সংবাদ শিরোনামঃ

স্থানীয় সরকার ধ্বংসের নীলনকশা ** কেন মানুষ অথৈ সাগর পাড়ি দিচ্ছে, দায় কার? ** দেশকে রাজনীতিহীন করার ষড়যন্ত্র ** গণতন্ত্রহীনতা দেশকে সঙ্কটের দিকে নিয়ে যাবে ** আফগানিস্তানে শান্তির সম্ভাবনা ** গণতন্ত্র পুনঃরুদ্ধারে ভোটাধিকারের সুযোগ দিতে হবে : বিচারপতি আব্দুর রউফ ** নরেন্দ্র মোদির সফর : বাংলাদেশের প্রত্যাশা! ** গণতন্ত্র ছাড়া দেশের উন্নতি কখনই সম্ভব নয় ** নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন প্রয়োজন ** সোনা নয়, সোনালী ফাঁস ** নিখোঁজ আর গুম ** জগতসেরা পর্যটক ইবনে বতুতা ** বোরো ধানের বাম্পার ফলন হলেও কৃষকের মুখে হাসি নেই ** কুষ্টিয়ায় পারিবারিক কলহে নৃশংস হত্যাকাণ্ড বাড়ছে **

ঢাকা, শুক্রবার, ৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪২২, ৩ শাবান ১৪৩৬, ২২ মে ২০১৫

এমদাদুল হক চৌধুরী
১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত, ভারতবর্ষ থেকে দীর্ঘ প্রায় আট’শ বছর শাসন করার পর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ায় মুসলমানদের জীবনে এক কঠিন সঙ্কটময় সময় আবির্ভুত হয়। জাতীয় জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। জাতি তার গন্তব্যপথ নিরূপণ করতে না পেরে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে, নৈরাশ্যের শিকার হয়। ফলে ধীরে ধীরে ভয়াবহ নির্জীবতা তাকে গ্রাস করে। সে অন্যায় দেখে কিন্তু অন্যায়ের প্রতিকার করতে পারে না, সে তার বন্দীত্বকে অনুভব করে কিন্তু তা থেকে মুক্ত হওয়ার মতো শক্তি খুঁজে পায় না। বিশেষ করে সিপাহী বিদ্রোহের পর থেকে রাজরোষে দগ্ধ হতে থাকলো ভারতবর্ষের মুসলমানরা। নির্যাতনের চরম স্টিম রোলার চলল মুসলমানদের উপর। বঞ্চিত, অবহেলিত, উৎপীড়িত মুসলমানদের অক্ষম ক্ষোভ, রোষে বেদনায় জ্বলতে থাকলো, পুড়তে লাগলো। কিন্তু এই উৎপীড়ন ও অন্যায় আচরণ ও নিষ্ঠুর অবহেলাই বহন করে নিয়ে এলো নতুন উত্থানের বীজ।

ঠিক এমনি একটি সময়ে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাব। পরাধীনতার শিকল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসার, জাতির কামনা-বাসনা নজরুলের মধ্যে মূর্ত হয়ে ওঠে, একমাত্র তাঁরই কলমের রচনায় ঝলসে উঠে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে উপমহাদেশের সকল মানুষের চিত্তের উদ্দীপনাময় আশা-আকাক্সক্ষা। তিনি শুধু ভারতবর্ষেরই নয়, বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের মুক্তির কামনায় সঙ্গীত রচনা করেন। গেয়ে উঠেনÑ

‘যবে       উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে নাÑ

অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে নাÑ

বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত

আমি       সেই দিন হব শান্ত!’

ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন ও স্বাধীনতার জন্য সমগ্র ভারতবাসীকে এক প্লাটফর্মে আনতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। তাইতো তার কন্ঠে বেরিয়েছে :

“হিন্দু না ওরা মুসলিম?’ ওই জিজ্ঞাসে কোন জন? কাণ্ডারী! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র।”

ব্রিটিশরা যে এ দেশে বণিকের বেশে শাসন ও শোষণ করার জন্য এসেছে, নজরুল তা স্পষ্টতই বুঝতে পেরেছিলেন। তাই নজরুলও নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার মতো ব্রিটিশ বেনিয়াদেরকে দু’চক্ষে দেখতে পেতেন না। নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা তো নবাব পরিবারে জন্মগ্রহণ করার কারণেই ইংরেজদের কাছ থেকে দেখেছেন, দেখেছেন তাদের অন্যায় দৌরাত্ম, লোভ, শঠতা, নিষ্ঠুরতা, দেশ দখলের উদগ্র বাসনা। সিরাজের বিশ্বাস ছিল সামান্য কিছু ইংরেজ সৈন্যদের বিতাড়নে তাকে তেমন কোনো শক্তি প্রয়োগ করতে হবে না। একটু তাড়া দিলেই ইংরেজ বণিকরা তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ফেলে ভেড়ার পালের মতো প্রাণ নিয়ে পালাতে দিশা পাবে না। কিন্তু তাঁর অমাত্যবর্গ যে, সামান্য আর্থিক সুবিধার জন্য দেশের স্বাধীনতা বিকিয়ে দিতে তলে তলে ইংরেজদের সাথে হাত মিলিয়েছে, সিরাজ তা বুঝে উঠতে পারেনি।

নজরুল নবাব পরিবারে জন্মগ্রহণ না করেও বাল্যকালে ইতিহাস মারফত ইংরেজদের চরিত্র ও তার কূটকৌশল সম্পর্কে জ্ঞাত হতে পেরেছিলেন। আর তাতেই ইংরেজদের প্রতি তাঁর ক্রোধের জন্ম হয়েছে। সিরাজউদ্দৌলা তো নবাব পরিবারে জন্মগ্রহণ করার কারণে অল্প বয়সেই তার শানিত দৃষ্টিতে ইংরেজদের প্রকৃত রূপটি ধরা পড়ে। তদানীন্তন ভারতবর্ষে শুধু ব্যবসার উদ্দেশ্যে যে ইংরেজরা আসেনি, তারা শোষণ করতে এসেছেন প্রতিভাবান বালক সিরাজউদ্দৌলার  তা সহজেই বুঝতে পেরেছিলেন।

নজরুল বন্ধু শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় তাঁর “আমার বন্ধু নজরুল” গ্রন্থে লিখেছেন :

“সিরাজউদ্দৌলার মত বালক নজরুলের একটি ইংরেজ-বিদ্বেষী চরিত্র এঁকেছেন। আসলে কোনো কোনো মানুষের চোখে শত্রুর রূপ চিহ্নিত হতে পরিণত বয়সের অপেক্ষা করে না। এই চারিত্রিক মিলনের জন্যে হয়ত বা নজরুলের চোখে সিরাজউদ্দৌলা উপমহাদেশের প্রথম মুক্তিযোদ্ধার প্রতীক ছিলেন।”

নবাব সিরাজদ্দৌলার চেয়ে ভারতবর্ষের প্রথম স্বাধীনতাযুদ্ধে শহীদ সিরাজদ্দৌলা অনেক বড়। আর এ কারণেই নজরুল ইসলাম সিরাজদ্দৌলার আত্মদানকে ভুলতে পারেনি।

বস্তুত সিরাজের সাথে পলাশীর যুদ্ধ এ যুদ্ধে বাঙালির আত্মদান ও ভারতবাসীর পরাজয়ের ইতিহাসের পৃষ্ঠায় যে গভীর বেদনার রক্তাক্ত ছবি এঁকেছেন নজরুল, তাঁর ‘কাণ্ডারী হুশিয়ারে’ বলেছেন :

কাণ্ডারী! তব সম্মুখে ঐ পলাশীর প্রান্তর,

বাঙালীর খুনে লাল হল যেথা ক্লাইভের খঞ্জর!

ঐ গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায়, ভারতের দিবাকর।

উদিবে সে রবি আমাদেরি খুনে রাঙিয়া পুনর্বার।

পরধনলোভী পরদেশীদের কাছ থেকে ভারতবর্ষকে মুক্ত করার জন্য নজরুল লিখলেন : ‘এ দেশ ছাড়বি কিনা বল, নইলে কিলের চোটে হাড় করিব জল।’

নজরুল স্পষ্টতই বুঝতে পেরেছিলেন যে কোনোভাবেই হোক, সর্বপ্রথম এ দেশকে দানবমুক্ত করার প্রয়োজন। আর এই দানব মুক্ত করার জন্য সুসংগঠিত শক্তির প্রয়োজন। তাই নজরুল ভারতবর্ষের হিন্দু-মুসলমান যৌথ শক্তিকে এক প্লাটফরমে আনতে গেয়ে উঠলেন :

‘অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরণ,

কাণ্ডারী! আজ দেখিবে তোমার মাতৃমুক্তি-পণ!

‘হিন্দু না ওরা মুসলিম?’ ওই জিজ্ঞাসে কোন্ জন?

কাণ্ডারী! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র!

নজরুলই সর্বপ্রথম তাঁর কাব্যে পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতার কথা বলেছেন। নজরুলের পূর্বে কোনো কবি-সাহিত্যিকই নজরুলের মতো করে এমন দ্ব্যর্থহীন পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতার আকাক্সক্ষার কথা ব্যক্ত করেনি। এমনকি দু’একটি বিছিন্ন ঘটনা ছাড়া রাজনীতিকদের মধ্যেও এ দাবি প্রকটভাবে তুলেনি কেউ। নজরুল নবযুগের দায়িত্ব নেয়ার পর বিভিন্ন সম্পাদকীয়তে ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি করেন। নজরুল ‘ধূমকেতু’র ১৩শ সংখ্যায় ১৩ অক্টোবর, ১৯২২ সালে ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি উত্থাপন করে লিখেন :

“স্বরাজ টরাজ বুঝি না, কেননা, ও কথাটার মানে এক এক মহারথী এক এক করে থাকেন। ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশ বিদেশীদের অধীনে থাকবে না। ভারতবর্ষের সম্পূর্ণ দায়িত্ব, সম্পূর্ণ স্বাধীনতা রক্ষা, শাসনভার সমস্ত থাকবে ভারতের হাতে। তাতে কোন বিদেশীর মোড়লী অধিকারটুকু পর্যন্ত থাকবে না। যারা এখন রাজা বা শাসক হয়ে এদেশে মোড়লী করে এ দেশকে শ্মশানভূমিতে পরিণত করেছেন, তাদের পাততাড়ি গুটিয়ে, বোঁচকা-পুটলি বেঁধে সাগর পাড়ে পাড়ি দিতে হবে। প্রার্থনা বা আবেদন-নিবেদন করলে তারা শুনবে না। তাঁদের সবটুকু সুবুদ্ধি হয়নি এখনো। আমাদের এই প্রার্থনা করার, ভিক্ষা করার কুবুদ্ধিটুকু দূর করতে হবে।”

‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতায় নজরুল অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে ব্রিটিশ বেনিয়াদের তাড়ানোর জন্য নিদ্রিত ভারতবাসীকে জাগাতে চাইলেন। ন্যায়সঙ্গত অধিকার আদায়ে আপোষকামিতাকে নজরুল ঘৃণা করেছেন। নজরুল বলতে চেয়েছেন, এই ভারত আমাদের তেত্রিশ কোটি ভারতবাসীর। এ কারো করুণা নয়, যে কারো কাছে নতজানু হয়ে ভিক্ষা চাইতে হবে। ভারত আজ ভিনদেশী বণিকদের অবৈধ দখলে। যে কোনো মূল্যে এ অবৈধ ভিনদেশী বণিকদের তাড়িয়ে দেয়া ভারতবাসীর এক নম্বর কর্তব্য।

অপরদিকে, রবীন্দ্রনাথের খ্যাতি তখন ছিল বিশ্বজোড়া। সাহিত্যে বিশাল অবদানের জন্য তাঁকে বিশ্বের সর্বোচ্চ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। অথচ তাঁর সেই শাণিত কলম দেশমাতাকে মুক্তির জন্য কোনো কাজে লাগাননি। বরং তিনি নানাভাবে দখলদার ইংরেজদের প্রশংসা করে তাদের আনুকূল্য পেয়েছেন।

১৯১১ সালে সম্রাট পঞ্চম জর্জ ভারতে আসেন এবং বঙ্গভঙ্গ রদ করেন। দিল্লি দরবারে সম্রাট পঞ্চম জর্জের রাজ্যভিষেক অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ  ইংরেজদের তোষণ করে “ভারত ভাগ্য বিধাতা’ বলে স্তুতি করেছেন।

নজরুল বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষের প্রতি কটাক্ষ করে বলেছেন, ‘মহেশ্বর আজ সিন্ধুতীরে যোগাসনে মগ্ন ধ্যানে।’ বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষ কারামুক্ত হয়ে বিপ্লবী কার্যক্রম ত্যাগ করে পণ্ডিচেরীতে আশ্রম প্রতিষ্ঠা করে আধ্যাত্মিক জীবন-যাপন শুরু করেন।

মাইকেল মধুসূদন দত্ত তো রীতিমতো নিজ ধর্ম স্বেচ্ছায় ত্যাগ করে খ্রিস্টানধর্ম গ্রহণ করেন এবং পুরোপুরি ইংরেজ বনে গিয়েছিলেন। বাংলা ভাষাকে তিনি ‘বর্বর ইতরের ভাষা’ বলে মনে করতেন। কাজেই তাঁর পক্ষে ইংরেজদের বিরুদ্ধাচারণ করা কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না।

নজরুলের অবিরাম সত্য প্রকাশ ও ক্ষুরধার লেখনিতে অবৈধ আধিপত্যবাদী ব্রিটিশ সরকারের সিংহাসন কেঁপে উঠল। সরকারের রোষানলে পড়তে হলো। ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতার জন্য নজরুলের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরওয়ানা জারি করা হলো। বিচার হলো। বিচারে তাকে এক বছর কারাদণ্ড দেয়া হলো। কবিতা লিখে একজন কবির জেলে যাওয়ার ঘটনা সম্ভবত বিশ্বসাহিত্য অঙ্গনে এটিই প্রথম। কারাগারেও নজরুল থেমে থাকলেন না। কারাগারে অনিয়ম, জুলুম, নিষ্পেষণের বিরুদ্ধেও সোচ্চার হলেন। একটানা ঊনচল্লিশ দিন অনশনব্রত পালন করলেন। কারাগারে বসে নজরুল লিখলেন :

‘শিকল পরার ছল মোদের এ শিকল পরার ছল

এ শিকল পড়ে তোদের করবো রে বিকল’,

তোমরা ভয় দেখিয়ে করছ শাসন জয় দেখিয়ে নয়,

সেই ভয়ের টুঁটি ধরব টিপে করব তারে লয়।

মোরা আপনি মরে মরার দেশে আনব বরাভয়,

মোরা ফাঁসি পরে আনব হাসি, মৃত্যুজয়ের কল।

আরো গাইলেনÑ

তোদের বন্ধকারায় আসা মোদের বন্দী হতে নয়।

ওরে ক্ষয় করে আশা মোদের সবার বাঁধন-ভয়।

এই বাঁধন পরেই বাঁধন-ভয়কে করবো মোরা জয়।

এই শিকল বাঁধা পা নয় এ শিকল-ভাঙা কল।

যে কবিতার জন্য নজরুলের বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরওয়ানা জারী করা হয়, সেই ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতাটি নি¤œà¦°à§‚প :

“আর কতকাল থাকবি বেটী মাটির ঢেলার মূর্তির আড়ালে?

স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল।

দেব-শিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবাদের দিচ্ছে ফাঁসি,

ভূ-ভারত আজ কসাইখানা, আসবি কখন সর্বনাশী?

দেব-সেনা আজ টান্ছে ঘানি তেপান্তরের দীপান্তরে;

রণাঙ্গণে নামবে কে আর তুই না এলে কৃপাণ ধরে?

বিষ্ণু নিজে বন্দী আজি ছয় বছরী ফন্দি কারায়,

চক্র তাঁহার চরকা বুঝি ভণ্ড হাতে শক্তি হারায়।

মহেশ্বর আজ সিন্ধুতীরে যোগাসনে মগ্ন ধ্যানে,

অরবিন্দ চিত্ত তাঁহার ফুটবে কখন কে সে জানে।

১৯২৩ সালে নজরুল যখন হুগলী জেলে কারাবন্দী জীবন-যাপন করছিলেন এবং অবৈধ দখলদার ব্রিটিশ সরকারের জেল-নিপীড়নের প্রতিবাদে অনশন ধর্মঘট পালন করছিলেন। সে সময় কবি-মাতা জাহেদা খাতুন পুত্রের অনশন ভাঙাতে হুগলী জেলে যান। সেখানেও দেখা যায় কবি কয়েদীদের উপর ব্রিটিশ শাসকের নিপীড়নের বিরুদ্ধে মায়ের অনুরোধ উপেক্ষা করেন।

কবি সম্ভবত ভেবেছিলেন সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সরকার কৌশলে তাঁর মাকে দিয়ে তাঁর উপবাস ভাঙাবার চেষ্টা করছে। মাতা-পুত্রের কথোপকথনের একটি অংশ এখানে তুলে ধরা হলো : কবি-মাতা বললেন : “বাবা, আমি ব্রিটিশ গভর্ণমেন্টের কাছে তোর হয়ে ক্ষমা চেয়ে নেব।” মায়ের এই কথা শুনে কবি ভীষণ উত্তেজিত হয়ে উঠলেন এবং বললেন, ‘মা, তুমি কারবালা প্রান্তরের আবদুল ওহাব জননীর কথা কি ভুলে গেছ? আবদুল ওহাব জননীর মত কথা বলোÑআমি শুনতে রাজি আছি।’

এরপর কবি পুনরায় মায়ের পদচুম্বন করে বললেন, ‘মা মনে রেখো, তুমি কাজী নজরুল ইসলামের জননী। তোমাকে বলছি দেশ মাতার সম্মান এবং গৌরব রক্ষার জন্য আমার জীবন সমর্পণ করেছি। তুমি আমাকে আর্শীবাদ করো যেন আমি তোমার এই কান্নাভরা মুখে হাসি ফোটাতে পারি। মা, তুমি কেঁদ না। কাজী নজরুল ইসলামের মায়ের কান্না শোভা পায় না।” (মাতা-পুত্র, কাজী আবদুর রহীম)

ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা নজরুল বুঝতে পেরেছিলেন, অশুভ দানব শক্তির হাত থেকে দেশমাতাকে মুক্ত করতে হলে আমাদের বিদ্রোহ করতে হবে, সকল নিয়ম-কানুন, বাঁধন শৃঙ্খলমান নিষেধের বিরুদ্ধে। আর এই বিদ্রোহ করতে হলে সকলের আগে আপনাকে চিনতে হবে। বুক ফুলিয়ে বলতে হবে, ‘আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্নিশ আমি দুর্বার, আমি ভেঙে করি সব চুরমার।’ ধূমকেতুর সম্পাদকীয়তে নজরুল বলেন, “... বিদ্রোহের মতো বিদ্রোহ যদি করতে পার, প্রলয় যদি আনতে পার, তবে নিদ্রিত শিব জাগবেইÑকল্যাণ আসবেই।”

‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতায় তো ব্রিটিশ সরকারের রাজত্বে এমনি জ্বালা ধরিয়ে দিয়েছিলো যে, পুলিশ এসে ‘ধূমকেতু’ অফিস ঘেরাও করে সকল কপি বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করে। নজরুলের নামে গ্রেফতারী পরওয়ানা জারী করে। গ্রেফতার এড়াতে নজরুল প্রথমে কলকাতা, পরে কুমিল্লায় আশ্রয় নেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নজরুল গ্রেফতার এড়াতে ব্যর্থ হন। ১৯২২ সালের ২৩ নভেম্বর বিকেলে কুমিল্লা ঝাউতলা রাস্তা দিয়ে আনমনে হাঁটার সময় উকিল যোগেন্দ্রনাথ দত্তের বাড়ির সামনে থেকে কুমিল্লার তৎকালীন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কর্তৃক গ্রেফতার হন। ‘নজরুল ধরা পড়েছে’Ñএই সংবাদ রাষ্ট্র হবার সঙ্গে সঙ্গে সারা কুমিল্লা শহর ও শহরতলিতে প্রচণ্ড হৈ চৈ পড়ে যায়।

‘দুর্দিনের যাত্রী’র প্রায় সবগুলো নিবন্ধনেই নজরুল চেষ্টা করেছেন ভারতবাসীর চেতনাকে বিদ্রোহ করতে, অবৈধ দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে স্বজাতিকে জাগিয়ে তুলতে। যেমন তিনি “মোরা সবাই স্বাধীন, সবাই রাজা” নিবন্ধে বলেছেন : “একবার শির উঁচু করে বল দেখি বীর, “মেরা সবাই স্বাধীন, সবাই রাজা।” দেখলে অমনি তোমার পূর্বপুরুষের রক্ত-মজ্জা-অস্থি দিয়ে পড়া রক্তদেউল তাদের ঘরের মত টুটে পড়েছে, তোমার আড়ালে গিয়ে লুকিয়েছে। তোমার হাতে-পায়ে গর্দানে বাঁধা শিকলে প্রচণ্ড মোচড় দিয়ে বল দেখি বীরѓমোরা সবাই স্বাধীন, সবাই রাজা”।

স্বরাজ মানে কি? স্বরাজ মানে, নিজেই রাজা বা সবাই রাজা; আমি কারো অধীন নই, আমরা কারুর সিংহাসন বা পতাকাতলে আসীন নই। এই বাণী যদি বুক ফুলিয়ে কোনো ভয়কে পরোয়া না করে মুক্ত কণ্ঠে বলতে পার, তবেই তোমরা স্বরাজ লাভ করবে, স্বাধীন হবে, নিজেকে রাজা বলতে পারবে, নৈলে নয়।’ ইত্যাদি।

নজরুল তাঁর জ্বালাময়ী কবিতা, কথা, গান, প্রবন্ধ দিয়ে গণজোয়ার সৃষ্টি করেছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, জনগণ না জাগলে অবৈধ দখলদার পশুশক্তিকে বিতাড়িত করে স্বাধীনতা আনা সম্ভব নয়। স্বাধীনতার পূর্বশর্ত গণজোয়ার। এ প্রসঙ্গে কাজী আবদুল ওদুদের মন্তব্য উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি বলেন, “বাংলা সাহিত্যিকদের মধ্যে একমাত্র তিনি (নজরুল) গণচিত্ত বিশেষভাবে স্পর্শ করতে সমর্থ হয়েছেন। এ-কালে দেশের যে গণশক্তির উত্থান তার মূলে নজরুল প্রতিভা বিশেষভাবে কার্যকরী হয়েছে। এই দিক দিয়ে তাঁর ঐতিহাসিক মর্যাদা অসাধারণ। (সওগাত/আধুনিক বাংলা সাহিত্য)

“মোরা সবাই স্বাধীন, সবাই রাজা” এই স্বপ্নে নজরুল যে একাই বিভোর ছিলেন এমন নয়। তিনি পুরো ভারতবর্ষকে এই স্বপ্নে উদ্বেলিত ও উদ্বুদ্ধ করতে পেরেছিলেন। শুধু ভারতবর্ষই নয়, এটা বাঙালি জাতিরও স্বপ্ন ছিলো। এই সুরে সুর মিলিয়ে বলা যেতে পারে, বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধে নজরুলের জ্বালাময়ী কবিতা ও গান আমাদের চিরন্তন প্রেরণা জুগিয়েছে, স্বপ্ন দেখিয়ে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের। যে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রক হবে শুধু বাঙালি। নজরুলের এই স্বপ্ন ও পথের সূচনা ধরে আজ আমরা স্বাধীন। নজরুল যথার্থই বলেছেন,

“এ দেশ ছাড়বি কিনা বল

নইলে কিলের চোটে হার করিব জল।”

নজরুল আমাদের প্রেরণার কবি, স্বপ্নের কবি, জাতীয় কবি। এই কবি স্বার্থপরতার সমস্ত মোহ ত্যাগ করে একটি ঘুমন্ত ও মুমুর্ষু জাতিকে জাগাবার জন্য  সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন, একাই যুদ্ধ করেছেন বিশাল সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সাথে। সে যুদ্ধে তিনি তাঁর আকাশচুম্বী যৌবনশক্তিকে তিলে তিলে ক্ষয় করে কালো ব্যাধির শিকার হয়েছেন, তবু দুর্জয় পশুশক্তির কাছে মাথা নত করেনি। বলতে দ্বিধা নেই, নজরুলের আগমন, অভ্যুদয় ও সংগ্রাম ছাড়া উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন এত দ্রুত ত্বরান্বিত হতো না। মানুষের মনে যে কবি মনুষ্যত্বের উদ্বোধন ঘটিয়েছেন, প্রেম জাগিয়েছেন, অত্যাচার উৎপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই করার শক্তি জুগিয়েছেন সেই কবির শৈশব থেকে আমৃত্যু দুঃখ-বেদনার ভেতর দিয়েই কেটেছে তাঁর জীবন। নিষ্ঠুর ব্যাধির কবলে গ্রেফতার হয়ে পড়েছেন একাকীত্বের কারাগারে।

লেখক : ইতিহাস চিন্তক

emdadul636@gmail.com

অন্যান্য মিডিয়া bdnews24 RTNN Sheersha News barta24 Prothom Alo Daily Nayadiganta Jugantor Samakal Amardesh Kaler Kantho Daily Ittefaq Daily Inqilab Daily Sangram Daily Janakantha Amader Shomoy Bangladesh Pratidin Bhorerkagoj Daily Dinkal Manob Zamin Destiny Sangbad Deshbangla Daily Star New Age New Nation Bangladesh Today Financial Express Independent News Today Shaptahik 2000 Computer Jagat Computer Barta Budhbar Bangladesherkhela Holiday Bangladesh Monitor BBC Bangla Pars Today
homeabout usdeveloped by

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ মো. তাসনীম আলম।

এটিএম সিরাজুল হক কর্তৃক হক প্রিন্টার্স ১০/৮ আরামবাগ, ঢাকা-১০০০ হতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। যোগাযোগের ঠিকানাঃ ৪২৩ এলিফেন্ট রোড, বড় মগবাজার, ঢাকা - ১২১৭।

ফোন: ৮৮ ০২ ৪৮৩১৯০৬৫, ই-মেইল: sonarbanglaweekly@gmail.com, weeklysonarbangla@yahoo.com, সার্কুলেশন: ০১৫৫২৩৯৮১৯০, বিজ্ঞাপন: ৪৮৩১৫৫৭১, ০১৯১৬৮৬৯১৬৮, ০১৭৩৪০৩৬৮৪৬।