রেজি : ডিএ ৫১৭ ॥ ৬৩ বর্ষ : ১ম সংখ্যা ॥ ঢাকা, শুক্রবার, ৮ চৈত্র ১৪৩০ ॥ ১১ রমজান ১৪৪৫ হিজরী ॥ ২২ মাচ ২০২৪

॥ এম. মুহাম্মদ আব্দুল গাফফার ॥
মহান রাব্বুল আলামিন মানুষকে সৃষ্টির সেরা জীব করে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। সৃষ্টির সেরা জীব করে পাঠানোর উদ্দেশ্যই হলো মানুষ পৃথিবীতে ভালো কাজ করবে আর সকল প্রকার অশ্লীলতা, অন্যায়, অবিচার, তথা ঘৃণ্য কাজকর্ম থেকে শুধু বিরতই থাকবে না বরং অন্যায়-অসুন্দরের বিরুদ্ধে বিরতিহীন সংগ্রাম চালিয়ে যাবে। কিন্তু মানুষ আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার দেয়া সে জ্ঞানকে উল্টো পথে কাজে লাগায় এবং দাম্ভিকতাবশত সে আত্মগর্ব তথা আত্মাহংকারে লিপ্ত হয়ে বিশ্বকে অগ্নিময় অশান্তির আবাসস্থল বানিয়েছে। এ মর্মে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা ঘোষণা করেন, ‘মানুষকে এমন জ্ঞান তিনি দিয়েছেন, যা সে জানতো না। না, মানুষ কী মনে করে এ কারণে যে, সে নিজেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেখতে পায়।’ (সূরা আল আলাক : ৫-৬)।
বর্ণিত আয়াতগুলোয় যে বিষয়টির প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, তা হলো মানুষ নিজেকে যতই বড় বা শ্রেষ্ঠ মনে করুক না কেন, মহান রাব্বুল আলামিনের হুকুম পালনের ক্ষেত্রে সে যদি শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় না দিতে পারে, তাহলে তার স্থান সর্বনিম্নে ও সে সর্বনিকৃষ্ট ঘৃণার পাত্র। এ মর্মে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা ঘোষণা করেন, ‘আমি মানুষকে অতীব উত্তম কাঠামোয় সৃষ্টি করেছি। পরে আমি তাকে উল্টো ফিরিয়ে সর্বনিম্নে পৌঁছিয়ে দিয়েছি সেই লোকদের ব্যতীত, যারা ঈমান এনেছে এবং নেক কাজ করতে থেকেছে, তাদের জন্য অশেষ শুভ প্রতিফল রয়েছে।’ (সূরা আত তীন: ৪- ৬)। পবিত্র কালামুল্লাহর এ ঘোষণা থেকে সুস্পষ্টভাবে জানা যাচ্ছে যে, মানুষ এক আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার ওপর দৃঢ় বিশ্বাস রাখবে এবং তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী ভালো কাজ করবে- এটাই হলো তার দায়িত্ব।
মাহে রমযানের সিয়াম সাধনা মানুষকে মূলত এ শিক্ষার দিকনির্দেশনাই দিয়ে থাকে। এ মর্মে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা ঘোষণা করেন, ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমাদের ওপর সাওমের বিধান দেয়া হয়েছে, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তী নবীদের উম্মতগণের ওপর ফরজ করা হয়েছিল; ফলে আশা করা যায় যে, তোমরা মুত্তাকি হবে।’ (সূরা বাকারা: ১৮৩)। মহাগ্রন্থ আল কুরআনের এ ঘোষণা থেকে এ কথা পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠলো যে, সিয়াম সাধনা শুধু সর্বশেষ রাসূল মুহাম্মদ (সা.)-এর উম্মতদের জন্যই নয়, পূর্ববর্তী জমানার সকল নবী-রাসূলগণের যুগসমূহেও বাধ্যতামূলক ছিল। ঐ সব উম্মতদের জন্য সময়কালের ভিন্নতা ছিল, কিন্তু সিয়ামের বিধান সকলের জন্যই কার্যকর ছিল।
এখন আমরা একটু চিন্তাভাবনা করে দেখি যে, মানুষের জন্য এ সিয়ামের উপকারিতা কী এবং সমাজ জীবনে এর ফলাফল কতটুকু? মানুষের জন্য আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা আহার, সম্পদ অর্জন, আরাম-আয়েশসহ বিবাহ-শাদীর মাধ্যমে পরিবার গঠনকে জায়েয করে দিয়েছেন। এসব কিছুই হালাল তথা বৈধ পন্থায় পরিচালনার কঠোর আদেশ জারি করেছেন। মহান রাব্বুল আলামিনের এ নির্দেশ লঙ্ঘনের কোনো সুযোগ নেই। এ মর্মে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা ঘোষণা করেন, ‘এবং তোমরা পারস্পারিক ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ কর না আর শাসকদের সম্মুখে উহা এ উদ্দেশ্যে পেশ করো না যে, তোমরা অপরের সম্পদের কোনো অংশ ইচ্ছা করে নিতান্ত অবিচারমূলকভাবে জেনেশুনে ভক্ষণ করার সুযোগ পাবে।’ (সূরা বাকারা: ১৮৮)।
মানব সৃষ্টির আদি থেকে যে বিষয়গুলো মানবসভ্যতাকে ধ্বংস করেছে, তা হলো ক্ষুধা নিবারণের লক্ষ্যে হন্যে হয়ে ন্যায় ও অন্যায়ের তোয়াক্কা না করে গলধঘর্ম তৎপরতা চালানো। মানুষ নিজের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য অন্যের অধিকারে অন্যায়ভাবে হস্তক্ষেপ করে থাকে, যার ফলে ঝগড়া-বিবাদের সূত্রপাত থেকে যুদ্ধ-বিগ্রহ পর্যন্ত সংঘটিত হয় এবং মানবসন্তানদের রক্তপ্রবাহে পৃথিবীর মাটি সিক্ত হয়। দ্বিতীয়ত, মানুষ একটু আরাম-আয়েশ লাভের জন্য সুরম্য অট্টালিকা নির্মাণসহ বিলাসবহুল বাসস্থান তৈরি তথা অন্যান্য বিলাসসামগ্রী সংগ্রহের তাগিদে অবৈধ পন্থায় সম্পদ অর্জনের লক্ষ্যে যে অপতৎপরতা চালায় তাতেও অন্যের অধিকার খর্ব হয় ফলে সমাজে অশান্তির অগ্নিময় শিখা দাউদাউ করে জ্বলতে থাকে। তৃতীয়ত, মানুষের সুন্দরী নারীর সাথে মিলনের আকাক্সক্ষা একেবারে সহজাত প্রবৃত্তি। নারীর সাথে যৌনমিলনের এ আগ্রহ সক্ষম সকল মানুষেরই ঘটে। মানুষের এ প্রবৃত্তি যদি মহান রাব্বুল আলামিনের দেয়া বিধান তথা শরিয়তের নিয়মের আওতায় চলতে থাকে, তাহলে সমাজ নির্লজ্জতা অশান্তি ও অশ্লীলতামুক্ত থাকে, আর যদি মানুষের খেয়াল-খুশিমতো পরিচালিত হয়, তাহলে শুধু আল্লাহর হুকুম যে লঙ্ঘিত হয়, তা নয় গোটা মানবসমাজ অসভ্যতা ও বর্বরতার অতল গহবরে তলিয়ে যায়। এ মর্মে মহানবী (সা.) এর একটি হাদীস এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। আলকামা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, একদিন আমি আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)-এর সাথে পথ চলছিলাম। তিনি বললেন, আমরা নবী (সা.)-এর কাছে উপস্থিত ছিলাম,  তিনি অর্থাৎ নবী (সা.) বললেন, তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি বিয়ে করার সামর্থ্য রাখে তার বিয়ে করা উচিত, কেননা বিয়ে চোখকে অবনতকারী ও লজ্জাস্থানের হেফাজতকারী। আর যে বিয়ে করতে সমর্থ নয় তার সাওম পালন করা অবশ্য কর্তব্য। কেননা সাওম কামবাসনা অবদমিত করে রাখে...।’ (সহীহ আল বুখারী, কিতাবুস সাওম)। বর্ণিত হাদীস থেকে আমরা দুটি বিষয়ের অতি জোরালো যুক্তি খুঁজে পাই। প্রথমত, আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার দেয়া বিধান সাওম পালন আর এ সাওম পালনের মাধ্যমে দিবাভাগে পানাহার থেকে দূরে থাকা, ঝগড়া-বিবাদ বিলাসিতাসহ যাবতীয় হারাম কাজ থেকে দূরে থাকা ও যৌনকর্মের ধারে-কাছেও না যাওয়া। দ্বিতীয়ত, হাদীসে স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে যে, সিয়াম সাধনায় আত্মনিয়োগ করলে যৌনক্ষুধা নিবারণের খায়েশ স্বভাবতই কমে আসে আর চোখের সিয়াম তথা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সিয়ামের মাধ্যমে যাবতীয় অপকর্মের লালসাকে কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। নিছক পানাহার থেকে বিরত থাকলেই যে সাওমের যথাযথ হক আদায় হয় না। এ মর্মে মহানবী (সা.)-এর একটি হাদীস এভাবে এসেছে। আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেছেন, সাওম পালন করে কেউ যদি মিথ্যা কথা বলা ও তদনুযায়ী কাজ করা পরিত্যাগ না করে, তবে তার শুধু খাদ্য ও পানীয় পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।’ (সহীহ আল বুখারী, কিতাবুল সাওম)।
স্মরণযোগ্য যে, মানবসভ্যতার রাহবার হযরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন গোটা মানবজাতির জন্য একমাত্র আদর্শ। বিশ্বনবী (সা.)-এর ওপর যে মহাগ্রন্থ কুরআনুল কারীম আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে নাজিল হয় সেটাই হলো একমাত্র গাইডবুক। এটি শুধু মুসলমানদের জন্য নয়, এটা গোটা মানবজাতিরই মুক্তি সনদ। এ মহাগ্রন্থটি নাজিলের সূচনা হয়েছে পবিত্র সিয়াম সাধনার মাস রমযানুল মুবারকেই। এ মর্মে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা ঘোষণা করেন, ‘রমযানের মাস, এতেই কুরআনুল কারীম নাজিল হয়েছে, তা গোটা মানবজাতির জন্য জীবনযাপনের বিধান এবং তা এমনই সুস্পষ্ট উপদেশাবলিতে পরিপূর্ণ যা সঠিক ও সত্য পথ প্রদর্শন করে এবং হক ও বাতিলের পার্থক্য পরিষ্কাররূপে তুলে ধরে ...।’ (সূরা বাকারা: ১৮৫)।
পবিত্র কুরআনুল কারীমের ঘোষণা অনুযায়ী মানুষ সিয়াম সাধনার দ্বারা আত্মশুদ্ধি লাভ করবে এবং এর সাথে সাথে সত্য-মিথ্যার পার্থক্য নির্ণয় করে ন্যায়, সত্য, সুন্দর, শালীন সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলবে- এটাই হলো মহান রাব্বুল আলামিনের এ ঘোষণার মুখ্য উদ্দেশ্য। এক আল্লাহর বান্দাহ ও তাঁর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টিজীব হিসেবে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের বিধান বাস্তবায়নের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালানোই হলো সবার জন্য অপরিহার্য কর্তব্য।
সিয়াম যেন কোনো ব্যক্তির ওপর জুলুম হিসেবে আবর্তিত না হয় এজন্য বৃদ্ধ, রোগী, দুর্বল এবং মুসাফির ব্যক্তিদের জন্য কাযা করারও বিধান রয়েছে যেটা পবিত্র কুরআনুল কারীম ও হাদীসের বর্ণনায় পরিষ্কার করে দেয়া হয়েছে। পবিত্র রমযান মাসের ফরয সিয়াম পালনের ক্ষেত্রে যে রকম কঠোর নির্দেশ রয়েছে, নফল সিয়াম পালনের ক্ষেত্রে মানুষের ইচ্ছার ওপর এর বাস্তবায়ন নির্ভরতার কথা পবিত্র হাদীস গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে। এ মর্মে বুখারী শরীফে কয়েকটি হাদীস প্রায় একই রকমভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এ মর্মে হাদীস এসেছে। আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রা.) বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আব্দুল্লাহ! আমি অবহিত হয়েছি যে, তুমি নাকি সর্বদা সাওম পালন কর আর রাতে সালাতে রত থাকো? আমি জবাব দিলাম হ্যাঁ, ইয়া রাসূলুল্লাহ! তিনি বললেন, এমনটি আর করো না। তুমি সাওম পালন করো এবং বিরতিও দাও, সালাত আদায় করো আবার ঘুমও যাও, কেননা তোমার ওপর তোমার শরীরের হক আছে, তোমার ওপর তোমার চোখ দুটির হক রয়েছে, তোমার ওপর তোমার স্ত্রীর (পরিবারের) হক রয়েছে, তোমার সাক্ষাৎকারীর (মেহমানের) হক রয়েছে। সুতরাং প্রতি মাসে তিন দিন (নফল) সিয়াম পালন করাই তোমার জন্য যথেষ্ট। কেননা প্রতি নেক কাজের বিনিময়ে তোমার জন্য রয়েছে দশগুন সওয়াব...।’ (সহীহ আল বুখারী, কিতাবুস সাওম)। এ হাদীসটা এখানে উল্লেখ করার উদ্দেশ্যই হলো মানুষ শারীরিক ইবাদত করতে গিয়ে এমন অবস্থার মুখোমুখি যেন না হয় যে, কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলে অবশেষে পারিবারিক, সামাজিক তথা সার্বিক দায়িত্ব পালনে অকেজো হয়ে না পড়ে।
রমযান মাসের একমাস সিয়াম সাধনার শেষলগ্নে শিশু, আবাল, বৃদ্ধ, বনিতাসহ নারী পূরুষ সকলের জন্য যে ফিতরা ধার্য করা হয় এবং তা গরিব, মিসকিন ও অসহায়দের মধ্যে বিতরণ করা হয় এতে মুসলমানদের মধ্যে সামাজিক বন্ধন আরো দৃঢ় হয়। এতে ধনী-গরিব সবাই ঈদের আনন্দে অংশগ্রহণ করতে পারে। এক মাস সিয়াম সাধনার শেষে ঈদগাহে সকলের সমবেত হবার দৃশ্য এ কথা সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, আদম সন্তান তথা মুসলিম উম্মাহ সকলেই ভাই ভাই।
মহান রাব্বুল আলামিন মুসলিম জাতিকে সিয়াম সাধনার এ মর্মবাণী উপলব্ধি করার তাওফিক দান করুন। আমীন।
লেখক : সদস্য, দারুল ইসলাম ট্রাস্ট, দরগাহ রোড, সিরাজগঞ্জ।



অন্যান্য মিডিয়া bdnews24 RTNN Sheersha News barta24 Prothom Alo Daily Nayadiganta Jugantor Samakal Amardesh Kaler Kantho Daily Ittefaq Daily Inqilab Daily Sangram Daily Janakantha Amader Shomoy Bangladesh Pratidin Bhorerkagoj Daily Dinkal Manob Zamin Destiny Sangbad Deshbangla Daily Star New Age New Nation Bangladesh Today Financial Express Independent News Today Shaptahik 2000 Computer Jagat Computer Barta Budhbar Bangladesherkhela Holiday Bangladesh Monitor BBC Bangla Pars Today
homeabout usdeveloped by

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ মো. তাসনীম আলম।

এটিএম সিরাজুল হক কর্তৃক হক প্রিন্টার্স ১০/৮ আরামবাগ, ঢাকা-১০০০ হতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। যোগাযোগের ঠিকানাঃ ৪২৩ এলিফেন্ট রোড, বড় মগবাজার, ঢাকা - ১২১৭।

ফোন: ৮৮ ০২ ৪৮৩১৯০৬৫, ই-মেইল: sonarbanglaweekly@gmail.com, weeklysonarbangla@yahoo.com, সার্কুলেশন: ০১৫৫২৩৯৮১৯০, বিজ্ঞাপন: ৪৮৩১৫৫৭১, ০১৯১৬৮৬৯১৬৮, ০১৭৩৪০৩৬৮৪৬।