সংবাদ শিরোনামঃ

সরকারের শেষ রক্ষা হবে না ** চাণক্যদের নোংরা খেলা ** ১০০ বছরের জ্বালানি সম্পদ হারিয়েছে বাংলাদেশ ** আফগানিস্তানে মতৈক্যের সরকার এবং শান্তির প্রত্যাশা ** সরকারের জুলুম-নির্যাতনের কারণে মানুষ ঈদের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়েছে ** কুরবানির পশুর চামড়া ক্রয় বিক্রয়ে সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন ** লতিফ সিদ্দিকী বনাম কাদের সিদ্দিকী ** জিতেছে চাঁদ দেখে পক্ষ ** ঝিনাইদহে সরকারি বিদ্যালয়ের জায়গা দখল করে আওয়ামী লীগ নেতার মার্কেট ** কবি ফররুখ আহমদের শিশু কবিতায় বিচিত্র পাখি **

ঢাকা, শুক্রবার, ২ কার্তিক ১৪২১, ২১ জিলহজ ১৪৩৫, ১৭ অক্টোবর ২০১৪

মুহাম্মাদ হাবীবুল্লাহ্ হাস্সান
সৃষ্টিশীল অঙ্গনে মুহূর্তের বলতে কিছু নেই। মুহূর্তের সৃষ্টি হতে পারে, তবে মুহূর্তে তা ম্রিয়মান নয়। কোনো পংক্তি, কোনো গান-কবিতা, কোনো গাদ্যিক বাক্য মুহূর্তে সৃষ্ট মনে হলেও করোটি-জরায়ুতে তার সৃষ্টি-প্রক্রিয়া চলে বহুদিন ধরে। ফলে কোনো কোনো সৃষ্টিশীল কর্ম মুহূর্তের হয়েও চিরকালীন ও শাশ্বতকালীন। আবার অনেক সৃষ্টি এমন আছে যা কাঠ-খড় পুড়িয়ে সৃষ্ট হলেও মুহূর্তে মিলিয়ে যায় অমূল্যায়নের অতলান্তে। সাহিত্য-শিল্পেরে বৈশ্বিক অঙ্গনে মুহর্তের বহু সৃষ্টিকে আজ চির ও শাশ্বতরূপে ভাস্বরিত দেখতে পাই। প্রাক-ইসলামী অজ্ঞতাযুগের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি, যাকে আমরা আস্-সাউল মুআ’ল্লাকাত তথা ‘ঝুলন্ত সাতটি কবিতা’ হিসেবে চিনি, সেগুলোও মূলত মুহূর্তের সৃষ্টি। ফররুখ আহমদের (১৯১৮-১৯৭৪) বিখ্যাত ‘ডাহুক’ও মুহূর্তের সৃষ্টি। সে কথা ইতিহাস তো বলেই, উপরন্তু কবি নিজেও ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় বলে গিয়েছেন ঘনিষ্ঠ অনেককে। অথচ সেটি সমকালকে চাপিয়ে আজকের এ মুহূর্তেও প্রাণবন্ত, আবেদনময়। সে আবেদন, নিশ্চিতভাবে বলা যায়, চিরকালই জীবন্ত থাকবে।

‘মুহূর্তের’ নামাঙ্কিত কোনো উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ বাংলাসাহিত্যে আছে বলে আমার জানা নেই। যেমন, মুহূর্তের কবিতা,  মুহূর্তের গল্প, মুহূর্তের নাটক বা মুহূর্তের গদ্য ইত্যাদি। এ নাম হয়তো অনেকের কাছে তেমন পরিপাটি মনে হয়নি। কিন্তু চিন্তা করলে দেখা যায়, এ নামের ভেতর এক অসাধারণ সৌন্দর্য, চৌকসতা ও দর্শনদীপ্তি লুকিয়ে রয়েছে। ‘মুহূর্তের’ নামাঙ্কিত কোনো সৃষ্টিকর্ম এক হাজার বছর পরও একজন পাঠকের হাতে পৌঁছুলে আপাতভাবে হলেও তার মনে হবে, এ যেন এ মুহূর্তের। মনে হবে, যেন আমার এ মুহূর্তের ভাবনা-বেদনার প্রতিনিধিত্ব করবে এ গ্রন্থ। প্রকৃতপইে যদি গ্রন্থটি শাশ্বতকাল ও চিরকালের উপযোগী হয়, তা হলে তো কথাই নেই। নামনির্বাচনের মৌহূর্তিক সচেতন পাণ্ডিত্য ছিল কবি ফররুখ আহমদের। ‘সাত সাগরের মাঝি’, ‘মুহূর্তের কবিতা’, ‘নতুন লেখা’, ‘নয়া জামাত’, ‘কাফেলা’, ‘দিলরুবা’ ইত্যাদি নাম দেখলে তা বোঝা যায়।

ফররুখ আহমদের একটি অসাধারণ কবিতাগ্রন্থের নাম ‘মুহূর্তের কবিতা।’ সম্পূর্ণ সনেট কবিতাগ্রন্থ। প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে। সে হিসেবে গত সেপ্টেম্বর মাসে এ গ্রন্থের অর্ধশতবর্ষ পূর্ণ হয়েছে। গ্রন্থটির দ্বিতীয় পরিমার্জিত সংস্করণ বের হয় অক্টোবর ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে। সম্পাদনা করেন জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী। ‘সাত সাগরের মাঝি’ ও ‘সিরাজাম মুনীরা’র পর ফররুখ আহমদের নতুন এক দিগমত্ম উন্মোচিত হয় ‘নৌফেল ও হাতেম’ কাব্যনাট্য দিয়ে। এর পরপরই কবিপ্রতিভার আরেক নবদিগন্ত উন্মোচিত হয় ‘মুহূর্তের কবিতা’র মাধ্যমে। প্রকাশের পরপরই সাড়া জাগিয়ে তুলে কাব্যাঙ্গনে। প্রকাশের কিছুদিন পরেই (১৯৬৪ সালে) সমালোচনা বের হয় পত্রিকায়। সমালোচনা করেন কবি-সমালোচক আবদুল কাদির এবং কবি-সমালোচক মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ।

আবদুল কাদির লিখেন : ‘‘ফররুখ আহমদের অনেক সনেটেই কল্পনা ঐশ্বর্য ও ভাবের বিস্তার প্রচুর। তাঁর কোনো কোনো সনেট বক্তব্য-প্রধান (Verse as speech) হলেও কয়েকটি সনেট বাস্তবিকই গীতধ্বনিময় কবিতা (Verse as song)। সাহিত্যে অনব্য সৃষ্টি ‘হাজারে না মিলে এক’। কাজেই স্বল্পসংখ্যক রচনার জন্যেই ফররুখ আহমদ সার্থক সনেটকার হিসাবেও মর্যাদার আসন পাবেন।’’

(ফররুখ আহমদ : জীবন ও সাহিত্য, আবদুল মান্নান সৈয়দ, বাংলা একাডেমি, ১৯৯৩, পৃ. ১৭৬)।

মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ লিখেছেন : ‘‘মুহূর্তের কবিতা’য় বিশুদ্ধ সৌন্দর্যবোধের সঙ্গে একটি বিশেষ জীবদৃষ্টি ও মানসধারা সম্মিলনের পরিচয় স্পষ্ট হয়ে আছে। সনেটের নিপুণ শিল্পী হিসাবে ফররুখ আহমদের খ্যাতি সুদীর্ঘকালের; আলোচ্য সংকলনে এই নিপুণতার সঙ্গে এমন আর একটি লণীয় বৈশিষ্ট্যের পরিচয় উদ্ভাসিত হলো, যা এতদিন অধিকাংশ সমালোচকের কাছেই ছিল অপরিজ্ঞাত। সনেটের আঙ্গিকে ফররুখ আহমদ শুধু বিশুদ্ধ সৌন্দর্যের সাধনা করেছেন এবং আরবী-ফারসী চলিত শব্দ ব্যবহার করেননি, এমন একটি ধারণা প্রায় সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছিল, কিন্তু এ-ধারণাটি যে নিতান্তই ভ্রান্ত সে পরিচয় আলোচ্য গ্রন্থে নতুনভাবে উদ্ভাসিত হলো।’’

(বাংলা কাব্যে ফররুখ আহমদ : তাঁর শক্তি ও স্বাতন্ত্র্যের স্বরূপ, মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ, ফররুখ একাডেমি, ঢাকা, ২০০৩, পৃ. ১৫৮)।

সনেটকেও মুহূর্তের কবিতা বলা হয়। তবে সে নাম বাঙালিদের জিহবায়-জবানে তেমন টেকেনি। সনেট বা চতুর্দশপদী-ই টিকে আছে এখনো। মুহূর্তে সৃষ্টি হয়ে সীমায়িত ফর্মে আটকানো হয় বলেই হয়তো কেউ তাকে এ নামে ডেকেছিল। তবে ফররুখের এ এক গ্রন্থ ছাড়া বাংলা ভাষায় মুহূর্তের কবিতা,  মুহূর্তের গল্প, মুহূর্তের নাটক বা মুহূর্তের গদ্য নামে কোনো উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ আছে বলে আমার জানা নেই। ফররুখের আগেও না, পরও না। কিন্তু ফররুখের কাছে সম্ভবত (বরং নিশ্চিতভাবে) এ নামই সবচে’ যুৎসই ও টেকসই মনে হয়েছিল। আজ এতোদিন পর, পঞ্চাশ অতিক্রান্ত হওয়ার পরও, উক্ত গ্রন্থের কবিতা সমষ্টিকে মনে হচ্ছে এ মুহূর্তের জীবন্ত কবিতা, টসটসে তরতাজা প্রাণবন্ত কবিতা। গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত প্রায় সকল কবিতার মূলবক্তব্য নিয়ে চিন্তা করলে বোঝা যাবে, কীভাবে অর্ধশতবর্ষের আগের কবিতাও বর্তমানের জন্য সমানভাবে সত্য ও প্রযোজ্য। যেন আজকের ঠিক এ সময়ণের জন্য লিখা হয়েছিল এসব কবিতা। এখানেই একজন কবির কালজয়ী ও কালোত্তর সফলতা। প্রতিভার পলিসে যুগের দূরত্ব ঘুচিয়ে নিজের সৃষ্টিকর্মকে সমকাল থেকে শাশ্বতকালে ছড়িয়ে দেয়ার মধ্যেই একজন কবির শক্তি, স্বাতন্ত্র্য ও বুকউপচানো গৌরব নিহিত। তবু যুগের চরম নৈরাজ্যের দিকে দেখে কবির সন্দেহ হয়েছিল, মুহূর্তের এসব কবিতা ও কলতান সুরের সম্ভার খুঁজে পায় কিনা? খুঁজে পায় কিনা সফলতার পথের সন্ধান? তবে তিনি এও বলেছেন, নগণ্য ণিকের এ গান মিনারের দম্ভ ছেড়ে ধূলি কণিকার মূল্যই চায়। কবির ভাষায় :

 à¦®à§à¦¹à§‚র্তের এ কবিতা,  মুহূর্তের এই কলতান

হয়তো পাবে না কণ্ঠে পরিপূর্ণ সে সুর সম্ভার,

হয়তো পাবে না খুঁজে সাফল্যের, পথের সন্ধান,

সামান্য সঞ্চয় নিয়ে যে চেয়েছে সমুদ্রের পার;

তবু মনে রেখো তুমি নগণ্য এ ণিকের গান

মিনারের দম্ভ ছেড়ে মূল্য চায় ধূলি কণিকার।

(মুহূর্তের কবিতা/ মুহূর্তের কবিতা)

মুহূর্তেই এবং মুহূর্তের জন্য যেসব চিন্তা-চেতনা-উপলব্ধি-ভাবনা কবিকে এবং কবির শিল্প-কৌতূহলকে নাড়া দিয়েছে, সেগুলিকে কবি মূল্যহীন মনে করেননি। মনে করেননি এগুলো মুহূর্তে ম্রিয়মাণ অপঝলক। এরকম মনে করা একজন কবির জন্য উচিতও নয়। বিশেষ করে তিনি যদি হন স্বভাবজাত, প্রতিভাধর, প্রতিভাসচেতন ও নিরীক্ষাপ্রবণ কবি। মূল্যহীন মনে করেননি বলেই তিনি এগুলোকে চিরস্থায়িত্ব দান করেছেন কবিতার কিমিয়াজাত ভাষ্যধারায়। মুহূর্তের কবিতা’র অন্তর্ভুক্ত ‘দুর্লভ মুহূর্ত’ কবিতায় দেখতে পাই এর সত্যায়িত চিত্রায়ণ :

এমন মুহূর্ত আসে এ জীবনে হয়তো ক্বচিৎ

(সে মুহূর্ত, তবু আসে, তবু ফিরে আসে)

যখন বিত মন ব্যথা কিম্বা বিষণœ সন্ত্রাসে

পড়িতে চাহে না বাধা, ফিরে পেতে চায় না সম্বিৎ

ফিরে পায় তপ্ত বে যে মুহূর্তে হারানো সঙ্গীত

আকাশের, বাতাসের, -শিশির ঝরানো ঘাসে ঘাসে

সমুদ্রের হৃদপিণ্ডে অথবা প্রিয়ার বাহু পাশে

প্রাণের মূর্ছনা মেশা জীবনের আশ্চর্য ইঙ্গিত।

জন্ম নেয় কবিতার রক্ত দল তখনি জীবনে,

-যে কবিতা মিশে আছে পৃথিবীর অরণ্যে, পাহাড়ে

যে কবিতা অর্ধস্ফুট গোলাপের পাত্রে সংগোপনে

সুরভি প্রশ্বাসে আর বিগত রাত্রির অশ্রুধারে

শিশিরে; -প্রকাশ যার নিজেরে হারায়ে বারে বারে

কাঁদিয়াছে বহু বর্ষ অন্ধকার মাটির বন্ধনে।

(মুহূর্তের কবিতা/ দুর্লভ মুহূর্ত)

জড়জগতের ঝড়ঝাপটায় এখন আমরাও পুরো বিশ্ব কতটুকু কান্ত? তা হয়তো কেউ-ই জরিপ দিয়ে স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিতে পারবে না। কারণ, যে ব্যক্তি বোঝানোর কসরত করবে, সে হয়তো আমাদের চেয়েও বেশি কষ্ট-কান্ত। কান্ত একই সঙ্গে বিশ্বমানবের শরীর ও মন, মনন ও মস্তিষ্ক; কান্ত মানুষের সাধারণ ও বিশেষ বিবেক। কান্তির শেষ কর্ম বা পরিণতি কী রকম? তা বৈজ্ঞানিকভাবে হয়তো কেউ প্রমাণিত করতে পারবে না। কান্তি-কষ্ট পরিমাপের থার্মোমিটার না থাকতে পারে। তবে মানুষমাত্রই তা অনুভব করে- একেকজন একেকভাবে। কবির কাছে কষ্ট-কান্তি হৃদয়ের স্তব্ধতা ও বোবাত্ব দিয়ে অনুমেয়। কান্তিবেদনায় সকল সুর থেমে যায়, নিভে যায় অনুভূতির সকল বাতিঘর। একটি পাখি যখন বেদনায় হিম হয়ে যায়, পাখাতে যখন পায় না সমুদ্র পাড়ি দেয়ার দুর্দান্ত গতি; নিঃসাড়-নিস্পন্দ যখন হয়ে যায় তার উড়ালমন, তখন সে আর ফেরে না বাসায়। মুক্তি তার কাছে অযুক্তিতে পরিণত হয়। তেমনি সমকালপ্লাবিত যন্ত্রণায় নীল হয়ে যাওয়া কবির মন আর মুক্তি খোঁজে না শুধু অসার কথায়। কিন্তু যুক্তি ও মুক্তিবিহীন অসার জীবন নিয়ে কবি বাঁচতেও চান না। ভারগ্রস্ত জীবনে কবি ফিরিয়ে আনতে চান দুরন্ত প্রাণের মূর্ছনা। নতুন সৃষ্টির বিস্ময়ে জাগাতে চান উদ্দাম গতি। তাঁর (মানে সমগ্র জাতির) উড়ালোন্মুখ হৃদয় বজ্রবেগ সৃষ্টি করতে চান প্রমুক্ত হাওয়ায়। কিন্তু চরম দুঃখ ও হতাশার ব্যাপার হলো, চলিঞ্চু বিবেকদংশিত পরিস্থিতিতে, মৃত্যু-স্তব্ধ রাতের ছায়ায় এবং অবরুদ্ধ আবেষ্টনে সংগ্রামী মানুষ ও মানসের সকল সাহস ও শক্তি লুপ্তপ্রায়। কবির ‘কান্তি’ কবিতায় যেমন-

আমার হৃদয় স্তব্ধ, বোবা হয়ে আছে বেদনায়,

যেমন পদ্মের কুঁড়ি নিরুত্তর থাকে হিমরাতে,

যেমন নিঃসঙ্গ পাখি একা আর ফেরে না বাসাতে;

তেমনি আমার মন মুক্তি আর খোঁজে না কথায়।

যখন সকল সুর থেমে যায়, তারা-রা হারায়,

নিভে যায় অনুভূতি-আঘাতে, কঠিন প্রতিঘাতে,

নিস্পন্দ নিঃসাড় হয়ে থাকে পাখি, পায় না পাখাতে

সমুদ্রপারের ঝড় প্রি গতি নিশামত্ম হাওয়ায়।

মুখ গুঁজে পড়ে আছে সে পাখির মত এ হৃদয়

রক্তরা। ভারগ্রস্ত এ জীবন আজ ফিরে চায়

প্রাণের মূর্ছনা আর নবতর সৃষ্টি বিস্ময়,

উদ্দাম অবাধ গতি, বজ্রবেগ প্রমুক্ত হাওয়ায়;

অথচ এখানে এই মৃত্যু-স্তব্ধ রাত্রির ছায়ায়

রুদ্ধ আবেষ্টনে আজ লুপ্ত হয় সকল সঞ্চয়।

(মুহূর্তের কবিতা/ কান্তি)

পঞ্চাশ বছর আগের একটি কবিতায়, কিংবা একটি কবিতার কিছু পঙক্তিতে আজকের জ্যান্ত বাস্তবতার রূপায়ণ কী অসাধারণ ধারাভাষ্যে হতে পারে, তার একটি উদাহরণ দেখা যাক :

দুঃস্বপ্নের রাত্রিশেষে তাই আজ প্রার্থনা আমার

স্বর্ণ ঈগলের মত মুক্ত হোক এই বন্দী মন,

আসুক পল্বলে ফিরে জীবনের বিপুল স্পন্দন

দীনতার সব গন্ডী ভেঙে যাক প্রাণের জোয়ার

সব ভ্রান্তি দূরে যাক, পুড়ে যাক মিথ্যার বন্ধন;

বলে যাব মুক্তকণ্ঠে এ পৃথিবী তোমার আমার।

(মুহূর্তের কবিতা/ মুক্তি স্বপ্ন)

তথ্য-উপাত্ত দিয়ে বলে না দিলে যেকোনো পাঠক মনে করতে পারে, এগুলো সদ্যপ্রকাশিত কবিতার কিছু নির্বাচিত পঙক্তি, যেগুলোতে প্রত্যেকের হৃদয়ে জমে থাকা দুর্বিষহ জীবনকথার ব্যাখা দেয়া হয়েছে। ‘শাক দিয়ে মাছ ঢাকা’র মতো আশরীরমন কৃত্রিম আধুনিক যুগের মানুষের ত অঙ্গ থেকে ঝরে পড়ছে রক্ত-পুঁজ। মানুষ, মানুষের জীবন ও জগৎ আজ বড়ই কেদাক্ত। মানুষ আজ এ শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে মুক্তি চায়, শান্তি চায়। চায় বেঁচে থাকার অধিকার। জাতি চায় স্বাধীন দেশের মাটির গন্ধ-স্পর্শ। কবিও একজন মানুষ (এবং অসাধারণ মানুষ) হিসেবে দুঃস্বপ্নের অবসান ঘটিয়ে স্বর্ণ-ঈগলের মতো মুক্ত হতে চেয়েছেন উক্ত কবিতায়। ফিরে পেতে চেয়েছে জীবনস্পন্দন। কবি শুধু প্রার্থনার হাত প্রসারিত করে ান্ত হননি। তিনি সোচ্চার কণ্ঠে উচ্চারণ করেছেন অধিকারের ভাষা ‘বলে যাব মুক্তকণ্ঠে এ পৃথিবী তোমার আমার।’

একটি কবিতাগ্রন্থে তাসবীর দানার মতো থরে-থরে সাজানো একশটি সনেট। কী নেই তাতে? জীবন-জগত, নিসর্গ-মাটি, রোমান্টিক কবিভাবনা, প্রেম-সৌন্দর্য-যৌবন, স্বদেশ-স্বজাতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য-ধর্ম, ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি, আদর্শানুরাগী কবি-সাহিত্যিকদের প্রতি শ্রদ্ধানিবেদন, সত্যে-সুন্দরে নিবেদিত কবিচিত্তের আত্মবিশ্লেষণ- এবং এছাড়াও আরো অনেক কিছু। এতোকিছুর পরও কবির হৃদয় অতৃপ্ত। তৃপ্তিপ্রয়াসী পিপাসিত কবিহৃদয়ে এখনো উত্তাল ঢেউয়ের স্রোত। সবকিছুকে কবির মনে হয়েছে শুধু নিমিষের রঙ, দরিয়ার গোত্রহীন বুদ্বুদ। যেখানে ল যুগ পলকেই মিটে যেতে পারে, সেখানে এসব বুদ্বুদের কান্না-হাসির খবরই বা কে রাখে? তবু মুহূর্তের আনন্দ একেবারে মূল্যহীন নয়। মুহূর্তের আনন্দও কখনো কখনো শাশ্বত আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে দিক দিগন্তে। এরকম আনন্দের সঙ্গে উপমায়িত হতে পারে ‘মুহূর্তের কবিতা’। শাশ্বত ও চির আলোকোদ্ভাসিত আনন্দের জন্যই ১০০ তম সনেটেও কবির অসাধারণ অতৃপ্তিবোধ! কবির ‘শেষ কথা’য় যেমন :

কিছু লেখা হল আর অলিখিত রয়ে গেল ঢের,

কিছু বলা হল আর হয়নি অনেক কিছু বলা;

অনেক দিগন্তে আজও হয় নাই শুরু পথ চলা!

কে জানে সকল কথা? কে পেয়েছে সংজ্ঞা সময়ের?

শুধু নিমিষের রঙে এই সব গান মুহূর্তের

অতলান্ত দরিয়ার এসব বুদ্বুদ গোত্রহীন

কখনো উঠেছে কেঁদে, কখনো বা হয়েছে রংগীন

দু’দণ্ড খেলার ছলে স্পর্শ নিতে পূর্ণ জীবনের।

ল যুগ-যুগান্তর মিটে যায় যেখানে পলকে

সেখানে এ বুদ্বুদের কান্না-হাসি, সংশয়িত কাল

কতটুকু, তবু তারে রাখে ঘিরে প্রদোষ সকাল

রঙের বৈচিত্র্য দিয়ে, অন্ধকারে তারার ঝলকে

দূরের ইশারা এনে। (মুহূর্তের আনন্দ উত্তাল

উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে দিক দিগন্তে শাশ্বত আলোকে)।

(মুহূর্তের কবিতা/ শেষ কথা)

লেখক : তরুণ কবি ও প্রবন্ধকার, চট্টগ্রাম।

অন্যান্য মিডিয়া bdnews24 RTNN Sheersha News barta24 Prothom Alo Daily Nayadiganta Jugantor Samakal Amardesh Kaler Kantho Daily Ittefaq Daily Inqilab Daily Sangram Daily Janakantha Amader Shomoy Bangladesh Pratidin Bhorerkagoj Daily Dinkal Manob Zamin Destiny Sangbad Deshbangla Daily Star New Age New Nation Bangladesh Today Financial Express Independent News Today Shaptahik 2000 Computer Jagat Computer Barta Budhbar Bangladesherkhela Holiday Bangladesh Monitor BBC Bangla Pars Today
homeabout usdeveloped by

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ মো. তাসনীম আলম।

এটিএম সিরাজুল হক কর্তৃক হক প্রিন্টার্স ১০/৮ আরামবাগ, ঢাকা-১০০০ হতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। যোগাযোগের ঠিকানাঃ ৪২৩ এলিফেন্ট রোড, বড় মগবাজার, ঢাকা - ১২১৭।

ফোন: ৮৮ ০২ ৪৮৩১৯০৬৫, ই-মেইল: sonarbanglaweekly@gmail.com, weeklysonarbangla@yahoo.com, সার্কুলেশন: ০১৫৫২৩৯৮১৯০, বিজ্ঞাপন: ৪৮৩১৫৫৭১, ০১৯১৬৮৬৯১৬৮, ০১৭৩৪০৩৬৮৪৬।