এম. মুহাম্মদ আব্দুল গাফ্্ফার
পবিত্র মাহে রমযানের দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর আসে ঈদুল ফিতরের উৎসব। শাওয়াল মাসের চাঁদ পশ্চিমাকাশে উদয়ের সাথে সাথে সিয়াম পালনকারী মুসলিম জাতি ঈদের খুশিতে পুলকিত হয়ে ওঠে। ইসলামের পরিভাষায় ঈদ অর্থ আনন্দ, আর ঈদুল ফিতর অর্থ হলো সাওম অর্থাৎ রোজার সমাপ্তিলগ্নে পানাহার শুরু করা। মুসলমানদের দুটি ঈদের মধ্যে পবিত্র ঈদুল ফিতর পালিত হয় শাওয়াল মাসের ১ তারিখে ও ঈদুল আজহার ঈদ হয় জিলহজ মাসের ১০ তারিখে।
ঈদ শুরু হয় দ্বিতীয় হিজরী সনে। বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আনাস (রা.) থেকে এ সম্পর্কিত একটি হাদীস এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। ‘নবী (সা.) যখন মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনায় এলেন, তখন তিনি দেখলেন যে, লোকজন বছরে দুটি নির্দিষ্ট দিনে খেলাধুলা ও আনন্দ উপভোগ করে। তিনি তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, এ দুটি দিন কেমন? তারা বলেন, আমরা ইসলামের আগমনের পূর্বে এ দুটি দিনে খেল-তামাশা ও আনন্দ উপভোগ করতাম। নবী (সা.) বলেন, আল্লাহ এ দুটি দিনের পরিবর্তে দুটি উৎকৃষ্টতর দিন নির্বাচিত করে দিয়েছেন। একটি ঈদুল ফিতরের দিন এবং অন্যটি ঈদুল আজহার দিন।’ (আল হাদীস)। ইসলাম পূর্বযুগে মদীনায় প্রচলিত ওইসব উৎসব ছিল কলুষ-কালিমায় পরিপূর্ণ জঘন্যতম পাপাচারের সমাহার মাত্র। জাহেলিয়াত যুগের এসব অনুষ্ঠান ইহুদি, খ্রিস্টান ও পৌত্তলিকদের সামাজিক অপসংস্কৃতি থেকে মদীনার জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিস্তার লাভ করেছিল। আল্লাহর রাসূল (সা.) এসব অপসংস্কৃতির সয়লাবকে উৎখাত করে তাওহীদভিত্তিক ইসলামী শরিয়ার নির্মল পন্থা পদ্ধতি চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
মুসলমানগণ মহান রাব্বুল আলামিনের আদেশ অনুযায়ী দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনায়রত থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে পানাহার শুরুর মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে প্রত্যাবর্তনের তাওফিক তথা সুযোগ যে মহাপ্রভু দান করলেন মূলত তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের দিবসটিই হলো ঈদুল ফিতর। এ দিনে সকল মুসলমান উন্মুক্ত মাঠে সমবেত হয়ে দু’রাকাত ওয়াজিব সালাত আদায় করেন। এ সালাতের একটা বৈশিষ্ট্য হলো দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের যে নিয়ম রয়েছে এবং জুমার সালাতের যে নিয়ম রয়েছে তার ব্যতিক্রম হলো অতিরিক্ত তাকবির উচ্চারণ করতে হয়। এছাড়া যে তাকবিরটি আস্তে আস্তে উচ্চারণ করতে করতে ঈদগাহের দিকে যেতে হয় এবং সালাত শেষে প্রত্যাবর্তন করতে হয়, তা হলো ‘আল্লাহু আকবর আল্লাহু আকবর লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবর আল্লাহু আকবর ওয়া লিল্লাহিল হামদ’ অর্থাৎ আল্লাহ মহান আল্লাহ মহান আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান এবং আল্লাহর জন্যই সব প্রশংসা। এসব বাক্য উচ্চারণের মাধ্যমে এ কথাই সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তাঁর একক কর্তৃত্ব মেনে নিয়ে তাঁর দাসত্বের অঙ্গীকারই হলো ঈদ সালাতের মুখ্য বিষয়। মহান রাব্বুল আলামিন যে এক মাসব্যাপী মুসলমানদের সিয়াম পালন ও রাত্রি জাগরণসহ লাইলাতুল কদর লাভের সৌভাগ্য দান করেছেন। এজন্য ঈদুল ফিতরে তাঁর শুকরিয়া আদায় করা জরুরি। বিশ্বনবী (সা.) ঘোষণা করেছেন, যার নিকট থেকে মাহে রমযান চলে গেলো অথচ সে এ মাসে আল্লাহ নির্ধারিত ইবাদত করে স্বীয় পাপের ক্ষমা লাভ করতে পারলো না, সে খুবই হতভাগ্য। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা এভাবে বর্ণনা করা যেতে পারে- ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর ফারুক (রা.) ঈদুল ফিতরের দিন উৎসবে শামিল না হয়ে বাড়িতে বসে ক্রন্দন করছিলেন। সহকর্মীগণ তাঁর ক্রন্দনের কারণ জিজ্ঞাসা করলে? তিনি বলেছিলেন যে, মহানবী (সা.) এর ঘোষণা অনুযায়ী যদি আমার পাপ রমযান মাসে মাফ না হয়ে থাকে, তাহলে আমি উৎসবে অংশগ্রহণ করে আনন্দ উল্লাস করবো কীভাবে? আমি তো এখনো বুঝতে পারছি না যে, আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন কিনা?
ঈদের সালাতে অংশগ্রহণের পূর্বেই সাদাকাতুল ফিতর, যা মুসলমানদের প্রতি বাড়ির সকল সদস্যদের পক্ষ থেকেই আদায় করতে হয়। জনপ্রতি ন্যূনতম এক কেজি সাড়ে ছয়শত গ্রাম গম বা তার সমপরিমাণ অর্থ গরিব, মিসকিন ও দুস্থদের মধ্যে বিতরণ করতে হয়Ñ যেন তারাও এ ঈদ আনন্দে অংশ নিতে পারে। ঈদের এ কার্যক্রমের ফলে মুসলমানদের মধ্যে যে সামাজিক বন্ধন সুদৃঢ় হবার ইঙ্গিত বহন করে তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
মহানবী (সা.) এবং খোলাফায়ে রাশেদীনদের শাসনামলে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় মহিলাগণও স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঈদ জামাতে শরিক হতেন এবং সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে আর্থিক সহায়তায় ভূমিকা রাখতেন।
ঈদ সম্পর্কিত অনেকগুলো হাদীস বর্ণিত আছে। এ প্রসঙ্গে একটি হাদীস এভাবে এসেছে আবু সাঈদ খুদরী (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী (সা.) ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার দিন ঈদগাহে যেতেন এবং সেখানে তিনি সর্বপ্রথম যে কাজ করতেন তা হতো সালাত। সালাত শেষে তিনি লোকদের দিকে ফিরে দাঁড়াতেন এবং তারা নিজ নিজ কাতারে বসে থাকতো। তিনি তাদেরকে উপদেশ দিতেন, অসিয়ত করতেন এবং (জরুরি বিষয়ে) আদেশ দান করতেন। অতঃপর সেনাবাহিনীর জন্য লোক আলাদা অর্থাৎ বাছাই করতেন অথবা কোনো কাজের ফরমান জারি করার ইচ্ছা করলে তিনি তা করতেন, এরপর তিনি (বাড়ি) ফিরে যেতেন। বর্ণনাকারী আবু সাঈদ বলেন নবী (সা.) এরপরও লোকেরা এ নিয়মই অনুস্মরণ করে চলতো...।’ (সহীহ আল বুখারী, কিতাবুল ঈদাইন)।
এভাবে মহিলাদের ঈদের সালাতে ঈদগাহে গমন এবং তাদের নিকট থেকে আর্থিক সহায়তা গ্রহণ ও তাদেরকে আত্মশুদ্ধির পথ অনুসরণ সংক্রান্ত আরেকটি হাদীস এভাবে উল্লেখ করছি। আতা জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি তাকে বলতে শুনেছেন, (একবার) নবী (সা.) ঈদুল ফিতরের দিন দাঁড়ালেন, তারপর প্রথমে সালাত আদায় করলেন, অতঃপর খুতবা দিলেন। খুতবা থেকে অবসর গ্রহণ করে নেমে এলেন এবং মহিলাদের সামনে উপস্থিত হলেন- এরপর বিলালের হাতের ওপর ভর দিয়ে তাদের হিতোপদেশ দিলেন। বিলাল তাঁর কাপড় প্রসারিত করে দিলেন, আর মহিলারা তাতে দানসামগ্রী ফেলেতে লাগলো। ইবনে জুরাইজ বর্ণনা করেছেন, আমি আতা ইবনে আবু রাবাহকে জিজ্ঞেস করলাম তারা কি (মহিলারা) সাদকায়ে ফিতর দান করছিল? তিনি বললেন, না, বরং তারা নফল সাদকা দিচ্ছিল। সে সময় কোনো মহিলা তার বৃহৎ আংটিটি দান করলে অন্যান্য মহিলারাও তাদের বৃহৎ আংটিগুলো দান করছিল। (অন্য বর্ণনায় এসেছে মহিলারা গলার হারও দান করছিল)। আমি আতা ইবনে আবু রাবাহকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, মহিলাদের উপদেশ দান করা কি ইমামের জন্য ওয়াজিব? তিনি বললেন হ্যাঁ, তা অবশ্যই ওয়াজিব। ইমামদের কি হয়েছে যে, তারা এরূপ করে না? হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে অন্য সূত্রে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেছেন আমি নবী (সা.) এর এবং আবু বকর, ওমর ও ওসমান (রা.) এর সাথে ঈদুল ফিতর সালাত আদায় করেছি (তারা সবাই এরূপ করতেন)। নবী (সা.) মহিলাদের কাতারে উপস্থিত হয়ে আল কুরআনের এ আয়াত পাঠ করলেন ‘হে নবী! যখন ঈমানদার নারীরা তোমার নিকট এ শর্তে বাইয়াত নিতে আসে যে, তারা আল্লাহর সাথে কোনো কিছু শরিক করবে না, চুরি করবে না, জিনা করবে না, সন্তান হত্যা করবে না, কারো বিরুদ্ধে কোনো মিথ্যা অপবাদ রটাবে না এবং সৎকাজের নির্দেশে তোমার অবাধ্য হবে না, তখন তুমি তাদের বাইয়াত গ্রহণ কর এবং তাদের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে, নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল ও মেহেরবান।’ (সূরা মুমতাহিনা: ১২)। এরপর নবী (সা.) তাদের জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি এ বাইয়াতের ওপর অবিচল আছো? একজন মহিলা বললো হ্যাঁ....। (বুখারী)।
এ দীর্ঘ হাদীসের বিষয়বস্তুগুলো পাঠকের সামনে তুলে ধরার উদ্দেশ্য হলো ঈদুল ফিতর তথা মুসলমানদের ঈদ নিছক আমোদ আহলাদের বিষয় নয়। ঈদে আল্লাহর শুকরিয়া আদায়ের সাথে সাথে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন ও সমাজের অর্থনৈতিক সচ্ছলতার প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপসহ সকল স্তরের মানুষের জন্য আল্লাহর দীনের প্রতি দায়িত্ববোধ জাগ্রত করার অনুশীলন জরুরি অবশ্যই। মহান রাব্বুল আলামিনের অসীম করুণায় আমরা যে দীনে হকে প্রবেশ করতে পেরেছি, এজন্য আত্মবিশ্লেষণের মাধ্যমে নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্যে তৎপর থাকার বিকল্প কোনো কিছুই হতে পারে না।
মহানবী (সা.) ঈদুল ফিতরের এ আনন্দে অসহায় দুস্থ, এতিম, ছিন্নমূলসহ শিশু-কিশোরদেরও সম্পৃক্ত করার প্রয়োজনীয়তাকেও উপেক্ষা করেননি। হযরত আয়েশা (রা.)সহ অনেক সাহাবীগণের বর্ণনা থেকে জানা যায় মহানবী (সা.)-এর সম্মতিতে শিশু-কিশোররাও দফ বাজিয়ে গান গেয়ে ঈদের দিন আনন্দ উপভোগ করেছিল। (সূত্র : সহীহ আল বুখারী, কিতাবুল ঈদাইন)।
মহান রাব্বুল আলামিন সমগ্র মুসলিম জাহানের সবার জীবনে ঈদুল ফিতরের মাধ্যমে কল্যাণ দান করুন। এ প্রার্থনাই জানাই তার দরবারে। আমীন।
লেখক: সদস্য, দারুল ইসলাম ট্রাস্ট, সিরাজগঞ্জ।
এ পাতার অন্যান্য খবর
- শাওয়াল মাসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য
- একটি ঐতিহাসিক ঈদকার্ড
- আল্লাহর লানত থেকে বাঁচতে রমাদানে গুনাহ মাফ করাতেই হবে
- ঈদের দিনে করণীয়
- লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব ও মর্যাদা
- যাকাত-ফিতরা কী এবং কার জন্য
- নূহের জাহাজ
- ফিলিস্তিন
- আশরাফ জামান-এর দুটি কবিতা
- জাকির আবু জাফর-এর কবিতা
- অফুরন্ত শান্তির ঈদ
- সোনার বাংলা
- সরল পথ
- লাহাব
- জেগে ওঠো ঐক্যবলে
- দৃষ্টিভঙ্গি বদলান : জীবনও বদলে যাবে
- সাদকাতুল ফিতর ও ঈদ উৎসব
- সারপ্রাইজ ডে
- সামাজিক নিরাপত্তার গ্যারান্টি যাকাত
- আনন্দের বারতা নিয়ে আসে ঈদুল ফিতর
- ঈদ আনন্দ আজ