মেঘনায় লঞ্চডুবি, ১১০ লাশ উদ্ধার

শরীয়তপুর থেকে ঢাকাগামী শরীয়তপুর-১ লঞ্চটি গত ১৩ মার্চ মঙ্গলবার মুন্সিগঞ্জের চররমজান বেগ এলাকায় মেঘনা নদীতে মালবাহী জাহাজের সঙ্গে ধাক্কা লেগে ডুবে যায়। লাশ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন স্বজনরা

নিখোঁজ শতাধিক, তিনটি তদন্ত কমিটি

সোনার বাংলা রিপোর্ট
গজারিয়ার মেঘনা নদীতে প্রায় ৩শ’ যাত্রী নিয়ে ডুবে যাওয়া এম.ভি শরীয়তপুর-১ লঞ্চটি থেকে শিশু ও নারীসহ ১১০টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। নিখোঁজ রয়েছে শতাধিক। লঞ্চটি গত ১৩ মার্চ মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ৭০ ফুট পানির নিচে ছিল বলে জানা গেছে। উদ্ধারকারী জাহাজ রুস্তম ঘটনাস্থলে পৌঁছে ডুবে যাওয়া লঞ্চটিকে রশি দিয়ে বেঁধেছে। অপর উদ্ধারকারী জাহাজ হামজা এসে পৌঁছানোর পর এটিকে টেনে তোলার ব্যবস্থা করা হবে। দমকল বাহিনী, স্থানীয় প্রশাসন, নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড ও বিআইডব্লিউটিএ’র ডুবুরিরা উদ্ধার তৎপরতা অব্যাহত রেখেছেন। লঞ্চডুবির ঘটনা তদন্তে তিনটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিগুলোকে পাঁচ থেকে সাতদিনের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। বিআইডব্লিউটিএ চেয়ারম্যান ড. শামসুদ্দোহা খন্দকার জানান, মেঘনার দুই কিলোমিটার চওড়া মূল চ্যানেলে লঞ্চটির সন্ধান মিলেছে। এই স্থানে গভীরতা  ৭০ ফুটের মতো। লঞ্চটিতে আড়াইশ’ থেকে তিনশ’ যাত্রী ছিল বলে তিনি উল্লেখ করেন। বিআইডব্লিউটিএ’র সচিব মাহবুবুর আলম বলেন, লঞ্চটি ১৯৯১ সালে তৈরি এবং এটির ২২৫ জন যাত্রী নিয়ে রাতে চলাচলের অনুমোদন রয়েছে। লঞ্চটির দৈর্ঘ্য ৩২ মিটার ও প্রস্থ ৮ মিটার। লঞ্চটির ভেতর ঘুরে আসা ডুবুরিরা জানিয়েছেন, এর ভেতরে বেশকিছু বস্তা রয়েছে। এগুলো সরিয়ে আনা না হলে লঞ্চটি টেনে তোলা কঠিন হবে। সোমবার রাত সাড়ে ৯টায় দ্বিতল লঞ্চটি শরীয়তপুরের নড়িয়া থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়। লঞ্চ মালিক সমিতির নেতা কলিমুল্লাহ জানান, ডুবে যাওয়া লঞ্চের মালিক শরিয়তপুরের ফিরোজ চৌধুরী।

পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গত ১২ মার্চ সোমবার রাত দেড়টার দিকে চর কিশোরী ও চর মুন্সীগঞ্জের মাঝামাঝি এলাকায় একটি কার্গো লঞ্চের সঙ্গে ধাক্কা লেগে যাত্রীবাহী লঞ্চটি ডুবে যায়। লঞ্চে অন্তত তিনশ’ যাত্রী ছিল বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। ৪০-৪৫ জনের মতো যাত্রী তীরে উঠতে সক্ষম হলেও বাকিদের ভাগ্যে কি ঘটেছে, তা এখনো অনিশ্চিত। চাঁদপুর থেকে ঢাকাগামী মিতালী নামের একটি লঞ্চ ডুবে যাওয়া লঞ্চের ৩০-৩৫ জন যাত্রীকে উদ্ধার করে বলে জানা গেছে। খবর পাওয়া মাত্র ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে স্বজনদের খুঁজতে হাজারো মানুষ ঘটনাস্থলে ভিড় করেন। ডুবে যাওয়া যাত্রীদের স্বজনদের কান্নায় ভারী হয়ে ওঠে এলাকার পরিবেশ।

বেঁচে যাওয়া লঞ্চযাত্রী দুলাল দেওয়ান জানান, একটি কার্গো লঞ্চের ধাক্কায় রাত আড়াইটায় যাত্রীবাহী লঞ্চটি মুহূর্তে ডুবে যায়। দুলাল দেওয়ান বেঁচে গেলেও তার পরিবারের ৮ জন নিখোঁজ রয়েছেন। এদের মধ্যে তার শ্যালক শামীম ফকির ও তার স্ত্রী পলির মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার ফ্লাইটে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার কথা ছিল। এ রকম দু’শতাধিক যাত্রী নিখোঁজ রয়েছেন বলে তিনি জানান। বেঁচে যাওয়া যাত্রী রাজু মিয়া জানান, আড়াইশ’ থেকে ৩শ’ যাত্রী ছাড়াও ৩শ’ বস্তা কাঁচা মরিচ ছিল লঞ্চটিতে। তিনি জানান, তার ভাই সেলিমকে (২২) এখনও পাওয়া যায়নি।

বেসরকারি টিভি চ্যানেল বাংলাভিশনের সিনিয়র ক্যামেরাম্যান মাসুদ চৌধুরী (৩০) নিখোঁজ রয়েছেন বলে তার ছোট ভাই মামুন চৌধুরী জানিয়েছেন। ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের ক্যামেরাম্যান মামুন চৌধুরী ভাইয়ের খোঁজ না পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি জানান, গ্রামের বাড়ি নড়িয়া থেকে সোমবার তিনি এই লঞ্চে ঢাকা রওনা হন। আবুল কালাম নামে আর একজন স্বজনদের খোঁজে ঢাকার মালিবাগ থেকে এসেছেন। তিনি জানান, ডুবে যাওয়া লঞ্চে তার ১৭ জন আত্মীয় ছিল। এদের মধ্যে চারজন ওই মিতালী লঞ্চে উঠতে পারলেও এখনও ১৩ জন নিখোঁজ রয়েছেন।

উদ্ধারকারী জাহাজ রুস্তমের কমান্ডার ফজলুর রহমান বলেন, ৬০ টনের অধিক হলে রুস্তম উদ্ধার করতে পারে না। এ লঞ্চে অনেক মালামাল ও অতিরিক্ত যাত্রী ছিল তাই প্রথমে কিছু মালামাল ও যাত্রী ডুবন্ত লঞ্চ থেকে বের করে আনা হচ্ছে। তাছাড়া উদ্ধারকারী জাহাজ হামজাও ঘটনাস্থলের উদ্দেশে রওনা হয়েছে।

তদন্ত কমিটি : নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব বায়তুল আমিনকে আহ্বায়ক করে ৫ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করে তাদের আগামী ৭ দিনের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। বিআইডব্লিউটিএ’র ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটির প্রধান পরিকল্পনা ও পরিচালন সদস্য মতিউর রহমান। এই কমিটিকে ৫ দিনের মধ্যে রিপোর্ট পেশ করবে।  এছাড়া সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।

নিহত ২০ জনের পরিচয় মিলেছে : ডুবে যাওয়া লঞ্চ থেকে  উদ্ধার করা ৩১টি লাশের মধ্যে ২০ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে। এরা হলেন, শরীয়তপুরের সালাউদ্দিন (৪০), সাদেক আলী (৫৫), বদরুন্নেছা (৫০), আলমগীর (৫০), আব্দুল লতিফ (২০), শবনম (২০), পারভেজ (২০), দিয়ানা (৭), মিলন (২২), বাদশা (৩২), হানিফ (৫০), আকাশ (৩২), জাকির, আলাউদ্দিন, শামসুদ্দিন, মিয়াজুল ইসলাম, বাচ্চু মিয়া, মো. মতিউর ও নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ এলাকার রুবেল (২০) ।