সংবাদ শিরোনামঃ

অর্থ লুটের মহোৎসব ** ভোটে আগ্রহ নেই মানুষের ** সারাদেশে গুম হত্যা আতঙ্ক ** ড. মাসুদের মুক্তির দাবিতে জামায়াতের মিছিল ** প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের দায় এই সরকারকেই নিতে হবে : খালেদা জিয়া ** পানির জন্য হাহাকার ** ক্ষমতার নিশ্চয়তা পেলেই আগাম নির্বাচন ** তিস্তা এখন ধু ধু বালুচর ** তেলের দাম কমানোর নামে প্রহসন ** সরকার দায় চাপানোর কৌশল নিয়েছে ** আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই জনগণের নিরাপত্তা বিধান করতে হবে ** ওনারা বললে দোষ হয় না! ** মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি কি সুদূর পরাহত? ** পার্বতীপুরে পানির জন্য হাহাকার ** টাঙ্গাইলের ছয় উপজেলায় সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় নেই! ** কুষ্টিয়ায় ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যু বাড়ছে **

ঢাকা, শুক্রবার, ১৬ বৈশাখ ১৪২৩, ২১ রজব ১৪৩৭, ২৯ এপ্রিল ২০১৬

॥ রায়হান আজাদ॥
ভয়াল ২৯ এপ্রিল। ১৯৯১ সালের এই দিনে বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী অঞ্চল বিশেষ করে চট্টগ্রাম ও তার আশেপাশের দ্বীপগুলোতে শতাব্দীর ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় প্রবাহিত হয়। মহাপ্রলয়ঙ্করী এ ঘূির্ণঝড় ও  জলোচ্ছ্বাসে লাখ লাখ আবালবৃদ্ধবণিতা প্রাণ হারায়। অর্থনৈতিকভাবে সীমাহীন বিপর্যস্ত হয় এতদাঞ্চলের আড়াই কোটি মানুষ। নিরীহ পশুপাখী, তে-খামার, হাট-বাজার ও দালান-কৌটার ব্যাপক তি সাধিত হয়। ২০/২৫ ফুট লোনা পানিতে তলিয়ে যায় দীন হীন মজুরের বসতভিটা। সৃষ্টির সেরা মানুষ ও হিংস্র কীট-পতঙ্গ একাকার  হয়ে লড়াই করে  জীবনের শেষ অস্তিত্বটুকুর জন্য। চারিদিকে মানবতা  ত্রাহি ত্রাহি। গলিত লাশের মিছিলে উৎকট গন্ধ। খালের পাড়ে, রাস্তার ধারে বেওয়ারিশ লাশের মাংস নিয়ে কুকুর ও শকুনের কাড়াকাড়ি। কোন উসিলায় বেঁচে যাওয়া আত্মীয়-স্বজনের বুকফাটা আহাজারি ও দু’মুঠো  ভাত পেটে দেয়ার অশ্রুসজল আর্তনাদ আকাশ বাতাস ভারী করে তোলে। ৪৭,২০১ বর্গ কি.মি. এলাকা জুড়ে বিস্তৃত বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল। ১৮০ কি. মি.  প্রচণ্ড গতিবেগে আবহাওয়া মুহূর্তেই সব নিঃশেষ করে দেয়। সরকারি হিসেব মতে, ১০২টি উপজেলায় দেড় ল মানুষ মারা যায়। আর বেসরকারি মতে, প্রায় আড়াই লাখ লোক মারা যায়। খোদ কুতুবদিয়াতে ১০ হাজারেরও বেশি লোক নিহত হয়। এভাবে গত ২০০ ( ১৭৯৪- ১৯৯৮) বছরে প্রায় ৭০টি জলোচ্ছ্বাস হয়। তন্মেধ্যে গত ৩৮ বছরে (১৯৬০-১৯৯৮) ১৫টি ভয়াল ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস আঘাত হানে।  ১৯৯১ এর ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে কক্সবাজার, মহেশখালী, চকরিয়া, পেকুয়া, কুতুবদিয়া, বাঁশখালী, আনোয়ারা, সন্দ্বীপ, হাতিয়া, চাঁদপুর ও নোয়াখালীর ১ কোটি মানুষ আত্মীয়-স্বজন ও ধন-দৌলত সবকিছু হারিয়ে নাস্তানাবুদ হয়ে পড়ে।  এতে ৫ লাখ গবাদি পশু মারা যায়। ১১ লাখ ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়।  ২,৭৮,৬০০ একর জমির  ফসল নষ্ট হয়, ৬৫০০ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়, ৪৭০ কি.মি. বাঁধ সমুদ্রে বিলীন হয়ে যায় । ৭২,০০০ হেক্টর আমন ধানের জমিতে লোনা পানি ঢুকে যায়। এসব এলাকায় মৃত্যু বিভীষিকার করুণচিত্র ভাষায় ফুটে তোলা অসম্ভব।

আমার বয়েস তখন ১৩; ৭ম শ্রেণীর ছাত্র। কৈশোরের উড়– উড়– মন। ফজরের আজান হলে পুকুর পাড়ে আম কুড়াতাম। চৈত-বোশেখের ঝড়ে আম ও কাঁঠাল চুরির জন্য লুকিয়ে থাকতাম মটরশুটির বনে। মনে পড়ে কী মজা আজলা ভরে আম কুড়ানো! জাম ও লিচু পেড়ে খেতাম গাছের আগায় উঠে। ঘুড়ি ওড়ানো, ডাঙ্গুলি আর মার্বেল খেলায় আমার ডাক ছিল। ২৯ এপ্রিল; গুম ধরা আকাশ, সন্ধ্যের পর পিন পিন বৃষ্টি। পাড়াময় হিড়িক পড়েছে তুফান হবে আজ। ১০নং মহাবিপদ সঙ্কেত। কুতুবদিয়া, মগনামা, বদরখালী, ছনুয়া ও রাজাখালীর হতদরিদ্র মানুষগুলো পাহাড়িয়া এলাকার আত্মীয়ের স›à¦¦à§à¦§à¦¾à¦¨à§‡ তল্পিতল্পাসহ ছুটছে। পেকুয়া উপজেলার উত্তর সীমানায় টইটং খালের পাশেই আমাদের বাড়ি। বাড়ির পাশ ঘেঁষে যেই সড়কটি পাহাড়িয়া এলাকায় চলে গেছে সেই সড়কে আতঙ্কিত মানুষের মিছিল। কাঁধে লেপ কাঁথা কম্বল। দু‘হাতে ব্যাগ-বাস্কেট আর কোলে পিঠে বাচ্চা-কাচ্চা ভ্যাঁ ভ্যাঁ করছে। খালে ফিশিং বোটের সারি। ডিঙ্গি, লঞ্চ, সাম্পান সবই আছে। মাঝি-মাল্লার চোখে মুখে বাঁচার আকুতি। আমাদের পাড়ার নি¤œà¦®à¦§à§à¦¯à¦¬à¦¿à¦¤à§à¦¤ সবাই যত পারে চাল ডাল আলু ক্রয় করে বেতার-টিভির নির্দেশনা মতো পলিথিন ও প্লাস্টিক মুড়িয়ে ঘরে গর্ত করে জমা রেখেছে। এশার পর আমরা ঘুমিয়ে পড়ছিলাম। রাত ১০টার পর চারিদিকে প্রবল বাতাস ছুটলে আব্বা আমাদেরকে পার্শ্ববর্তী চাচাদের দ্বিতল বিল্ডিংয়ে রেখে আসে। সেখানে যাওয়ার পথটি ঝরে পড়া আম আর নারিকেলে বিছানো ছিল। মনে পড়ে, এমন দুর্দিনেও আমি দু’চারটি পাকা আম কুড়িয়ে নিয়েছিলাম। মাঝ নিশিথে বাবুদের ঐ বিল্ডিংয়ে লোকে লোকারণ্য। নিচ তলায় আমাদের  ঠাঁই নেই। দ্বিতলায় উঠে দেখি, সমাজের গরিব লোকগুলো ওখানে ইলিশ ফাইল। পাড়ার মফিজ বউ পাগলা। সে সদ্য বিয়ে করেছে। এমন ভয় ও ভিড়ে সে তার বউকে বলছে ‘অ বউ তুই ধরিস” কথাটি এখনো আমার কানে বাজে। এলাকার মুরব্বীরা নিচ তলায় রেডিওর খবর শুনছে। র্ঘ্যা র্ঘ্যা করছে রেডিও। কিছু বুঝা যায় আর কিছু যায় না।

কৈশোরের চঞ্চলতায় আমি একা হলেও ঘরে আটকে থাকতে পারিনি। ঠিক রাত ৩টার দিকে তীব্র বাতাসের উলটো দিক থেকে হেঁটে বাড়ি থেকে ওয়াপদা বেড়ি বাঁধে উঠি। দেখি! কী যে গোঙ্গানি। চিত্রটা যেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত কবিতা ‘খেয়াপারের তরণী’র মতো! আমি দেখলাম, দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে আগুনের কুণ্ডলী। হু হু বাতাসে ধেয়ে আসছে পানি। গায়ে ছেদ পড়া টপ টপ বৃষ্টি। বিদ্যুৎ-বিজলী ঠাস্ ঠাস্ আওয়াজে বিভীষিকাময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে। নিজকে স্থির রাখতে পারছি না, তবু চোখ বুলিয়ে দেখলাম, আমাদের মসজিদ-ফোরকানিয়া-কবরস্থান, ঘিরা-বেড়া সবই তছনছ হয়ে গেছে। শেষতক নিজেকে রাস্তায় ধরে রাখতে না পেরে আবার চাচাদের বিল্ডিংয়ে ফিরে এলাম। এখানে দেখি, লোকজন গিজ গিজ করছে। দোতলায় আমার ঠেস দিয়ে বসতেই ঘুম। ফজর হলে চোখ খুলে দেখি ভিটেবাড়ি সব লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। আমি কোমরগাড়া পানিতে হাঁটতে হাঁটতে আমাদের বাড়িতে গিয়ে দেখি টিনের চাল উড়ে গেছে বহুদূরে। কাচারি বিল্ডিংয়ের দেয়াল ফেটে গেছে। পাকা ইটের সীমানা প্রাচীর ভেঙ্গে পুকুর-পরীখায় পড়েছে। আমার বাবা জীবনে কখনো জামায়াত মিস করেছে কিনা জানি না। এদিনও তিনি ভাসমান চৌকিতে আমাকে নিয়ে ফজরের নামাজ জামায়াতে আদায় করেন।

চারিদিকে লোনা পানি থৈ থৈ। আমাদের গুদামঘরের মাটির দেয়াল তিন হাত ডুবে গেছে। ভিটাবাড়ি আর পুকুর-পরীখা সমান পানিতে একাকার। দামাল বয়সের ছেলে হিসেবে আমি তো দমবার পাত্র নই। উঠোন আর পুকুর পাড় থেকে যে পারি ঝরে পড়া ভাসমান নারিকেল আর ডাব সংগ্রহ করলাম যা কিনা পরে তিনবেলা আহারের ঘাটতি পূরণ করেছে। হলদে রোদ তখনও টাটকা হয়নি। ডাক পড়েছে বাবার, জানাজা পড়াতে হবে। আমিও পেছনে পেছনে ছুটলাম। আমাদের গ্রামে তুফানে মাত্র কয়েকজন লোক মারা গেছে। তবে ভেসে আসা সারি সারি লাশ গ্রামের ওয়াফদা রাস্তায় এসে ঠেকেছে। এসব লাশ কুতুবদিয়া, মাতারবাড়ি মগনামা ও রাজাখালী থেকে ভেসে এসেছে। সবুজ শার্টপরা এক যুবকের লাশের দৃশ্য আমাকে হকচকিয়ে তোলে। বাবার নেতৃত্বে এলাকার লোকজন যা পারে এসব লাশ শরীয়াহ সম্মতভাবে দাফনের ব্যবস্থা করে। গরু-ছাগল ও হাঁস-মুরগির মৃতদেহ এবং বাসার আসবাবপত্র যত্রতত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকে। কারো সেদিকে খেয়াল নেই। প্রায় দু‘সপ্তাহ ধরে  পাড়াময় বিকট দুর্গন্ধ বিরাজমান ছিল। খালে-বিলে ও ডোবায় দেদারছে চিংড়ি মাছ পাওয়া যেতো এসময়। চারপাশের গাছপালা দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া এবং পাতাশূন্য হয়ে পড়ায় বিরান বিরান অবলোকন হয়। আমাদের এলাকায় পর্যাপ্ত পরিমাণে রিলিফ পৌঁছেনি। এলাকাবাসী ওসবের জন্য অত উৎসুকও ছিল না।

দিন যত গড়িয়ে যায় ততই সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে উঠে। গাছে গাছে পল্লব ফোটে। মাঝে মাঝে বৃষ্টিপাত ঘটে; বাতাসে উড়িয়ে নেয় উৎকট ঘ্রাণ। নির্মিত হয় ভেঙ্গে পড়া মসজিদ-মাদরাসা-ঘরবাড়ি। রাস্তাঘাট শক্তভাবে মেরামত করা হয়। জনগণ দিন দিন পোষাতে থাকে ক্ষয়ক্ষতি। ফলে সমাজ ও প্রকৃতিতে ফিরে আসে  প্রাণস্পন্দন। সবাই যার যার কাজে মনযোগী হয়ে পড়ে, ভুলতে থাকে বিষাদময় ঊনত্রিশে এপ্রিলের ভয়াল থাবা কিন্তু এখনও আমার মন তুফানের রাতের আগুন-বৃষ্টি-বাতাসের সাথে ভয়ার্তভাবে মিশে আছে, জোয়ারে ভেসে আসা সবুজ শার্টপরা হতভাগা মজুর ছেলেটার জন্য মাতম তোলে। হৃদয়পটে বার বার ভেসে উঠে বঙ্গোপসাগরের পাড় থেকে পালিয়ে আসা অসহায়-হতবিহ্বল মানুষের দৌড়াদৌড়ির দৃশ্য। আমি ভুলতে পারছি না আপামর জনতার সাথে সকল প্রাণীর বিদঘুটে লাশের নির্মম স্মৃতি।

লেখক : সম্পাদক, মাসিক সমকাল ডাইজেস্ট. চট্টগ্রাম।

ও সেক্রেটারি, সেন্টার ফর রিসার্চ এন্ড পলিসি স্টাডিজ- CRPS.

ই-মেইল : raihanazadctg1980@gmail.com

এ পাতার অন্যান্য খবর

অন্যান্য মিডিয়া bdnews24 RTNN Sheersha News barta24 Prothom Alo Daily Nayadiganta Jugantor Samakal Amardesh Kaler Kantho Daily Ittefaq Daily Inqilab Daily Sangram Daily Janakantha Amader Shomoy Bangladesh Pratidin Bhorerkagoj Daily Dinkal Manob Zamin Destiny Sangbad Deshbangla Daily Star New Age New Nation Bangladesh Today Financial Express Independent News Today Shaptahik 2000 Computer Jagat Computer Barta Budhbar Bangladesherkhela Holiday Bangladesh Monitor BBC Bangla Pars Today
homeabout usdeveloped by

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ মো. তাসনীম আলম।

এটিএম সিরাজুল হক কর্তৃক হক প্রিন্টার্স ১০/৮ আরামবাগ, ঢাকা-১০০০ হতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। যোগাযোগের ঠিকানাঃ ৪২৩ এলিফেন্ট রোড, বড় মগবাজার, ঢাকা - ১২১৭।

ফোন: ৮৮ ০২ ৪৮৩১৯০৬৫, ই-মেইল: sonarbanglaweekly@gmail.com, weeklysonarbangla@yahoo.com, সার্কুলেশন: ০১৫৫২৩৯৮১৯০, বিজ্ঞাপন: ৪৮৩১৫৫৭১, ০১৯১৬৮৬৯১৬৮, ০১৭৩৪০৩৬৮৪৬।