কুষ্টিয়ায় আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে শিশু-শ্রমিক

কুষ্টিয়ায় ইটভাটায় কর্মরত এক শিশু শ্রমিক

কুদরতে খোদা সবুজ, কুষ্টিয়া : কুষ্টিয়ায় আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা। দারিদ্র্য, অশিক্ষা, পারিবারিক বিচ্ছেদ, বড় পরিবার, বাবা অথবা মায়ের একাধিক বিবাহ, পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তির মৃত্যুসহ নানা প্রতিবন্ধকতার ফলে সৃষ্ট দূরাবস্থায় পতিত শিশুরাই মূলত হয়ে উঠছে শিশু শ্রমিক।

সূত্র জানায়, বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালের শিশু আইনে ১৬ বছর বয়স পর্যন্ত এবং ন্যাশনাল চিলড্রেন পলিসি ১৪ বছর পর্যন্ত মানুষকে শিশু হিসেবে চিহ্নিত করেছে। শিশু শ্রম নিরসনের জন্য ১৯৭৩ সালের জুনে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংস্থার (আইএলও) ৫৮তম অধিবেশনে ন্যূনতম বয়স সংক্রান্ত কনভেনশন ১৩৮ গৃহীত হয়। এ কনভেনশনে ন্যূনতম বয়স ১৫ বছর ঘোষণা করা হয়। কনভেনশন অনুযায়ী, যেসব কাজ শিশুর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ সেক্ষেত্রে শ্রম নিয়োগের বয়স কোনো অবস্থাতেই ১৮ বছরের কম হবে না। হালকা ধরনের কাজের ক্ষেত্রে ১৩ থেকে ১৫ বছরের ছেলেমেয়েদের নিয়োগ করা যাবে। তথ্যে সূত্রে জানা যায়, শিশু শ্রমিকরা প্রায় ৩৪৭ ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। এর মধ্যে ৪৭ ধরনের কাজকে ঝুঁকিপূর্ণ এবং ১৩ ধরনের কাজকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজের মধ্যে রয়েছে ব্যাটারিসহ বিভিন্ন বিষাক্ত রাসায়নিক কারখানায় শিশু শ্রম, ট্যানারি শিল্প, যৌনকর্ম, বিড়ি ও তামাক ফ্যাক্টরি, পরিবহন খাত, ময়লা আবর্জনা সংগ্রহ করা, গ্যাস ফ্যাক্টরি, লেদ মেশিন ও ওয়েল্ডিংয়ের কাজ, অটো মোবাইল কারখানা, লবণ কারখানা, রিকশা ও ভ্যান চালানো, কাঠ মিস্ত্রির কাজ, জুয়েলারি শিল্পে কারিগরের কাজ, চাল ও মসলার কারখানায় কাজ, ম্যানুফ্যাকচারিং কারখানার কাজ, মাদকদ্রব্য বিক্রি, অস্ত্রবহন ও চোরাচালানি ইত্যাদি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, পারিবারিক ও আর্থসামাজিক কারণে ৬ থেকে ৭ বছর বয়সেই বাংলাদেশে শিশুদের বড় একটি অংশ জীবনধারণের জন্য শ্রম বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। দারিদ্র্যের কষাঘাতে স্বাস্থ্য, পুষ্টি, বাসস্থান, শিক্ষা, বিনোদন ও নিরাপত্তা লাভের মৌলিক অধিকার থেকে এসব শিশু বঞ্চিত। রাত জেগে কাজ করা, অত্যাধিক কাজের চাপ, অবহেলা, পর্যাপ্ত আলো বাতাসের অভাব, প্রয়োজনীয় খাদ্য ও পানীয়জলের অভাব, আগুনের ব্যবহার, ময়লা, নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর কাজের পরিবেশ, ধারালো যন্ত্রপাতি ও রাসায়নিকদ্রব্য ব্যবহার, কম মজুরি, মালিকের দুর্ব্যবহার, পর্যাপ্ত চিকিৎসার অভাব এবং দীর্ঘসময় ধরে কাজ করার ফলে শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছে এসব শিশু। কেটে যাওয়া ক্ষত, আগুনে পোড়াসহ নানা ইনজুরি ও ইনফেকশন, চর্মরোগ, চোখের সমস্যা, শ্রবণ সমস্যা, শ্বাসকষ্ট, পেটের পীড়া ও মাথাব্যথাসহ নানা রকম জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা যায়, প্রতি ১০ জন শিশুর মধ্যে একজন শ্রমিক। এসব শিশু বিভিন্ন দোকান, হোটেল রেস্তোরাঁ, ওয়ার্কশপ, কারখানা, ভাঙারি দোকান, টেম্পো হেলপার ও বাসাবাড়িতে কাজ করছে। অনেকে রাস্তায় রাস্তায়, বিভিন্ন স্কুলে চকলেট, পত্রিকা বাদামসহ বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করছে। আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, সীমান্ত এলাকায় শিশুরা মাদক পাচার ও চোরাচালানির সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ছে। এরা জীবনের ঝুঁঁকি নিয়ে প্রতিদিন সীমান্ত পারাপার করছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো এ ক্ষেত্রে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না। এ প্রসঙ্গে শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. আতাহার আলী বলেন, অপরিচ্ছন্ন অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, বয়সের তুলনায় অনেক বেশি পরিশ্রম এবং প্রয়োজনীয় খাবারের অভাবে এসব শিশু দ্রুত নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে। কেউ কেউ মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। ফলে অনেকেই অকালে মারা যাচ্ছে অথবা দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতায় ভুগছে। প্রশাসনের উদাসিনতা, সরকারের পর্যাপ্ত মনিটরিংয়ের অভাব এবং সস্তা ও বিনা পারিশ্রমিকে শিশুশ্রমিক পাওয়ার কারণে দিনদিন শিশুশ্রমিকের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।