সংবাদ শিরোনামঃ

সাঁড়াশি অভিযানের আড়ালে প্রতিপক্ষ দলন ** ঈদের পরে মাঠে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে ২০ দল ** বাজেট বৈষম্যমূলক-অসহনীয়, ব্যবসাবান্ধব নয় ** সিয়ামের প্রকৃত শিক্ষাকে ধারণ ও বাস্তব জীবনে প্রতিফলন ঘটাতে হবে : নূরুল ইসলাম বুলবুল ** বিরোধী রাজনীতিকদের চাপে রাখার কৌশল ** নিরপরাধ নেতাকর্মীদের জীবন নিয়ে নির্মম তামাশা মেনে নেয়া যায় না : ছাত্রশিবির ** দ্বন্দ্ব ছড়িয়ে পড়েছে গ্রাম-গঞ্জে ** নেপথ্য খলনায়কদের আড়াল করতেই ক্রসফায়ার! ** সমাজে বিভক্তির কারণেই মৃত্যুর পরেও সম্মান পাননি মনিরুজ্জামান মিঞা : ড. এমাজউদ্দিন ** ‘অভিযান ছিল লোক দেখানো, বাণিজ্য হয়েছে পুলিশের’ ** ক্রসফায়ার : একটি ধারাবাহিক গল্প ** ক্রসফায়ার নয়, আদালতের মাধ্যমেই দোষীদের শাস্তি দিতে হবে ** টাকার ‘সাগর’ এবং অর্থমন্ত্রী ** রোজার তাৎপর্য ** একটি পারিবারিক বৈঠকের কিছু কথা ** ঈদকে ঘিরে ব্যস্ত কুষ্টিয়ার বুটিকস কারিগররা ** ‘বিশেষ’ অভিযান শেষ হলেও বন্ধ হয়নি গণগ্রেফতার ** সারাদেশে বিভিন্ন সংগঠনের ইফতার মাহফিল **

ঢাকা, শুক্রবার, ১০ আষাঢ় ১৪২৩, ১৮ রমজান ১৪৩৭, ২৪ জুন২০১৬

॥ সৈয়দ খালিদ হোসেন॥
দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনের চেইন অব কমান্ড নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন বিশিষ্টজনেরা। অব্যাহত গুপ্তহত্যার সঙ্গে জড়িতদের বিচার ও এসব ঘটনার নেপথ্যের খলনায়কদের সনাক্তে সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে শুধু প্রশ্নই নয়, দেশজুড়ে বিতর্কও চরমে। অন্যদিকে কথিত জঙ্গি দমনের নামে দেশজুড়ে সাঁড়াশি অভিযানে ১৪ হাজারেরও বেশি নিরীহ মানুষ, রাজনৈতিক কর্মী গ্রেফতারের যৌক্তিকতা এবং এর সাফল্য নিয়েও সন্তোষজনক কোনো ব্যাখ্যা নেই বললেই চলে।

চলতি মাসে পুলিশ অফিসারের স্ত্রী হত্যার পরই বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের ঘুম ভাঙে। হাওয়ায় আলোচনা ভাসে পুলিশের মনোবল ভেঙেছে বা ভাঙবে! সৌদি আরব সফর শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসপি’র স্ত্রীসহ সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে তথ্য রয়েছে বলে মন্তব্য করার পর বিরোধীরা এ নিয়ে সরব হন। খোদ বিএনপির চেয়ারপারসন প্রশ্ন তোলেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে তথ্য থাকলে ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের কেন গ্রেফতার করা হচ্ছে না। সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ডগুলো নিয়ে যখন দেশজুড়ে তোলপাড় চলছিল ঠিক তখনই মাদারীপুরের কলেজ শিক্ষক রিপন চক্রবর্তী হত্যাচেষ্টায় জড়িত থাকার অভিযোগে স্থানীয়রা গোলাম ফাইজুল্লাহ ফাহিমকে হাতেনাতে ধরে পুলিশে দেয়। এ ঘটনার পর আতঙ্কিত দেশবাসী কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করলো। দেশবাসী আশ্বস্ত হলো এবার সরকার হয়তো ক্লু পাবে! কিন্তু এবারও সাধারণ মানুষের আশায় গুড়েবালি। ‘ক্রসফায়ারে’ গোলাম ফাইজুল্লাহ ফাহিম নিহত হওয়ার পর এবার সন্দেহে আরও তীব্র হয়। ইতঃপূর্বে বিভিন্ন সময় হত্যাকাণ্ড ঘটনার পর এর সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িতদের ক্রসফায়ারে দেওয়ার নজির থাকলেও এ নিয়ে দেশজুড়ে এতো সমালোচনা হয়নি। ঢাকায় প্রকাশ্যে যুবলীগ নেতা মিল্কি হত্যার পর এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার হওয়া অপর যুবলীগ নেতা ক্রসফায়ারে নিহত হন। ওই সময়ও অভিযোগ ওঠে এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত গডফাদারদের আড়াল করতেই তাকে হত্যা করা হয়েছিল। কিন্তু এবারের ঘটনা সম্পূর্ণ ভিন্ন। ধারাবাহিক গুপ্তহত্যায় কেউ গ্রেফতার হচ্ছিল না। সরকার এসব হত্যাকাণ্ডের জন্যে বিরোধী দল বিশেষ করে বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীকে দায়ী করছিল, অন্যদিকে বিএনপি-জামায়াত এসব ঘটনার জন্য সরকারকে দায়ী করে বক্তব্য দিচ্ছে। মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন, মন্দিরের পুরোহিত, খ্রিস্টানদের ধর্মগুরু, বিদেশী নাগরিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, লেখক, ব্লগারসহ রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী প্রকাশ্যে খুন করে পালিয়ে যাওয়ার পর পুলিশ এর কোনো রহস্য খুঁজে বের করতে পারছিল না। এমন অভিযোগ যখন সরকারের বিরুদ্ধে ঠিক তখনই জনতাই দায়িত্ব নিল অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের ধরতে সাহায্য করার। মাদারীপুরের কলেজ শিক্ষক রিপন চক্রবর্তী হত্যাচেষ্টায় জড়িত অভিযোগে স্থানীয়রা গোলাম ফাইজুল্লাহ ফাহিমকে হাতেনাতে ধরে ফেলে এবং পুলিশের হাতে তুলে দেয়। কিন্তু একটি ক্রসফায়ার দেশবাসীর স্বপ্ন ভেঙে দেয়। মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে পুনরায় নিঃশ্বাস তোলার আগেই ধারাবাহিক হতাকাণ্ডগুলোর ‘সূত্রের পতন’ হয়। গোলাম ফাইজুল্লাহ ফাহিম ‘কথিত ক্রসফায়ারে নিহত’ হওয়ার ঘটনার পর দেশজুড়ে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়। শুধু সরকারের বিরোধীরাই নন, সরকার সমর্থক বিশ্লেষক, বুদ্ধিজীবীরাও এর তীব্র সমালোচনা করে। আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলোও ফাহিম নিহতের বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে সংবাদ প্রকাশ করে।

এদিকে জঙ্গি দমনের নামে সারাদেশে যে গ্রেফতার ও আটক অভিযান চালানো হয়েছে তা নিয়ে সব (ক্ষমতাসীনরা ছাড়া) মহলেই বিতর্ক হয়েছে। পুলিশের পক্ষ থেকে শতাধিক জঙ্গি গ্রেফতারের দাবি করা হলেও এরা প্রকৃতপক্ষে জঙ্গি কিনা তাও নিশ্চিত হওয়ার সুযোগ কম। পুলিশ ঘোষণা দিয়ে গ্রেফতার অভিযান চালানোর ঘটনা নিয়ে শুধু রাজনৈতিক নেতারাই নন, সুশীল সমাজের লোকেরাই প্রশ্ন তুলেছেন। কেউ কেউ বলেছেন সরকারি দলের সন্ত্রাসীদের রক্ষা ও বিরোধী দল দমনের জন্যই ঘোষণা দিয়ে অভিযান চালানো হয়েছে। শুরুতেই বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয় সরকার অভিযানের নামে তাদের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার ও হয়রানি করছে। এ অভিযানকে অনেকে পুলিশের ঈদ (ঘুষ গ্রহণ) বোনাস হিসেবেও অভিহিত করেছেন। রাজনীতিকরা বলছেন, সরকার পরিস্থিতিকে ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করার জন্যই বিশেষ অভিযান চালিয়েছে।

পুলিশের গ্রেফতার অভিযান নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন বলেন, যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে তাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। অন্যদিকে সন্দেহভাজন হিসেবে যাদের আটক করা হচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ না পাওয়া গেলে পুলিশ তাদের ছেড়ে দেবে। সাদা পোশাকে গ্রেফতার বিষয়ে হাইকোর্টের দেওয়া রায় লঙ্ঘিত হচ্ছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গ্রেফতার বা আটকের বিষয়ে হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছে সেটা লঙ্ঘিত হচ্ছে এমন সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেলে তখন বলা যাবে। তিনি বলেন ৫৪ ধারায় গ্রেফতার নিষেধ করা হয়নি, এ বিষয়ে দিক-নির্দেশনা (সাদা পোশাকে গ্রেফতার করা যাবে না) দেওয়া হয়েছে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গত ১৮ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সভায় অংশ নিলে সাংবাদিকরা তার কাছে জানতে চান ‘গায়ে বুলেট প্রুফ জ্যাকেট, মাথায় হেলমেট থাকার পরও ফাহিম কীভাবে গুলিতে নিহত হলো? এমন প্রশ্নের সঠিক কোনো জবাব দিতে পারেননি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। মাদারীপুরে কলেজ শিক্ষক রিপন চক্রবর্তীকে কুপিয়ে হত্যা চেষ্টায় হাতেনাতে আটক গোলাম ফায়জুল্লাহ ফাহিমের ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হওয়ার ঘটনার বিষয়ে সঠিক কোনো তথ্য নেই বলেও দাবি করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। গায়ে বুলেট প্রুফ জ্যাকেট থাকার পরও কীভাবে ফাহিম গুলিবিদ্ধ হয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এমনও হতে পারে তার সঙ্গি সাথীরা তাকে গুলি করেছে, যাতে কারো নাম না বলতে পারে। ফাহিম নিহত হওয়ার বিষয়ে ব্যাখ্যা না দিলেও তিনি পুলিশের সাঁড়াশি অভিযানের সফলতার কথা উল্লেখ করেন।  আসাদুজ্জামান কামাল বলেন, সাঁড়াশি অভিযান সফল হয়েছে। কোর্টের বিভিন্ন মামলায় যেসব আসামির বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট ছিল, নির্বাচনের কারণে আমরা তাদের আটক করতে পারিনি। তাই আমরা স্পেশাল এ ড্রাইভটি দিয়ে আসামিদের গ্রেফতার করতে পেরেছি। যারা আমাদের সন্দেহভাজন ছিল তাদেরও গ্রেফতার করতে পেরেছি।

গত ১৮ জুন জাতীয় প্রেসক্লাবে ইফতার মাহফিলে অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাম্প্রতিক গুপ্তহত্যার প্রসঙ্গ তুলে বক্তৃতা করেন। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘গুপ্তহত্যা চলছে। আমি বলেছিলাম তথ্য আছে। মাদারীপুরে শিক্ষককে হত্যাচেষ্টা থেকে এখন প্রমাণ হয়েছে। সেখানে জনগণ হাতেনাতে ধরেছে। এ ঘটনার পর কারও সন্দেহ থাকার কথা নয়। এরপর এভাবেই মানুষ ধরবে।’ কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে ফাহিম নিহতের প্রসঙ্গ আসেনি।

এদিকে মাদারীপুরে শিক্ষক হত্যাচেষ্টায় গ্রেফতার ফয়জুল্লাহ ফাহিম রিমান্ডে থাকা অবস্থায় ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হওয়ার ঘটনার খবর বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশের পর পরই ফেসবুকে ঘটনাটি নিয়ে মন্তব্য করেছেন সাংবাদিক গোলাম মোর্তোজা। তিনি লিখেছেন, “রাজনৈতিক বক্তৃতায় যে কাউকে অভিযুক্ত করা যায়। নিজেরা ধরতে পারি না, জনগণ ধরে দেয়। তাদের ক্রসফায়ারে বা বন্দুকযুদ্ধে হত্যা করা হয়। এমন একটি হত্যাকাণ্ড  যে ঘটতে যাচ্ছে, অভিযানের ধরনে তা প্রত্যাশিতই ছিল।”

“তিনি আরো লিখেছেন- কারা জঙ্গি, কারা তৈরি করে, কারা পৃষ্ঠপোষক, কারা জঙ্গি-গুপ্তহত্যা টিকিয়ে রেখে সুবিধা পেতে চায়- সব প্রশ্নের উত্তর আছে এই একটি হত্যাকাণ্ডের মধ্যে।”

এ ঘটনায় সমালোচনা করতে ছাড়েননি চিত্র জগৎ এর লোকেরাও। মাদারীপুরে কলেজ শিক্ষক হত্যাচেষ্টায় হাতে নাতে আটক ফাহিম পুলিশ হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদকালে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হওয়ার খবর প্রকাশের পর তা নিয়ে তুমুল সমালোচনার ঝড় উঠেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে। ফাহিমের ‘রহস্যেঘেরা’ এই মৃত্যু নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন বিপুলসংখ্যক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারী। সমালোচনার ঝড় উঠেছে, তার হাত পেছন থেকে হ্যান্ডকাফে বাঁধা ছিল, তা নিয়েও। ফাহিমকে যখন ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠানো হয় ওই সময় তার বুকে গুলির চিহ্ন দেখা যায়। তার পরনে প্যান্ট ও একটি সাদা রংয়ের গেঞ্জি রয়েছে। হাত পেছন থেকে হ্যান্ডকাফে আটকানো।

একের পর এক হত্যাকাণ্ডের যখন সুরাহা করা যাচ্ছিল না, তখন ফাহিম গ্রেফতার হওয়ায় বেশকিছু তথ্য পাওয়া যাবে এমন আশা ছিল দেশবাসীর। “মাদারীপুরে কলেজ শিক্ষক হত্যাচেষ্টার আসামি ফাহিম রিমান্ডে থাকাকালীন ১৮ জুন শনিবার ভোররাতে ‘বন্ধুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন। মৃত্যুর পর তার হাতে হাতকড়া দেখা গেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। ফাহিমের মৃত্যু নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। ১৮ জুন সকালে নিজের ফেসবুকে ‘বন্দুক, তুমি যুদ্ধ বোঝো, তদন্ত বোঝো না?’ শিরোনামে লেখা ওই পোস্টে তিনি বলেছেন, ‘'যেখানে এই আক্রমণের হাত থেকে আস্তিক নাস্তিক, সংখ্যালঘু সংখ্যাগুরু, নারী পুরুষ, সিভিলিয়ান পুলিশ কেউই ছাড় পাচ্ছিলো না, যেখানে এটা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ছিল এবং আমরা কোনো বিশ্বাসযোগ্য তদন্তের আলামত দেখছিলাম না, সেখানে মাদারীপুরের মানুষ এক আসামি হাতে নাতে ধরে ফেলার পর আশা করছিলাম ভেতরের কলকাঠির সুলুক সন্ধান করা হবে। সেই স্থলে এই বন্দুকযুদ্ধের কি মানে?'’ বুধবারের (১৫ জুন) ওই হত্যাচেষ্টার ঘটনায় বৃহস্পতিবার (১৬ জুন) মামলা দায়েরের পর শুক্রবার (১৭ জুন) কলেজ ছাত্র ফাহিমকে দশ দিনের রিমান্ডে পাঠায় আদালত। সেদিন রাতে জেলার মিয়ারচর এলাকায় জঙ্গিবিরোধী অভিযানে পুলিশের গুলিতে নিহত হন ফাহিম।

সাংবাদিক ফজলুল বারী ফেসবুকে লিখেছেন, “আমাদের ভালো ইচ্ছাগুলোকে করে দেওয়া হচ্ছে প্রশ্নবিদ্ধ! মাদারীপুরে ধরা ফাহিম ছেলেটির রিপোর্টে পড়ছিলাম তাকে নিয়ে নানা জায়গায় অপারেশনে গিয়ে পুলিশ সুনির্দিষ্ট কোনও তথ্য পাচ্ছিল না! আদালতে বিচারককে সে চিৎকার করে বলে এই ঘটনার সঙ্গে সে জড়িত না। স্থানীয় এক নেতা তাকে ফাঁসিয়ে দিয়েছেন। সাধারণত কোনও জঙ্গি এভাবে কোর্টে বলে না। কিন্তু পুলিশ তাকে মেরে ফেললো ক্রসফায়ারে? স্থানীয় যে নেতার কথা ফাহিম বলেছিল, সে কি পুলিশের জন্য বিব্রতকর ছিল?”

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনু মুহাম্মাদ এ বিষয়ে ফেসবুকে লিখেছেন, “এই আশংকাটাই করছিলাম। শিক্ষক রিপন চক্রবর্তীর ওপর হামলাকারী ফাহিমকে রিমান্ডে নিয়ে বন্দুকযুদ্ধের নামে খুন করা হলো। এখন আর কোনো প্রমাণ নেই সুতরাং নানা কাহিনী চালিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে। কেউ ধরা না পড়লে যথারীতি অনেক গল্প শুনতাম, কিন্তু গোল বাঁধিয়েছে এলাকার মানুষ ফাহিমকে হাতে নাতে ধরে। পুরোটা না পারলেও ফাহিম কিছুটা সূত্র দিতে পারতো নিশ্চয়ই।

এদিকে ক্ষমতাসীন ১৪ দলের শরিক নুরুল আম্বিয়া ও নাজমুল হক প্রধানের নেতৃত্বাধীন জাসদ ১৮ জুন গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে দাবি করেছে, পুলিশ হেফাজতে থাকা অবস্থায় ‘বন্দুকযুদ্ধে’ গোলাম ফয়জুল্লাহ ফাহিম নিহতের ঘটনা ‘রহস্যজনক’।

মাদারীপুরের নাজিম উদ্দিন কলেজের প্রভাষক রিপন চক্রবর্তীর উপর হামলার অভিযোগে হাতেনাতে ধরা পড়া গোলাম ফাইজুল্লাহ ফাহিমকে রিমান্ডে থাকা অবস্থায় তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যা করার ঘটনা সম্পর্কে জামায়াতে ইসলামীও প্রশ্ন তুলেছে। দলটির ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমান ১৮ জুন গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলেন, “মাদারীপুরের নাজিম উদ্দিন কলেজের প্রভাষক রিপন চক্রবর্তীর উপর হামলার অভিযোগে হাতেনাতে ধরা পড়া গোলাম ফাইজুল্লাহ ফাহিমকে রিমান্ডে থাকা অবস্থায় তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যা করার উদ্দেশ্য কি?

গোলাম ফাইজুল্লাহ ফাহিমকে গ্রেফতার করার পর তাকে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। রিমান্ডে থাকা অবস্থায় তাকে তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যা করার ঘটনাটি রহস্যজনক বলে মনে করে দেশের জনগণ। তাকে গ্রেফতার করার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে তার নিকট থেকে তথ্য উদ্ধার করে তার সাথে থাকা অন্যদেরও গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা উচিত ছিল। আইন অনুযায়ী আদালত তাদের বিচার করে দোষী প্রমাণিত হলে উপযুক্ত শাস্তি বিধান করবেÑএটাই ছিল দেশবাসীর প্রত্যাশা।

কিন্তু আইনের পথ উপেক্ষা করে তথাকথিত বন্দুক যুদ্ধের নামে গোলাম ফাইজুল্লাহ ফাহিমকে হাত কড়া পরা অবস্থায় হত্যা করার ঘটনায় জনগণের মনে প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছে যে, প্রকৃত ঘটনা জনগণকে জানতে না দিয়ে ধামাচাপা দেয়ার উদ্দেশ্যেই কি গোলাম ফাইজুল্লাহ ফাহিমকে তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যা করা হলো? সে বেঁচে থাকলে থলের বিড়াল বেরিয়ে পড়ার আশংকায়ই কি তাকে গুলি করে হত্যা করা হলো? এ সম্পর্কে সঠিক তথ্য দেশবাসী জানতে চায়। অভিজ্ঞ মহল মনে করে, গোলাম ফাইজুল্লাহ ফাহিমকে রহস্যজনকভাবে হত্যা করার ফলে প্রকৃত ঘটনা ধামাচাপা পড়ে গেল এবং ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পিতভাবে বিচারের পথ বন্ধ করে দেয়া হলো। ফাহিমকে তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে হাতকড়া পড়া অবস্থায় গুলি করে হত্যা করার ঘটনাটি তদন্ত করে প্রকৃত রহস্য দেশবাসীকে জানানোর আহ্বান জানায় জামায়াত।

জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদের আসল ঘটনা আড়াল করতেই মাদারীপুরের কলেজ শিক্ষক রিপন চক্রবর্তী হত্যাচেষ্টা মামলায় রিমান্ডে থাকা গোলাম ফাইজুল্লাহ ফাহিমকে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে বিএনপি। ১৮ জুন বিএনপি এক সংবাদ সম্মেলনে এ অভিযোগ করে। দলের পক্ষে সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘ওখানে উচিৎ ছিল আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আরো কারা জড়িত সেটা উদঘাটন করা। তাকে আইনি প্রক্রিয়ায় নেওয়া যেত। তার কাছ থেকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী নেয়া যেত। যাচাই-বাছাই করে জানা যেতে এরা প্রকৃত জঙ্গি কী না, জানা যেতো আর কারা কারা জড়িত। এটা জনসন্মুখে উদ্ভাসিত হতো তাদের নামগুলো জানা যেত।’ তিনি বলেন, ‘সরকার তাকে (ফাহিম) ক্রসফায়ারে হত্যা করল, হত্যা করা মানে প্রকৃত ঘটনা আড়াল করা। এটাকে সামনে আসতে দিল না। আমরা আগেই বলেছি প্রতিটি সন্ত্রাসের সঙ্গে রাষ্ট্রের একটা সম্পর্ক আছে। আমাদের দলের চেয়ারপারসন বলেছেন উগ্রবাদী চক্রের সঙ্গে সরকার জড়িত। এ ঘটনাটিতে যে ঘনকুয়াশা তৈরি করেছে সরকার। এর সঙ্গে সরকার জড়িত।’ সম্প্রতি সাঁড়াশি অভিযান সম্পর্কে রিজভী বলেন, ‘জঙ্গি দমনের নামে প্রহসনের এক চরম নাটক অনুষ্ঠিত করছে সরকারি দায়িত্বশীল লোকেরা। মামলা হচ্ছে, তদন্ত হচ্ছে, কিন্তু কুপিয়ে হত্যাকারী প্রকৃত অপরাধীরা অধরাই থেকে যাচ্ছে।

“ফাহিমের ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মৃত্যু নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে” এই শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক একটি প্রভাবশালী সংবাদ মাধ্যম। এতে বলা হয়, মাদারীপুরে একজন কলেজ শিক্ষকের উপর হামলার ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া অভিযুক্ত জঙ্গি ফায়জুল্লাহ ফাহিমের, পুলিশ রিমান্ডে থাকা অবস্থায় কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হওয়ার ঘটনায় তীব্র বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে দেশজুড়ে। গত কয়েক মাস ধরে চালানো একের পর এক হত্যাকাণ্ডের মতো একই কায়দায় শিক্ষককে হত্যার চেষ্টা চালানোর সময় গোলাম ফায়জুল্লাহ ফাহিমকে হাতেনাতে ধরে ফেলেছিল প্রত্যক্ষদর্শীরা। মনে করা হচ্ছিল, তার কাছ থেকে ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ড ও জঙ্গিবাদ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাবে। কিন্তু জিজ্ঞাসাবাদ শুরুর চব্বিশ ঘণ্টার মাথায় সে কথিত ক্রসফায়ারে নিহত হবার পর এ নিয়ে বাংলাদেশে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ এই হত্যা বড় কোনো কিছুকে আড়াল করার চেষ্টা নয়তো?

২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার আগে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধের অঙ্গিকার করলেও ক্ষমতায় এসে দলটি সেই অঙ্গিকার রক্ষা করেনি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির (বিতর্কিত) নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগের ইশতেহার থেকে ‘বিচারবহির্ভূত হত্যা’র প্রসঙ্গটি বাদই পড়ে যায়। দলটির এই দুই মেয়াদে ‘ক্রসফায়ার’, ‘বন্দুকযুদ্ধ’ তো বন্ধ হয়ইনি, বরং এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ‘গুম-গুপ্তহত্যা’।

আইন ও সালিস কেন্দ্র আসকের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৩ সালে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় ৪৩ জন। কিন্তু এ বছর বিরোধী দলের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সারাদেশে সহিংসতা-সংঘর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে নিহত হয় আরও ১৭৯ জন।

আসকের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৪ সালে ১২৮ জন, ২০১৫ সালে ১৪৬ জন কথিত বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারে নিহত হয়। আর চলতি বছরের ১৯ জুন পর্যন্ত ৫৯ জন নিহত হয়। তাদের মধ্যে ১১ জন আইনগতভাবে গ্রেফতারের পর হেফাজতে থাকা অবস্থায় নিহত হয়। তবে ধর্মের নামে জঙ্গি তৎপরতায় সন্দেহভাজনদের ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হওয়ার ঘটনা শুরু হয় গত ২৪ নভেম্বর। ওই দিন রাতে ঢাকায় কথিত বন্দুকযুদ্ধে এক জেএমবি সদস্য, এরপর ১৩ জানুয়ারি আরও দুই জেএমবি সদস্য নিহত হয়।

রিমান্ডে থাকা আসামি ফাহিম বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার ঘটনা অত্যন্ত জঘন্যতম নিকৃষ্ট ঘটনার দৃষ্টান্ত বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান এডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন।

পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে পুলিশ হেফজতে মারা গেলে তার দায় সরকার এড়াতে পারে না বলে মন্তব্য করেছেন, সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি এডভোকেট জয়নুল আবেদীন। তিনি বলেন, এ সরকার কিছুই মানছে না। এটা অনভিপ্রেত।

এ বিষয়ে আইনবিদ ড. শাহ দীন মালিক বলেন, আমারতো মনে হয় দেশে কারো কোনো সন্দেহ নেই যে পুলিশ তাদের ইচ্ছাকৃতভাবে মেরে ফেলছে। তিনি বলেন, ২০০৪-০৫ সালে হয় তো কেউ কেউ বন্দুকযুদ্ধের কিচ্ছা বিশ্বাস করতেন, এখন কেউ এটা বিশ্বাস করেন না।

এ পাতার অন্যান্য খবর

অন্যান্য মিডিয়া bdnews24 RTNN Sheersha News barta24 Prothom Alo Daily Nayadiganta Jugantor Samakal Amardesh Kaler Kantho Daily Ittefaq Daily Inqilab Daily Sangram Daily Janakantha Amader Shomoy Bangladesh Pratidin Bhorerkagoj Daily Dinkal Manob Zamin Destiny Sangbad Deshbangla Daily Star New Age New Nation Bangladesh Today Financial Express Independent News Today Shaptahik 2000 Computer Jagat Computer Barta Budhbar Bangladesherkhela Holiday Bangladesh Monitor BBC Bangla Pars Today
homeabout usdeveloped by

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ মো. তাসনীম আলম।

এটিএম সিরাজুল হক কর্তৃক হক প্রিন্টার্স ১০/৮ আরামবাগ, ঢাকা-১০০০ হতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। যোগাযোগের ঠিকানাঃ ৪২৩ এলিফেন্ট রোড, বড় মগবাজার, ঢাকা - ১২১৭।

ফোন: ৮৮ ০২ ৪৮৩১৯০৬৫, ই-মেইল: sonarbanglaweekly@gmail.com, weeklysonarbangla@yahoo.com, সার্কুলেশন: ০১৫৫২৩৯৮১৯০, বিজ্ঞাপন: ৪৮৩১৫৫৭১, ০১৯১৬৮৬৯১৬৮, ০১৭৩৪০৩৬৮৪৬।