সংবাদ শিরোনামঃ

মহাবিপর্যয়ের দিকে বাংলাদেশ ** সংবিধান সংশোধনের নামে এমন কিছু করা ঠিক হবে না যা জাতিকে আরো বিভক্ত করে মুখোমুখি হতে প্রণোদিত করে ** রাজনৈতিক নিপীড়নের উদ্দেশ্যেই মুজাহিদকে শ্যোন অ্যারেস্ট ** পশ্চিমবঙ্গে লাল দুর্গের পতন ** জামায়াত গণমানুষের অধিকারের কথা বলে তাই সরকার নেতৃবৃন্দের উপর দলন-পীড়ন চালাচ্ছে ** সাহসী বুকে অব্যাহত থাকুক এ পথচলা ** বিসমিল্লাহ বর্জন : হিন্দুত্ববাদের অধীনস্থ করাই ল্য ** প্রচারের অভাবের পরেও ডাক বিভাগের মোবাইল মানিঅর্ডার জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ** গ্রামের পতিত জমিতে সূর্যমুখী ও কৃষকের হাসি ** গ্রাহাম ই ফুলারের ইসলামবিহীন পৃথিবী **

ঢাকা শুক্রবার ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪১৮, ১৫ জমাদিউস সানি ১৪৩২, ২০ মে ২০১১

নাজিব ওয়াদুদ
আমার পিতা আমাকে প্রায় দিনই একটা জায়গায় নিয়ে à¦¯à§‡à¦¤à§‡à¦¨Ñ à¦¸à§‡à¦Ÿà¦¾ একটা জলাভূমি, অনেকটা বিলের মত, কিন্তু বিল নয়, কেউ তাকে বিল বলে না। তার কোনও নাম ছিল না। আমার পিতা সেটাকে কখনও বিল, কখনও জলা, যখন যা মনে আসত, বলতেন। সেখানে আমরা মাছ ধরতে যেতাম। অনেক মাছ থাকত জলাটায়। মাছ ধরতে আমার খুব ভাল লাগত। এ নিয়ে প্রায় দিনই অনুযোগ করতেন মা। আমরা কেউ গা করতাম না। সকালে উঠে আমরা যাত্রার আয়োজন করতাম। মা ভীষণ রাগ করতেনÑগর্জন করতেন, রাগে তার মুখ লাল হয়ে যেত, তাতেও যখন কাজ হতো না, তখন, কোনও কোনও দিন, তিনি মুষ্টি পাকিয়ে আমাদের আঘাত করতে চেষ্টা করতেন, হাতের কাছে যা পেতেন তাই ছুঁড়ে দিতেন আমাদের দিকে। আমরা এসবে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। আমরা এর কোনও প্রত্যুত্তর করতাম না, বেরিয়ে যেতাম নিজেদের কাজে, তাকে অগ্রাহ্য করে, যেন তিনি আমাদের কাছে গণনাযোগ্য নন। ঘর থেকে বেরিয়ে উঠোন পেরুলে তার গর্জন ধীরে ধীরে ফিকে হতে হতে আর শোনা যেত না। সেদিকে আমাদের কোনও ভ্রƒà¦ªà§‡ ছিল না। কিন্তু আমরা বুঝতে পারতাম, তিনি দাঁড়িয়ে আছেন বাড়ির ফটকটায়, অম রাগে শরীর দুমড়াচ্ছেন, আর আমাদের শাপ-শাপান্ত করছেন-আমাকে এভাবে একা ফেলে রেখে যেতে বড় সুখ, না? দেখবে মজা। একদিন ঠিকই মজা দেখবে। এই ছোঁড়া, তোকে না আমি দশ মাস পেটে ধরেছি। তুই-ও একটা দিন আমার কথা শুনবি না? বলে গর্জান আর কাঁদেন। তার কথা, রাগ, গালাগালি, প্রায় সবই আমার উদ্দেশ্যে, কিন্তু ধীরে ধীরে আমি বুঝে গিয়েছিলাম, তার আসল ল্য আমি নই, আমার পিতা।

আমরা সাইকেলে চড়ে সেই জলার দিকে ছুটতাম। শিগগিরই ঢুকে পড়তাম ছায়ানিবিড় বনের মধ্যে। তারপর এক সময় সেই জলা আমাদের চোখের সামনে চিকচিক করে উঠত। আমি চীৎকার করে বলতাম, ‘ওই তো বিলটা দেখা যাচ্ছে। আজ তার ওপর সূর্য কেমন চকচকে রোদ ছড়িয়ে দিয়েছে দেখেছ? মুক্তার মত জ্বলজ্বল করছে!’ আমার পিতা খুব কম কথা বলতেন। বলতেন কেবল অতি প্রয়োজনীয় কথাটুকুই। আর আমার মুখের ওপর দৃষ্টি ফেলতেন কদাচিৎ। সেই তিনিও এ রকম মুহূর্তে কোনও কোনও দিন হাস্যোজ্জ্বল মুখে আমার দিকে তাকাতেন, বলতেন, ‘অপূর্ব! সত্যিই অপরূপ সুন্দর!’

আমার পিতা কেমন যেন। সব সময় একটা বিষাদঘন হয়ে থাকত তার মুখে-চোখে। কোনও কিছুতে তার আগ্রহ বোঝা যেত না। আমার মায়ের কাছ ঘেঁষতেন না। হয়তো মা-ই তার কারণ। মা সব সময় ঝগড়া করতেন। এমনকি হাত-মুখ খামচে দিতেন। কিন্তু আমাদের বেলা অন্য রকম। পারলে যেন বুকের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখেন। কী জানি কেনÑআমাদের দুই ভাইকে নিয়ে সব সময় উৎকণ্ঠা তার। তিনি চাইতেন না আমরা পিতার কাছে যাই। কিন্তু ঘরে বসে থাকতে আমার ভাল লাগত না। তাই পিতার সঙ্গে বাইরে যেতাম। আমাদের প্রতি তার কোনও স্নেহ-ভালবাসা আমরা টের পেতাম না। তবু আমি তার ন্যাওটা হয়ে থাকতাম। কারণ একমাত্র তার সাথেই বাড়ির বাইরে যাবার সুযোগ মিলত। আমার পিতা সংসার দেখাশোনায় অবহেলা করতেন না। কিন্তু তিনি যেন সংসারের বাইরের মানুষ ছিলেন।

একটু বড় হয়ে আমি বুঝতে শিখেছিলাম আমার পিতা-মাতার মধ্যে কোনও গোপন দাম্পত্য কলহ আছে। অভিমানও হতে পারে সেটা। কিন্তু ও নিয়ে মাথা ঘামাইনি আমি। আমরা বেড়ে উঠছিলাম নিজেদের মত করে, অনেকটা বন্য গাছের মত।

একদিন খেলাচ্ছলে আমি একটা সাপ ধরে ফেললাম। সরু দড়ির মত সুন্দর একটা লতানো প্রাণী। তার গলায় আংটির মত গোল হলদে ডোরা, আর সারা শরীরে সোনালী, লাল ও কাল ফোঁটা। প্রাণিটা কীভাবে যেন জঙ্গল ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিল। আমরা তাকে ছাড়লাম না। ধরে নিয়ে গেলাম বাড়িতে। মা তো ভয়ে বাঁচেন না। চিৎকার-চেঁচামেচি করে পাড়া জড়ো করার যোগাড়। কিন্তু আব্বা শুনলেন না। তিনি একটা খাঁচা বানিয়ে দিলেন আমাকে। তার মধ্যে জায়গা হলো সাপটার। তারপর আমাদের যেন নেশা ধরে গেল। একেক দিন একেক রকম প্রাণীর পেছনে ধাওয়া করতে লাগলাম। বেজি, অঞ্জনি, মায় কাকলাস পর্যন্ত। আমাদের বাড়িটা রীতিমত একটা চিড়িয়াখানা হয়ে উঠল। এতে মায়ের যন্ত্রণা আরও বেড়ে গেল। তিনি কিছুতেই এটা অনুমোদন করতে পারলেন না। প্রাণিগুলোর ভয়ে মা ওদের কাছে ঘেঁষতেন না। ছোট ভাইটাকে জড়িয়ে ধরে তিনি ঘরের ভেতর খিল এঁটে বসে থাকতেন। ছোট ভাইটাও ছিল একেবারে মা-নেওটা। মা যেমনটি বলতেন তেমনটি করে চলত সে।

খাঁচার ভেতর প্রাণীগুলো ভালই থাকত। ঘুমোত বেশির ভাগ সময়। আর কখনও কখনও বেশ ছটফট করত। বাড়িতে ফিরে আমরা, মানে আমার পিতা ও আমি, প্রাণীগুলোর যতœ-আত্তি নিতাম। ওরা মনে হয় পোষ মেনে গিয়েছিল। ওরা আমাদের দিকে তাকিয়ে কেমন পিটপিট করে চাইত। বেশ মজা পেতাম আমরা। মাছ ধরার পাশাপাশি নতুন নতুন জীব-জন্তুর পেছনে ধাওয়া করা আমাদের অভ্যাসে পরিণত হলো।

কিন্তু আমার মা সব সময় তটস্থ হয়ে থাকতেন। জীব-জন্তুকে এত ভয় তার! আমাকে বাগ মানাতে না পেরে ছোট ভাইটিকে আগলে রাখতেন। এই ভাবেই চলছিল।  

তারপর ছোট ভাইটাও সাবালক হয়ে উঠল। নাকের নিচে গোঁফের রেখা সবুজ হয়ে উঠছে। একদিন আব্বা তাকেও ডাকলেন। মায়ের মত তারও জীব-জন্তুর প্রতি অনীহা ছিল। সেটা ভয়ও হতে পারে। কিন্তু বাইরের আকর্ষণ তাকে সে ভয় কাটাতে সাহায্য করল। আমরা মাছ ধরতাম, কোনও নতুন পোকা-মাকড় বা সরীসৃপ দেখলে তার পেছনে ছুটতাম, আর ভাইটি ভাবুকের মত অবাক হয়ে গাছ-পাতা লতা-গুল্ম দেখে বেড়াত। আমরা যখন বাড়ি ফিরতাম তখন কী যে মুগ্ধতা তার চোখে-মুখে ফুটে থাকত!

সেদিন দেখলাম মা নেই। মানে প্রত্যেকদিন যেমনটি বাড়ির ফটক পর্যন্ত আসতেন তেমনটি দেখা গেল না। ক’দিন থেকেই দেখছি কেমন নিশ্চুপ হয়ে যাচ্ছেন তিনি। হতাশায় ন্যুব্জ হয়ে পড়েছেন। তাকে হইচই করতে না দেখে আমরা অবাকই হলাম একটু। ছোট ভাইটা তো খুশিই হলো। কারণ মাকে অগ্রাহ্য করে বাইরে যেতে তার খারাপ লাগত।

এইভাবেই চলছিল। সেদিন, দুপুরের রোদ যখন ততটা গরম হয়ে ওঠেনি, আমাদের ফেরার সময় হয়নি, তখন ফিরলাম আমরা। আমাদের ফিরতে হলো। না ফিরে উপায় ছিল না। পাড়ায় ঢুকতে না ঢুকতে লোকজন আমাদের পিছু নিল। মা তখন দুপুরের রান্না-বান্নার তদারকি করছিলেন। আব্বার ঘাড়ে ছোট ভাইটা নেতিয়ে হাত-পা ছড়িয়ে দিয়েছে। তাই দেখে তিনি তৎণাৎ চীৎকার করে অজ্ঞান হয়ে গেলেন।

একটা অদ্ভূত সাপ দেখেছিলাম আমরা। তার দেহের হলুদ রঙের ওপর লালচে ও কালচে ছোপ আঁকা। তাকে জব্দ করা বড় কঠিন হয়ে উঠল আমাদের প।ে ছোট ভাইটিকেও আমরা বাধ্য করলাম আমাদের সঙ্গে যোগ দিতে। সেই সাপের কামড়ে ভাইটি আমার মারা পড়ল।

আমি বুঝতে পারতাম, আমার মা তার স্বামী লোকটাকে বিশ্বাস করতেন না। লোকটা তার ছেলেদের মেরে ফেলার ফন্দি আঁটে বলে তার ধারণা। তার এই অমূলক ভয় একটা মনোরোগের ফল, ডাক্তাররা সে রকমই বলেছিলেন। সে কথা আমরা বিশ্বাস করেছিলাম। কিন্তু সেদিন জ্ঞান ফেরার পরে মা যখন বললেন, তুমি সত্যি সত্যিই আমার ছেলেকে মেরে ফেললে? তখন আমার পিতাকে অসহায় দেখাচ্ছিল, কিন্তু স্ত্রীর অভিযোগ তিনি যেন অস্বীকার করলেন না।

আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। কেন মা এ কথা বললেন? আর কেনই বা আব্বার মুখ কালো হয়ে গেল? কেন তিনি কোনও জবাব দিলেন না?

আমি খাঁচার সব প্রাণীকে ছেড়ে দিলাম।

আমার পিতার সঙ্গে আমি আর কখনও মাছ ধরতে কেন, কোনও কাজেই কোথাও যাইনি। এমনকি কথাও বলতাম না। সব সময় মায়ের কোল ঘেঁষে থাকতাম। আমার মা কথা-বার্তা, কাজ-কর্ম ছেড়ে বিছানাগত হয়ে পড়লেন। স্বামীর সঙ্গে কথা বলাও একেবারে বন্ধ করে দিলেন। আমার পিতাও যেন কেমন এক অপরাধবোধে কাবু হয়ে থাকতেন সব সময়। তাদের এই অবস্থা দেখে প্রথম প্রথম আমার খুব কষ্ট হতো। তারপর এক সময় সেটাও সয়ে গেল।

অনেক দিন পর, আমার মা তখন বেশ অসুস্থ, হয়তো তার দিন শেষ হয়ে আসছে, একদিন আমাকে ডেকে বললেন, তোর বাপকে ডাক দে।

আমার পিতা বোধ হয় জানতেন যে তার ডাক পড়বে। তাকে না ডাকতেই তিনি এসে হাজির হলেন, চিহ্নিত দাগী অপরাধীর মত অবনত মস্তক তার। মুখে-চোখেও ঠিক তেমনই অভিব্যক্তি।

তাকে সাী রেখে মা বললেন, ল্য আমি, যে, আমাকে জন্ম দিতে গিয়ে তার খুব কষ্ট হয়েছিল। আর ছোট ভাইটির সময় তিনি নাকি মারাই যাচ্ছিলেন। উভয় েেত্রই ডাক্তাররা সন্তানকে মেরে মায়ের জীবন রার পরামর্শ দিয়েছিলেন। আমার পিতা তা-ই করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মা রাজী হননি। আমার মা দু’টি সন্তান জন্ম দিয়ে প্রায় অথর্ব হয়ে পড়েছিলেন। সারা বছর শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতায় ভুগতেন। কোনও রকমে বাড়ির মধ্যে একটু চলে-ফিরে বেড়াতেন এই যা। আমার পিতা তার স্ত্রীর এই করুণ অবস্থার জন্যে আমাদের দুই ভাইকে দায়ী মনে করতেন। এ নিয়ে প্রথম প্রথম তাদের মধ্যে ঝগড়াও হয়েছে। আমাদের পিতা আমাদের দুই ভাইকে পছন্দ করতেন না বলে মায়ের ধারণা।

সত্যি বলতে কী আমি কখনও বুঝতে পারিনি। আমার পিতা রাশভারি মানুষ, কথা কম বলেন, হাসেন একেবারেই কম, আমাদের প্রতি তার স্নেহের কোনও বহিঃপ্রকাশ দেখিনি। সেটা তার প্রকৃতি বলেই আমরা মনে করেছি। কিন্তু আমাদের দুই ভাইকে হিংসা করতেন এমনটি কখনও মনে হয়নি।

Ñআসলে তোর আব্বা আমাকে তার প্রাণের চেয়েও ভালবাসত। শুধু আমারই জন্যে সে তোদের ওপর অসন্তুষ্ট ছিল। আর সে কারণে আমি তাকে সব সময় সন্দেহ করতাম। তোরা তাকে মা করে দিস।

মায়ের শিয়রে বসা আমার পিতার দিকে আমি চোখ তুলে তাকাতে পারিনি। বাইরে তখন অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছিল। মেঘ ডাকছিল গুড়গুড় করে। বিজলি চমকাচ্ছিল। আব্বা মায়ের কপালে হাত রাখলেনÑঅনেক দিন পর। মা সেই স্পর্শে ঘুমিয়ে পড়লেন।     

লেখক : কবি ও কথা সাহিত্যিক

এ পাতার অন্যান্য খবর

অন্যান্য মিডিয়া bdnews24 RTNN Sheersha News barta24 Prothom Alo Daily Nayadiganta Jugantor Samakal Amardesh Kaler Kantho Daily Ittefaq Daily Inqilab Daily Sangram Daily Janakantha Amader Shomoy Bangladesh Pratidin Bhorerkagoj Daily Dinkal Manob Zamin Destiny Sangbad Deshbangla Daily Star New Age New Nation Bangladesh Today Financial Express Independent News Today Shaptahik 2000 Computer Jagat Computer Barta Budhbar Bangladesherkhela Holiday Bangladesh Monitor BBC Bangla Pars Today
homeabout usdeveloped by

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ মো. তাসনীম আলম।

এটিএম সিরাজুল হক কর্তৃক হক প্রিন্টার্স ১০/৮ আরামবাগ, ঢাকা-১০০০ হতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। যোগাযোগের ঠিকানাঃ ৪২৩ এলিফেন্ট রোড, বড় মগবাজার, ঢাকা - ১২১৭।

ফোন: ৮৮ ০২ ৪৮৩১৯০৬৫, ই-মেইল: sonarbanglaweekly@gmail.com, weeklysonarbangla@yahoo.com, সার্কুলেশন: ০১৫৫২৩৯৮১৯০, বিজ্ঞাপন: ৪৮৩১৫৫৭১, ০১৯১৬৮৬৯১৬৮, ০১৭৩৪০৩৬৮৪৬।