সংবাদ শিরোনামঃ

জনগণের আন্দোলন সফল হবেই ** কোকোর জানাজায় লাখো মানুষের আহাজারি ** সঙ্কট সমাধানে প্রয়োজন সকল দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন ** বিরোধী দলের আন্দোলনে শঙ্কিত সরকার ** সারাদেশে স্বতঃস্ফূর্ত অবরোধ-হরতাল চলছে ** সংহতি রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে আরব নেতাদের ** দেশের মানুষ সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে প্রকৃত সরকার দেখতে চায় ** শওকত মাহমুদের মামলা প্রত্যাহার ও বন্ধ মিডিয়া খুলে দেয়া না হলে সরকার পতনের আন্দোলন ** সংলাপেই সমঝোতা করুন ** আবারও দৃশ্যপটে ভারতের সেই ঝানু কূটনীতিক ** কান্নাভেজা চোখে ছেলেকে শেষ বিদায় জানালেন খালেদা জিয়া ** ভারতবর্ষে শিক্ষা বিস্তারে মুসলমানদের অবদান ** জনপ্রতিরোধে রাজধানী ঢাকার সাথে সারাদেশের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ** কার্পেটিং জুট মিলের স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণকারীদের কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ **

ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ মাঘ ১৪২১, ৯ রবিউস সানি ১৪৩৬, ৩০ জানুয়ারি ২০১৫

॥ মু. শাহে আলম॥
শের-ই-বাংলা একজন বাঙালি রাজনীতিবিদ। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাঙালি কুটনীতিক হিসেবে বেশ পরিচিত ছিলেন। রাজনৈতিক মহল এবং সাধারণ মানুষের নিকট ‘শের-এ-বাংলা’ এবং ‘হক সাহেব’ নামে পরিচিত। বাংলাদেশের গণমানুষের অবিসংবাদিত মহানায়ক জাতীয় নেতা বাংলার বাঘ খ্যাত আবুল কাশেম ফজলুল হক ১৮৭৩ সালের ২৬ অক্টোবর তৎকালীন বাকেরগঞ্জ মহকুমার বর্তমানে ঝালকাঠী জেলার রাজাপুর থানার সাতুরিয়া গ্রামে তার নানার ভিটা সাতুরিয়ার মিয়া বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। শের-ই-বাংলা নামেই তিনি বহুল পরিচিত। তিনি রাজনৈতিক অনেক পদে অধিস্তান করেছেন কলকাতার মেয়র (১৯৩৫), অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী (১৯৩৭-১৯৪৩), পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী (১৯৫৪), পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী (১৯৫৫), পূর্ব পাকিস্তানের গর্ভনর (১৯৫৬-৫৮) পদ অলঙ্কৃত করেন তিনি। যুক্তফ্রন্টের অন্যতম প্রধান নেতা ছিলেন তিনি।

কাজী মৌলভী ওয়াজেদ আলী এবং সাইদুন্নেসা খাতুন ছিলেন তার বাবা-মা। শের-এ-বাংলার প্রাথমিক পড়াশোনা বাড়িতেই। গৃহশিক্ষকদের কাছে আরবি, ফার্সি, বাংলায় শিক্ষালাভ করেন। ১৮৮১ সালে বরিশাল জিলা স্কুলে ভর্তি হন। ১৮৮৯ সালে বরিশাল জেলা স্কুল থেকে প্রবেশিকা (এন্ট্রান্স) পরীক্ষায় ঢাকা বিভাগে মুসলমানদের মধ্যে প্রথম স্থান দখল করেন। ১৮৯১ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফএ পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন এবং স্কলারশিপ লাভ করেন। ১৮৯৩ সালে তিনটি বিষয়ে অনার্সসহ প্রথম শ্রেণীতে বিএ পাস করেন। ১৮৯৫ সালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় এম এ ভর্তি হয়ে ১৮৯৬ সালে ইংরেজি ও অংক বিষয়ে এমএ পাস করেন। ১৮৯৭ সালে ডিস্টিংশনসহ বিএল পাস করে মনীষি স্যার আশুতোষ মুখোপধ্যায়ের অধীনে কলকাতা হাইকোর্টে যোগদান করেন। একই বছর একাডেমিক শিক্ষার সমাপ্তি টেনে তিনি কর্মজীবনে পদার্পণ করেন। শিক্ষনবীশ আইনজীবী হিসেবে কিছু কাল অতিবাহিত করে ১৯০০ সালে তিনি এককভাবে কাজ শুরুর একবছরের মধ্যে অর্থাৎ ১৯০১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি তার পিতা বিশিষ্ট আইনজীবী মৌলভী কাজী ওয়াজেদ আলী মারা যান। পিতৃ বিয়োগের পরে তিনি কলকাতা ছেড়ে ফিরে এলেন তার নিবাস বরিশালে। এখানে এসে তিনি নতুনভাবে আইন ব্যবসায় আত্মনিয়েগ করেন।

শিক্ষাজীবন শেষ করে তিনি ১৮৯৬ সালে  নবাব আবদুল লতিফ সিআইই’র পৌত্রী খুরশিদ তালাত বেগ কে বিয়ে করেন। সেখানে তার দুই কন্যা সন্তান জন্ম লাভ করলে তার স্ত্রীর অকাল মুত্যু হয়। খুরশিদের মৃত্যুর পর হুগলি জেলার অধিবাসী ও কলকাতায় বসবাসকারী জনাব ইবলে আহমদের মেয়ে জিন্নাতুন্নেসা বেগমকে বিয়ে করেন। নিঃসস্তান জিন্নাতুন্নেসা মারা গেলে অবশেষে ১৯৪২ সালে ভারতের মিরাটের এক সম্ভান্ত মুসলিম পরিবারের বিদুষী মেয়ে খাদিজা খাতুনকে বিয়ে করেন। ১৯৪৪ সালে খাদিজার গর্ভে একমাত্র পুত্র সন্তান এ কে ফাইজুল হকের জন্ম হয়।

১৯১৩ সালে শের-এ-বাংলা বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯১৪ সালে তিনি নিখিল ভারত কংগ্রেস দলে যোগ দেন। খেলাফত আন্দোলনেও তিনি অংশ নেন। জমিদার মহাজনদের অত্যাচার-নির্যাতন থেকে এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দরিদ্র কৃষকদের বাঁচানোর জন্য প্রতিষ্ঠা করেন তার বিখ্যাত ঋণ সালিশি বোর্ড। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তিনি। ১৯৬২ সালের ২৭ এপ্রিল তিনি ইন্তিকাল করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন তিন নেতার মাজারে তিনি সমাহিত।

তিনি ছিলেন আপোষহীন সংগ্রামের প্রতীক সর্বপ্রকার সামাজিক অবিচার, অসম্মান ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন এক বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। তাঁর কর্মময় জীবন ছিল বিংশ শতকের বাংলা ও বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায়। তাই তাকে আপোষহীন সংগ্রামের প্রতীক বলা হয়। ঢাকা হাইকোর্টের জজ রাধিকারঞ্জন গুহ এ কে ফজলুল হক সম্বন্ধে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছিলেন, ফজলুল হক আমেরিকায় জন্ম নিলে হতেন ওয়াশিংটন, বিলাতে জন্ম নিলে হতেন ডিজহেরলি, রাশিয়ার জন্ম নিলে হতেন লেলিন, জার্মানিতে জন্ম নিলে হতেন হিটলার এবং ফ্রান্সে জন্ম নিলে হতেন রুশো অথবা নেপোলিয়ন।

১৯৩৭ সনে ১৫ অক্টোবর লক্ষেèৗ শহরে নিখিল ভারত মুসলীম লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। মহাকালের এই মাহান নেতা এ অনুষ্ঠানে বাংলার প্রধানমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক ঊর্দু ভাষায় জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়ে লক্ষেèৗবাসীর হৃদয় জয় করেন। তারা ফজলুল হকের অনলবর্ষী ও বীরত্বব্যঞ্জক বক্তৃতায় আকৃষ্ট হয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাকে শেরে-ই-বাংলা উপাধি দেন। সেদিন থেকেই তিনি শেরে বাংলা নামে অভিহিত হন।

শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক বাংলার কিংবদন্তির নায়ক। তিনি ছাত্র শিক্ষকের নায়ক। তিনি রাজনীতিবিদদের নায়ক। তিনি আমলাদের কাছে একজন দক্ষ শাসক। তিনি কবি, সাহিত্যিকদের পৃষ্ঠপোষক। সংগ্রামী জনতার কাছে একজন বীরশ্রেষ্ঠ বাঙালি। তিনি সর্বস্তরের মানুষের অন্তর জয় করেছিলেন। তার খ্যাতির মূলে ছিল তার নির্মোহ সৃষ্টিশীল নেতৃত্ব।

শের-ই-বাংলার কর্মজীবনের বিভিন্ন দিক

১৯২৩ সালে শের-ই বাংলার মাত্র ৩৩ বছর বয়সে পেশা জীবনের পরিবর্তন আসে। তিনি ওকালতি ও অধ্যাপনা ছেড়ে দিয়ে তৎকালীন সরকারের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে যোগদান করেন। ১৯১১ সালে সরকার তাকে সমবায় বিভাগের নিবন্ধকের দায়িত্ব দেন। একই সময় তিনি বরিশাল বিএম কলেজে ইংরেজির অধ্যাপক এবং বরিশাল জেলা স্কুলে ফার্সি ভাষায় পরীক্ষকের কাজও করতেন। ১৯০২ সালে “ভারত সুহৃদ” নামের সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদকও ছিলেন শের-ই বাংলা।

রাজনীতিতে পদার্পণ

ভারত সুহৃদ পত্রিকা প্রকাশের মধ্যে দিয়েই শের-ই-বাংলা রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি ও দেশকাল সম্পর্কে অনেক সচেতন হয়ে পড়েন। তিনি ১৯০২ সালে বরিশাল পৌরসভা নির্বাচনে দাঁড়ালেন এবং বিপুল ভোটে জয়ী হলেন। পৌরসভা নির্বাচনের পরে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেন জেলা বোর্ড নির্বাচনে সেখানেও তিনি বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। ১৯০৫ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক সর্বভারতীয় মুসলিম সম্মেলনের উদ্যোক্তা নবাব স্যার সলিমুল্লাহ সম্মেলন বাস্তবায়নে সর্বসম্মত মতামতের ভিত্তিতে জনাব এ কে ফজলুল হককে দায়িত্ব অর্পণ করেন। এর পরে ১৯০৬ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত “নিখিল ভারত শিক্ষা সম্মেলন”-এর পক্ষে গোটা ভারতের মুসলমানদের একত্রিত করতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন তিনি। এর পরে ১৯১৩ সালে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এ কে ফজলুল হক। ১৯১৬ সালে তিনি বঙ্গীয় প্রদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯১৮ সালে শের-ই বাংলা ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের জেনারেল সেক্রেটারি নির্বাচিত হন। তখন একই ব্যক্তি ইচ্ছা করলে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের সদস্যপদ নিতে পারতেন তিনি তাই করেছিলেন।

বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার নির্বাচন

বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক পদের বিপরীতে ঢাকা বিভাগীয় একটি কেন্দ্র হতে ১৯১৩ সালে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এ কে ফজলুল হক। তার সাথে অপর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন প্রভাবশালী হিন্দু জমিদার রায় বাহাদুর মাহেন্দ্রনাথ মিত্র। এই নির্বাচনে তিনি বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে প্রমাণ করলেন যে তিনি মুসলমান হিন্দু নির্বিশেষে সকলের প্রিয় নেতা।

আইন পরিষদে প্রথম ভাষণ

১৯১৩ সালে নির্বাচিত হয়ে নতুন সদস্য হিসাবে তিনি আইন পরিষদে তথ্যপূর্ণ বক্তব্য প্রদান করেন। প্রথম দিনেই তিনি জ্বালাময়ী বক্তব্য উপস্থাপন করে সকলকে মুগ্ধ করেন। আইন পরিষদে উপস্থিত বাংলার লাট কারমাইকেল শের-ই বাংলার বক্তব্যে মুগ্ধ হয়ে আসন ছেড়ে তার সাথে করমর্দন করে অভিনন্দিত করেন। এবছরই তিনি নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সদস্যপদ লাভ করেন।

অত্যাচারী মহাজন ও জমিদারদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম

১৯১৪ সালে শের-ই বাংলা দেশের অত্যাচারী মহাজন ও জমিদারদের বিরুদ্ধে শুরু করেন তার রাজনৈতিক আন্দোলন। তারই প্রেক্ষিতে জামালপুরে অনুষ্ঠিত হয় কৃষকপ্রজা সাধারণ সম্মেলন। এই সম্মেলনে শের-ই বাংলার উদাত্ত আহ্বানে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে দেশের সাধারণ প্রজাদের মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। যার ফলে অল্পদিনের মধ্যেই এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। যার প্রেক্ষিতে ১৯১৫ সালে শের-ই বাংলার নেতেৃত্বে গঠিত হয় নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতি। পরবর্তীতে এই সংগঠন দেশের জমিদার, জোতদার ও মহাজনদের বিরুদ্ধে সৃষ্ট আন্দোলন পরিচালনা করে।

শিক্ষা বিস্তারে শের-ই বাংলা

শেরে বাংলা ১৯১৩ সনের আইন সভায় প্রবেশ করেই মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের জন্য বিশেষ জোর দেন। তিনি উপলব্ধি করেন যে মুসলিম সমাজ যদি পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণ না করে তবে সম্প্রদায় হিসেবে তারা ধ্বংস হয়ে যাবে। কারমাইকেল হোস্টেল, টেইলার হোস্টেল, কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ, লেডি ব্রাবোর্ন কলেজ, তেজগাঁও কৃষি কলেজ, ফজলুল হক হল, চাখার ফজলুল হক কলেজ, আদিনা ফজলুল হক কলেজ, হরগঙ্গা কলেজ, ঢাকা সেন্ট্রাল উইমেন্স কলেজ, সেন্ট্রাল ল’ কলেজ প্রভৃতি ফজলুল হকের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় ছিল তার সক্রিয় সহযোগিতা। তার সময় দু হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় ও শত শত মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।

শিক্ষা আন্দোলনের যে কোনো কার্যক্রমের প্রতি তার ছিল অকুণ্ঠ সমর্থন। তার চেষ্টাতেই ১৯১৬ সালে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় দুটি ছাত্রাবাস যেমন টেইলর হোস্টেল ও কারম্ইাকেল হোস্টেল যা কিনা সে সময়ের যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত ছিল। এছাড়া ১৯২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত শিক্ষা বয়কট নীতির এক সম্মেলনে তিনি উপস্থিত থেকে এ নীতির বিরোধিতা করেন। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও কোলকাতা আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এর অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন শের-ই বাংলা একে ফজলুল হক। তিনি আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের “ফাউন্ডেশন মেম্বার অবদি ফাস্ট কোর্ট” ছিলেন।

তার শিক্ষানীতি দ্বারা মুসলিম, হিন্দু, নমশুদ্ররাও উপকৃত হয়েছে। তার প্রতিষ্ঠিত অধিকাংশ শিক্ষায়তনে হিন্দু ছাত্র ও শিক্ষকগণের সংখ্যাই বেশি ছিল। আজকের উভয় বাংলার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি তার শিক্ষানীতির ধারাবাহিকতার ফসল। তিনি গণশিক্ষা বিস্তারের জন্য আমরণ সংগ্রাম করেছেন।

তখন স্কুলসমূহে হিন্দুদের প্রভাব ছিল বেশি। মুসলমান ছাত্রদের সংস্কৃত পড়তে হত। সরকারি স্কুল ছাড়া অন্য স্কুলে আরবি ফার্সি পড়ানো হত না। তাই ফজলুল হক মন্ত্রী হয়ে আদেশ জারী করেন যে, কোনো স্কুলে সরকারি সাহায্য পেতে হলে ১ জন মুসলমান শিক্ষক ও ১জন মৌলভী নিয়োগ করতে হবে। তিনি স্কুল, কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং ও মেডিকেল কলেজে মুসলমান ছাত্রদের আসন নির্দিষ্ট করে দেন। তারা ভর্তি না হলেও সিট খালি থাকবে। এ ব্যবস্থার ফলে কলেজে মুসলমানরা শিক্ষা ক্ষেত্রে অগ্রসর হতে পেরেছিল।

সমাজ সংস্কারক শের-ই বাংলা

রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ-সাহিত্য, সংস্কৃতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে নবযুগের সূচনা হয়। শান্তি, শৃঙ্খলা অক্ষুণœ থাকে। দেশে ন্যায় বিচার, সত্য বলার জন্য সংবাদ পত্রের স্বাধীনতা দেয়া হয়। এ সকল কারণে এ কে ফজলুল হকের প্রধানমন্ত্রিত্বের কালকে ইতিহাসের স্বর্ণযুগ বলে আখ্যায়িত করা হয়।

কৃষক প্রজা সমিতির নির্বাচনে পটুয়াখালীতে ফজলুল হকের বিজয় বাংলার ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। এ ভোট যুদ্ধের ফলে বাংলায় কৃষকরাজ প্রতিষ্ঠিত হয়। এ বিজয়ের ফলে তিনি বাংলার প্রধানমন্ত্রী হন। এ বিজয়ই তাকে মুকুটহীন সম্রাটের মর্যাদা দিয়েছিল।

কৃষকদের জন্য এ কে ফজলুল হক সরকারি ঋণের ব্যবস্থা করেন। তিনি কৃষকদের জন্য ঋণ, ত্রাণ ও টেস্ট রিলিফের ব্যবস্থা করেন। তিনি কৃষকদের মধ্যে উন্নত বীজ সরবরাহ করে শস্যের গুণগত মান উন্নয়ন ও চাষিদের ন্যায্য মূল্য প্রদানের নিশ্চয়তা প্রদান করেন এবং এ উদ্দেশ্যে ১৯৩৮ সনে পাট অধ্যাদেশ জারি করেন।

পাল, সেন, সুলতানি ও মোঘল আমলে জমির মালিক ছিল সম্রাটরা। কৃষকরা ছিল ভূমিদাস। তাদের সামাজিক মর্যাদা ছিল না। ইংরেজদের আমলে জমির মালিক ছিল জমিদাররা। হাজার বছরের সামস্ত প্রথাকে ধ্বংস করে ফজলুল হকের অবিরাম সংগ্রামের ফলে কৃষক জমির মালিক হলো। কৃষকের সমস্যা ছিল সময়মত ঋণ পাওয়া। তিনি শত শত সমবায় সমিতি সৃষ্টি করে কৃষি ঋণের ব্যবস্থা করেন। তিনি খাজনার দায়ে জমি বিক্রি, সার্টিফিকেট প্রথা প্রভৃতি রহিত করেন। যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার আমলে তিনি কৃষি ঋণ মওকুফ করেন। তার সময় অনেক ক্ষুদ্র ও ভারি শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে।

এ.কে ফজলুল হক বাংলার লাখ লাখ কৃষক পরিবারকে ঋণ মুক্ত করার জন্য ১৯৪০ সনে মহাজনী আইন পাস করেন। এই আইনে সুদের উচ্চহার নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়। চক্রবৃদ্ধি সুদ বন্ধ করা হয়। সাধারণ সুদের হার ও বন্ধক রেখে সুদ করলে সুদের হার শতকরা ৮% এবং বিনা বন্ধকে ঋণ গ্রহণ করলে সুদের হার বেশি হতে পারবেনা।

এ কে ফজলুল হক কৃষি ক্ষেত্রে নতুন চিন্তার উন্মেষ ঘটান। তিনি কৃষিশিক্ষা, প্রদর্শনী খামার, প্রচার, বাজার ঋণ প্রদান, গবেষণা, বিকল্প কর্মসংস্থান প্রভৃতি কর্মসূচি গ্রহণ করেন। আধুনিক কৃষি বিস্তারের লক্ষে ফজলুল হকের মন্ত্রিসভা ঢাকা, রাজশাহী ও খুলনার দৌলতপুরে কৃষি ইনস্টিটিউট ও ঢাকায় ডেইরি ফার্ম প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৩৮ সনের ১৬ ডিসেম্বর ফজলুল হক ঢাকার তেজগাঁও কৃষি ইন্সটিটিউটের ভিত্তি স্থাপন করেন। ফার্মগেট থেকে শুরু করে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল পর্যন্ত ডেয়রি ফার্ম ও কৃষি ইন্সটিটিউট বিস্তৃৃত ছিল। পশু সম্পদ বৃদ্ধির জন্য তিনি উন্নত জাতের গবাদি পশু আমদানী এবং পশুপালন উন্নয়নের জন্য অর্থ বরাদ্দ করেন। গবাদি পশু পালন ও দুগ্ধ সরবরাহ বাড়ানোর জন্য কর্মসূচি গ্রহণ করেন।

এ কে ফজলুল হক তার শাসনামলে নারী ও শিশুর মানবাধিকার সংরক্ষণ ও নির্যাতন প্রতিরোধের লক্ষে আইন প্রণয়ন করেন। নারী কর্মচারী ও শ্রমিকদের কল্যাণে ১৯৩৯ সালে ম্যাটারনিটি বেনিফিট এ্যাক্ট বা মাতৃমঙ্গল আইন প্রণীত হয়। নারী চাকরিজীবীরা সন্তান প্রসবের পূর্বে ১ মাস ও পরে ১ মাস বেহন ভাতাদিসহ ছুটি ভোগের অধিকার লাভ করে। শিশু শ্রমিকদের কল্যাণে শিশুশ্রম বন্ধের জন্য ১৯৩৮ সালে শিশু নিয়োগ আইন প্রণয়ন করা হয়। এ আইনে ১২ বছর পর্যন্ত বয়স্ক শিশুদের শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ বন্ধ করা হয়। ঝুঁকিপূর্ণ ক্ষেত্রে শিশুদের নিয়োগ নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৪৩ সালে ভবঘুরে আইন প্রণয়ন করে আশ্রয়হীন নারী ও শিশুদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হয়। শেরে বাংলার উদ্যোগে বাংলাদেশে অনেক এতিমখানা প্রতিষ্ঠিত হয়।

শের-ই বাংলা পল্লী উন্নয়নের জন্য ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন। গ্রামে গ্রামে পল্লী মঙ্গল সমিতি, খাদ্য ভাণ্ডার, কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠা করা হয়। তিনি জনগণের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। ম্যালেরিয়া জ্বর থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য হক মন্ত্রীসভা কুইনাইন ও চিকিৎসার ব্যবস্থা উন্নত করা হয়। অফিস আদালতে টাউট দমনের জন্য ১৯৩৭ সনে টাউট আইন প্রণয়ন করা হয়। দুর্ভিক্ষের সময় ক্ষুধার্ত মানুষের জন্য ১৯৩৮ সনে দুর্ভিক্ষ বীমা আইন প্রণয়ন করেন।

চাকরি বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যে তিনি মুসলমানদের শতকরা ৫০ ভাগ এবং তফসিলি সম্প্রদায়ের জন্য শতকরা ১৫ ভাগ চাকরির নিশ্চয়তা প্রদান করে বিধি জারি করেন। অনুন্নত ও তাদের পত্রিকাগুলো ফজলুল হককে তীব্র ভাষায় সমালোচনা করে এবং অভিযোগ করে যে যোগ্য প্রার্থীদের বাদ দিয়ে অনুপযুক্ত মুসলমানদের নিয়োগ করা হচ্ছে। ফজলুল হক সংবাদপত্রে ও আইন সভায় যোগ্যতার সংখ্যার ব্যাখ্যা ও তথ্য দিয়ে প্রমাণ করেন যে তিনি উপযুক্ত প্রার্থীদের চাকরি দিচ্ছেন এবং ইংরেজি ভাষায় পাণ্ডিত্য যোগ্যতার একমাত্র মাপকাঠি নয় তাও বুঝিয়ে দিয়েছেন। এমনকিভাবে আইন প্রণয়ন, বিধিজারী ও কর্মসূচি গ্রহণ করে বাংলার নির্যাতিত, নিপীড়িত কৃষক শ্রমিকদের জন্য মুক্তির দ্বার উদঘাটন করেন ফজলুল হক।

এ কে ফজলুল হকের উদ্যোগে ১৯৫০ সনে জমিদারী উচ্ছেদ আইন পাস করা হয়। কিন্তু কার্যত: কোনো জমিদারী দখল করা হয় না। ফজলুল হক আজীবন সংগ্রাম করেছেন জমিদারদের বিরুদ্ধে। ১৯৫৪ সনের তার জীবন সংগ্রাম সফল হলো। তিনি ঐ সনেই এপ্রিল মাসে নিজের জেলা বরিশালেই প্রথম জমিদারী উচ্ছেদ শুরু করেন। লাখ লাখ কৃষক প্রজা এইভাবে জমিদার তালুকদারদের শোষণ থেকে মুক্তি পেলেন এবং তারা জমির মালিক হলেন।

ফজলুল হক মনেপ্রাণে খাটি বাঙালি ছিলেন। বাঙালি জাতিসত্ত্বা বিকাশে তিনি অপরিমেয় সংগ্রামী ভূমিকা পালন করেছেন। বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিক বাঙালিজাতি গঠনের প্রধান বাহন। এ কে ফজলুল হক নিজে একজন বিজ্ঞ পণ্ডিত ও রাজনৈতিক চিন্তাবিদ ছিলেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি তার ছিল সীমাহীন মমত্ববোধ। তিনি বাংলার কবি সাহিত্যিকদের পরম শ্রদ্ধা করতেন। কাজী নজরুল ইসলাম, কবি জসিমউদদীন ও গায়ক আব্বাসউদ্দীন সব সময় তার সাহায্য সহানুভূতি পেয়েছেন। তিনি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে আন্তরিকভাবে শ্রদ্ধা করতেন।

মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন প্রখ্যাত কবি ও সাংবাদিক আ. গণি হাজারীকে অন্যতম সম্পাদক করে কার্জন হলে একটি সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। পাকিস্তান হওয়ার পরে এই সর্বপ্রথম পশ্চিম বঙ্গ থেকে বিখ্যাত কবি শিল্পীরা ঢাকায় আগমন করেন। এ সাহিত্য সম্মেলন বাঙালিদের নিজস্ব সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক বিকাশের সূচনা করে। গণনাট্য সংঘ ও চট্টগ্রামের রমেশশীলের দল সাহিত্য সংস্কৃতির চমৎকার অনুষ্ঠান করেন। পশ্চিমবঙ্গ থেকে আগত মনোজ বসু, অচিন্ত কুমার সেন গুপ্ত, পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, রাধা রাণী দেবী নরেন্দ্র দেব প্রমুখ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। এ সম্মেলন পূর্ব বাংলার সংস্কৃতি অঙ্গনে নতুন প্রাণের সঞ্চার করে।

এ কে ফজলুল হক ছিলেন সর্বস্বত্যাগী। তার জীবনের সঞ্চিত অর্থ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গরিব ছাত্র ও অসহায় মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দিয়েছেন। কাবুলিওয়ালাদের কাছ থেকে টাকা ধার করে তিনি গরিব ছাত্রদের পড়ার খরচ, পরীক্ষার ফি, কন্যাদায়গ্রস্ত মাতাপিতাকে উদ্ধার এবং মসজিদ ও মাদরাসায় চাঁদা দিয়েছে। অনেক রোগীর চিকিৎসার ব্যবস্থা তিনি করেছেন। হিন্দু, মুসলমান নির্বিশেষ সকলকে মুক্ত হস্তে দান করেছন। দেনার দায়ে তাকে দেউলিয়া পর্যন্ত হতে হয়েছে। তিনি আয় করেছেন অনেক কিন্তু নিজের বিলাসিতার জন্য ব্যয় করেছেন খুব কমই। এক এক সময় তার ঘরে খাবারের অভাব হয়েছে কিন্তু সে সময়ও তার দ্বার সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল।

শের-ই বাংলা ফজলুল হকের বিশাল ব্যক্তিত্ব বিভিন্ন উপাদানের সংমিশ্রন। একদিকে তার প্রতিভা, পাণ্ডিত্য, বুদ্ধি ও যুক্তি এবং অন্যদিকে আবেগ, উচ্ছাস, সরলতা, উদারতা ও সহিষ্ণুতা। বাংলার অবারিত মাঠ, উদ্দাম, নদ-নদী, উদার আকাশ, অপূর্ব শ্যামলিমা সব কিছু একত্রে সন্নিবেশ হয়ে যেন ফজলুল হকের ব্যক্তিত্বে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল। বর্তমান সময়ের এই ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন ও সংস্কারে প্রয়োজন তার মতো একজন মহীরুহ নির্মোহ মানব নেতৃত্ব। আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা শের-ই বাংলার  মতো মানুষের জন্মস্থানে থেকেও তাঁর আদর্শ ও শিক্ষা গ্রহণ করতে পারিনি। পারিনি তার কর্মময় জীবনকে গ্রহণ করে তাঁর কাজের স্বীকৃতি দিতে। মানুষ ও জাতি হিসেবে এটাকি আমাদের অযোগ্যতা, ব্যার্থতা ও উদাসিনতা নয়?

লেখক : সাংবাদিক

অন্যান্য মিডিয়া bdnews24 RTNN Sheersha News barta24 Prothom Alo Daily Nayadiganta Jugantor Samakal Amardesh Kaler Kantho Daily Ittefaq Daily Inqilab Daily Sangram Daily Janakantha Amader Shomoy Bangladesh Pratidin Bhorerkagoj Daily Dinkal Manob Zamin Destiny Sangbad Deshbangla Daily Star New Age New Nation Bangladesh Today Financial Express Independent News Today Shaptahik 2000 Computer Jagat Computer Barta Budhbar Bangladesherkhela Holiday Bangladesh Monitor BBC Bangla Pars Today
homeabout usdeveloped by

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ মো. তাসনীম আলম।

এটিএম সিরাজুল হক কর্তৃক হক প্রিন্টার্স ১০/৮ আরামবাগ, ঢাকা-১০০০ হতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। যোগাযোগের ঠিকানাঃ ৪২৩ এলিফেন্ট রোড, বড় মগবাজার, ঢাকা - ১২১৭।

ফোন: ৮৮ ০২ ৪৮৩১৯০৬৫, ই-মেইল: sonarbanglaweekly@gmail.com, weeklysonarbangla@yahoo.com, সার্কুলেশন: ০১৫৫২৩৯৮১৯০, বিজ্ঞাপন: ৪৮৩১৫৫৭১, ০১৯১৬৮৬৯১৬৮, ০১৭৩৪০৩৬৮৪৬।