॥ এম ওবায়দুল্লাহ আনসারী ॥
বিশ্বব্যাপী বার বার রমযান আসে মুমিন-মুত্তাকিদের মাঝে রহমত, বরকত ও নাজাতের পয়গাম নিয়ে। রমযান আসে মুমিন-মুত্তাকিদের মাঝে আনন্দের বারতা নিয়ে। এর অতি-উত্তম কারণ রমযান এলেই মুমিনের সাওয়াব কয়েকগুণ বৃদ্ধি পায় এবং গুনাহ মাফের মোক্ষম সুযোগ সৃষ্টি হয়। দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর শাওয়ালের চাঁদ দেখে যে উৎসব বিশ্বের মুসলমানরা পালন করে থাকেন, সেটিই পবিত্র ঈদুল ফিতর। আর এ ঈদুল ফিতর মুসলমানদের এক গুরুত্বপূর্ণ ও অনাবিল আনন্দের উৎসব। এদিন প্রতিটি মুসলিমসত্তা নবউৎসাহ-উদ্দীপনায় জেগে ওঠে।
নবী কারীম সা. নিজে ঈদ পালন করেছেন এবং সাহাবীদের ঈদ উদযাপন করার জন্য তাগিদ দিয়েছেন। মদীনায় হিজরত করে যাওয়ার পর রাসূল সা. দেখলেন, লোকজন দুটি দিনকে উদযাপন করে খেলাধুলা করছে। তাদের এ খেলাধুলা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তারা বলে, আমরা জাহেলি যুগ থেকেই এ দুদিন খেলাধুলা করতাম। তখন মহানবী সা. বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, এ দুদিনের পরিবর্তে তোমাদের এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ দুটি দিন দিয়েছেন। তা হলোÑ ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা।’ (আবু দাউদ)।
বিশ্বের মুসলমানরা অনাবিল আনন্দের মাধ্যমে ঈদুল ফিতর উদযাপন করে থাকেন। রমযান মাসের সিয়াম আদায়ের পর সব দুঃখ-কষ্ট ভুলে শাওয়াল মাসের এক ফালি চাঁদ দেখার প্রহর গুনতে থাকেন সবাই। পূর্ণতা, আনন্দ ও বিজয়ের বার্তা নিয়ে আগমন ঘটে শাওয়াল মাসের। এরপর থেকেই প্রত্যেক মুসলমান উৎসবের আমেজে মেতে ওঠেন। ছোট-বড় সবাই আনন্দে পুলকিত হয়ে ওঠেন। পূর্বের সব হিংসা-ক্লেশ-বিচ্ছিন্নতা ভুলে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি ও ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হন প্রত্যেক মুসলমান। মাহে রমযানের সিয়ামের মাধ্যমে নিজেদের অতীত জীবনের সব পাপ-পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত হওয়ার অনুভূতি ধারণ করেই পরিপূর্ণতা লাভ করে ঈদের খুশি।
প্রিয়নবী মুহাম্মদ (সা.) সানন্দে ঘোষণা করেন, ‘প্রত্যেক জাতিরই আনন্দ-উৎসব রয়েছে। আমাদের আনন্দ-উৎসব হচ্ছে এ ঈদ।’ (বুখারি ও মুসলিম)। অন্যান্য জাতির উৎসব শুধু নিজেদের মাঝে কেন্দ্রীভূত, কিন্তু মুসলিমদের উৎসব ধনী-গরিব সব মানুষের মহামিলনের বার্তা বহন করে। ঈদুল ফিতর ভ্রাতৃত্ববন্ধন অটুট রাখতে উদ্বুদ্ধ করে। ত্যাগের শিক্ষা দেয়। তাই ঈদুল ফিতরের দিন সাদাকাতুল ফিতর আদায়ের নির্দেশ দেওয়া হয়েছেÑ যাতে এর মাধ্যমে ধনী-গরিব সব ভেদাভেদ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। সবাই একই বেশে একই সাজে হাতে হাত মিলিয়ে কোলাকুলি করে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে সুদৃঢ় করে তোলার সুযোগ সৃষ্টি হয়।
ঈদুল ফিতরের অন্যতম ফজিলতপূর্ণ খুশির মাধ্যম হলোÑ ঈদের দিন সূর্যোদয়ের পর দুই রাকাত নামায আদায়, যা ওয়াজিব। আল্লাহর কাছে পূর্ণতা চাওয়ার এক অপার সুযোগ এ নামায। সারিবদ্ধ কাতারে দাঁড়িয়ে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের একসঙ্গে নামায পড়ার সুযোগ এনে দেয় পবিত্র ঈদুল ফিতর। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে সিয়াম আদায়ের পর ঈদের নামায আদায় করা হয়। নামায আদায়ের পর ঈদগাহ ময়দানে একে-অপরের হাতে হাত, বুকে বুক মিলিয়ে আলিঙ্গন করলে মুসলমানরা এক মাস রোজার কারণে ক্ষুধা-তৃষ্ণা-দুঃখ-ক্লেশ ভুলে যান। সমাজের সর্বস্তরের মুসলিম মিল্লাত ঈদের নামাযের বার্ষিক জামাতে সানন্দে উপস্থিত হন। এ যেন একে-অন্যের সঙ্গে সাক্ষাৎ, কোলাকুলি ও কুশলবিনিময়ের এক অপূর্ব সুযোগ। তখন ছোট-বড়, ধনী-গরিব, আমির-ফকির, শিক্ষিত-অশিক্ষিতের মধ্যে কোনোরকম ভেদাভেদ বা বৈষম্য থাকে না। ঈদুল ফিতর বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্মীয় উৎসব। ঈদের মাধ্যমে যে আনন্দ ও আত্মতৃপ্তি অনুভব হয়, তা অন্য কোনো উৎসবে হয় না।
প্রতি বছর আমরা দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনা (রোজা) করি। রোজার ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলোর জন্য আমরা ফিতরা আদায় করে থাকি। তাই ঈদের দিন সুবহে সাদিক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাদাকাতুল ফিতর ওয়াজিব হয়। সুতরাং কোনো ব্যক্তি যদি ঈদুল ফিতরের দিন সুবহে সাদিকের আগে ইন্তেকাল করেন, তার সাদাকাতুল ফিতর আদায় করতে হবে না। আর যদি কোনো সন্তান সেদিন সুবহে সাদিকের আগে জন্মগ্রহণ করে, তার পক্ষ থেকে ফিতরা আদায় করতে হবে। (তাহতাবী)।
ঈদের নামায শেষে ধনী-গরিব ছোট-বড় নির্বিশেষে সবাই একে-অপরের সঙ্গে বুকে বুক ও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কোলাকুলি করেÑ এমন দৃশ্য মুসলমান ছাড়া অন্য কোনো ধর্মাবলম্বীর মধ্যে দেখা যায় না। ঈদের নামাযের পর মহানবী সা. তার সাহাবীদের সঙ্গে মুসাফাহ ও মু’আনাকাহ করতেন। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। হযরত হাসান (রা.) একদিন রাসূল সা.-এর কাছে এলেন। তিনি তখন তাকে জড়িয়ে ধরলেন এবং কোলাকুলি করলেন।’ (শারহুস সুন্নাহ)।
মুসলিম উম্মাহর জন্য পবিত্র দুটি ঈদ (ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা) আনন্দ-উৎসবের দিন। এদিনে আমরা সব ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে ধনী-গরিব সবাই সবার সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করে থাকি। ইবনে হাজার (রহ.) বলেন, সাহাবীরা ঈদের দিন ঈদের নামাযের পর বিভিন্ন রকমের ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করতেন। ঈদ মোবারক ইনশাআল্লাহ, ঈদকুম সাঈদ এ ধরনের বাক্য বলে একে-অপরের সঙ্গে ঈদের নামাযের পর শুভেচ্ছা বিনিময় করতেন।
বিশ্বের মুসলমানরা পবিত্র ঈদের দিন আনন্দ-উৎসবের পাশাপাশি আত্মীয়-স্বজনদের খোঁজখবর নিয়ে থাকেন। আমরা দেশে-প্রবাসে বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান করা আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে টেলিফোন-ফেসবুকে খোঁজখবর নিয়ে থাকি। ঈদের দিন আত্মীয়-স্বজনদের বাসায় বেড়াতে যাওয়া একটি বিশেষ সুযোগ সৃষ্টি করে। আত্মীয়দের সঙ্গে সবসময় সম্পর্ক রাখতে হবে। নবী কারীম সা. বলেন, ‘যে আখিরাতে বিশ্বাস রাখে, সে যেন আত্মীয়দের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে।’ (বুখারি)।
ঈদুল ফিতরের আনন্দ হলো মাহে রমযানের এক মাস সিয়াম সাধনার পর আত্মশুদ্ধি এবং আল্লাহর নিকট থেকে পুরস্কার প্রত্যাশার জন্য। মাহে রমযানের শিক্ষার আলোকে বাকি ১১টি মাস জীবনযাপন করা ঈমানের দাবি। এ দাবি পূরণ করলেই সিয়াম ও ঈদুল ফিতর কঠোর সাধনার পুরস্কার দুনিয়া ও আখিরাতে আমরা লাভ করতে পারব। আমাদের ব্যক্তিগত-পারিবারিক জীবন, সমাজ-রাষ্ট্র হবে ইসলামের সুমহান আদর্শের আলোকে আলোকিত। ঈদুল ফিতর মূলত এ বারতাই আমাদের জন্য নিয়ে আসে প্রতি মাহে রমযান শেষে ১ শাওয়ালে।
লেখক : সাংবাদিক।
এ পাতার অন্যান্য খবর
- শাওয়াল মাসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য
- একটি ঐতিহাসিক ঈদকার্ড
- আল্লাহর লানত থেকে বাঁচতে রমাদানে গুনাহ মাফ করাতেই হবে
- ঈদের দিনে করণীয়
- লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব ও মর্যাদা
- যাকাত-ফিতরা কী এবং কার জন্য
- নূহের জাহাজ
- ফিলিস্তিন
- আশরাফ জামান-এর দুটি কবিতা
- জাকির আবু জাফর-এর কবিতা
- অফুরন্ত শান্তির ঈদ
- সোনার বাংলা
- সরল পথ
- লাহাব
- জেগে ওঠো ঐক্যবলে
- আত্মবিশ্লেষণে সামাজিক উৎসব ঈদুল ফিতর
- দৃষ্টিভঙ্গি বদলান : জীবনও বদলে যাবে
- সাদকাতুল ফিতর ও ঈদ উৎসব
- সারপ্রাইজ ডে
- সামাজিক নিরাপত্তার গ্যারান্টি যাকাত
- ঈদ আনন্দ আজ