॥ গোলাপ মাহমুদ সৌরভ ॥
আমি তখন অনেক ছোট। বয়স আট-দশ বছর হবে। ক্লাস ফাইভে পড়ি। আম্মার মুখে শুনেছি আগামীকাল রোজা। তখন দেখেছি আমার আম্মা ঘরের যত পুরনো কাপড়-চোপড় এবং ঘরের সব জিনিসপত্র ধোয়ামোছা করতেন এবং মাটির ঘর কাদামাটি দিয়ে পুনরায় লেপালেপি করতেন। আর আব্বাকে বলতো কিছু বাজার-সদাইপাতি কিনতে হবে। যেমনÑ মুড়ি, খেজুর, কাবলি বুট, ছোলা, মিঠাই, চিনি, বেসন আরো সাংসারিক দৈনন্দিন যা লাগে ইত্যাদি। শুধু আমাদের ঘরেই না সকল মুসলমানদের ঘরে যেন একটা রোজার আমেজ কাজ করত। কেমন জানি চারদিকে একটা আনন্দ-উল্লাসের ঝলকানিতে রোজার অনুভব করত। পরের দিন সন্ধ্যাবেলা আমার আম্মা ভালো ভালো মজাদার রান্না করছেন। আমি পাশে বসে আম্মাকে জিজ্ঞেস করলাম, আম্মা এত রান্না করছেন কেন? আমরা তো খাওয়া-দাওয়া শেষ করেছি। এখন শুয়ে পড়ব। তাহলে কী আমাদের বাড়িতে কোনো মেহমান আসবে? আম্মা বললেন, নারে বাজান, আমরাই খামু। আমি তো বড্ড খুশি। তাহলে কী এখনই খামু। না আজ রাতে রোজা, ভোরবেলা উঠে খামু, রোজা রাখতে হবে।
আমি কী রোজা রাখব আম্মা? হুম তুমিও রাখবা, এখন যাও ঘুমিয়ে পড়।
ঠিক আছে আম্মা আমি ঘুমাই, সময় হলে আমাকে ডাক দিয়েন।
ঠিক আছে যাও। আমি ঘুমে বিভোর।
ছোট মানুষ বলে কথা, আম্মা আমার পিঠে হাত বুলিয়ে ডাকছে। ওঠ খোকন, সময় হয়েছে, খাবি ওঠ, রোজা রাখবি না।
আমি কিছুতেই চোখের পাতা খুলতে পারছি না। হাত-পা মুড়িয়ে ঘুমাচ্ছি। একটু পরে আব্বা এসে আম্মাকে বলল, আজ প্রথম রোজা আমাদের সাথে খোকন রোজা রাখবো, তাছাড়া...।
হুম আমি তো ডাকছি, উঠছে না, আপনি পারলে ডেকে তোলেন।
আব্বা এসে আমার কানের কাছে বললেন, খোকন ওঠ বাবা। তুই রোজা রাখবি না? এ বলে আব্বা আমাকে দুই হাত ধরে টেনে উঠাল।
সেদিন আব্বা-আম্মার সাথে রাতে সাহরি খেলাম।
তারপর একটু পরই মসজিদে মুয়াজ্জিন সাহেব মাইকে বলছেন, আর মাত্র পাঁচ মিনিট সময় আছে, যারা এখনো খাননি তারা তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করুন। উঠুন রোজা রাখুন, রমযানের পবিত্রতা রক্ষা করুন।
কিছুক্ষণ পর আযানের শব্দ শুনতে পেলাম। আব্বা বললেন, চল খোকন মসজিদে যাই নামায পড়ে আসি।
আমি পাঞ্জাবি আর টুপি পরে আব্বার সাথে মসজিদে গিয়ে নামায পড়লাম। তারপর বাড়িতে এসে দেখি আমার আম্মা নামায পড়ে বসে তসবি জপছে বসে। আমার আম্মা হাসি দিয়ে বললেন, আজ আমার খোকন রোজা রেখেছে।
আমাকে বললেন, আমার পাশে বসো, রোজার নিয়ত করেছ তুমি?
না আম্মা আমি তো পারি না।
আম্মা বললেন, তুমি আমার সাথে বলো, নাওয়াইতুয়ান.... তারপর আম্মার সাথে সাথে রোজার নিয়ত পাঠ করলাম।
ছোট মানুষ ভোরবেলা উঠেছি। তাই একটু আম্মার কাছে রোজার বিভিন্ন বিষয় শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে যাই। প্রায় একটানা পাঁচ ঘণ্টা ঘুমিয়ে দশটা বাজে উঠি। ওঠে দেখি, আম্মা রান্না করে নাই। তারপর আমি বললাম, আম্মা রান্না করছেন না এখনো? এখন কীসের রান্না করবো খোকন আমরা তো রোজা রেখেছি! ও আচ্ছা, তাই তো আম্মা রোজা রাখলে কি দিনের বেলা খাওয়া যায় না? না, খাওয়া যায় না। কিছু খাইলে রোজা হয় না, ভেঙে যায় আর তার জন্য গুনাহগার হতে হয়। আচ্ছা আম্মা, রোজা কী? আম্মা বললেন, রোজা মানে দিনের বেলা পানাহার বন্ধ করে আল্লাহকে ভয় করে উপোস থাকা, মিথ্যা কথা না বলা, কাউকে গালমন্দ না করা, অপ্রয়োজনীয় বেশি কথা না বলা, আর কুরআন তেলাওয়াত করা, নামায পড়া আর এরই নাম রোজা বা ইবাদত। আম্মার কাছে রোজার কথা শুনে সারা দিন উপোস থেকে রোজা রাখলাম, সারা দিন উপোস থেকে সন্ধ্যা হলেও মাগরিবের আজান দিতে আরো আধাঘণ্টা বাকি আমি আম্মাকে বললাম, আর কতক্ষণ পর খেতে হবে আম্মা? আর একটু ধৈর্য ধরো কিছুক্ষণ পর আযান দিলেই খেতে পারবে।
আমি বাইরে খেলাধুলা করছি আর আমার আম্মা এদিকে পিঁয়াজু, বেগুনি, আলুর চপ, শরবত-দই দিয়ে ইফতারের আয়োজন করছেন। যখন আযান হলো আব্বা বললেন, আসো খোকন আযান হয়েছে ইফতার করো। আমি দৌড়ে এসে খেতে বসলাম। তারপর আম্মা আমাকে ইফতারের দোয়া পাঠ করিয়ে খেতে দিলেন। আজ সেই ছোট বেলার রোজা এখনো মনে পড়ে। মনে হয় আগের দিনগুলো কতই না সুন্দর কেটেছে, কত ভালো লেগেছে। আবেগ-অনুভূতি ছিলো অন্যরকম আর এখনকার রোজা আগের মতো হৈ-হুল্লোড় করে রাখা হয় না। সারা দিন কর্মের ব্যস্ততা নিজেকে ক্লান্ত করে তোলে। তবুও আল্লাহর বিধান এবং আদেশ-নিষেধ পালন করতে হবে। আর এটাই আমাদের মুসলমানের পাপ মোচনের একটা সুযোগ এবং সকল গুনাহ থেকে প্রভুর কাছে মাফ পাওয়ার একটা সুযোগ।