সংবাদ শিরোনামঃ

মহাবিপর্যয়ের দিকে বাংলাদেশ ** সংবিধান সংশোধনের নামে এমন কিছু করা ঠিক হবে না যা জাতিকে আরো বিভক্ত করে মুখোমুখি হতে প্রণোদিত করে ** রাজনৈতিক নিপীড়নের উদ্দেশ্যেই মুজাহিদকে শ্যোন অ্যারেস্ট ** পশ্চিমবঙ্গে লাল দুর্গের পতন ** জামায়াত গণমানুষের অধিকারের কথা বলে তাই সরকার নেতৃবৃন্দের উপর দলন-পীড়ন চালাচ্ছে ** সাহসী বুকে অব্যাহত থাকুক এ পথচলা ** বিসমিল্লাহ বর্জন : হিন্দুত্ববাদের অধীনস্থ করাই ল্য ** প্রচারের অভাবের পরেও ডাক বিভাগের মোবাইল মানিঅর্ডার জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ** গ্রামের পতিত জমিতে সূর্যমুখী ও কৃষকের হাসি ** গ্রাহাম ই ফুলারের ইসলামবিহীন পৃথিবী **

ঢাকা শুক্রবার ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪১৮, ১৫ জমাদিউস সানি ১৪৩২, ২০ মে ২০১১

হারুন ইবনে শাহাদাত
জ্ঞান-বিজ্ঞানের ইতিহাসের সাথে যাদের নাম জড়িয়ে আছে, প্লেটো তাদের মধ্যে প্রথম সারির একজন। হযরত ঈসা (আ.)-এর জন্মের ৪২৭ বছর আগে এথেন্সের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন প্লেটো। তিনি মৃত্যুবরণ করেন হযরত ঈসা (আ.)-এর জন্মের ৩৪৭ বছর আগে। একাত্মবাদী দর্শনে বিশ্বাসী দার্শনিক সক্রেটিস ছিলেন তার শিক্ষক। জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখাকেই সমৃদ্ধ করে গেছেন প্লেটো। তরুণদের মাঝে জ্ঞানের প্রসারের মহান উদ্দেশ্যে তিনি একাডেমি নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। প্লেটোর ছাত্র এরিস্টটলও একজন দার্শনিক হিসেবে সর্বকালের জ্ঞানীদের কাছে সমাদৃত।

প্লেটোর রচনাবলী আজও বহুল পঠিত। তার লেখা উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ দি রিপাবলিক, দি স্টেটসম্যান ও দি লজ।

কালের বিবর্তনে তার চিন্তা দর্শনকে বিভিন্ন সময় নিজেদের সুবিধামত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। অনেক চিন্তাবিদ তার খণ্ডিত বক্তব্যকে প্রমাণ হিসেবে দাঁড় করিয়ে তাকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করেছেন। শিল্প-সাহিত্য  বিশেষ করে কবি ও কবিতা সম্পর্কে তার চিন্তাধারা বলে যা প্রচলিত আছে তা সত্যি মারাত্মক। তাকে কবি বিদ্বেষী দার্শনিক হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছে, তার কিছু উক্তির ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে, এ প্রসঙ্গে সাহিত্য চিন্তা গ্রন্থে শিবনারায়ণ রায় লিখছেন, ‘প্লেটো তার  আদর্শ রাষ্ট্র হতে কবিকুলকে নির্বাসিত করেছিলেন। তার অভিযোগ ছিল যে, কবিরা চরিত্রহীন, অসংযমী এবং সত্যভ্রষ্ট। চরিত্রহীন, তার প্রমাণ তারা পরস্পর বিরোধী বিভিন্ন চরিত্র কল্পনা করে তাদের সাথে একাত্ম হতে পারেন। অসংযমী তার কারণ তারা প্রেরণার দ্বারা পরিচালিত এবং প্রেরণার ওপরে যে কোন সংযম চলে না তা সকলেরই জানা। আর যেহেতু ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের অনুকরণের মধ্যে কবি কল্পনা স্ফূর্তি লাভ করে, সেই কারণে সত্য কখনো কাব্যের ধ্যেয় হতে পারে না। সত্য অজর, অমর, অতীন্দ্রিয়। শুধু দার্শনিকের একাগ্র সাধনার মধ্যেই সত্যের প্রতি ফলন সম্ভব। সুতরাং জ্ঞান, ন্যায়নিষ্ঠা এবং চারিত্রের ওপরে ভিত্তি করে কোন আদর্শ রাষ্ট্র যদি গড়ে তুলতে হয় তবে সে রাষ্ট্র থেকে যত ব্যথিতই মনে হোক, কবিদের বিদায় দেয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই।’

প্লেটো ছিলেন বাস্তব বুদ্ধিসম্পন্ন দার্শনিক। তিনি বিশ্বাস করতেন-‘সদগুণই জ্ঞান।’ আবেগ তাড়িত হয়ে কেউ কিছু বললেই তা গ্রহণ করার পক্ষে নন তিনি। তিনি তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘রিপাবলিক’-এ তিন স্তর বিশিষ্ট শিক্ষা ব্যবস্থার রূপ রেখা দিয়েছেন। এতে শৈশব হতে বিশ বছর পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষার সিলেবাসে তিনি যেসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করেছেন তা হলো-সাহিত্য, সঙ্গীত, প্রাথমিক গণিত। উচ্চশিক্ষাকে তিনি দুই ভাগে ভাগ করেছেন। ২০ হতে ৩০ বছর পর্যন্ত এবং ৩০-৩৫ বছর পর্যন্ত। এতে তিনি ২০-৩০ বছরের সিলেবাসে রেখেছেন-উচ্চতর গণিত, জ্যামিতি, জ্যোতিষশাস্ত্র ও সঙ্গীত।

তার শিক্ষা ব্যবস্থার সিলেবাসের দিকে নজর দিলে খুব সহজেই বুঝা যায় তিনি আসলে কবি বিদ্বেষী ছিলেন না। সত্যি যদি তিনি কবি বিদ্বেষী হতেন তা হলে তার শিক্ষা ব্যবস্থায় সাহিত্য এবং সঙ্গীতের স্থান হতো না। অধ্যাপক সেবাইন হিস্টি অব পলিটিক্যাল থিওরি গ্রন্থে প্লেটো লিখিত রিপাবলিক গ্রন্থে শিক্ষা ব্যবস্থার আলোচনা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে লিখেছেন-‘ফরাসী দার্শনিক রুশোর মতে প্লেটোর  ‘রিপাবলিক’ কোন রাজনৈতিক গ্রন্থ নয় বরং শিক্ষা সম্পর্কে এ যাবৎ যত গ্রন্থ লিখিত হয়েছে তার মধ্যে এটি হচ্ছে সর্বোৎকৃষ্ট।’

শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে লেখা সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থে শিল্প-সাহিত্যের সমৃদ্ধ শাখা কবিতা সম্পর্কে বিদ্বেষ থাকবে এ কথা কোন যুক্তিতেই মেনে নেয়া যায় না। শিক্ষার কারিকুলামে স্পষ্ট ভাষায় সঙ্গীতের কথা তিনি উল্লেখ করেছেন। এ কথা কারও অজানা নয়- কবিতার শব্দ আর ছন্দেই সঙ্গীত প্রাণ পায়। তারপরও কেন প্লেটো সম্পর্কে এ অপবাদ এতদিন পর্যন্ত দৃঢ়তার সাথে চালু আছে তা বুঝতে হলে, তৎকালীন গ্রিক কবিদের সম্পর্কে একটু আলোচনা করা দরকার মনে করছি। গ্রিক শব্দ এনথুজ যা হতে ইংরেজি এনথুজিয়াজম-এর উদ্ভব তার অর্থ হলো দেবতায় পাওয়া। যেমন বলা হয় অমুকের ওপর অপদেবতা ভর করেছে, ভূতে ভর করেছে। গ্রীকদের ভ্রান্ত বিশ্বাস ছিল যে বিশেষ বিশেষ মানুষের ওপরে দেবতারা ভর করে। তখন তারা আর নিজেদের অধীনে থাকে না। দেবতা পাওয়া ঐসব মানুষদের বর্ণিত পঙক্তিমালাকে তারা ঈশ্বরের বাণী জ্ঞান করত। তারা বাস্তবতা বর্জিত উদ্ভট কথা বলেও সাধারণ মানুষ তা বিশ্বাস করত। কবিদের বাণীকে অবিশ্বাস করাকে তারা পাপ মনে করতো। ‘এই কারণে সঙ্গীত বা সাহিত্যের পাঠ্য বিষয়ে হোমার, হিসিয়ড প্রমুখ মহাকবিদের কাব্যগ্রন্থ থেকে সংকলন করা হতো। কিন্তু প্লেটো কবিদের শিক্ষা বা বাণীকে নির্বিচারে গ্রহণ করার পক্ষে ছিলেন না।’ গ্রিক কাব্য সংকলনে তার লেখা কিছু কিছু টুকরো কবিতা পাওয়া যায়। এতে নিঃসন্দেহে বলা যায় তিনি নিজেও একজন কবি ছিলেন, কবিতা বিদ্বেষী ছিলেন না।

প্লেটোর শিক্ষক সক্রেটিস ছিলেন একত্মবাদে বিশ্বাসী বাস্তব বুদ্ধিসম্পন্ন একজন দার্শনিক। তার জীবনে এই মহান শিক্ষকের কত গভীর প্রভাব পড়েছিল তা প্লেটোর সাহিত্য পড়লে খুব সহজেই বুঝা যায়। প্লেটো শিক্ষক-ছাত্রের সংলাপের মাধ্যমে তার লেখা দার্শনিক তত্ত্ব উপস্থাপন করেছেন। অর্থাৎ তিনি সক্রেটিসকে শিক্ষকের আসনে বসিয়ে তার মুখের সংলাপের মাধ্যমে বক্তব্য প্রকাশ করেছেন। তার রচনাবলীর সাহিত্য মান বিচার করে সহজেই অনুধাবন করা যায় তিনি কবি ও কবিতা সম্পর্কে প্রাচীন গ্রীক সামজের মানুষের অন্ধ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। তার রচনাবলীর শিল্প ও কাব্য মান বিচার করে শিবনারায়ণ রায় মন্তব্য করেছেন, এই ঘোর কাব্যবিরোধী দার্শনিক প্রকৃতির দিক থেকে অনেক কবিদের সমধর্মী ছিলেন।

তিনি কবি ও কবিতার নামে ভণ্ডামীর বিরোধিতা করেছেন। আধুনিককালেও অনেকে মনে করেন বাস্তব জ্ঞান বর্জিত, আধা পাগল হওয়া কবিদের বৈশিষ্ট্য। আরও এক ধাপ এগিয়ে বলতে চান মদ, গাঁজা, ভাং না খেলে সে আবার কিসের কবি? প্লেটো এই চরিত্রের কবিদেরই নির্বাসন কামনা করেছেন- তার আদর্শ রাষ্ট্র হতে।

আদর্শ ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার গাইড বুক এই সব কবির প্রসঙ্গে পবিত্র আল-কোরআনের সূরা আশ ‘শু’আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, আর কবিদের কথা। তাহাদের পিছনে চলে বিভ্রান্ত লোকরা। তোমরা কি দেখ না যে, তাহারা প্রতিটি প্রান্তরে বিভ্রান্ত হইয়া ঘুরিয়া মরে এবং এমন সব কথাবার্তা বলে যাহা তাহারা নিজেরা করে না।’ (আয়াত ২২৪-২২৬)

ঐসব কবি থেকে ঈমানদার কবিদের পৃথক করতে পরবর্তী আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, সেই সব লোকগণ ছাড়া যাহারা ঈমান আনিয়াছে, আর নেক আমল করিয়াছে এবং আল্লাহকে খুব বেশি বেশি স্মরণ করিয়াছে, আর তাহাদের উপর যখন যুলুম করা হইয়াছে তখনই শুধু তাহারা প্রতিশোধ গ্রহণ করিয়াছে। (আয়াত ২২৭)

উল্লেখিত সূরার ২২৬ নম্বর আয়াত পর্যন্ত পড়ার পর আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা, কাব বিন মালিক এবং হাসান বিন সাবিত (রা.) রাসূল (সা.)-এর নিকট কাঁদতে কাঁদতে গিয়ে বলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ কবিদের সম্পর্কে ‘এ আয়াত নাযিল হয়েছে এবং আমরা কবি।’ রাসূল (সা.) বললেন, সম্পূর্ণ আয়াত পড়। ঈমানদার নেকারদের বলা হয়নি।

আসলে আদর্শ সমাজ সচেতন কোন যুগেই সুসভ্য গঠন জনশক্তি ছাড়া সম্ভব নয়। এ কথা কবিদেরও মনে রাখতে হবে। তারা তাদের তীব্র অনুভূতি শক্তি দিয়ে সমাজকে দেখবেন। তীক্ষè মেধা দিয়ে প্রকৃতি, সমাজ, সমাজের মানুষের জীবনাচরণ পর্যবেক্ষণ করবেন, তারপরই কবিতার ছন্দে তা লিপিবদ্ধ করবেন। যাদের এমন মহান ও কঠিন দায়িত্ব তারা যদি হন অর্ধ উন্মাদ, মাতাল, বেখেয়ালি তা হলে গোটা সমাজব্যবস্থায় এর বিরূপ প্রভাব পড়বে, এটাই স্বাভাবিক। এই বিরূপ প্রভাব হতে দেশ ও সমাজকে বাঁচাতে বাস্তব সম্মত কবিতার চর্চা বৃদ্ধির জন্যই প্লেটো ঐসব অর্ধ উন্মাদ কবিদের নির্বাসন কামনা করেছেন।

ঈসা (আ.)-এর জন্মের প্রায় সাড়ে চার শত বছর পূর্বে যে দার্শনিক এমন মহান চিন্তা করেছেন তার ওপর আরও ব্যাপক গবেষণা করতে হবে। কারণ তার  আদর্শ রাষ্ট্র ও অন্যান্য মতবাদ নিয়েও পাশ্চাত্যের দার্শনিকরা বিভ্রান্তিমূলক মতামত ব্যক্ত করেছেন। এই বিভ্রান্তির জাল ব্যাপক গবেষণা ছাড়া ছিন্ন করা সম্ভব নয়।

লেখক : সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক

এ পাতার অন্যান্য খবর

অন্যান্য মিডিয়া bdnews24 RTNN Sheersha News barta24 Prothom Alo Daily Nayadiganta Jugantor Samakal Amardesh Kaler Kantho Daily Ittefaq Daily Inqilab Daily Sangram Daily Janakantha Amader Shomoy Bangladesh Pratidin Bhorerkagoj Daily Dinkal Manob Zamin Destiny Sangbad Deshbangla Daily Star New Age New Nation Bangladesh Today Financial Express Independent News Today Shaptahik 2000 Computer Jagat Computer Barta Budhbar Bangladesherkhela Holiday Bangladesh Monitor BBC Bangla Pars Today
homeabout usdeveloped by

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ মো. তাসনীম আলম।

এটিএম সিরাজুল হক কর্তৃক হক প্রিন্টার্স ১০/৮ আরামবাগ, ঢাকা-১০০০ হতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। যোগাযোগের ঠিকানাঃ ৪২৩ এলিফেন্ট রোড, বড় মগবাজার, ঢাকা - ১২১৭।

ফোন: ৮৮ ০২ ৪৮৩১৯০৬৫, ই-মেইল: sonarbanglaweekly@gmail.com, weeklysonarbangla@yahoo.com, সার্কুলেশন: ০১৫৫২৩৯৮১৯০, বিজ্ঞাপন: ৪৮৩১৫৫৭১, ০১৯১৬৮৬৯১৬৮, ০১৭৩৪০৩৬৮৪৬।