রেজি : ডিএ ৫১৭ ॥ ৬৩ বর্ষ : ৩য় সংখ্যা ॥ ঢাকা, শুক্রবার, ২২ চৈত্র ১৪৩০ ॥ ২৫ রমজান ১৪৪৫ হিজরী ॥ ৫ এপ্রিল ২০২৪

॥ মাওলানা সাখাওয়াত উল্লাহ॥
যাকাত ইসলামী সমাজ ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অনন্য বিধান। যাকাত একদিকে দরিদ্র, অভাবী ও অক্ষম জনগোষ্ঠীর সামাজিক নিরাপত্তার গ্যারান্টি; অন্যদিকে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির অন্যতম প্রধান হাতিয়ার। যাকাত সম্পদ পবিত্র করে, বিত্তশালীদের পরিশুদ্ধ করে, দারিদ্র্যমোচন করে, উৎপাদন বৃদ্ধি করে, অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস করে এবং সমাজে শান্তি আনে। ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে তৃতীয়টি হচ্ছে যাকাত। ঈমানের পর সালাত এবং তার পরই যাকাতের স্থান।
যাকাত ইসলামের অন্যতম রুকন বা স্তম্ভ। অধিক সাওয়াবের আশায় অনেকে রমযান মাসে যাকাত আদায় করে থাকে। যদিও যাকাতের সঙ্গে রমযানের সম্পর্ক নেই, তথাপি এ মাসে যাকাত আদায় করা অধিক সওয়াবের কাজ।
পূর্ববর্তী আসমানি ধর্মে যাকাত: যাকাতব্যবস্থা অতীতের সব নবীর উম্মতের ওপর অবশ্য পালনীয় ছিল। তবে সম্পদের পরিমাণ ও ব্যয়ের খাত বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ছিল। যেমনÑ ইবরাহিম (আ.) ও তাঁর বংশের নবীদের কথা উল্লেখ করার পর আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘আর তাদের করেছিলাম নেতা। তারা আমার নির্দেশ অনুসারে মানুষকে পথ প্রদর্শন করত। তাদের ওহি প্রেরণ করেছিলাম সৎকর্ম করতে, নামায কায়েম করতে এবং যাকাত প্রদান করতে।’ (সূরা আম্বিয়া : ৭৩)। ইসমাঈল (আ.) সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘সে তার পরিবার-পরিজনকে নামাজ ও যাকাতের নির্দেশ দিত।’ (সূরা মারইয়াম : ৫৫)
ঈসা (আ.)-এর প্রসঙ্গে এসেছে, তিনি বলেছেন, ‘যেখানেই আমি থাকি না কেন, তিনি আমাকে বরকতময় করেছেন। তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন যতদিন জীবিত থাকি, ততদিন সালাত ও যাকাত আদায় করতে।’ (সূরা মারইয়াম : ৩১)। মোটকথা, প্রাচীনকাল থেকেই সব নবী-রাসূলের উম্মতের ওপর সালাত ও যাকাত ফরজ হিসেবে পালনীয় ছিল। তবে মুসলমানদের ওপর ধনীদের সম্পদ পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে হিসাব করে প্রতি বছর যাকাত আদায় বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
কার ওপর যাকাত ফরজ : যাকাত স্বাধীন, পূর্ণবয়স্ক এমন মুসলিম নর-নারী আদায় করবে, যার কাছে নিসাব পরিমাণ সম্পদ আছে। তবে এর জন্য শর্ত হলোÑ এক. সম্পদের ওপর পূর্ণাঙ্গ মালিকানা থাকতে হবে। দুই. সম্পদ উৎপাদনক্ষম ও বর্ধনশীল হতে হবে। তিন. নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকতে হবে। চার. সারা বছরের মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর পর অতিরিক্ত সম্পদ থাকলেই শুধু যাকাত ফরজ হবে। পাঁচ. যাকাত ফরজ হওয়ার জন্য ঋণমুক্ত হওয়ার পর নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকা শর্ত। ছয়. কারো কাছে নিসাব পরিমাণ সম্পদ পূর্ণ এক বছর থাকলেই শুধু ওই সম্পদের ওপর যাকাত দিতে হবে।
যাকাতের নিসাব ও হিসাব : ক. সোনা ৭.৫ তোলা=৯৫.৭৪৮ গ্রাম (প্রায়)। খ. রুপা ৫২.৫ তোলা=৬৭০.২৪ গ্রাম (প্রায়)। (আহসানুল ফাতাওয়া : ৪/৩৯৪; আল ফিকহুল ইসলামী : ২/৬৬৯)। দেশি-বিদেশি মুদ্রা ও ব্যবসায়িক পণ্যের নিসাব নির্ধারণে সোনা-রুপা হলো পরিমাপক। এ ক্ষেত্রে ফকির-মিসকিনদের জন্য যেটি বেশি লাভজনক হবে, সেটিকে পরিমাপক হিসেবে গ্রহণ করাই শরিয়তের নির্দেশ। তাই মুদ্রা ও পণ্যের বেলায় বর্তমানে রুপার নিসাবই পরিমাপক হিসেবে গণ্য হবে। যার কাছে সাড়ে ৫২ তোলা সমমূল্যের দেশি-বিদেশি মুদ্রা বা ব্যবসায়িক পণ্য মজুদ থাকবে, তার ওপর যাকাত ওয়াজিব হবে। যে সম্পদের ওপর যাকাত ফরজ, তার ৪০ ভাগের এক ভাগ (২.৫০ শতাংশ) যাকাত দেওয়া ফরজ। সম্পদের মূল্য নির্ধারণ করে শতকরা আড়াই টাকা বা হাজারে ২৫ টাকা হারে নগদ অর্থ কিংবা ওই পরিমাণ টাকার কাপড়চোপড় বা অন্য কোনো প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনে দিলেও যাকাত আদায় হবে। (আবু দাউদ, সুনানে তিরমিযী)।
যেসব সম্পদে যাকাত ফরজ : সব ধরনের সম্পদে যাকাত ফরজ হয় না। শুধু সোনা-রুপা, টাকা-পয়সা, পালিত পশু (নির্ধারিত নিয়ম অনুযায়ী) এবং ব্যবসার পণ্যে যাকাত ফরজ হয়। সোনা-রুপার অলংকার সবসময় বা কালেভদ্রে ব্যবহৃত হোক কিংবা একেবারেই ব্যবহার না করা হোক, সর্বাবস্থায় তার যাকাত দিতে হবে। (আবু দাউদ)। অলংকার ছাড়া সোনা-রুপার অন্যান্য সামগ্রীর ওপরও যাকাত ফরজ। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক)। মৌলিক প্রয়োজন থেকে উদ্বৃত্ত টাকা-পয়সা নিসাব পরিমাণ হলে এবং এক বছর স্থায়ী হলে বছর শেষে তার যাকাত আদায় করা ফরজ। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক)। ব্যাংক ব্যালান্স, ফিক্সড ডিপোজিট, বন্ড, শেয়ার সার্টিফিকেট ইত্যাদিও নগদ টাকা-পয়সার মতোই। এসবের ওপরও যাকাত ফরজ। টাকা-পয়সা ব্যবসায় না খাটিয়ে এমনি রেখে দিলেও তাতে যাকাত ফরজ। (আদ্দুররুল মুখতার)।
হজের উদ্দেশ্যে কিংবা ঘরবাড়ি নির্মাণ, ছেলে-মেয়ের বিয়েশাদি ইত্যাদি প্রয়োজনের জন্য যে অর্থ সঞ্চয় করা হয়, তারও যাকাত দিতে হবে। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা)। দোকানপাটে যা কিছু বিক্রির উদ্দেশ্যে রাখা থাকে, তা বাণিজ্যিক পণ্য। এর মূল্য নিসাব পরিমাণ হলে যাকাত আদায় করা ফরজ। (সুনানে আবু দাউদ)। ব্যবসার নিয়তে কোনো কিছু ক্রয় করলে, তা স্থাবর সম্পত্তি হোক, যেমনÑ জমিজমা, ফ্ল্যাট কিংবা অস্থাবর সম্পত্তি, যেমন- মুদিসামগ্রী, কাপড়চোপড়, অলংকার, নির্মাণসামগ্রী, গাড়ি, ফার্নিচার, ইলেকট্রনিক সামগ্রী, হার্ডওয়্যার সামগ্রী, বইপুস্তক ইত্যাদি, তা বাণিজ্যিক পণ্য বলে গণ্য হবে এবং মূল্য নিসাব পরিমাণ হলে যাকাত দিতে হবে। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক)। যদি সোনা-রুপা, টাকা-পয়সা কিংবা বাণিজ্যিক পণ্যের মধ্যে কোনোটি পৃথকভাবে নিসাব পরিমাণ না থাকে, কিন্তু এসবের একাধিক সামগ্রী এ পরিমাণ রয়েছে, যা একত্র করলে সাড়ে ৫২ তোলা রুপার সমমূল্য বা তার চেয়ে বেশি হয়, তাহলে এক্ষেত্রে সব সম্পদ হিসাব করে যাকাত দিতে হবে। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক)।
ভূমি বা প্লটের যাকাত : এক. যদি ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে ভূমি বা প্লট ক্রয় করা হয়, তাহলে প্রতি বছর ভূমি বা প্লটের বাজারমূল্য বিবেচনা করে যাকাত দিতে হবে। উদাহরণস্বরূপ- কেউ যদি পাঁচ লাখ টাকায় পাঁচটি প্লট ক্রয় করে, তারপর এক বছরের মাথায় ওই প্লটের বাজারমূল্য সাত লাখ টাকা হয়ে যায়, তাহলে তাকে সাত লাখ টাকার যাকাত দিতে হবে।
দুই. যদি নিজের বসবাসের জন্য ক্রয় করা হয়, তাহলে ওই প্লটের যাকাত দিতে হবে না। তাছাড়া ব্যবসা বা বসবাসের উদ্দেশ্য ছাড়া এমনিতে ক্রয় করলেও ওই জমি বা প্লটের যাকাত দিতে হবে না। (আপকে মাসায়েল আওর উনকা হল, তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৮৪)
দোকানের পণ্যের যাকাত : দোকানের ডেকোরেশন, আলমারি, তাক ইত্যাদি মূল্যের ওপর যাকাত ফরজ নয়, বরং সেল বা বিক্রি করার জন্য যেসব পণ্য বিদ্যমান, তার মূল্য যদি নিসাব পরিমাণ হয়, তাহলে তার যাকাত ফরজ হবে। যাকাত হিসাব করার পদ্ধতি হলো, বছরের একটা সময় দিন-তারিখ নির্ধারণ করে দোকানে বিদ্যমান পণ্যের মূল্যের হিসাব করে দেখা গেল, পাঁচ লাখ টাকার পণ্য আছে। অতঃপর ওই বছর অতিবাহিত হওয়ার পর আবার আনুমানিক পণ্যের মূল্য ধরে দেখা গেল, শুরুতে যে পরিমাণ সম্পদ ছিল, তা নিসাব পরিমাণ। আবার এক বছর অতিবাহিত হওয়ার পর যে পণ্য আছে, তা-ও নিসাব পরিমাণ, তাহলে সমুদয় সম্পদের আড়াই শতাংশ যাকাত দিতে হবে। (তাতারখানিয়া; হিন্দিয়া; দুররুল মুখতার)।
ব্যাংকে সঞ্চয়কৃত টাকার যাকাত: কোনো ব্যক্তি সঞ্চয়ের জন্য যদি ব্যাংকে টাকা জমা রাখে, তাহলে ঋণমুক্ত অবস্থায় যেদিন তার জমাকৃত টাকা নিসাব পরিমাণ হবে, সেদিন থেকে এক বছর পূর্ণ হলে ওই টাকার ওপর যাকাত দিতে হবে। (ফাতাওয়া আলমগিরি; মাহমুদিয়া)।
দোকানের অ্যাডভান্স টাকায় যাকাত : বর্তমানে গাড়ি বা দোকান ভাড়া নেওয়ার সময় মোটা অঙ্কের টাকা অ্যাডভান্স রাখতে হয়। অ্যাডভান্সের এ টাকা গাড়ি বা দোকানের মালিকের হয়ে যায় না, বরং যিনি ভাড়া নিচ্ছেন, তাঁর মালিকানায় এ টাকা রয়ে যায়। তাই নিসাবের পরিমাণ হলে ওই টাকাসহ যাকাত দিতে হবে। দোকান বা বাড়িভাড়া গ্রহণকারী ব্যক্তির জন্য ওই টাকার যাকাত আদায় করা জরুরি। (আদ্দুররুল মুখতার, ফাতাওয়া দারুল উলুম)।
প্রভিডেন্ট ফান্ডের যাকাতের বিধান : সরকারি কর্মচারীদের বেতন থেকে প্রভিডেন্ট ফান্ডের জন্য বাধ্যতামূলক যে পরিমাণ টাকা কর্তন করে রাখা হয়, সেই পরিমাণ অর্থ উত্তোলনের আগে কর্মচারীর মালিকানায় আসে না। তাই সরকারি প্রভিডেন্ট ফান্ডে অর্থ থাকাকালে তার ওপর যাকাত দিতে হবে না। এ কারণে ওই ফান্ডের টাকা পাওয়ার পর বিগত বছরের যাকাতও দিতে হবে না। তবে যদি কর্মচারী ওই প্রভিডেন্ট ফান্ডের সঞ্চিত অর্থ অন্য কোনো ইনস্যুরেন্স কোম্পানিতে স্থানান্তর করিয়ে নেন, সেক্ষেত্রে ওই অর্থ স্বতন্ত্রভাবে বা অন্য যাকাতযোগ্য মালের সঙ্গে যোগ হয়ে নিসাব পরিমাণ হলে যথানিয়মে তার ওপর যাকাত ওয়াজিব হবে। (আহসানুল ফাতাওয়া)। বীমায় যে পরিমাণের টাকা কাজে লাগানো হয়েছে, তার ওপর যাকাত ওয়াজিব। প্রতিবছর যাকাত আদায় করার সময় নিজ সম্পদের হিসাব করতে হবে। (ফাতাওয়া উসমানি)। কোম্পানির অংশ ক্রয় করা এই শর্তে জায়েজ আছে যে তার লেনদেন যদি বৈধ হয়। এক্ষেত্রে তার অংশের মূল্যের ওপর যাকাত ওয়াজিব হবে। (ফাতাওয়া উসমানি)।
গরু, বকরি ও মুরগির ফার্মের যাকাত : ব্যবসার জন্য গরু, বকরি বা মুরগির ফার্ম করা হয়। ওই ফার্মের লালিত প্রাণী একপর্যায়ে বিক্রি করা হয়। এসব প্রাণীর বিক্রয়মূল্য যদি নিসাব পরিমাণ হয়, তাহলে তার যাকাত দেওয়া আবশ্যক। (ফাতাওয়া উসমানি)।
যাদের যাকাত দেওয়া যাবে না : এক. অমুসলিম, তবে তাদের সাদাকা বা যেকোনো স্বেচ্ছা দান করা যাবে। দুই. নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক। তিন. নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিকের নাবালক সন্তান। চার. বনু হাশেমের লোক। পাঁচ. মা-বাবা, দাদা-দাদি, নানা-নানি একইভাবে যত ওপরের স্তরের দিকের কাউকে যাকাত দেওয়া যাবে না। অর্থাৎ যাদের মাধ্যমে দুনিয়ায় এসেছ, তাদেরসহ ওপরের স্তরের কাউকে যাকাত দেওয়া যাবে না। ছয়. নিজের মাধ্যমে যারা দুনিয়ায় এসেছে, অর্থাৎ ছেলে-মেয়ে ও তাদের সন্তানাদি, একইভাবে তাদের সন্তানদের যাকাত দেওয়া যাবে না। সাত. স্ত্রী ও স্বামী একে অন্যকে যাকাত দিতে পারবে না। আট. মসজিদ-মাদরাসা, পুল, রাস্তা, হাসপাতাল বানানোর কাজে ও মৃতের দাফনের কাজে যাকাতের টাকা দেওয়া যাবে না। (ফাতাওয়া হিন্দিয়া)।
ভাই-বোনকে যাকাত দেওয়া যাবে? সহোদর ভাই-বোন, ফুফু-ফুফা, খালা-খালু, মামা-মামি যেহেতু উসুল বা ফুরু অর্থাৎ যাকাতদাতার মূল বা শাখা নয়, তাই তাদের যাকাত দেওয়া যাবে, যদি তারা যাকাত গ্রহণের উপযোগী হয়। এমনিভাবে যাকাতের টাকা দিয়ে কাপড় কিনে দিলেও যাকাত আদায় হয়ে যাবে। অন্তরে যাকাতের নিয়ত রেখে মুখে তা উল্লেখ না করে দিয়ে দিলেও যাকাত আদায় হয়ে যাবে। (হিদায়া)
যাকাত আদায়ের খাতসমূহ: যাকাত আদায়ের খাত সরাসরি কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। এরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই যাকাত ফকির, মিসকিন ও সেই সব কর্মচারীর জন্য, যারা সদকা উসুলের কাজে নিয়োজিত এবং যাদের চিত্ত আকর্ষণ করা হয় তাদের জন্য। আর দাসমুক্তির জন্য, ঋণগ্রস্তদের ঋণ পরিশোধ, আল্লাহর পথে ও মুসাফিরদের (সাহায্যের) জন্য। এটা আল্লাহর বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।’ (সূরা তওবা : ৬০)।
আলোচ্য আয়াতে আটটি খাতে যাকাতের অর্থ ব্যয় করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কুরআনে উল্লিখিত আট ধরনের লোকদের মধ্যে এক প্রকার হলো, কাফির বা দুর্বল ঈমানের মুসলমানদের মনোরঞ্জনের জন্য যাকাত দেওয়া। হযরত ওমর (রা.)-এর শাসনামলে ইসলামের বহুমুখী প্রসার, ইসলামী রাষ্ট্রের সম্প্রসারণ ও মুসলমানদের ব্যাপক শক্তি অর্জিত হওয়ার পর অমুসলিমদের যাকাত দেওয়ার বিধান রহিত হয়ে যায়। ওই সময়ে সব সাহাবায়ে কেরাম হযরত ওমর (রা.)-এর এ সিদ্ধান্তে একমত পোষণ করেন। অবশিষ্ট সাত ধরনের লোক হলো : এক. ফকির বা অভাবগ্রস্ত। হানাফি মাজহাব মতে, ফকির বলা হয় ওই ব্যক্তিকে, যার মালিকানায় যাকাতের নিসাব পরিমাণ সম্পদ নেই, যদিও ওই ব্যক্তি কর্মক্ষম ও কর্মরত হয়। দুই. মিসকিন বা নিঃস্ব। মিসকিন বলা হয় ওই ব্যক্তিকে, যার মালিকানায় কোনো ধরনের সম্পদ নেই।
লক্ষণীয় যে নিজের মা-বাবা, দাদা-দাদি, নানা-নানি, ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনি ফকির-মিসকিন হলেও তাদের যাকাত দেওয়া যাবে না। পক্ষান্তরে নিজের ভাই-বোন, চাচা, ফুফু, খালা, মামা, সন্তান, শ্বশুর-শাশুড়ি, জামাতা নিঃস্ব ও অভাবগ্রস্ত হলে তাদের যাকাত দেওয়া যাবে।
তিন. আমেল তথা যাকাতের অর্থ সংগ্রহকারী। ইসলামী সরকারের পক্ষ থেকে যাকাত সংগ্রহে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের আমেল বলা হয়। তাঁদের সংগৃহীত যাকাতের সম্পদ থেকে বিনিময় দেওয়া বৈধ। তবে বর্তমানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কর্তৃক যাকাত সংগ্রহে নিয়োজিত ব্যক্তিদের কমিশন হারে যাকাত থেকে বিনিময় দেওয়া কোনোভাবেই শরিয়তসম্মত নয়। চার. গোলাম বা দাস মুক্তির জন্য যাকাত দেওয়া। বর্তমানে এ খাতও বিদ্যমান নেই। পাঁচ. ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি। কোনো ব্যক্তি এ পরিমাণ ঋণগ্রস্ত হলে তাকে যাকাত দেওয়া যাবে, যার ঋণ আদায় করার পর তার কাছে নিসাব পরিমাণ সম্পদ অবশিষ্ট থাকে না।
ছয়. আল্লাহর রাস্তায় থাকা ব্যক্তি। যেসব মুসলমান আল্লাহর পথে রয়েছে, তাদের কাছে প্রয়োজনীয় অর্থ-সম্পদ না থাকলে তাদের যাকাত দেওয়া যাবে। বেশির ভাগ উলামায়ে কেরাম ও ইমামের মতে, ‘আল্লাহর রাস্তা’ বলতে এখানে আল্লাহর পথে যুদ্ধরত ব্যক্তিদের বোঝানো হয়েছে।
সাত. মুসাফির। কোনো ব্যক্তি যদি নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়া সত্ত্বেও কোথাও সফরে এসে সম্পদশূন্য হয়ে পড়ে, তাহলে তাকে বাড়িতে পৌঁছার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ যাকাত হিসেবে দেওয়া যাবে।
উল্লিখিত সব খাতে অথবা যেকোনো একটি খাতে যাকাত দিলে যাকাত আদায় হয়ে যাবে। এ খাতগুলো ছাড়া অন্য কোনো খাতে যাকাত দিলে যাকাত আদায় হবে নাÑ সেটি যতই ভালো কাজ হোক না কেন। তাই মসজিদ-মাদরাসা নির্মাণ, হাসপাতাল, রাস্তাঘাট, সেতু ইত্যাদি নির্মাণ এবং কোনো প্রকল্প, যেখানে কোনো ব্যক্তিকে মালিক বানিয়ে দেওয়া সম্ভব নয় এমন খাতে যাকাতের অর্থ ব্যয় করলে যাকাত আদায় হবে না। সেটি পুনরায় আদায় করতে হবে। কেননা যাকাত আদায় হওয়ার জন্য কোনো ব্যক্তিকে মালিক বানিয়ে দেওয়া অপরিহার্য। তবে মাদরাসায় এতিম, অসহায় ও দরিদ্র ছাত্রদের ভরণ-পোষণের জন্য যাকাত দেওয়া যাবে। স্মরণ রাখতে হবে, সমাজের দারিদ্র্যকে ঐশী নিয়মে সমূলে দূরীকরণই যাকাতের কাজ। সাময়িক অভাব পূরণের জন্য যাকাত নয়। সাময়িক অভাব পূরণের জন্য ইসলাম সদকা, ফিতরাসহ অন্যান্য দানের বিধান রেখেছে। তাই দারিদ্র্যবিমোচনের লক্ষ্যে পরিকল্পনা অনুযায়ী যাকাত দিতে হবে। যাকাত আদায়ের সর্বোত্তম পদ্ধতি হলো যাকে যাকাত দেবে, তার মৌলিক অভাব পূরণ করে দিতে চেষ্টা করবে। তাকে যেন আর কারো কাছে হাত বাড়াতে না হয়।
শাড়ি-লুঙ্গি দিলে কি যাকাত হবে? শাড়ি-লুঙ্গি দিয়ে যাকাত আদায়ের একটি ধারা প্রচলিত আছে বাংলাদেশের ধনাঢ্য শ্রেণির মধ্যে। সাধারণত রমযানের শেষভাগে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যাকাতের শাড়ি-লুঙ্গি প্রদানের ঘোষণা দেওয়া হয়। এলাকার শিল্পপতি ও বিশিষ্টজনরাই এ ঘোষণা দিয়ে থাকেন। ঘোষণার দিন সকাল থেকে মানুষ লাইন দেয়। দীর্ঘ অপেক্ষার পর তারা শাড়ি বা লুঙ্গি পায়। আবার কেউ কেউ খালি হাতেই ফেরে। নিকট-অতীতে যাকাতের শাড়ি-লুঙ্গি নিতে এসে পদপিষ্ট হয়ে নিহত হওয়ার ঘটনাও দেখা যায়। অন্যদিকে রমযান মাসে বিভিন্ন মার্কেট ও শপিংমলের সামনে ‘এখানে যাকাতের শাড়ি-লুঙ্গি পাওয়া যায়’ মর্মে নোটিশ ঝোলাতে দেখা যায়। যাকাতের শাড়ি-লুঙ্গির অর্থ হলো সাধারণ মানের চেয়েও একটু নিম্নমানের কাপড়। এভাবে যাকাত প্রদানের আগে বিপুল প্রচারণা ও নিম্নমানের কাপড় দিয়ে তা আদায় করা কি ঠিক?
এ বিষয়ে ইসলামী আইনজ্ঞরা বলেন, নগদ টাকা দিয়ে যাকাত আদায় করা উত্তম, যেন যাকাতগ্রহীতা নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী তা ব্যয় করতে পারে। গ্রহীতার প্রয়োজন বিবেচনা না করে ঢালাওভাবে শাড়ি-কাপড় ইত্যাদি দ্বারা যাকাত আদায়ের প্রচলনটি ঠিক নয়। এতে কখনো এমন হয় যে এক গরিব একাধিক কাপড় পায় অথচ তার চাল-ডাল বা অন্য কিছুর প্রয়োজন ছিল। তখন সে তার কাপড়টি নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করে; যার অর্থ দাঁড়ায়, গরিব ব্যক্তি পুরো টাকাটা পেল না। অবশ্য কেউ যদি যাকাতের টাকা দ্বারা কাপড় কিনে তা গরিবদের দিয়ে দেয়, তাতেও যাকাত আদায় হয়ে যাবে। তবে কাপড় বা যে জিনিসই দেওয়া হোক, এক্ষেত্রে গ্রহীতার কী ধরনের জিনিস প্রয়োজন সে বিষয়টি দৃষ্টিতে রাখা উচিত।
একইভাবে যাকাত আদায়ের আগে ব্যাপক প্রচারণা, যাকাত প্রদানের দৃশ্য ধারণ করে গণমাধ্যমে প্রচার করা এবং সাধারণ মানের চেয়ে নিম্নমানের কাপড় দেওয়া যাকাতের মহিমাকে ক্ষুণ্ন করে। সামর্থ্যবান ব্যক্তির জন্য যাকাত প্রদান করা ফরজ ইবাদত। ইবাদতের ক্ষেত্রে প্রচার ও প্রদর্শন নিন্দনীয় ও বর্জনীয়। আর সাধারণ মানের চেয়ে নিম্নমানের কাপড় দেওয়া মানুষের প্রতি অসম্মানের শামিল। অথচ আল্লাহ তায়ালা মানুষকে সম্মানিত করেছেন। ধনী-গরিব সবারই মানুষ হিসেবে এ সম্মান প্রাপ্য। (তথ্যসূত্র : সূরা : বনি ইসরাঈল : ৭০ ও সূরা : মাউন  : ৬-৭; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, বর্ণনা ১০৫৩৯; কিতাবুল আসল ২/১০৪; বাদায়েউস সানায়ে ২/১৪৬; আলবাহরুর রায়েক ২/২২১; ফাতহুল কাদির ২/১৪৫)
যাকাতের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো জরুরি : অর্থনীতিবিদদের মতে, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ২৫ শতাংশ যাকাত প্রদানের সার্মথ্য রাখে এবং তাদের থেকে বছরে ৩০ হাজার কোটি টাকা যাকাত আদায় করা সম্ভব। কিন্তু ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগে তার খুব সামান্য অংশই আদায় হয়। গত ৪ মে ২০১৯ ঢাকার কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে সেন্টার ফর যাকাত ম্যানেজমেন্ট আয়োজিত এক সেমিনারে দেশের বরেণ্য অর্থনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীরা এসব তথ্য তুলে ধরেন। তাঁরা আরো বলেন, ব্যক্তি ও করপোরেট অফিসগুলো নিজস্ব উদ্যোগে যাকাত দেওয়ায় দরিদ্র ব্যক্তি সাময়িকভাবে উপকৃত হলেও যাকাতের দীর্ঘমেয়াদি সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। দারিদ্র্যবিমোচনে যাকাতের কাক্সিক্ষত সুফলও আসছে না। সেমিনারে আলোচকরা যাকাত ব্যবস্থাপনায় সমন্বয়, প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার ওপর গুরুত্ব দেন। (সূত্র : কালের কণ্ঠ, ৫ মে ২০১৯)।
রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা, উদ্যোগ ও বাধ্যবাধকতা না থাকায় যাকাত দেওয়া ফরজ এমন বহুসংখ্যক মানুষ যাকাত দিচ্ছে না। অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় করব্যবস্থা যাকাতের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ না হওয়ায় যাকাত বোঝায় পরিণত হচ্ছে সাধারণ মানুষের ওপর। একইভাবে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সংগৃহীত যাকাতের অর্থের পরিমাণ ও তা ব্যয়ের খাত সম্পর্কেও মানুষের স্বচ্ছ ধারণা নেই। ফলে তারা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার প্রতি আস্থাশীল হতে পারছে না। অথচ সঠিক ব্যবস্থাপনা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা গেলে ৩০ হাজার কোটি টাকা বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে দারিদ্র্যবিমোচনে যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে পারত। এ বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে সমাজের পিছিয়ে পড়া মুসলিম জনগোষ্ঠীর শিক্ষা, চিকিৎসা, পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা যেতে পারে। গবেষকদের দাবি, সঠিক ব্যবস্থাপনায় যাকাতের অর্থ বণ্টন করা হলে মাত্র ১০ বছরে দারিদ্র্য শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনা সম্ভব। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি সামাজিক নিরাপত্তার অন্যতম অনুষঙ্গ। এ নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই।


অন্যান্য মিডিয়া bdnews24 RTNN Sheersha News barta24 Prothom Alo Daily Nayadiganta Jugantor Samakal Amardesh Kaler Kantho Daily Ittefaq Daily Inqilab Daily Sangram Daily Janakantha Amader Shomoy Bangladesh Pratidin Bhorerkagoj Daily Dinkal Manob Zamin Destiny Sangbad Deshbangla Daily Star New Age New Nation Bangladesh Today Financial Express Independent News Today Shaptahik 2000 Computer Jagat Computer Barta Budhbar Bangladesherkhela Holiday Bangladesh Monitor BBC Bangla Pars Today
homeabout usdeveloped by

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ মো. তাসনীম আলম।

এটিএম সিরাজুল হক কর্তৃক হক প্রিন্টার্স ১০/৮ আরামবাগ, ঢাকা-১০০০ হতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। যোগাযোগের ঠিকানাঃ ৪২৩ এলিফেন্ট রোড, বড় মগবাজার, ঢাকা - ১২১৭।

ফোন: ৮৮ ০২ ৪৮৩১৯০৬৫, ই-মেইল: sonarbanglaweekly@gmail.com, weeklysonarbangla@yahoo.com, সার্কুলেশন: ০১৫৫২৩৯৮১৯০, বিজ্ঞাপন: ৪৮৩১৫৫৭১, ০১৯১৬৮৬৯১৬৮, ০১৭৩৪০৩৬৮৪৬।