সংবাদ শিরোনামঃ

মহাবিপর্যয়ের দিকে বাংলাদেশ ** সংবিধান সংশোধনের নামে এমন কিছু করা ঠিক হবে না যা জাতিকে আরো বিভক্ত করে মুখোমুখি হতে প্রণোদিত করে ** রাজনৈতিক নিপীড়নের উদ্দেশ্যেই মুজাহিদকে শ্যোন অ্যারেস্ট ** পশ্চিমবঙ্গে লাল দুর্গের পতন ** জামায়াত গণমানুষের অধিকারের কথা বলে তাই সরকার নেতৃবৃন্দের উপর দলন-পীড়ন চালাচ্ছে ** সাহসী বুকে অব্যাহত থাকুক এ পথচলা ** বিসমিল্লাহ বর্জন : হিন্দুত্ববাদের অধীনস্থ করাই ল্য ** প্রচারের অভাবের পরেও ডাক বিভাগের মোবাইল মানিঅর্ডার জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ** গ্রামের পতিত জমিতে সূর্যমুখী ও কৃষকের হাসি ** গ্রাহাম ই ফুলারের ইসলামবিহীন পৃথিবী **

ঢাকা শুক্রবার ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪১৮, ১৫ জমাদিউস সানি ১৪৩২, ২০ মে ২০১১

মনসুর আহমদ
সৃষ্টি জগতের সমস্ত সৃষ্টির নিজ নিজ ভাষা আছে, কিন্তু সেসব ভাষায় নেই কোন পরিবর্তন বিবর্তন। কিন্তু আল্লাহ প্রদত্ত মানুষের ভাষায় রয়েছে ভাষাবৈচিত্র্য ও পরিবর্তন বিবর্তনের গতি। মানুষের ভাষা আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুদরতের নিদর্শন। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হচ্ছে, “তার নিদর্শনাবলীর অন্যতম নিদর্শন হল আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণবৈচিত্র্য নিশ্চয়ই এতে জ্ঞানীদের জন্য রয়েছে নিদর্শন।”

পৃথিবীতে রয়েছে কয়েক হাজার ভাষা। সময়ের স্রোতে প্রতিটি ভাষা কম বেশি তার রূপ বদলায়। আমাদের মাতৃভাষা বাংলাও বিভিন্ন সময় তার রূপ পাল্টিয়েছে। প্রতিটি ভাষার রূপের কারিগর ঐ ভাষাভাষী মানুষ। আমাদের মাতৃভাষা বাংলার যে সুন্দর রূপ বর্তমানে আমরা দেখতে পাই তার পেছনে রয়েছে বাঙালির বহু শতাব্দীর সাধনা।

বাঙালা ভাষা তার আধুনিক অর্থাৎ বাঙ্গালা রূপ গ্রহণ করেছিল খ্রিস্টীয় ১০০-এর দিকে। বাংলাদেশে আর্যদের আসার আগে এ দেশবাসী যে ভাষা ব্যবহার করতেন, তার কোন নিদর্শন আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। ঐতিহাসিকরা মনে করেন, বাংলাভাষার প্রাথমিক স্তর পঞ্চম থেকে দশম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় উ™à¦­à§‚ত হয়েছিল। বাংলাদেশে বাংলাভাষা ও বাংলা সাহিত্যের উদ্ভব ও প্রসার লাভ ঘটেছে বৌদ্ধ আমলে; বিশেষ করে স্বাধীন পাল রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায়। পাল এবং সেন বংশীয় রাজাদের আমলে বাঙালি জনগণ ও তাদের ভাষাও অন্যতম মুখ্য বিশিষ্টতা প্রাপ্ত হয়। নতুন ভাষা বাংলার  রূপ গ্রহণের সাথে সাথে বাঙালির মানসিক সংস্কৃতির এই ভাষার মাধ্যমে আত্ম প্রকাশের কাজে লেগে গেল- আনুমানিক দশম শতক হতে প্রাচীন বাংলায় রচিত বৌদ্ধ চর্যাপদকে অবলম্বন করে বাংলা ভাষার সাহিত্যিক ইতিহাস শুরু হল।

বাংলাভাষা ও সাহিত্যের যে রূপ নিয়ে আমরা গর্ব করি তা প্রকৃত প্রস্তাবে শুরু হয়েছিল বাংলাদেশে মুসলিম শাসনামল থেকে। গুপ্তদের শাসনামলে সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের যে চর্চা শুরু হয়, পাল ও সেন আমলে সে ধারা অব্যাহত থাকে। তবে বাংলাদেশের স্বাধীন শাসক পালদের আমলে দেশীয় ভাষা হিসেবে প্রথম বাংলার চর্চা শুরু হয়। বাংলাদেশে বাংলাভাষা ও বাংলা সাহিত্যের উদ্ভব ও প্রসার ঘটেছে বৌদ্ধ আমলে; বিশেষ করে স্বাধীন পাল রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায়। হিন্দু সেন রাজাদের আমলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য পৃষ্ঠপোষকতা থেকে বঞ্চিত হয়। সেন আমলে বাংলাভাষার চর্চা না হলেও এ ভাষার নিজস্ব সত্তা একেবারে লোপ পায়নি। স্বাভাবিকভাবে মুসলমানদের আগমনের পর মুক্ত পরিবেশে সাধারণের মুখের ভাষা বাংলার ব্যাপক চর্চার সুযোগ ঘটে।

বাংলাভাষা মুসলমান প্রভাবের পূর্বে অতীব অনাদর ও উপেক্ষায় আত্মপ্রকাশ করতেছিল। ইতরের ভাষা বলে বাংলাভাষা পণ্ডিত সমাজে অপাংক্তেয় ও উপেক্ষার পাত্র ছিল। মুসলমান বিজয় বাংলাভাষার জন্য শুভদিন বয়ে আনল। বাংলাভাষা-সাহিত্য তথা বাঙালির জন্য ১২০৫ খ্রিস্টাব্দে এক মহা ঐতিহাসিক ক্ষণ। তুর্কি মুসলিম সেনাপতি মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজি বাংলাদেশে মুসলিম রাজত্ব কায়েমের ফলে বাংলাভাষা ও সাহিত্যের নবজন্ম ঘটে। মুসলমান শাসক হুসেনশাহ, গৌড়ের সামসুদ্দিন ইউসুফ শাহ এবং অপরাপর মুসলমান সম্রাটেরা বাংলাদেশে বাংলাভাষাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে আমাদের সাহিত্যে এক নতুন যুগ সৃষ্টি করেছিলেন। এসব ইতিহাস সামনে রেখে শ্রী দীনেশ চন্দ্র সেন মন্তব্য করেন, “মুসলমান সম্রাটগণ বর্তমান বঙ্গ-সাহিত্যের এইরূপ জন্মদাতা বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। ... বঙ্গ সাহিত্য মুসলমানদেরই সৃষ্ট, বঙ্গভাষা বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা।”

মধ্য যুগে মুসলিম সুলতান ও অমাত্যগণের অকৃপণ পৃষ্ঠপোষকতায় হিন্দু মুসলিম উভয় কবিদের মিলিত প্রচেষ্টায় সুসমৃদ্ধ সাহিত্য গড়ে ওঠে। মধ্যযুগে আরবী-ফারসি-তুর্কি-উর্দু শব্দের সংমিশ্রণে বাংলা যেমন সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে, বাঙালি মুসলিম হিন্দু নির্বিশেষে সে ভাষায় কাব্যচর্চা করে বাংলা সাহিত্য ভাণ্ডারকে পূর্ণ করে তোলেন।

১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে বাংলার স্বাধীন সূর্য অস্তমিত হবার পর বাংলা সাহিত্যে আবার পালাবদল হল। পবিরর্তন ঘটল মুসলিম শাসনের সনাতন শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে গড়ে উঠতে লাগল ইংরেজ সৃষ্ট নতুন ইঙ্গ-হিন্দু মার্কা শিক্ষাব্যবস্থা। ফরাসির বদলে নতুন রাষ্ট্র ভাষা হল ইংরেজি। ইংরেজি ভাষা-সাহিত্যের প্রভাবে ইংরেজি পড়া বাঙালির হাতে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের গোড়াপত্তন হল।

ফোর্ট উইলিয়ামের সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতেরা বাংলাভাষা পণ্ডিতী রীতির জন্মদান করেন এবং বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১) তার প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন। তাদের আমলে বাংলাভাষা এক রকম বাঙালিত্ব বর্জন করে খাঁটি আর্য ভাষায় (সংস্কৃত) রূপান্তরিত হয়েছে। উল্লেখ করা যেতে পারে, আধুনিক বাংলার জনক নামে পরিচিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ভাষা এত খাঁটি ছিল যে, তার “বেতাল পঞ্চবিংশতি” ও “সীতার বনবাস” গ্রন্থদ্বয়ের শব্দ সম্ভারের শতকরা ৯০ থেকে ৯৯ ভাগ পর্যন্ত সংস্কৃত হয়ে উঠেছিল। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজকে কেন্দ্র করে যে বাংলা গদ্যের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয় বাঙালি হিন্দু সমাজ ছিল তার প্রধান রূপকার। বাঙালি মুসলমানদের তরফ থেকে এই প্রয়াসের বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ জ্ঞাপন করা হয়েছিল, দুর্ভাগ্যক্রমে তা বিশেষ আমলে আনা হয়নি।

ফোর্ট উইলিয়ামের পণ্ডিতেরা নির্মীয়মান বাংলা থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে আরবী-ফার্সি শব্দ বর্জন করেছিলেন। তারা বাংলাভাষার বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য এই শব্দ বর্জনের পরামর্শ দিয়েছিলেন। হিন্দু পণ্ডিতগণ এ আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন  করেছিলেন। কিন্তু মুসলমান কবিরা আরবি-ফার্সি শব্দাবলীকে বাংলা ভাষার নিজস্ব সম্পদ মনে করে তা বর্জন করতে রাজি হননি।

ফোর্ট উইলিয়ামের পণ্ডিতগণ ও তার পরবর্তী হিন্দু সাহিত্যিকগণ যাই করুন না কেন, বাঙালি মুসলমান লেখকগণ কিন্তু এই অভিনব গদ্য-পদ্যের ধারাকে কোনদিনই মনে প্রাণে গ্রহণ করতে পারেনি। ফলে তথাকথিত আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ধারা থেকে তারা বহুদিন ধরে দূরে অবস্থান করেছেন।

প্রকৃতপক্ষে প্যারীচাঁদের “আলালের ঘরের দুলাল” রচনাকাল থেকে আধুনিক বাংলা গদ্য রীতির একটি শক্তিশালী ধারার উদ্ভব ঘটে। বঙ্কিমচন্দ্র (১৮৩৮-১৮৯৪) আলালের ঘরের দুলালের ভাষা- রীতির দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে বাংলাগদ্য পুনর্নির্মাণের গরজ অনুভব করেছিলেন। বক্সিমমচন্দ্রের সমসাময়িক কালে মধুসূদনের আবির্ভাব। বিশাল প্রতিভার অধিকারী মধুসূদন বাংলায় প্রথম সার্থক মহাকাব্য, সনেট, গীতিকাব্য, নাটক ও প্রহসন রচনা করেন। মধুসূদনের পরে বাংলা সাহিত্যে যে যুগান্তকারী প্রতিভার আবির্ভাব ঘটে তিনি হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১)। তিনি নানা বৈচিত্র্যে ও অভূতপূর্বে অবদানে বাংলা সাহিত্যকে এক নতুন দিগন্তে পৌঁছে দেন।

রবীন্দ্রনাথের পরে বাংলা কাব্যের সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য কবি হলেন কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬)। রবীন্দ্রনাথের প্রভাব বলয় অতিক্রম করে তিনি বাংলা কাব্যে এক নতুন ধারার যুগান্তকারী বৈশিষ্ট্য নিয়ে আসেন। বাংলার যে একটি মুসলমানী রূপ আছে নজরুল ইসলাম তার কাব্যে সেটা সার্থকভাবে তুলে ধরেছেন। নজরুল ইসলাম বাংলা কাব্যে যে তেজস্বিতা, প্রাণময় উদ্দীপনা ও নতুন বৈশিষ্ট্য নিয়ে এলেন, তার সমকালে অনেক কবি তাতে অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলা কাব্যকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করে তোলেন।

এভাবে আমরা দেখতে পাই, মধ্যযুগের বাংলাভাষা ও সাহিত্যের উন্নতি ও শ্রীবৃদ্ধির মূলে রয়েছে মুসলমান আমীর-উমরাহ থেকে শুরু করে বিভিন্ন মুসলিম কবি সাহিত্যিক।

এরপরে গৃহীত লাহোর প্রস্তাব থেকে শুরু করে ১৯৪৭ সনে উপমহাদেশের মুসলমানদের জন্য স্বাধীন রাষ্ট্র পাকিস্তানের অভ্যুদয়ের প্রেক্ষাপটে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য এক নতুন আবহ সৃষ্টি হয়। ১৯৪০ সালের ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের সময় পর্যন্ত যদি ইতিহাস পর্যালোচনা করা যায়, তাহলে বিভিন্ন মুসলিম ব্যক্তিদের ঐতিহাসিক ভূমিকার পরিচয় দীপ্ত হয়ে উঠবে।

মাতৃভাষা বাংলার সাথে উর্দুর একটি প্রতিযোগিতা গড়ে উঠেছিল দেশ বিভাগের বেশ আগ থেকেই। একশ্রেণীর বাঙালি মুসলমানের মনে উর্দু প্রীতির উদ্ভব ঘটেছিল বিভিন্ন কারণে। যেমন, “যখন বাঙ্গালা সাহিত্য চর্চায় বাঙ্গলার মুসলমানগণের একটা ঘৃণা জন্মিয়া গেল, তখন তাহারা কোথাকার উর্দু ভাষাকে মাতৃভাষা বলিয়া বরণ করিয়া লইতে বৃথা চেষ্টা করিতে লাগিলেন।”

দেশ বিভাগের অনেক আগে, ১৯৪২ সালেরও আগে, ‘পূর্ব পাকিস্তান কথাটি’ একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও প্রতীক হিসেবে চালু হয়ে গিয়েছিল এবং বুদ্ধিজীবীদের মনোরাজ্যেও ঠাঁই করে নিয়েছিল। বস্তুতঃ  এ কারণেই সাবেক পাকিস্তান প্রতিষ্ঠারও বহুকাল আগে ১৯৪২ সালেই কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি এবং ঢাকায়’ পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ।’  দেশ বিভাগ ও (সাবেক) পকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হবার পর ‘পূর্ব পাকিস্তান’-এর রাষ্ট্র ভাষা কি হবে, এ নিয়ে রেনেসাঁ আন্দোলনের নায়করা চিন্তাভাবনা করেছিলেন দেশ বিভাগের বহু আগে, ১৯৪২-৪৩ সালেই। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগেই বাংলাভাষাকে নতুন রাষ্ট্রের, রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দানের দাবি উঠেছিল। বস্তুত সেকালেই ‘দৈনিক আজাদ’, ‘মাসিক মোহাম্মদী;, ‘সওগাত’ প্রভৃতি পত্রিকায় প্রবন্ধ ও অন্যান্য রচনার মাধ্যমে মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নিয়ে আন্দোলন শুরু করেন। ‘আজাদ’-এর প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ ছিলেন বাংলা ভাষার সুপণ্ডিত শক্তিমান লেখক, মাতৃভাষার প্রতি গভীর অনুরাগী ও শ্রদ্ধাশীল। ‘বাংলা ভাষা বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা কিনা’ এই হটকারী ও বিভ্রান্তিমূলক প্রশ্নের উত্তরে ১৩২৫ সালেই মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ বলেছিলেন-

‘দুনিয়ায় অনেক রকম অ™à¦­à§‚ত প্রশ্ন আছে, বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা কি? উর্দু না বাংলা? এই প্রশ্নটা তাহার মধ্যে সর্বাপেক্ষা অ™à¦­à§‚ত। নারিকেল গাছে নারিকেল ফলিবে না বেল? ... বঙ্গে মোছলেম ইতিহাসের সূচনা হইতে আজ পর্যন্ত বাংলাভাষাই তাহাদের লেখ্য ও কথ্য মাতৃভাষা রূপে ব্যবহৃত হইয়া আসিয়াছে এবং ভবিষ্যতেও মাতৃভাষা রূপে ব্যবহৃত হইবে।’

উর্দুকে মাতৃভাষা রূপে গ্রহণ করার মানসিকতা কিছু মুসলমানের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছিল এক বিশেষ প্রেক্ষাপটে। ইতিহাসের প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় হিন্দু নেতারা বার বার মুসলমানদের ভাষা উর্দুকে দূরে ঠেলে দিয়ে হিন্দিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা চালিয়েছে’ ‘অং বধৎষু ধং ১৮৬৭, ঐরহফঁ খবধফবৎং রহ ইবহধৎবং নবমধহ ধ সড়াবসবহঃ ঃড় ৎবঢ়ষধপব টৎফঁ- ঃযব পযরবভ ষধহমঁধমব ড়ভ ঃযব গঁংষরসং-নু ঐরহফর’- ১৯১৮ সালে বিশ্ব ভারতীয়তে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভারতবর্ষে বাংলার পরিবর্তে হিন্দীকে রাষ্ট্র ভাষা করার প্রস্তাব করেছিলেন। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ হিন্দির পরিবর্তে বাংলার পক্ষে যুক্তি তর্ক উপস্থাপন পেশ করেন এবং বলেন, “শুধু ভারত কেন, সমগ্র এশিয়া মহাদেশেই বাংলা ভাষার স্থান হবে সর্বোচ্চ। ভাব সম্পদ ও সাহিত্যের গুণে বাংলাভাষা এশিয়ার ভাষা গোষ্ঠীর মধ্যে অদ্বিতীয়।” হিন্দুরা সেদিন এটি মেনে নিতে পারেনি। উর্দু-হিন্দি-বাংলা বিতর্কে কংগ্রেসের সব নেতাই হিন্দির পক্ষে রায় দেন। শুধু রায়ই নয়, সমগ্র ভারতকে এক রাষ্ট্রে পরিণত এবং এক জাতীয়তায় আবদ্ধ করার জন্য কংগ্রেসের সব নেতাই এক বাক্যে হিন্দির পক্ষে রায় দেন। এ ঘটনার প্রায় ৩০ বছর পরে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রাক্কালে ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. জিয়াউদ্দীন আহমদ স্বাধীন ভারতে হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা করার মোকাবিলায় পাকিস্তানে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ইতিহাসের এই গতি ধারায় মুহম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তান সৃষ্টির পরে ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ ঢাকায় গোটা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দু উপযুক্ত হবে বলে বিবেচনা করে ঘোষণা প্রদান করেন যে উর্দু হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। জিন্নাহর এই ঘোষণাকে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ মাতৃভাষা বাংলা ও সংস্কৃতির ওপর হামলা বিবেচনা করে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। ১৯৪৮ সালের রাজপথে শুরু হওয়া ভাষা আন্দোলন- যা ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জন করে অমর মহিমা। ঢাকার রাজপথে কিছু মুসলিম তরুণ তাদের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করল।

বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য ৫২-এর ভাষা আন্দোলন রাজনৈতিক আন্দোলনের রূপ ধারণ করে। ’৪৮ পূর্ব আন্দোলন ছিল বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন। স্বাধীনতা পূর্বকালে ১৮৯৯ সালে বাংলাদেশের মুসলিম পুনর্জাগরণের অগ্রদূত সৈয়দ নওয়াব আলীর নেতৃত্বে ‘বঙ্গীয় সাহিত্য বিষয়ক মুসলিম সমিতি’ গড়ে ওঠে এবং ১৯১১ সালে ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’ যে উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে যাত্রা শুরু করেছিল সেই একই উদ্দেশ্যে স্বাধীনতা উত্তরকালে জন্ম লাভ করে ‘তমদ্দুন মজলিস’। এই তমদ্দুন মজলিসই সর্বপ্রথম ভাষা আন্দোলনকে সাংগঠনিক রূপদান করে। এভাবেই তুর্কী আগমনের পর থেকে শুরু করে বাংলা ভাষার উন্নতি ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে মুসলমানগণ সক্রিয় অংশগ্রহণ করে ’৫২ সালে শাহাদাতের মধ্যদিয়ে বিশ্বের দরবারে মাতৃভাষাকে মর্যাদার আসনে স্থান দিতে সক্ষম হয়।

১৯৬১ সালে বাংলার উন্নতি ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কায়েম হয় ‘পাক সাহিত্য সংঘ’ ১৯৬৯ সালে ‘মুক্তবুদ্ধি সাহিত্য সংঘ’, স্বাধীনতা উত্তরকালে ১৯৭২ সাল থেকে ‘স্বদেশ সংস্কৃতি সংসদ, সোনার বাংলা সাহিত্য সভা, ঢাকা সাহিত্য সংস্কৃতি কেন্দ্র ইত্যাদি কাজ করে যাচ্ছে। এ ধারাবাহিকতা থেকেই ১৯৮৩ সালে বাংলা সাহিত্য পরিষদ প্রতিষ্ঠিত হয়। এসব সাহিত্য সংস্কৃতি সংসদগুলো মাতৃভাষার উন্নতি এবং নিজস্ব কৃষ্টি সংস্কৃতি লালনে যে ভূমিকা পালন করে আসছে তা ওজনের দিক থেকে বিশাল।

লেখক : কলামিস্ট

এ পাতার অন্যান্য খবর

অন্যান্য মিডিয়া bdnews24 RTNN Sheersha News barta24 Prothom Alo Daily Nayadiganta Jugantor Samakal Amardesh Kaler Kantho Daily Ittefaq Daily Inqilab Daily Sangram Daily Janakantha Amader Shomoy Bangladesh Pratidin Bhorerkagoj Daily Dinkal Manob Zamin Destiny Sangbad Deshbangla Daily Star New Age New Nation Bangladesh Today Financial Express Independent News Today Shaptahik 2000 Computer Jagat Computer Barta Budhbar Bangladesherkhela Holiday Bangladesh Monitor BBC Bangla Pars Today
homeabout usdeveloped by

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ মো. তাসনীম আলম।

এটিএম সিরাজুল হক কর্তৃক হক প্রিন্টার্স ১০/৮ আরামবাগ, ঢাকা-১০০০ হতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। যোগাযোগের ঠিকানাঃ ৪২৩ এলিফেন্ট রোড, বড় মগবাজার, ঢাকা - ১২১৭।

ফোন: ৮৮ ০২ ৪৮৩১৯০৬৫, ই-মেইল: sonarbanglaweekly@gmail.com, weeklysonarbangla@yahoo.com, সার্কুলেশন: ০১৫৫২৩৯৮১৯০, বিজ্ঞাপন: ৪৮৩১৫৫৭১, ০১৯১৬৮৬৯১৬৮, ০১৭৩৪০৩৬৮৪৬।