলা পথ বন্ধ আজ চোখের সম্মুখে

তারকার আলো নিভে নিকট আকাশে

কেন যে নিশ্চুপ তুমি তোমার ভুবনে

হতবাক সব দুপুর জমিনের ’পর

গোপন নির্দেশ দাও।

(ভোর : বোধের আড়ালে বোধ)

স্রষ্টার প্রতি আর্তি আর দার্শনিকতার নন্দনতাত্ত্বিক বাঙময়তার বহিঃপ্রকাশ লক্ষ্য করা যায় অপর একটি কবিতায়:

আমি নই তার/আমি শুধু তার

অথবা, প্রভু তবে ঝড় দাও

দাও প্রভু নূহের বন্যা

জলের স্রোতে ভেসে যাক পাপের ফসল

যে পারে তবে পেয়ে যাক সেই মুক্তিতরী।

(মুক্তিতরী : ফুটুকু তবে ফালগুন)

চাই শুধু চাই আমি পূর্ণ হেদায়াত

তোমার পথেই দেখি আলো জ্বলে স্পষ্ট

হারাবো না আমি আর দরোজার চাবি

হাশরের মাঠে তাই চাই শাফায়াত।

(শাফায়াত : বিলম্বিত ভোর)

তার কবিতাগুলোর গুরুত্বপূর্ণ দিক এই যে, তিনি উপমা, রূপক, চিত্রকল্প বা অলঙ্কারের সন্ধানে বিদেশি সংস্কৃতি বা কাব্য ঐতিহ্যের যেমন দ্বারস্থ হননি তেমনি দেশীয় কবিদের অন্ধ অনুকরণও করেননি। যা ভেবেছেন, যা করেছেন যেন একান্ত নিজের মতো করেই। ফলে নিজের সমাজ, নিজের পরিবেশ-ধর্ম ইত্যাদির অংশবিশেষ থেকেই বাছাই করা তার উপমা, উৎপ্রেক্ষা, চিত্র ও চিত্রকল্প। বর্তমান সময়ে বাংলা কবিতার যে বহুমাত্রিকতা আর নানান রকমের নিরীক্ষা à¦šà¦²à¦›à§‡Ñ à¦ অবস্থায় ‘প্রীতি প্রকাশন’ থেকে প্রকাশিত ‘বোধের আড়ালে বোধ’, ‘আত্মপ্রকাশন’ থেকে প্রকাশিত মোমিন উদ্দিন খালেদের আঁকা প্রচ্ছদে ‘ফুটুকু তবে ফালগুন’ ও আফসার নিজামের প্রচ্ছদে একই প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ‘বিলম্বিত ভোর’ কাব্যগ্রন্থের অনেক কবিতাই আমাদের কাছে শিল্পোত্তীর্ণ সৃষ্টি হিসেবে ভিন্ন ধারার কাব্যিক উদ্দীপনার জায়গা হয়ে উঠতে পারে।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, [বাংলা], সরকারি আশেক মাহমুদ কলেজ, জামালপুর।