রিহান

ফজলে রাব্বী দ্বীন
আজ একা একা মাঠের এক কোণে বসে আছে রিহান। মাঠের ভিতর ছেলেমেয়েদের নানান খেলা দেখছে আর নিজের দুষ্টুমির কথাগুলো বারবার মনে করছে। প্রত্যেকদিন তার দুষ্টুমির জন্য কাউকে না কাউকে কষ্ট পেতেই হয়। এইতো গতকালকে কানামাছি খেলায় সময় দুষ্টুমির ছলে ভুল করে তানিশাকে ধাক্কা মেরে ফেলেছিল আর সে ধাক্কাতে তানিশার হাঁটুর চামড়া হালকা উঠে গিয়েছিল। দুষ্টুমির এ কাজের জন্য তানিশার সামনে আর কখনও সে যেতে পারে না। এখন অবশ্য অন্য বন্ধুরাও তাকে দেখলে মুখ ঘুরিয়ে চলে যায়।

‘আচ্ছা আমি এমন কেন?’-নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করে রিহান। কিন্তু কোন উত্তর পায় না। সেদিন একটা ঘটনার কথা খুব স্পষ্টই মনে আছে তার। তাদের স্কুলে বার্ষিক ফুটবল খেলার বিশাল এক আয়োজন চলচ্ছিল। মাঠের ভেতর রেফারি বাঁশিতে ফুঁক দিবে এমন সময় কে যেন একটা ফুটবলের উপর সজোরে কিক বসিয়ে দিল। আর সে কিকেই বলটা একবারে গিয়ে লাগল রেফারির মাথায়। অবশেষে দুদিন পর হাসপাতালের বেডে জ্ঞান ফিরেছে তার। এদিকে সেই খেলার মাঝখানটায় যখন বেশ উত্তেজনার এক মুহূর্ত চলছিল এমন সময় কে যেন সাইড থেকে বলের উপর একটা শট বসাতেই বল চলে গেল একেবারে গোল পোস্টের ভিতর। নতুন রেফারি কোন দিগবিদ্বিগ না দেখেই বাঁশিতে ফুঁক দিয়ে গোলের কথাটা জানিয়ে দিল। অনেক দাঙ্গা-হাঙ্গামার পর শেষমেষ একটা মীমাংসা করে দিয়েছিল প্রিন্সিপাল স্যার। কিন্তু দুটা কাজের ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিকে উনার খুঁজতে একটুও দেরী হয়নি। পরদিন সবার সামনে রিহানকে দাড় করিয়ে রেখেছিল পুরো কাস। কিন্তু সত্যিকার অর্থে দুটা কাজের মধ্যে একটা কাজও সেদিন করেন রিহান। কিন্তু খেলার সময় তার নানান দুষ্টুমিগুলো যে সবারই বেশ মুখস্থ হয়ে গেছে এ ব্যাপারে ছাড় পাবার তো কোন রাস্তাই তার খালি নেই। একা একা অনেকক্ষণ ধরে চোখের জল মুছতে লাগলো সে। হঠাৎ পিছন থেকে কে যেন তার গায়ের উপর হাত রাখলো। অমনি মুখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখে তার মা।

-কি ব্যাপার,একা একা কাঁদছিস কেন?

-এমনিতেই মা।

-এমনিতেই কেউ কি কাঁদে! বুঝেছি আজকে আবার কোন একটা দুষ্টুমি করেছিস। তাই হয়ত বন্ধুরা তোকে খেলতে নেয়নি!

-না মা, বিশ্বাস করো আজ আমি একটুও দুষ্টুমি করিনি। আর আমার ওই বন্ধুরা তো আমাকে এমনিতেই খেলতে নেয়না।

রিহানের কথাটা মায়ের মনে কষ্টের একটা রেখা টেনে দিল। ছেলেকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে নিচু স্বরে বলল :

-ওরা তোকে যে যাই বলুক আমার কাছে কিন্তু তুই-ই সবথেকে ভালো ছেলে। যদিও প্রত্যেকদিন তোর স্কুল থেকে নানান অভিযোগ দেখে অনেক বকাঝকা করি।

-আমাকে তোমার খারাপ লাগেনা মা?

-মাঝে মাঝে লাগে। এই দেখ্ আমাদের পাশের বাসার রনিকে সবাই কত ভদ্র ছেলে বলে ভালোবাসে। প্রত্যেকবারই স্কুলে ফার্স্ট হয়ে বাবা-মায়ের মুখটাকে কি সুন্দর উজ্জ্বল করে দেয়! তার হাতে যখন অনেকগুলো সারপ্রাইজ দেখি তখন আমার তোর কথা ভেবে খ্বু খারাপ লাগে। আসলে চেষ্টা করলেই মানুষ পৃথিবীর সবকিছু করতে পারে, যেটা তুই একদম-ই করতে চাস না!

-সত্যিই কি মা! আচ্ছা আমিও কি তাহলে চেষ্টা করলে ভালো রেজাল্ট করতে পারবো?

-কেন পারবি না, যারা ভালো রেজাল্ট করে তারা কি তোর মতো মানুষ নয়!

-ঠিকআছে মা, তাহলে আজ থেকেই আমি বদলে যাবো। আর কোনদিন দুষ্টুমি করবোনা। ঠিকমত পড়াশোনা করবো। আর তুমি বললে তবেই খেলতে যাবো। মায়ের দুচোখ দিয়ে সুখের এক ঝরনা বইতে লাগলো। যে ছেলেকে কোনদিন বকাঝকা আর পিটুনি দিয়েও ভালো করা সম্ভব হয়নি সে কিনা আজ মায়ের মুখের এমন মিষ্টি কথাতেই পাল্টে গেল! হাজার স্বপ্নের জোনাকি টুকরা ছেলেটার অশ্রুভরা চোখটাকে বারবার মুছে দিতে গিয়ে নিজের চোখটাকে যে কতবার মুছেছেন তা হয়ত রিহান ছাড়া আর কেউই বলতে পারবে না!