সংবাদ শিরোনামঃ

অবশেষে সরকার ও আ’লীগের পরাজয় ** তত্ত্বাবধায়কের দাবি মানুন নয় তো বিদায় নিন ** আওয়ামী লীগাররা বিস্মিত হতবাক! ধস আর ঠেকানো যাচ্ছে না! ** উন্নয়নের রাজনীতি উপহার দিন না হলে তীব্র গণআন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতা থেকে বিদায় করে দেয়া হবে ** আ’লীগের ফ্যাসিবাদী চেহারা ** প্রধানমন্ত্রীর ব্যঙ্গ-তামাশা বনাম খালেদা জিয়ার আলটিমেটাম ** সংবাদপত্রের পাতা থেকে ** ঢাকার মহাসমাবেশে আসতে পথে পথে বাধা ** ৪২টি ট্রেন চলাচলের জংশন স্টেশন পার্বতীপুরে যাত্রী ভোগান্তির শেষ নেই **

ঢাকা শুক্রবার ২ চৈত্র ১৪১৮, ২২ রবিউস সানি ১৪৩৩, ১৬ মার্চ ২০১২

শেখ আবুল কাসেম মিঠুন

[পর্ব-২]

সেই সময়ে সেই বাংলা ভূখণ্ডে হিন্দু ও খ্রিস্টানদের মিলিত শোষণ ও শাসনে এবং ষড়যন্ত্রের ভয়াল রূপ প্রত্যক্ষ করেছিলেন মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ। যতই ষড়যন্ত্র, যতই নির্যাতন শোষণ চলেছে মাওলানা আকরম খাঁর মুসলিম দরদি মন ততই মুসলমানদের উপর নিগূঢ় প্রেম-ভালোবাসায় আরো ফুলে-ফেঁপে মহাসাগরের মতো হয়েছে। ঈমান বেড়েছে, দৃঢ়তর হয়েছে কল্যাণকামী ইচ্ছাশক্তি।

বিংশ শতাব্দির প্রথমেই যে অবস্থায় মুসলমানদের পাওয়া গেল তাহলো অত্যাচারে অত্যাচারে নিকৃষ্ট রোগাক্রান্ত প্রাণীর মত। হিন্দু ও ইংরেজ খ্রিস্টানদের হিংস্রতায় ক্ষত-বিক্ষত জীবন। মুসলমানরা তখন খ্রিস্টানদের তৈরি করা হিন্দু জমিদারদের ভোগ-বিলাসের অর্থের যোগান দিতে জমিতে খেটে খাওয়া কঙ্কালসার মজুর। খ্রিস্টানরা যথার্থ মূল্যের চেয়ে কমদামে কিংবা বিনামূল্যেই ভারত থেকে বিভিন্ন কৃষিপণ্য ও কৃষিজাত পণ্য ইংল্যান্ড ও ইউরোপের অন্যান্য দেশে রফতানি করতো। জমিদার ও জোতদাররা খেটে খাওয়া মুসলমান মজুরদের রক্ত শুষে তাদের অর্থ উসুল করতো। “এই শোষণের তীব্রতা ১৯০০ সালেই বৃদ্ধি পেয়েছিল।”

মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষায় মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁর ঈমানী চেতনা, নিষ্ঠা, সততা ও সাহসীকতার উৎস নির্ণয়ে মুসলমানদের উপর অবিচার ও বঞ্চনার আরো কিছু তথ্য আমাদের সামনে রাখা প্রয়োজন। মুসলিম শাসকরা তাদের শাসনকার্যের সময় সৈন্যবাহিনী পাঠিয়ে এলাকার পর এলাকা, গ্রামের পর গ্রাম, বিস্তির্ণ ভূমি যা ছিল দুর্গম এবং বন-জঙ্গলে পূর্ণ, সে সব এলাকা মনুষ্য বসতির জন্য আবাদ করেছিল। এলাকা ও গ্রামগুলির নাম যুদ্ধে জেতা বিশিষ্ট সৈনিক ও দেশপ্রেমিক কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তির নামে নামকরণ করেছিল। হিন্দু ও খ্রিস্টানরা মুসলমানদের কাছ থেকে সেই সব জমি ও সম্পদ কেড়ে নিয়েছিল ১৭৯৩ সালে “চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের” নামে। তারপর থেকে ধারাবাহিকভাবে সেই আবাদী এলাকার নাম, যা ছিল মুসলিম ব্যক্তিদের নামে তা উঠিয়ে দিয়ে, মুছে ফেলে, হিন্দুরা খ্রিস্টানদের যোগসাজশে হিন্দু ও খ্রিস্টান উভয় নামেই এলাকা, প্রতিষ্ঠান, রাস্তা, নদী ও গ্রাম-শহরের নামকরণ করতে থাকে। পাকিস্তান নামের ক্ষমতা পেয়েও যা মুসলমানরা পরিবর্তন করেনি।

“মুসলমানরা ছিল বহুমুখী নির্যাতন, শোষণ ও বঞ্চনার শিকার। সে সময়ে বেশির ভাগ কারখানা ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের কার্যদিনের পরিসর ছিল ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা।” এই বিপুল শ্রমদান করেও মুসলমানরা দু-বেলা দুইমুঠো খেতে পারতো না। দুর্ভিক্ষ লেগেই ছিল। দুর্ভিক্ষের সময় কলেরা ও প্লেগ মহামারী রূপে দেখা দিত। “১৮৯৬-১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ভারতে ৬০ লক্ষ মানুষ প্লেগে প্রাণ হারিয়েছিল।”

পরিবেশ, পরিস্থিতি মানুষের মননশীলতা, নৈতিকতা এবং গঠনশীল চিন্তাধারা তৈরিতে প্রবল ভূমিকা রাখে। মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ ব্যর্থ, পরাজিত, অপমানিত এবং অশিক্ষিত এক জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি। তিনি জানতেন এই জনগোষ্ঠী শত শত বছর ধরে পৃথিবী শাসন করেছে। পৃথিবীর মানুষের মধ্যে সমস্ত সদগুণ এদের মাধ্যমেই আল্লাহতাআলা পৃথিবীময় ছড়িয়ে দিয়েছেন। আর একমাত্র এদেরকেই স্বরূপে গতিময় করতে পারলেই পৃথিবী শান্তিময় হতে পারে।

তিনি প্রথমেই দৃষ্টি দেন তার চার úাশের মুসলিম জনগোষ্ঠীর দিকে। যুগ যুগ ধরে অত্যাচার, নিষ্পেষণ আর বঞ্চনায় ভয়ার্ত মুসলমানদের দৃষ্টিভঙ্গি সংকীর্ণ হয়ে গেছে। চিন্তাধারা হয়ে গেছে আত্মকেন্দ্রিক। মুসলিম সমাজ সর্বজনীন বোধশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। তারা যেন “সিজোফ্রেনিয়া” রোগী। বির্যবত্তা, সাহস, সদিচ্ছা কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। আর এই সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছে হিন্দু এবং খ্রিস্টানরা। তারা মুসলমানদের মধ্যে কাদিয়ানী ফিরকা ঢুকিয়ে দিয়েছে। তারা হাজার হাজার মুসলমানকে হিন্দু এবং খ্রিস্টান বানাচ্ছে জোর করে। এরই মধ্যে সুকৌশলে ঢুকিয়ে দিয়েছে “মাযহাব” ফিরকা। না খেতে পাওয়া সংকীর্ণ চিন্তার দরিদ্র, বুভুক্ষ, অশিক্ষিত মুসলমানরা সেই ‘মাযহাব’ ফিরকার দ্বন্দ্ব সংঘাতে লিপ্ত। কোথায় হারিয়ে গেছে তাদের ক্ষমতা, বল-বীর্য, কোথায় পালিয়েছে স্বাধীনতা- সেদিকে কারো দৃষ্টি নেই, ছিল না।

মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁর মুসলিম দরদি মন কেঁদে ওঠে বারবার। আগে ঘরের আগুন নেভাতে হবে। এই দ্বন্দ্ব-সংঘাত যেভাবে হোক মিটিয়ে ফেলতে হবে, নইলে ধ্বংসপ্রাপ্ত মুসলমানদের “ছাই”-এর মত পড়ে থাকা বাকি অস্তিত্বটুকুও অত্যাচারের প্লাবনে ধুয়ে মুছে যাবে। তিনি মাদরাসায় কোরআন-হাদিস পড়েই পাশ করেছেন, তিনি আবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে গভীর মনোনিবেশ সহকারে অর্থ বুঝে বুঝে পড়তে শুরু করলেন। “না” শরীয়তের মূল বিষয়বস্তু নিয়ে কোথাও গুরুতর কোনো মতভেদ নেই।

মুসলমানদের স্বার্থরক্ষার জন্য নতুন করে কোরআন হাদিস নিয়ে গবেষণা করাটা তার ছিল চিন্তা-চেতনা, নিষ্ঠা, সততা ও আদর্শ জীবন সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য জ্ঞান ও সাহস, নীতি ও নৈতিকতা, ইচ্ছা ও ইচ্ছা পূরণের নির্দিষ্ট পথ আবিষ্কারের তৃতীয় উৎস।

এই সময়ে অন্যান্য পত্র-পত্রিকার পাশাপাশি কলকাতা থেকে “বঙ্গবাসী” ও “হিতবাদী” নামে দুটি বহুল জনপ্রিয় পত্রিকা প্রকাশ হতো। এই পত্রিকাগুলোতে প্রায়শ মুসলিম সমাজ ও ইসলাম ধর্মকে হেয় প্রতিপন্ন করে প্রবন্ধাবলী প্রকাশিত হতো। শুধু বাংলায় নয়, সমগ্র ভারতে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের প্রধান অন্তরায় ছিল কংগ্রেসের উগ্রপন্থিদের মুসলিম বিদ্বেষ। এদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন মুম্বাইয়ের বালগঙ্গাধর তিলক। [১৮৫৬-১৯২০।] এই বালগঙ্গাধর তিলক ছিলেন একজন বিপ্লবী কমিউনিস্ট এবং ‘কেশরী’ ও ‘মারাঠা’ নামে দুটি সংবাদপত্র প্রকাশ করতেন। এইসব পত্রিকায়ও মুসলমান ও ইসলামের বিরুদ্ধে প্রবন্ধ লেখা হতো। “মুসলমানদের অপমান করার জন্য তিলক ইচ্ছাকৃতভাবে গণপতি উৎসবের সূচনা করেন। মহররমের অনুষ্ঠান অনুকরণ করে তিলক হিন্দু সম্প্রদায়কে সংগঠিত করতে সচেষ্ট হন।” ‘তিলকের মুসলিম বিদ্বেষী পত্রিকা এত জনপ্রিয় হয় যে ১৯০০ সালের দিকে কলকাতায় তিলকের বামপন্থি ও ইসলাম বিরোধী সংগঠনের অনুরূপ সংগঠন গড়ে ওঠে। এমনকি ১৯০৬ সালে কলকাতায় জাতীয় কংগ্রেসের এক অধিবেশনে চরমপন্থিদের প্রার্থী হিসেবে কংগ্রেসের সভাপতির জন্য তিলকের নাম প্রস্তাবিত হয়।”

পত্র-পত্রিকার প্রভাব সম্পর্কে মাওলানা আকরম খাঁ নিশ্চিত ছিলেন। আর হিন্দুদের পত্রিকায় মুসলমানদের বিরুদ্ধে, ইসলামকে হেয় প্রতিপন্ন করে প্রবন্ধাবলী প্রকাশিত হতো যাতে হিন্দুরা ইসলাম ও মুসলমানকে আরো ঘৃণা করতো এবং মুসলমানদের অনেকেই, যাদের ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞান কম ও ঈমান দুর্বল তারাও বিভক্ত হতো।

“এগুলো পাঠ করে মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ নিজ ধর্ম ও সমাজের নিন্দায় খুবই ক্ষুণœ হন এবং এর ফলে স্বীয় সমাজের মুখপাত্র হিসেবে পত্রিকা প্রকাশের ভাবনা ক্রমশ: তার মনে দৃঢ় হয়ে ওঠে।” এই সময়ে বাংলা ভাষায় মুসলমানদের তেমন কোনো পত্রিকা ছিল না। তবে উর্দু ও ইংরেজীতে নরমপন্থি ধরণের হলেও মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ‘আল হিলাল’, মুহম্মদ আলী ‘কমরেড’, এবং জাফর আলী ‘জমিদার’ প্রকাশ করে ঔপনিবেশিক সরকারের সমালোচনা করতেন।

পত্রিকার মাধ্যমে মাওলানা আবুল কালাম আজাদ মুসলমানদের মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁও তার কর্তব্য, কর্ম, করণীয় নির্ধারণ করে ফেললেন। প্রথমে ঘুমন্ত মুসলমানদের জাগ্রত করতে হবে। তাদের সুপ্ত, লুপ্ত চেতনায় আঘাত করে করে নিজেদের চেনার উপযোগী করে তুলতে হবে। ১৯০০ সালে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সমাপ্ত করেই তিনি তার সারা জীবনের কর্মসূচি, পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়নের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে এগিয়ে গেলেন। এ জন্যে অর্থের প্রয়োজন। নেপথ্য সহযোগিতা প্রয়োজন। “ মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ পত্রিকা প্রকাশের মতো আর্থিক সঙ্গতি না থাকায় অর্থ সংগ্রহের লক্ষ্যে গ্রামের বাড়ি গমন করেন। সেখানে তিনি খালার কাছ থেকে মাত্র ১ টাকা সংগ্রহ করতে সক্ষম হন। এ সামান্য অর্থ সম্বল করে তিনি কলকাতায় ফিরে এসে পত্রিকা প্রকাশের উপায় খুঁজতে থাকেন।” আসলে কোনো সর্বজনীন আদর্শিক চিন্তা-চেতনা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন একমাত্র ঈমানী শক্তি, ইচ্ছাশক্তি, জ্ঞান-বুদ্ধি, শ্রম দেবার একান্ত ইচ্ছা, সততা, নিষ্ঠা ও সেই বিশেষ কাজটার প্রতি অসীম ভালোবাসা। মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ চাকরি নিলেন। “আহলে হাদিস” শীর্ষক একটি সাপ্তাহিকীর মাধ্যমে তিনি প্রথম সাংবাদিক জীবনে প্রবেশ করেন। এরপর “মুহাম্মাদি আখবার” পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন। কিন্তু এ চাকরিতে বৃহত্তর কল্যাণ সাধন যেমন সম্ভব নয় তেমনি নিজের লক্ষ্যে পৌছানোও সম্ভব নয়। নিজের মালিকানায় পত্রিকা প্রকাশ করা দরকার, যেখানে তিনি এমন কিছু তুলে ধরবেন যাতে অলস মুসলমান সচল হয়ে ওঠে। ঘুম ভেঙ্গে জাগ্রত হয়, শিক্ষা-দীক্ষায় জ্ঞানে-গুণে মুসলমানরা যেন পূর্বের সোনালি যুগের সেই শ্রেষ্ঠ মানুষের পর্যায়ে উন্নীত হয়, মানব উন্নয়ন সাধিত হয়- এই ছিল মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁর বাস্তব চিন্তা এবং স্বপ্ন।   [চলবে]

অন্যান্য মিডিয়া bdnews24 RTNN Sheersha News barta24 Prothom Alo Daily Nayadiganta Jugantor Samakal Amardesh Kaler Kantho Daily Ittefaq Daily Inqilab Daily Sangram Daily Janakantha Amader Shomoy Bangladesh Pratidin Bhorerkagoj Daily Dinkal Manob Zamin Destiny Sangbad Deshbangla Daily Star New Age New Nation Bangladesh Today Financial Express Independent News Today Shaptahik 2000 Computer Jagat Computer Barta Budhbar Bangladesherkhela Holiday Bangladesh Monitor BBC Bangla Pars Today
homeabout usdeveloped by

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ মো. তাসনীম আলম।

এটিএম সিরাজুল হক কর্তৃক হক প্রিন্টার্স ১০/৮ আরামবাগ, ঢাকা-১০০০ হতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। যোগাযোগের ঠিকানাঃ ৪২৩ এলিফেন্ট রোড, বড় মগবাজার, ঢাকা - ১২১৭।

ফোন: ৮৮ ০২ ৪৮৩১৯০৬৫, ই-মেইল: sonarbanglaweekly@gmail.com, weeklysonarbangla@yahoo.com, সার্কুলেশন: ০১৫৫২৩৯৮১৯০, বিজ্ঞাপন: ৪৮৩১৫৫৭১, ০১৯১৬৮৬৯১৬৮, ০১৭৩৪০৩৬৮৪৬।