সংবাদ শিরোনামঃ

অবশেষে সরকার ও আ’লীগের পরাজয় ** তত্ত্বাবধায়কের দাবি মানুন নয় তো বিদায় নিন ** আওয়ামী লীগাররা বিস্মিত হতবাক! ধস আর ঠেকানো যাচ্ছে না! ** উন্নয়নের রাজনীতি উপহার দিন না হলে তীব্র গণআন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতা থেকে বিদায় করে দেয়া হবে ** আ’লীগের ফ্যাসিবাদী চেহারা ** প্রধানমন্ত্রীর ব্যঙ্গ-তামাশা বনাম খালেদা জিয়ার আলটিমেটাম ** সংবাদপত্রের পাতা থেকে ** ঢাকার মহাসমাবেশে আসতে পথে পথে বাধা ** ৪২টি ট্রেন চলাচলের জংশন স্টেশন পার্বতীপুরে যাত্রী ভোগান্তির শেষ নেই **

ঢাকা শুক্রবার ২ চৈত্র ১৪১৮, ২২ রবিউস সানি ১৪৩৩, ১৬ মার্চ ২০১২

মনসুর আহমদ

বাংলার পল্লী জীবনের নানা দিক রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্পগুলোতে আত্মপ্রকাশ করেছে। পল্লী জীবনের বিভিন্ন চিত্র অংকন করতে গিয়ে কবি তাঁর প্রচুর গল্পে বিবাহ বেদনার ছবি চিত্রিত করেছেন এমন সুনিপুণভাবে যে, পাঠকের অন্তরে থেকে থেকে একটি করুণ সুর সর্বদা উত্থিত হতে থাকে। এখানে তাঁর কয়েকটি গল্পের ট্রাজেডির দিক নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা গেল।

ঘাটের কথা

প্রথমেই আলোচনা করা যাক ‘ঘাটের কথা’ নিয়ে। গল্পের নায়িকা বিধবা কুসুমের সাথে এক সময় সাক্ষাৎ ঘটেছিল গৌরতনু সৌম্যোজ্জ্বল মুখোচ্ছবির এক সন্ন্যাসীর সঙ্গে। কুসুমের অন্তরে সন্ন্যাসীর প্রতি একটি প্রবল অনুরাগ সৃষ্টি হলো। সন্ন্যাসী কুসুমের অনুরাগের প্রতি কোনো দুর্বলতা না দেখিয়ে ছুটে গেল প্রশস্ত ধরণীর কোলে। বিদায় বেলা সন্ন্যাসী কহিলেন “তবে আমি চলিলাম।”

কুসুম আর কিছু না বলিয়া তাহাকে প্রণাম করিল, তাঁহার পায়ের ধুলা মাথায় তুলিয়া লইল।

সন্ন্যাসী চলিয়া গেলেন।

কুসুম কহিল, “তিনি আদেশ করিয়া গিয়াছেন তাহাকে ভুলিতে হইবে।” বলিয়া ধীরে ধীরে গঙ্গার জলে নামিল।

এতটুকু বেলা হইতে সে জলের ধারে কাটইয়াছে, শ্রান্তির সময় এ জল যদি হাত বাড়াইয়া তাহাকে কোলে করিয়া না লইবে, তবে কে আর লইবে। চাঁদ অস্ত গেল, রাত্রি ঘোর অন্ধকার হইল। জলের শব্দ শুনিতে পাইলাম, আর কিছু বুুঝিতে পারিলাম না। অন্ধকারে বাতাস হুহু করিতে লাগিল; পাছে মাত্র কিছু দেখা যায় বলিয়া সে যেন ফুঁ দিয়া আকাশের তারাগুলিকে নিভাইয়া দিতে চায়।

আমার কোলে যে খেলা করিত সে আজ তাহার খেলা সমাপন করিয়া আমার কোল হইতে কোথায় সরিয়া গেল, জানিতে পরিলাম না।” কুসুম এ বিচ্ছেদ বেদনা না সইতে গঙ্গায় ঝাঁপ দিল। কুসুমের জীবনের প্রবাহমান স্রোতের মধ্যে বিশ্বে তরাঙ্গাঘাত মূক ঘাটের সোপানাবলীর বুকে চিরদিনের জন্য মুদ্রিত হয়ে রইল; যা পাঠক কুলকে সামান্য সময়ের জন্য হলেও ব্যথিত করে তোলে।

দেনা-পাওনা

কবি গুরু এ গল্পটি লিখেছিলেন আজ হতে প্রায় শতবর্ষ আগে। পণপ্রথা যে কতদূর বর্বর ও নৃশংস হতে পারে, এ গল্প তার দৃষ্টান্ত। সেই কন্যাদায় বর্তমানে তখন থেকে আরও যে উদগ্র হয়ে উঠে তা নিশ্চিত। পিতা রামসুন্দর মাত্র দশ হাজার টাকা পণ অঙ্গীকার করে এক রায়বাহাদুরের ছেলের সাথে কন্যা নিরূপমার বিবাহ দিয়েছিলেন। সেই টাকাটার সবটা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় পিতা তার কন্যাকে আর নিজ গৃহে আনতে পারছেন না। এদিকে কন্যা শ্বশুর বাড়িতে উঠতে বসতে নানা গঞ্জনা সয়ে, না খেয়ে যতœ না পেয়ে ভীর্ষণ রোগে পড়ে।

‘‘রোগ যখন গুরুতর হইয়া উঠিল তখন শাশুড়ি বলিলেন, ‘‘ওর সমস্ত ন্যাকামি।” অবশেষে একদিন নিরু সবিনয়ে শাশুড়িকে বলিল, “বাবাকে আর আর আমার ভাইদের একবার দেখব, মা।

শাশুড়ি বলিলেন, “কেবল বাপের বাড়ি যাইবার ছল।” কেহ বলিলে বিশ্বাস করিবে না যেদিন সন্ধ্যায় নিরুর শ্বাস উপস্থিত হইল সেইদিন প্রথম ডাক্তার দেখিল এবং সেইদিন ডাক্তারের দেখা শেষ হইল।

বাড়ির বড় বৌ মরিয়াছে, খুব ধুম করিয়া অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হইল।”

পণের টাকা আদায় করতে মানুষকে এমন অবহেলা, বরের পিতার বড়লোকী বর্বরতাকে এমন ভীষণ ব্যঙ্গ এমন করুণ ও মর্মস্পর্শী করে অন্য কেউ ফুটিয়ে তুলেছেন কি না জানি না। এ ট্রাজেডি শুধু রামসুন্দর ও নিরুপমার নয়; এ ট্রাজেডি গোটা বাঙালির।

তারাপ্রসন্নের কীর্তি

রবীন্দ্র কথা সাহিত্যে দাম্পত্য সম্বন্ধকে নানাভাবে দেখান হয়েছে। এ গল্পটিতে দাক্ষায়ণী একেবারে সেকেলে। স্বামী তারাপ্রসন্ন একজন দরিদ্র ও বিফল লেখক। কিন্তু তার বিফলতা ও দারিদ্র্য স্ত্রী দাক্ষায়ণীর স্বামী গর্বকে বিনষ্ট করতে পারেনি। এই দাক্ষায়ণীটি হচ্ছে স্বামীগতপ্রাণা ও স্বামী গর্বিতা, স্বামীর মঙ্গলের জন্য অন্ধ শক্তিতে বিশ্ব পরায়ণা পল্লীসতীর সমুজ্জ্বল চিত্র। সে মরবার সময়ও তার ভোলানাথ স্বামীকে তাবিজ মাদুলিতে সুরক্ষিত করে যাবার প্রয়াস ভুলতে পারেনি। দাক্ষায়ণী ইতোমধ্যে চারটি কন্যা সন্তান জন্ম দিয়েছে, আর কন্যা সন্তান জন্ম দেয়ার অপরাধ নিজ কাঁধে টেনে নিয়েছে। কিন্তু তারাপ্রসন্ন এ কারণে দাক্ষায়ণীর ওপর কখন দোষ চাপায়নি বরং পঞ্চম কন্যা সন্তান প্রসবকলে স্ত্রীকে বাঁচাতে তার ব্যর্থ প্রচেষ্টা পাঠক হৃদয়ে একটি করুণ রাগ সঞ্চার করে। অন্যদিকে মরণের মুখোমুখি  দাঁড়িয়ে নির্মম কুটিল বুদ্ধি চক্রান্তকারীদের ব্যাপারে দাক্ষায়ণীর সতর্কতা স্বামী স্ত্রীর মধ্যে বিরাজমান গভীর ভালোবাসার একটি বিরল চিত্র গল্পে ফুটে উঠেছে। গল্পের শেষ অংশে “আসন্ন প্রসবকালে দাক্ষায়ণীর শারীরিক অবস্থা এমন হইল যে, সকলের বিশেষ চিন্তার কারণ হইয়া দাঁড়াইল। নিরূপায় তারাপ্রসন্ন পাগলের মতো হইয়া বিশ্বম্ভরের কাছে গিয়া বলিল, “দাদা আমার এই খান পঞ্চাশেক বই বাঁধা রাখিয়া যদি কিছু টাকা দাও তো আমি শহর হইতে ভালো দাই আনাই।

.... তারপরে মহোদরের মতো তাঁহার বিশ্বাস প্রবণ ভোলানাথ স্বামীটিকে পৃথিবীর নির্মম কুটিল বুদ্ধি চক্রান্তকারীদের সম্পর্কে সতর্ক করিয়া দিলেন। অবশেষে চুপি চুপি বলিলেন, “দেখো আমার যে মেয়েটি হইবে সে যদি বাঁচে তাহার নাম রাখিও ‘বেদান্তপ্রভা’, তারপরে তাকে শুধু প্রভা বলিয়া ডাকিলেই চলিবে।” এই বলিয়া স্বামীর পায়ের ধুলা মাথায় লইলেন। মনে মনে কহিলেন, ‘কেবল কন্যা জন্ম দিবার জন্য স্বামীর ঘরে আসিয়াছিলাম। এবার বোধহয় সে আপদ ঘুচিল’।

ধাত্রী যখন বলিল! “মা, একবার দেখো মেয়েটি কি সুন্দর হইয়াছে”- মা একবার চাহিয়া নেত্র নিমীলন করিলেন, মৃদুস্বরে বলিলেন, ‘বেদান্তপ্রভা’। তারপর ইহসংসারে আর একটি কথা বলিবারও অবসর পাইলেন না।

বেদনান্তপ্রভাকে উপহার দিয়ে ইহ সংসার হতে দাক্ষায়ণীর চির বিদায় তারাপ্রসন্নের জীবনে যে ট্রাজেডি বয়ে এনেছে তা শুধু তারাপ্রসন্নেরই নয় বরং বাংলার সমালোচক সম্প্রদায়ের জন্য ট্রাজেডি।

জয়পরাজয়

জয়পরাজয় গল্পটিতে হিন্দুরাজসভায় বিচার ছবিকে অবলম্বন করে একটি সত্যকে সুন্দরভাবে পরিস্ফুট করে তোলা হয়েছে। গল্পটিতে কল্পপন্থী রীতির সঙ্গে বিগ্রহপন্থী রীতিটাও মিশে গিয়েছে। ‘জয়পরাজয়ের কবি শেখর, রাজকন্যা অপরাজিতা, পণ্ডিত পুণ্ডরীক, রাজা উদয় নারায়ণ- সকলেই প্রতিনিধি চরিত্র। তাঁরা শুধু বিশেষ বিশেষ মানব শ্রেণীর প্রতিনিধি নহেন; তারা এক একটা আইডিয়ার প্রতিনিধি। ... ইহাতে শেখর ও পুণ্ডরীকেরযুদ্ধ বর্ণিত হইয়াছে। রাজা উদয়  ও প্রজাসাধারণ তার জয়পরাজয়ে বিচারক। এ যুদ্ধ কবিত্ব ও পাণ্ডিত্যের মধ্যে। ... প্রজাসনাথ উদয় নারায়ণ হইয়াছেন মূর্খ জনসাধারণের প্রতিনিধি, - যে জনসাধারণ তাহাদের সুখদুঃখে কবির গানে আনন্দ ও সান্ত্বনা লাভ করে, কিন্তু পাণ্ডিত্য অথবা পাণ্ডিত্যের পণ্ডুত্বের সামনে এক মুহূর্তেই কিছু না বুঝিয়া যেন আরো বেশি অভিভূত হইয়া পড়ে এবং তাদের চিরদিনের কবিকে ভুলিয়া পাণ্ডিত্যের কণ্ঠে জয়মাল্য পরাইয়া দেয়। পাণ্ডিত্য সম্বন্ধে মূর্খতার যে একটা অন্ধ মোহ আছে সেই সত্যই শোতৃমণ্ডলীসহ উদয় নারায়ণে পরিস্ফুট হইয়াছে। রাজকন্যা অপরাজিতা হইয়াছে গুণমুগ্ধ ভক্ত হৃদয়- শুল্ক পাণ্ডিত্যের গুরু গম্ভীর গর্জনের মধ্যে অপরাজিতা থাকিয়া আপনার স্নিগ্ধ দৃষ্টি দিয়া কবির প্রাণকে চিরকাল সঞ্জীবিত রাখে, আপন আলোক দিয়া সেখানে নিত্য সুখ ও নিত্য দুঃখের স্বর্ণকমল ফুটাইয়া তোলেন এবং আপন স্বতঃ উৎসারিত পুষ্পিত ভক্তি প্রীতির অম্লান জয়মাল্য দিয়া তার অবজ্ঞাত মরণাহত কবিকে বরণ করিয়া লয়। মরণাহত কবিকে বরণ করে নেয়ার অপূর্ব চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন কবি তাঁর মনের মাধুরী মিশিয়ে এভাবে। “একটি সুমধুর কণ্ঠে উত্তর শুনিলেন, “কবি আসিয়াছি।” শেখর চমকিয়া উঠিয়া চক্ষু মেলিলেন; দেখিলেন শয্যার সম্মুখে এক অপরূপ রমণী মূর্তি।

মৃত্যুসমাচ্ছন্ন বাষ্পাকুল নেত্রে স্পষ্ট করিয়া দেখিতে পাইলেন না। মনে হইল তাহার হৃদয়ের সেই ছায়াময়ী প্রতিমা অন্তর হইতে বাহির হইয়া মৃত্যুকালে তাহার মুখের দিকে স্থির নেত্রে চাহিয়া আছে।

রমণী  কহিলেন, “আমি রাজকন্যা অপরাজিতা।”

কবি প্রাণপণে উঠিয়া বসিলেন।

রাজকন্যা কহিলেন, “রাজা তোমার সুবিচার করেন নাই। তোমার জয় হইয়াছে, কবি, তাই আমি আজ তোমাকে জয়মাল্য দিতে আসিয়াছি।

বলিয়া অপরাজিতা নিজের কণ্ঠ হইতে স্বহস্ত রচিত পুষ্পমাল্য খুলিয়া কবির গলায় পরাইয়া দিলেন। মরণাহত কবি শয্যার উপরে পড়িয়া গেলেন।” যে রাজকন্যা অপরাজিতা তাঁর সমস্ত গানের উৎস এবং কেন্দ্র, যাকে তিনি কখনও চক্ষে দেখেন নাই, মৃত্যুর পূর্বে তাঁর স্বহস্তের জয়মাল্য অথবা বরমাল্য যখন কবি লাভ করিলেন, তখনই তাঁর জীবনের বিফলতা ঘুচিয়া গেল; জীবন এক মুহূর্তে সার্থক, সুন্দর ও মহিমাময় হইয়া উঠিল। এ গল্পে শেখর জীবনের ট্রাজেডি শুধু তার একার নয়, তা যেন আজ সমগ্র বিশ্বজনের হৃদয়ে ঘনিয়ে এসেছে। “যেন দেখি, ওই পরাজয় জগতের সমস্ত মন্দের কাছে সমস্ত ভালোর পরাজয়, জড়ের কাছে আত্মার পরাজয়, জটিল চক্রান্তের কাছে সতীত্বের পরাজয়, পার্থিব ক্ষমতামদ ও নিষ্করুণতার কাছে পিতাপুত্রীর স্বর্গীয় স্নেহ বন্ধনের পরাজয়, বস্তু জীবন ও হৃদয়দৌর্বল্যের কাছে জীবনের আদর্শের পরাজয়।”

জীবিত ও মৃত

মৃত মনে করে মাদম্বিনীকে পোড়াতে পাঠানো হয়েছিল, মৃতকল্প অবস্থা থেকে তার জেগে উঠার পর তার মনস্তত্ত্ব এবং লৌকিক পৃথিবীর সঙ্গে তার ব্যবহারকে ভিত্তি করে এই গল্পের পত্তন।

সারদা শঙ্করের বিধবা পুত্রহীনা ভ্রাতৃবধূ কাদম্বিনীর হৃদয়স্পন্দন হঠাৎ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কয়েকজন লোক মৃত দেহটিকে পোড়াতে নিয়ে গিয়েছিল দূর শ্মশানে। কিন্তু শ্রাবণ রাত্রের দুর্যোগের মধ্যেমৃত দেহকে শ্মশানে রেখে তারা দূরে সরে গেল। তাদের অনুপস্থিতিকালে মৃত দেহটি খাঁড়া হয়ে দাঁড়াল। কিন্তু তখন সে আর নিজকে জীবজগতের অধিবাসী বলে মনে করতে পারল না। কাদম্বিনীর আর ঘরে ফেরা হলো না। এক পর্যায়ে সে আশ্রয় নিল তার সইয়ের বাড়ি। কিন্তু সেখানে কিছুর সাথে সে কোনো রকম যোগ অনুভব করতে পারল না। সেখান থেকে গোপনে এক রাতে সে ফিরে এল সারদাশঙ্করের অন্তঃপুরে। সেখানে তার পৃথিবীর একমাত্র বন্ধন সারদাশঙ্করের পীড়িত ছেলেটিকে কোলে নিয়ে তার স্নেহকণ্ঠের  ‘কাকীমা’ ডাকটুকু শুনে ছিল তখন শুধু মুহূর্তের জন্য চারদিকের সংসারটি সেই স্নেহপুত্রকে ঘিরে তার কাছে আবার পরিস্ফুট ও সত্য হয়ে উঠেছিল। খোকা ঠিকই তার কাকীমাকে চিনতে পেরেছিল, কাদম্বিনী এই মায়ার সংসারে টিকে থাকার আকাক্সক্ষায় ‘ব্যাকুলভাবে কহিল, “দিদি, তোমরা আমাকে দেখিয়া কেন ভয় পাইতেছ। এই দেখ, আমি তোমাদের সেই তেমনি আছি।” কিন্তু না, কেউই তার কথা বিশ্বাস করল না। তখন কাদম্বিনী আর সহিতে পারিল না’; তীব্র কণ্ঠে বলিয়া উছিল, “ওগো আমি মরি নাইগো, মরি নাই। আমি কেমন করিয়া তোমাদের বুঝাইব, আমি মরি নাই। এই দেখো, আমি বাঁচিয়া আছি।” বলিয়া কাঁসার বাটিটা ভূমি হইতে তুলিয়া কপালে আঘাত করিতে লাগিল, কপাল ফাটিয়া রক্ত বাহির হইতে লাগিল। তখন বলিল, “এই দেখে আমি বাঁচিয়া আছি।”

শারদা শঙ্কর মূর্তির মতো দাঁড়াইয়া রহিলেন; খোকা ভয়ে বাবাকে ডাকিতে লাগিল: দুই মূর্ছিতা রমণী মাটিতে পড়িয়া রহিল।

তখন কাদম্বিনী “ওগো আমি মরি নাইগো, মরি নাইগো, মরি নাই” বলিয়া চিৎকার করিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া, সিরি বাহিয়া নামিয়া অন্তঃপুরের পুষ্করিণীর জলের মধ্যে গিয়া পড়িল। শারদাশঙ্কর উপরের ঘর হইতে শুনিতে পাইলেন ঝপাস করিয়া একটা শব্দ হইল।

সমস্ত রাত্রি বৃষ্টি পড়িতে লাগিল; তাহার পরদিনও বৃষ্টি পড়িতেছে, মধ্যাহ্নেও বৃষ্টির বিরাম নাই।  কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল, সে মরে নাই।’ সে মরে নাই। তা প্রমাণের জন্য কাদম্বিনীর মরণ ব্যতিত দ্বিতীয় কোনো উপায় ছিল না। গল্প পড়া শেষ হলে কাদম্বিনীর ট্রাজেডি কিছু সময়ের জন্য হলেও পাঠক মনে একটি বেদনার ঝড় তোলে।

মহামায়া

বাংলার কৌলিন্য ও সতীদাহ প্রথার উপর “মহামায়া” গল্পটি প্রতিষ্ঠিত। গল্পের মহামায়া কুলীনের ঘরের কুমারী। রাজীব লোকটি বিদেশে। তার স্নেহশীলা পিসি তাকে নিয়ে মহামায়ার বড় ভাই ভবানীচরণ চট্টোপাধ্যায়ের প্রতিবেশী রূপে বাস করতেন। মহামায়া এক কঠিন চিত্তের রমনী রাজীব মহামায়ার সাথে দু’ চারটি মনের কথা বলবার অবসর খুঁজে বেড়ায়। মহামায়া তাকে সে সুযোগ দেয় না- তার নিস্তব্ধ গভীর দৃষ্টি রাজীবের ব্যাকুল হৃদয়ে। একটা গভীর ভীতির সঞ্চার করে তোলে। এরপরেও রাজীব শতবার মাথার দিব্য দিয়ে একটি ভাঙা মন্দিরে আনতে কৃতকার্য হলো। “তাই মনে করিয়াছিল যত কিছু বলিবার আছে আজ সব বলিয়া লইবে, তাহার পর হয় আমরণ সুখনয় আজীবন মৃত্যু। জীবনের এমন একটা সঙ্কটের দিনে রাজীব কেবল কহিল, “চলো তবে বিবাহ করা যাউক।” এবং তারপরে বিস্মৃতপাঠ ছাত্রের মতো থতমত খাইয়া চুপ করিয়া রহিল।” রাজীব যে এরূপ প্রস্তাব করিবে মহামায়া যেন আশা করে নাই। অনেকক্ষণ তাই নীরব হইয়া রহিল।” এক পর্যায়ে মহামায়া মাথা নেড়ে উত্তর দিল, “না, সে হইতে পারে না।” মহামায়া রাজীবকে ছেড়ে যখন গমনোদ্যত, এমন মুহূর্তে ভবানীচরণের হঠাৎ আগমনে রাজীব মন্দির ছেড়ে পালাতে চেষ্টা করে, কিন্তু মহামায়ার সবলে তাকে আটকে ফেলে। ভবানীচরণ মন্দিরে প্রবেশ করে, নিস্তব্ধভাবে উভয়ের দিকে দৃষ্টিপাত করল।” মহামায়া রাজীবের দিকে চাহিয়া অবিচলিতভাবে কহিল, “রাজীব, তোমার ঘরেই আমি যাইব। আমার জন্য অপেক্ষা করিও।”

মহামায়াকে তার ওয়াদা পূরণে বেশি দেরি করতে হলো না। সে রাতেই গঙ্গাযাত্রীর ঘরে যে বৃদ্ধ ব্রাণ মৃত্যুর জন্য প্রতীক্ষা করছিল তার সাথে মহামায়ার হাত পা বেঁধে চিতায় সমর্পণ করে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হলো। এমন সময় প্রচণ্ড ঝড় ও মুষল ধারে বৃষ্টি শুরু হওয়ায় দাহকারীরা গঙ্গাযাত্রীর ঘরে আশ্রয় নিল। অপরদিকে মহামায়া অর্ধদগ্ধ অবস্থায় স্থানে স্থানে দগ্ধবস্ত্র  খণ্ড গায়ে জড়িয়ে নিজ শূন্য গৃহে ফিরে এল। প্রদীপ জ্বালিয়ে একখানা কাপড় পরে মুখের উপর দীর্ঘ ঘোমটা টেনে মহামায়া রাজীবের বাড়ি গেল। রাজীব উচ্ছ্বসিত স্বরে জিজ্ঞাসা করল, ‘মহামায়া’ তুমি চিতা হইতে উঠিয়া আসিয়াছ?”

মহামায়া কহিল, হ্যাঁ। আমি তোমার কাছে অঙ্গীকার করিয়াছিলাম, তোমার ঘরে আসিব। সেই অঙ্গীকার পালন করিতে আসিয়াছি। ... আর যদি প্রতিজ্ঞা কর, তখনো আমার ঘোমটা খুলিবে না, আমার মুখ দেখিবে না- তবে আমি তোমার ঘরে থাকিতে পারি।”

মহামায়া এখন রাজীবের ঘরে, কিন্তু রাজীবের জীবনে সুখ নেই। মহামায়ার ঘোমটা ছিল রাজীবের কাছে মৃত্যুর চেয়ে যন্ত্রণাদায়ক। এমন করে দু’জনে কতকাল একত্র যাপন করিল।

শুল্ক পক্ষের এক জ্যোৎস্না প্লাবিত রজনীতে রাজীব মহামায়ার শয়নমন্দিরে প্রবেশ করলো। মহামায়া তখন নিদ্রা মগ্ন।

“রাজীব কাছে গিয়া দাঁড়াইল- মুখ নত করিয়া দেখিল- মহামায়ার মুখের উপর জ্যোৎস্না পড়িয়াছে। কিন্তু, হায়,এ কী! সে চিরপরিচিত মুখ কোথায়। চিতানলশিখা তাহার নিষ্ঠুর লেলিহান রসনায় মহামায়ার বাম গণ্ড হইতে কিয়দংশ সৌন্দর্য একবারে লেহন করিয়া লইয়া আপনার ক্ষুধার চিহ্ন রাখিয়া গেছে।

বোধ করি রাজীব চমকিয়া উঠিল, বোধ করি একটি অব্যক্ত ধ্বনিও তাহার মুখ হইতে বাহির হইয়া থাকিবে। মহামায়া চমকিয়া জাগিয়া উঠিল; দেখিল সম্মুখে রাজীব। তৎক্ষণাৎ ঘোমটা টানিয়া শয্যা ছাড়িয়া একেবারে দাঁড়াইল। রাজীব বুঝিল এইবার বজ্র উদ্যত হইয়াছে। ভূমিতে পড়িল; পায়ে ধরিয়া কহিল, “আমাকে ক্ষমা কর।”

মহামায়া একটি উত্তর মাত্র না করিয়া, মুহূর্তের জন্য পশ্চাতে না ফিরিয়া, ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল। রাজীবের ঘরে আর সে প্রবেশ করিল না। কোথাও তাহার আর সন্ধান পাওয়া গেল না। সেই ক্ষমাহীন চিরবিদায়ের নীরব ক্রোধানল রাজীবের সমস্ত ইহজীবনে একটি সুদীর্ঘ দগ্ধচিহ্ন রাখিয়া দিয়া গেল।”

কবি এই ট্রাজেডির মাধ্যমে মহামায়ার অন্তর তলে কতটুকু জমানো আগুন ও উত্তাপ, প্রেম শক্তি ও হৃদয়াবেগ রয়েছে তা স্পষ্ট করেছেন।

উদ্ধার

দাম্পত্য জীবনের এক চিত্র লেখা উদ্ধার গল্পটি। স্ত্রীর সচ্চরিত্রতার সম্বন্ধে সন্ধিহান এক শ্রেণীর স্বামীগণের প্রতিনিধি চরিত্র গল্পের স্বামী পরেশ। উদ্দীপ্ত চরিত্রের গৌরীর প্রতি সন্দেহ গৌড়ির অতৃপ্ত দাম্পত্য রসকে ধীরে ধীরে ভক্তি রসের দিকে মোড় ফিরাল। একটি তরুণ সন্ন্যাসীকে ঘিরে গৌরী তার জীবনের সার্থকতা খুঁজতে লাগল। কিন্তু যখন তরুণ সন্ন্যাসীটি এই স্বামী উৎপীড়িতাকে বিশেষ এক রকম করুণার চোখে দেখতে শুরু করল। “সেই দিন মফস্বলে পরেশের একটি জরুরি মকদ্দমা ছিল। সন্ন্যাসীর এতদূর পতন হইয়াছিল যে, তিনি সেই সংবাদ লইয়া গৌরীর সহিত সাক্ষাতের জন্য প্রস্তুত হইয়াছিলেন। সদ্য বিধবা গৌরী যেমন বাতায়ন হইতে গুরুদেবকে চোরের মতো পুষ্করিণীর তটে  দেখিল, তৎক্ষণাৎ ব্রজচকিতের ন্যায় দৃষ্টি অবনত করিল। গুরু যে কোথা হইতে কোথায় নামিয়াছেন, তাহা যেমন বিদ্যুতালোকে সহসা এই মুহূর্তে তাহার হৃদয়ে উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল। গুরু ডাকিলেন, “গৌরী।”

গৌরী কহিলেন, “আসিতেছি গুরুদেব।”

তখন এই দৃপ্তা দুর্ভাগিনী গৌরী আত্মহত্যা করে সকল জ্বালা জুড়াল। ‘মৃত্যু সংবাদ পাইয়া পরেশের বন্ধুগণ যখন সৎকারের জন্য উপস্থিত হইল, দেখিল গৌরীর মৃতদেহ স্বামীর পার্শ্বে শয়ান। সে বিষ খাইয়া মরিয়াছে।

গল্পের ট্রাজেডি গৌরীর আত্মহত্যার মধ্যদিয়ে তার মাঝের প্রচ্ছন্ন বজ্রশক্তির পরিচয় পাওয়া গেছে ঠিক, তবে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়ে গৌরী যদি সন্ন্যাসীকে ভিন্নপথে শিক্ষা দিয়ে নিজের প্রতি পরেশের বিশ্বাস পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হতো তাহলে গৌরীর মতো বাংলার অনেক নারী স্বামীর সন্দেহ প্রবণতা থেকে নিজেদের রক্ষা করে জীবনের আনন্দ রস উপভোগ করতে পারতো।

দিদি

শিশু দাম্পত্য রসের মিশ্রণে এবং বিরোধিতায় সবচেয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে “দিদি” গল্পটি। জন্মকাল থেকে ছয় বছর পর্যন্ত শিশু নীলমনির চিত্র এ গল্পে আঁকা হয়েছে। শিশু এক্ষণে দিদির ভাইরূপে দেখা দিয়েছে। মধ্য বয়সী বহু সন্তানবতী শশীর প্রবাসী স্বামী জয়গোপাল বহু বছর পরে যখন প্রবাস থেকে ফিরে এল তখন পিতৃমাতৃহীন নীলমনি তার দিদির হৃদয় জয় করে নিয়ে, শ্বশুরের সম্পত্তির উত্তরাধিকারে প্রবল বাধারূপে এবং দাম্পত্য মিলনের পক্ষেও দূরতিক্রম্য অন্তরায় হয়ে দেখা দিয়েছে। শশি চরিত্রের মধ্যে স্বামী প্রেমের সঙ্গ ভাতৃস্নেহ ও অন্যায়কারী স্বামীর কবল থেকে ভাইয়ের সম্পত্তি রক্ষার চেষ্টা ও দ্বন্দ্ব  অতি কৌশলে অঙ্কিত হয়েছে। সেই কৌশলের অংশ হিসেবে ভাইকে বিদায় করতে “ঘোমটার মধ্য হইতে অবিরল অশ্রু মোচন করিতে করিতে শশী কহিল, “লক্ষ্মী ভাই, যা ভাই- আবার তোর দিদির সঙ্গে দেখা হইবে।”

আবার সেই বহুকালের চির পরিচিত পুরাতন ঘরে স্বামী-স্ত্রীর মিলন হইল। প্রজাপতির নির্বন্ধ।

কিন্তু, এ মিলন অধিক দিন স্থায়ী হইল না। কারণ, ইহার অনতিকাল পরই একদিন প্রাতঃকালে গ্রামবাসীগণ সংবাদ পাইল যে, রাত্রে শশী ওলাওঠা রোগে আক্রান্ত হইয়া মরিয়াছে এবং রাত্রেই তাহার দাহক্রিয়া সম্পন্ন হইয়া গেছে। ... বিদায়কালে শীশী ভাইকে কথা দিয়া গিয়াছিল, আবার দেখা হইবে। সেই কথা কোনখানে রক্ষা হইয়াছে জানি না।”

শশীর মৃত্যু না হলে নীলমনির সাথে পুনরায় তার দেখা হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু শশীর মৃত্যু ঘটিয়ে সেই সম্ভাবনাকে চিরতরে রুদ্ধ করে পাঠক মনে ট্রাজেডির রসকে স্থায়ী করে দেয়া হলো।

সম্পত্তি সমর্পণ

এ গল্পের প্রধান চরিত্র যজ্ঞনাথ কুণ্ডের মধ্যে বাংলা সাহিত্যের একটি শ্রেষ্ঠ কৃপণের চরিত্র অর্জন করেছে। পুত্র বৃন্দাবন কুণ্ড তার বাবার তুলনায় বেশ আধুনিক হওয়ায় এক সময় নবীনের সঙ্গে প্রাচীনের টক্কর লেগে গেল। এক পর্যায়ে বৃন্দাবন পুত্র গোকুলকে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গেল। গোকুল বাড়ি থেকে চলে যাওয়ায় যজ্ঞনাথের কিছু খরচ কমে গেল বটে, কিন্তু তার অভাবটাও বৃদ্ধের বুকে কাঁটার মতো বিঁধে রইল। শূন্য গৃহে গোকুল চন্দ্রের  উপদ্রব না থাকাতে গৃহে বাস করা যজ্ঞনাথের জন্য কঠিন হয়ে উঠল। কিন্তু গোকুল আর ফিরল না। যখন সে ফিরল তখন সে নিতাই পাল।

যজ্ঞের হাতে তার সমস্ত ধন দৌলত সমর্পণ করে গেলে এদিন গোকুল তা লাভ করবে মনে করে যজ্ঞনাথ মোহরের ঘড়াগুলি সমেত নিতাই পালকে জীবন্ত সমাধি দিয়ে আসল। কিন্তু যখন সে জানতে পারল এই নিতাই পালই তার প্রিয়তম দৌহিত্র তখন সে চেতনা হারাল।

“চেতনা লাভ করিয়া যজ্ঞনাথ বৃন্দাবনকে মন্দিরে টানিয়া লইয়া গেলেন। কহিলেন, “কান্না শুনতে পাইতেছ?” বৃন্দাবন কহিল, “না।”

“কান পাতিয়া শোন দেখি, “বাবা বলিয়া কেহ ডাকিতেছে?”

বৃন্দাবন কহিল,  “না।”

বৃদ্ধ তখন যেন ভারি নিশ্চিত হইল।

তাহার পর হইতে বৃদ্ধ সকলকে জিজ্ঞাসা করিয়া বেড়ায়, “কান্না শুনিতে পাইতেছ? পাগলামির কথা শুনিয়া সকলে হাসে।

অবশেষে বৎসর চারেক পরে বৃদ্ধের মৃত্যুর দিন উপস্থিত হইল। যখন চোখের ওপর হইতে জগতের আলো নিভিয়া আসিল এবং শ্বাস রুদ্ধপ্রায় হইল তখন বিকারের বেগে সহসা উঠিয়া বসিল; একবার দুই হস্ত চারদিকে হাতড়াইয়া মুমুর্ষু কহিল, নিতাই, আমার মইটা কে উঠিয়ে নিলে।”

সেই বায়ুহীন আলোকহীন মহাগহ্বর হইতে উঠিবার মই খুঁজিয়া না পাইয়া আবার সে ধূপ করিয়া বিছানায় পড়িয়া গেল। সংসারের লুকোচুরি খেলায় যেখানে কাহাকেও খুঁজিয়া পাওয়া যায় না সেইখানে অন্তর্হিত হইল।”

যজ্ঞনাথের চরিত্রে কৃপণতা ও স্নেহের দ্বন্দ্ব সমুজ্জ্বল হয়ে ফুটে উঠেছে। এই বিরুদ্ধতার মিশ্রণ পাঠকের কাছে মনোজ্ঞ হয়ে দেখা দিয়েছে। এবং তার সহানুভূতি আদায় করে নিয়েছে। ট্রাজেডির মধ্যদিয়েই গল্পের করুণ রসটি এমন সুন্দর ও নিবিড়ভাবে জমে উঠেছে।

সদর ও অন্দর

এ গল্পটিতে মানব চরিত্রের রহস্য ও মিথ্যা সন্দেহ নিয়ে লঘুভাবে কৌতুক করা হয়েছে। গল্পে বিপিন কিশোরের সুন্দর চেহারা ও গান গাইবার ও গান তৈরি করার ক্ষমতায় মুগ্ধ হয়ে রাজা তাকে সাদরে নিজের অনুচর শ্রেণীতে ভুক্ত করে নিয়েছিলেন।’ এই নিরাশ্রয়ী গুণী লোকটি রাজা চিত্তরঞ্জনের প্রিয়পাত্র হইয়া রাণী বসন্ত কুমারীর মনোবিকারেরই কারণ হইয়া উঠিয়া ছিল। তারপর যখন রাণী তার গুণ আবিষ্কার করিয়া তাহাকে লইয়া পড়িলেন, তখন রাজা ঈর্ষায় জ্বলিয়া উঠিলেন। “রাজা মধ্যাহ্নে জমিদারি কাজ দেখিতেন। একদিন সকাল-সকাল অন্তঃপুরে গিয়া দেখিলেন রাণী কী একটা পড়িতেছেন। রাজা জিজ্ঞাসা করিলেন, “ও কী পড়িতেছ?

রাণী প্রথমটা একটু অপ্রতিভ হইয়া কহিলেন, “বিপিন বাবুর একটা গানের খাতা আনাইয়া দুটো একটা গানের কথা মুখস্ত করিয়া লইতেছি; হঠাৎ তোমার শক মিটিয়া গিয়া আরতো গান শুনিবার জো নাই।” বহুপূর্বে শখটাকে সমূলে বিনাশ করিবার জন্য রাণী যে বহুবিধ চেষ্টা করিয়াছিলেন, সে কথা কেহ তাহাকে স্মরণ করাইয়া দিল না।

পরদিন বিপিনকে রাজা বিদায় করিয়া দিলেন; কাল হইতে কী করিয়া কোথায় তাঁহার অন্নমুষ্টি জুটিবে সে সম্বন্ধে কোনো বিবেচনা করিলেন না।

দুঃখ কেবল তাহাই নহে, ইতোমধ্যে বিপিন রাজার সহিত অকৃত্রিম অনুরাগে আবদ্ধ হইয়া পড়িয়া ছিলেন; বেতনের চেয়ে রাজার প্রণয়টা তাঁহার কাছে অনেক বেশি দামি হইয়া উঠিয়াছিল। কিন্তু, কী অপরাধে যে হঠাৎ রাজার হৃদ্যতা হারাইলেন, অনেক ভাবিয়াও বিপিন তাহার ঠিক করিতে পারিলেন না এবং দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া তাঁহার পুরাতন তম্বুরটিতে গেলাপ পরাইয়া বন্ধুহীন বিরাট সংসারে বাহির হইয়া পড়িলেন; যাইবার সময় রাজভৃত্য পুটোকে তাহার শেষ সম্বল দুইটা টাকা পুরস্কার দিয়া গেলেন। আর এভাবেই মিথ্যা সন্দেহে নিপতিত হয়ে এই গৃহহীন জীবটি দুই দিকের দুই পর্বত গাত্রে প্রতিহত হয়ে গুড়া হয়ে গেল। বিপিনকিশোরের জীবনের এ ট্রাজেডি বিচিত্রময় এ জগতের অনেক মানব মানবীর ট্রাজেডি জীবনের এক আলেখ্য মাত্র।

অন্যান্য মিডিয়া bdnews24 RTNN Sheersha News barta24 Prothom Alo Daily Nayadiganta Jugantor Samakal Amardesh Kaler Kantho Daily Ittefaq Daily Inqilab Daily Sangram Daily Janakantha Amader Shomoy Bangladesh Pratidin Bhorerkagoj Daily Dinkal Manob Zamin Destiny Sangbad Deshbangla Daily Star New Age New Nation Bangladesh Today Financial Express Independent News Today Shaptahik 2000 Computer Jagat Computer Barta Budhbar Bangladesherkhela Holiday Bangladesh Monitor BBC Bangla Pars Today
homeabout usdeveloped by

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ মো. তাসনীম আলম।

এটিএম সিরাজুল হক কর্তৃক হক প্রিন্টার্স ১০/৮ আরামবাগ, ঢাকা-১০০০ হতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। যোগাযোগের ঠিকানাঃ ৪২৩ এলিফেন্ট রোড, বড় মগবাজার, ঢাকা - ১২১৭।

ফোন: ৮৮ ০২ ৪৮৩১৯০৬৫, ই-মেইল: sonarbanglaweekly@gmail.com, weeklysonarbangla@yahoo.com, সার্কুলেশন: ০১৫৫২৩৯৮১৯০, বিজ্ঞাপন: ৪৮৩১৫৫৭১, ০১৯১৬৮৬৯১৬৮, ০১৭৩৪০৩৬৮৪৬।