॥ ফিরোজ আহমদ ॥
১৫ জানুয়ারি ২০২৪। ব্যাঙ্গালুরু থেকে হাওড়া যেতে আমরা দুরন্ত ট্রেনে উঠেছি। তিন দিনের ভোগান্তি দালালের যন্ত্রণায়। ১২০০ রুপির টিকিট কিনতে ২৭০০ রুপি শেষ করতে হয়েছে। এটা নন এসি স্লিপিং বেড। একতলা, দোতলা, তিনতলা করে প্রতি কক্ষে দুই পাশে ৬ জন এবং সামনের দুই বেডে দুজন- এ নিয়ে মোট ৮ জন যাত্রীর একটি কক্ষ। কিন্তু এ কী আশ্চর্য! আমাদের কক্ষেই বেডে, মেঝেতে গাদাগাদি করে শুয়ে-বসে রাত কাটালেন ১১ যাত্রী। রাতে উঠে ওয়াশরুমে যাবো। দোতলা থেকে নেমে সামনে পা বাড়াবো। কিন্তু সে ক্ষমতা আমার নেই। সামনে-পেছনে চোখ মেলে দেখি মেঝের ওপরে শত শত মানুষ- কেউ শায়িত, কেউ কাত হয়ে ঝিমাচ্ছে। কেউ বা আবার বসে আছে। অন্যান্য নারী, পুরুষ ও শিশুরা একের ওপরে অন্যজন, তার ওপরে আরেকজন আলুর বস্তার মতো পড়ে আছে। এসবে আমি বিস্মিত হয়ে গেলাম। এসব দেখে মনে পড়ে গেল, ফিলিস্তিনের মুসলমানদের লাশের স্তূপের কথা।
দীর্ঘ ৭০ বছর ধরে ফিলিস্তিনের মুসলমানদের ওপর অনবরত সীমাহীন বোমা ও গুলির আগুনে মানুষ সব পুড়ে ছাই হয়ে গেল। জ্বলজ্যান্ত মানুষকে ধরে নিয়ে হাত-পা বেঁধে ফেললো। ছটফটে মানুষ চিৎকার করছে। ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি করে সবাইকে লাশ বানিয়ে ফেলছে। এসব শত শত লাশ উন্মুক্ত স্থানে মাঠের মধ্যে স্তূপ করে ফেলে রাখে এখানে-সেখানে। কী নির্মম সেই হত্যাকাণ্ড।
আজকের এই ট্রেন জার্নিতে এমনভাবে যাত্রীসাধারণের কষ্টকর অবস্থা দেখে আমার মনে খুবই দুঃখ লাগল। এতো টাকা খরচ করে টিকিট কিনে এতো লম্বা ভ্রমণ করতে হবে কেন?
শুনতে পেলাম পূজার ছুটিতে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ছাত্ররা দলে দলে এসে এই ট্রেনে উঠেছে। যাত্রীর ভিড় এজন্য হয়েছে। আফসোস এমন অনাকাক্সিক্ষত দুর্গতির জন্য। আল্লাহ আমাদের রহম করুন।
কেউ হাসে, কেউ কাঁদে
আবার সেই ইমিগ্রেশন। দীর্ঘ ২৫ দিনের মেহমান ছিলাম বন্ধু দেশ ভারতে। আমার আগে পিছে হাজারো বাংলাদেশি লাইন ধরেছে ইমিগ্রেশনে। ঘণ্টা পার হয়ে গেল। দীর্ঘ সফরে সবাই দৈহিক ও মানসিকভাবে ক্লান্ত। তবুও ইমিগ্রেশনে এসে বিরক্তির পর বিরক্তিতে ঘর্মাক্ত সবাই। লাইনের পর লাইন ধরেই আছে ধৈর্যের সাথে। নিজের জায়গা-সম্পত্তি শেষ করে চিকিৎসা বা পর্যটনে গিয়ে প্রতিজনে আমার মতো সেখানে শেষ করেছে লাখ লাখ টাকা। স্ত্রী-পুত্র পরিজনের মায়ায় আরো টাকা খরচ করেছে। প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র কিনতে গিয়ে বিদায়ী কেনাকাটা করেছে। কিনেছে কম্বল, সোয়েটার, জামা, কসমেটিক, খেলনা, চাদর ইত্যাদি। আবার কোনো বেকার যুবক দুই টাকা কামাই করে জীবন সংগ্রামে জয়ী হতে সীমান্তের এ টেনশনের লাইনে ঢুকেছে। আমাদের আল-আমীন তেমন কিছুই কিনতে পারেনি। দুজন মিলে বিশ কেজিও হবে না। অথচ ইমিগ্রেশনের এ টেনশনের লাইনের বিরক্তিকর, অস্বস্তিকর চাপে পড়ে সেও ঘেমে অস্থির। যারা লাখ লাখ টাকার নানারকম মালপত্র কিনে এনেছে তাদেরকে দেখে মনে হয় চরম সিরিয়াস। মাঝে মাঝে যখন কাউকে আটকে দেওয়া হয়, হাজার হাজার টাকা জরিমানা করা হয়, তখন অপেক্ষমাণ পেছনের অনুরূপ অপরাধীদের দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে ছটফট করতে দেখলাম। আমি এই নবাগত মেহমান এতোসব কাণ্ডকারখানা দেখতে দেখতে ভাবছি আরো কথা। আমি হিসাব মিলিয়ে দেখতে পেলাম প্রতিদিন হাজার হাজার মেহমান থেকে হাসিখুশিতে বৈধ-অবৈধ উপায়ে কোটি কোটি টাকা বাগিয়ে নিচ্ছে তারা।
অধিকাংশ যাত্রী জটিল রোগের চিকিৎসার জন্য ডাক্তার, হাসপাতাল, ট্রেন, বাস, বাসাভাড়া, খাওয়া-দাওয়া, সরকারি ট্যাক্স ইত্যাদি মিলিয়ে বিপুল পরিমাণে ভারতীয় রুপি খরচ করতে হয়।
পাসপোর্ট রিনিউ করা, ভিসা করতেও প্রতিজনকে বের করতে হয় হাজার হাজার টাকা। এতোকিছুতে তারা সীমাহীন লাভবান। অথচ ছোট-খাটো ত্রুটি-বিচ্যুতি তারা মেনে নিতে পারে না।
বাংলাদেশ ও ভারতের সরকার কি পারে না পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে উভয় দেশের নাগরিকদের কল্যাণে শান্তিপূর্ণ সমাধানে পৌঁছাতে।